বিরসার আত্মবলিদান দিবস উপলক্ষে – আবুয়া রাজ সেতের জানা মহারানী রাজ টুন্ডু জানা

মহারানীর (বৃটিশ) শাসন নিপাত যাক-
আমাদের শাষন শুরু হোক
” বিরসা মুন্ডার এই স্লোগানে উড়িষ্যা, পশ্চিমবঙ্গ সহ ঝাড়খণ্ডের অগনিত আদিবাসী মানুষের ঢল নেমেছিল বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনে। বিরসা মুন্ডার (Birsa Munda) নেতৃত্বে শুরু হয়েছিল এক মরনপণ সংগ্রাম। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে তাই বিরসার এই দূ্র্নিবার আপোষহীন সংগ্রাম এক উজ্জ্বল স্থান করে নিয়েছে।

ছোটনাগপুর (Chhotanagpur) মালভূমির আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষ ছিলেন। বর্তমান ঝাড়খান্ডের (Jharkhand) খুঁটি জেলার উলিহাতু গ্রামের এক দারিদ্র পীড়িত পরিবারে ১৮৭৫ সালের ১৫ই নভেম্বর জন্ম গ্রহন করেন। তার বাবা সুগনা মুন্ডা এবং মা করমি হাতু। এক গ্রাম থেকে আরেক গ্রাম ঘুরে ঘুরে পিতা মাতার সঙ্গে ওনার বাল্যকাল অতিবাহিত হয়। প্রথম জীবনের পাঠ তিনি জয়পাল নাগ নামে এক শিক্ষকের কাছ থেকে পান। জয়পাল নাগের সুপারিশে জার্মান মিশন স্কুলে ভর্তির লক্ষে বিরসাকে খৃষ্টান ধর্মান্তরিত করা হয়।যদিও তিনি সেই স্কুল থেকে কিছুদিন পরে বেরিয়ে আসেন।
সমাজে খৃষ্টান ধর্মের এতটা প্রভাব তা তিনি পরে হলেও বুঝতে পারেন । বৃটিশ ঔপনিবেশিক শাসক এবং মিশনারীগুলির আদিবাসীদের খৃষ্টান ধর্মে ধর্মান্তরিত করার প্রয়াস ও উদ্দ্যেশ্যর ব্যাপারে তিনি সবিশেষ বুঝতে পারার পর আন্দোলন শুরু করেন। মুন্ডা ও ওরাঁও জনগোষ্ঠির লোকজন তাঁর ধর্মমন্ত্রে উদ্দীপিত হয়ে আন্দোলনে সামিল হন এবং “বিরসাইত” (Birsait) নামে বিখ্যাত হন । ভারত উপমহাদেশে আদিবাসীদের মুক্তির জন্য বিরসা মুন্ডা এক মহান নেতা হয়ে অবতীর্ন হয়েছিলেন । তিনি ব্রিটিশদের অত্যাচার থেকে মুন্ডাদের শৃঙ্খলমুক্ত করার জন্য জীবন উৎস্বর্গ করছিলেন। অগনিত আদিবাসী তাঁকে অনুসরন করে মুক্তির আশা দেখেছিলেন। বিরসা মুন্ডা বুঝতে পেরেছিলেন যে ব্রিটিশরা তাঁদেরকে শোষণ করতে এসেছে, সম্পদ লুট করে বিদেশে নিয়ে যাবার জন্য এসেছে। এজন্য তিনি মুন্ডাদের মুক্তির পথপ্রদর্শক হিসেবে আবির্ভূত হন। ঊনিশ শতকের শেষের দিকে আদিবাসীদের নির্মম অত্যাচারের বিরুদ্ধে আদিবাসীরা একত্রিত হতে থাকে। ছোটনাগপুর অঞ্চলে তিনি অত্যাচারিত মুন্ডা আদিবাসীদের বিদ্রোহী নেতা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন।
১৮৮৬ থেকে ১৮৯০ এই অনেকটা সময় চাইবাসায় থাকেন যা সর্দার আন্দোলনের প্রানকেন্দ্র ছিল এবং সর্দারদের ক্রিয়াকলাপ তাঁর মনে গভীর রেখাপাত করে। ছোটনাগপুর অঞ্চলে তিনি অত্যাচারিত মুন্ডা আদিবাসীদের বিদ্রোহী নেতা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন।তাঁর আন্দোলনকারী গোষ্ঠী “ বিরসাইত” বিখ্যাত হয়ে ওঠে ।
১৮৯৯ সালের ২৪ ডিসেম্বর বিরসা মুন্ডা তাঁর বিরসাইতদের নিয়ে শোষন বঞ্চনার বিরুদ্ধে প্রথম আক্রমন হানেন মিশনগুলোতে। বিদ্রোহের আগুন জ্বলতে থাকে সমগ্র মালভূমির প্রত্যন্ত প্রান্তরে। বেশ কিছু বৃটিশ ও মিশনারী সাহেব, পুলিশ গুরুতর আহত এবং নিহত হন। বিরসার এই আক্রমনে বৃটিশরা প্রমাদ গুনলেন। বিরসার বিদ্রোহ দমনের জন্য বৃটিশরা সাঁড়াশি অভিযান চালান। বিদ্রোহের পরে কিছুদিন আত্মগোপন করে থাকার সময়ে ১৯০০ সালের ৩রা মার্চ নিজস্ব আদিবাসী গেরিলা বাহিনীর সঙ্গে নিদ্রিত অবস্থায় চক্রধরপুরের জামকোপাইয়ের জঙ্গল থেকে ইংরেজ বাহিনীর হাতে ধরা পড়েন বিরসাসহ তাঁর শতাধিক সঙ্গী গ্রেপ্তার হন। বিচারে তাঁর ফাঁসির হুকুম হয়। ফাঁসির আগের দিন ১৯০০ সালের ৯ জুন রাঁচি জেলের খাদ্যে বিষ প্রয়োগের ফলে বিরসার মৃত্যু ঘটে। তিনি মাত্র পঁচিশ বছরের স্বল্প জীবনই বেঁচেছিল্ন ।ধৃত অন্যান্য দুজনের ফাঁসি, ১২ জনের দ্বীপান্তর এবং ৭৩ জনের যাবত্জীবন কারাবাস হয়।বিরসার মৃত্যুর সাথে সাথেই বৃটিশদের বিরুদ্ধে আদিবাসীদের বিদ্রোহ স্তিমিত হয়ে পড়ে । বিরসার অদম্য জেদের ফলে বৃটিশদের বিরুদ্ধে আদিবাসী বিদ্রোহ গতি পায় এবং ঔপনিবেশিক কর্মকর্তারা আদিবাসীদের জন্য জমির অধিকার আইন বলবৎ করতে বাধ্য হন। মুন্ডাদের এই সংগ্রাম, প্রতিবাদ শুধু অরণ্যের নয় বরং ধর্ম ও সংস্কৃতি রক্ষার, বেঁচে থাকার। প্রকৃত অর্থে অন্যায় শোষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ।
এক নবীন আদিবাসী নেতা হিসাবে বিরসার সাফল্য তাই বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনে বীরগাথা হয়ে যুগ যুগ ধরে আমাদের লোক সংস্কৃতি ও সাহিত্যে স্থান পেয়েছে এবং জনমানসে পূজিত হয়েছে ।

সৌমিত্র সেন (Soumitra Sen)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.