১৬/০৮/১৯৪৬, ভোরের আলো ফুটেছে কি ফোটেনি। ঘড়িতে সাড়ে চারটে। প্রতিদিনের অভ্যাসমত হাওয়া খেতে বেরিয়েছিলেন উত্তর কলকাতার এক দুগ্ধ ব্যবসায়ী। কিন্তু সেদিনের সূর্য তাঁর কাছে অদেখাই রয়ে গিয়েছিল। পশ্চিম দিক থেকে আসা মরুঝড় শাণিত ছুরির রূপ ধরে নেমে এসেছিল তাঁর উপর। নামটা জানা যায়নি আজও। কিন্তু তিনিই কুখ্যাত ‘দ্য গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং’-এর প্রথম শিকার। তারপর চার দিন ধরে রক্তগঙ্গা বয়েছিল কালীক্ষেত্র কলকাতায়। প্রথম দিকে উজানে, তারপর পাল্টা ভাটার টানে।
কলকাতা স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসার পর ‘দ্য স্টেটসম্যান’ পত্রিকা ছাপা হতে আরম্ভ করে এবং ঐ পত্রিকারই সম্পাদকীয়তে এই ঘটনাকে ‘The Great Calcutta Killing’ নামে অভিহিত করা হয়। কলিকাতা তখন ছিল অবিভক্ত বঙ্গের রাজধানী এবং তার শাসনকর্তা ছিল মুসলিম লীগ সরকারের প্রধানমন্ত্রী হাসান শহীদ সোহরাওয়ার্দী।
কংগ্রেস নেতৃত্ব মুখে বলত অখণ্ড ভারতের স্বাধীনতার কথা। গান্ধীজী বলেছিলেন ভারত ভাগ করতে গেলে তাঁর মৃতদেহের উপর দিয়েই করতে হবে। কিন্তু কলকাতা গণহত্যার পর আক্ষরিক অর্থেই ভীত হয়ে পড়ে কংগ্রেস। গান্ধীজী ছিলেন নীরব, তিনি প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে কোন বিবৃতি দেননি। জওহরলাল নেহেরু কেন্দ্রে ১৯৪৬-এর সেপ্টেম্বরে মুসলিম লীগের সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকার গঠন নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। গান্ধী বা নেহেরু কেউই কলকাতা গণহত্যার পর নাগরিকদের অবস্থা দেখতে কলকাতা আসেননি।
সলতে পাকানো চলছিল বহুদিন ধরে। কংগ্রেস এবং মুসলিম লীগের মধ্যে রাজনৈতিক টানাপোড়েন চলছিল। পাকিস্তান সৃষ্টির দাবীতে মুসলিম লীগ ছিল দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। কংগ্রেস এই দাবীকে আপাতভাবে প্রত্যাখ্যান করলে, প্রাক্তন কংগ্রেসী জিন্নার নেতৃত্বাধীন মুসলিম লীগ বাহুবলে পাকিস্তান ছিনিয়ে নেওয়ার হুমকি দেয়। ‘লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান’ নামক কুখ্যাত শ্লোগানটি এইসময় ভারত জুড়ে পাকপন্থীদের মধ্যে ধ্বনিত হতে থাকে।
১৯৪০ সালে ২৩ শে মার্চ লাহোর প্রস্তাবে জিন্নাহ্ বললেন, “ভারতবর্ষের সমস্যা সাম্প্রদায়িক নয়, বরং জাতিগত। এটা খুবই দুঃখের যে হিন্দুরা ইসলাম ও হিন্দুত্বের প্রকৃত স্বরূপ বুঝতে পারছেন না। ইসলাম এবং হিন্দুত্ব শুধু আলাদা ধর্ম নয়, সম্পূর্ণ বিপরীত দুই জাতিসত্তা। এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই যে, হিন্দু ও মুসলমানরা দুটি পৃথক ইতিহাস থেকে প্রেরণা পায়। এদের একজনের মহাপুরুষ অন্য জনের শত্রু। মুসলমানরা সংখ্যালঘু নয়, মুসলমানরা একটা আলাদা জাতি। জাতি গঠনের সমস্ত প্রয়োজনীয় উপাদান তাদের মধ্যে আছে। তাই তাদের অবশ্যই নিজের বাসভূমির অধিকার আছে।”
২৮ শে জুলাই বোম্বেতে মুসলিম লীগ পাকিস্তানের দাবীতে ঘোষণা করে যে ১৯৪৬ সালের ১৬ ই আগষ্ট ‘প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবস’ অনুষ্ঠিত হবে সারা ভারত জুড়ে। অবিভক্ত বঙ্গ ছিল মুসলিম শাসনাধীনে থাকা ভারতের একমাত্র প্রদেশ, লীগ নেতৃত্বও এখানেই পাকিস্তানের দাবীতে প্রত্যক্ষ সংগ্রামের বাস্তব রূপ দেখানোর সিদ্ধান্ত নেয়।
১৯৪৬ সালের ৫ ই আগস্ট স্টেটসম্যান পত্রিকার এক নিবন্ধে সোহরাওয়ার্দী লিখলেন, “হিংসা এবং রক্তপাত অন্যায় নয়, যদি তা মহৎ উদ্দেশ্যে করা হয়। মুসলমানদের কাছে আজ পাকিস্তান আদায় করা ছাড়া অন্য কোনো প্রিয় কাজ নেই।” ওই দিনই খাজা নাজিমুদ্দিন, যিনি পরে পূর্ব বাংলার মুখ্যমন্ত্রী হন, তিনি মুসলিম ইনস্টিটিউটে মুসলিম ন্যাশনাল গার্ডদের এক সমাবেশে বলেন, “মুসলিম লীগের এটা পরম সৌভাগ্য যে এই রমজান মাসেই সংগ্রাম শুরু হবে। কারণ এই রমজান মাসেই জিহাদের নির্দেশ দিয়েছেন আল্লা।” এছাড়াও কলকাতার মুসলমান মেয়র ওসমান খান উর্দুতে একটি প্রচারপত্র বিলি করেন যাতে লেখা ছিল, “আশা ছেড়ো না, তরোয়াল তুলে নাও… ওহে কাফের, তোমাদের ধ্বংসের দিন বেশী দূরে নয়।” এই লিফলেটে ছিল তরোয়াল হাতে জিন্নার ছবি। এ ছাড়া মুসলিম লীগের পক্ষ থেকে হিন্দুদের কিভাবে ধ্বংস করা যাবে, সেই রকম ২৩ টি নির্দেশ সংক্রান্ত একটি লিফলেট বিলি করা হয়।
ধনী-দরিদ্র, শিক্ষিত-অশিক্ষিত, ছাত্র-শ্রমজীবী সহ সর্বস্তরের পাকিস্তানপন্থী সেদিন জিন্না-সোহরাওয়ার্দীর ডাকে সাড়া দিয়েছিলো। বাঙ্গালীদের মধ্যে একটা চাপা আতঙ্ক। ঠিক কী হতে চলেছে, তাই নিয়ে স্পষ্ট ধারণা ছিল না তাদের মধ্যে। লঙ্কাকান্ডের আগে লঙ্কাবাসীও বুঝতে পারেনি কী হতে চলেছে।
১৬/০৮/৪৬ তারিখে ভোর সাড়ে চারটেয় মানিকতলায় যে হত্যাকান্ড সংঘটিত হয়েছিল, তা সূর্য ওঠার সাথে সাথেই সারা কলকাতায় ছড়িয়ে পড়েছিল। রাজাবাজার থেকে মানিকতলা, শিয়ালদহ থেকে ধর্মতলা, রিপন কলেজ থেকে চৌরঙ্গী — রক্ত আর রক্ত। একের পর এক সশস্ত্র মিছিল, লুঠতরাজ, জনসমাবেশ, ছুরি, গুলি, ধর্ষণ, বাঙ্গালীর রক্ত। প্রথমদিনে একতরফা মার খেল বাঙ্গালী।
তখন কলকাতা শহরে ছিল অন্ততঃ দুটি ডিপার্টমেন্টাল স্টোর্স, যারা শপিং মলের আদিপুরুষ। একটি ‘হল অ্যান্ড অ্যান্ডারসন’, অপরটি ‘কমলালয় স্টোর্স’। ধর্মতলা রোডের কমলালয় স্টোর্স ছিল কলকাতার অন্যতম নক্ষত্র। এখানেই ১৯৪৩ সালে বইয়ের দোকান খোলেন রাম হালদার। বিদেশ থেকে সদ্য প্রকাশিত বইও পাওয়া যেত। আর পাশেই ছিল চায়ের দোকান। এই ঘটনা তখন কলকাতার কবি-সাহিত্যিক-রাজনীতিবিদ-শিল্পীদের কাছে নতুন দিগন্ত খুলে দেয়। লেগেই থাকত তারকা সমাবেশ। গোপাল হালদার, সুশোভন সরকার, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, বিষ্ণু দে, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, সৈয়দ মুজতবা আলি, রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর… কাকে ছেড়ে কার কথা বলবেন?
সেই কমলালয় স্টোর্সও লুঠ হয়ে গেল। রক্ষা পেলনা চলচ্চিত্রকার ছবি বিশ্বাসের বাড়ী, গণিতজ্ঞ যাদব চক্রবর্ত্তীর বাড়ী।
বাঙ্গালী জেগে উঠল তারপর। বুঝতে পারল যে বাঙ্গালীকে বাঁচাতে সরকার বা পুলিশ কিছুই করবে না। অতএব, যা করার নিজেদেরই করতে হবে। এই ভাবনা প্রবলভাবে যাঁদের মনে জেগে উঠেছিল, তাঁদের মধ্যে অন্যতম গোপাল মুখার্জী, যুগল ঘোষ। গোপাল মুখার্জী বেশী পরিচিত ছিলেন গোপাল পাঁঠা নামেই। তিনি নিজে ছিলেন একজন কসাই, নাম গোপাল, পাঁঠার মাংস বিক্রি করতেন বলে তাঁর নাম হয়েছিল গোপাল পাঁঠা। সেই গোপাল পাঁঠা, যুগল ঘোষেরা একদিনের মধ্যে হাজারখানেক হিন্দু ও শিখ যুবককে সঙ্গে নিয়ে এক বাহিনী গড়ে তোলেন এবং পাল্টা দাঙ্গাবাজদের হত্যা করতে শুরু করেন। কিন্তু তাঁদের কয়েকটি কড়া নির্দেশ ছিল। প্রথমতঃ, অস্ত্রহীন মুসলমানকে মারবে না। উল্টে সে নিরাপত্তা চাইলে তাকে বা তার পরিবারকে নিরাপত্তা দেবে। দ্বিতীয়তঃ, মুসলিম মেয়েদের দিকে মুখ তুলে তাকাবে না। কিন্তু অস্ত্রধারী মুসলমানকে ছাড়া চলবে না। হরেন ঘোষ নামে এক গানের শিক্ষক ছিলেন, যিনি সোহরাওয়ার্দীর বাহিনীর অনেক ষড়যন্ত্র ধরে ফেললেন। সোহরাওয়ার্দীর মেয়েকে তিনি গান শেখাতেন। একদিন ছোট্ট মেয়েটির হাত থেকে তিনি একটি কাগজ উদ্ধার করেন। তাতে লেখা ছিল হাওড়া ব্রিজ, টালার জল ট্যাঙ্ক, ভিক্টোরিয়া, শিয়ালদহ স্টেশন কিভাবে বোম মেরে উড়িয়ে দেবে, তার প্ল্যান। বাঙ্গালী বাহিনী প্রতিটি জায়গা থেকে হামলাকারীদের হটিয়ে দিল। পুলিশ বেগতিক দেখে সেই জায়গাগুলোর দখল নিল। সোহরাওয়ার্দীর সন্দেহ গিয়ে পড়ল নিজের মেয়ের শিক্ষক হরেন ঘোষের উপর। পরে ছয় টুকরো অবস্থায় পাওয়া যায় হরেন ঘোষের দেহ।
খুব দ্রুত পরিস্থিতি দাঙ্গাবাজদের বিরুদ্ধে যেতে থাকে এবং সোহরাওয়ার্দী তাঁর বিপদ বুঝতে পারেন। তাই মার খাওয়া শুরু হতেই সোহরাওয়ার্দী দ্রুত পুলিশ প্রশাসনকে সক্রিয় করেন এবং দাঙ্গা থামাতে বাধ্য হন।
এবার এক প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ শুনুন। বক্তা অবিভক্ত বঙ্গের রংপুর কারমাইকেল কলেজের ২০ বছর বয়সী এক ছাত্র, “পাড়া হল বিমর্ষ। গভীরভাবে চিন্তিত। বিকেলের দিকে পাড়ার বয়ঃবৃদ্ধরা সমাগত হলেন এবং আমাদের পাড়ায় যদি মুসলমান গুন্ডাদের কোন আক্রমণ হয়, তার প্রতিরোধের বিষয়ে চিন্তাভাবনা শুরু করলেন। এক পুরানো জীর্ণ গোয়ালঘর ভেঙ্গে ফেলে তার ধ্বংসাবশেষ থেকে ইঁট-পাটকেল সংগ্রহ করে পাড়ার বিভিন্ন সুরক্ষার দৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ জায়গাগুলিতে জড়ো করা হল, যাতে আক্রমণকারীদের তার দ্বারা প্রতিরোধ করা যায়। স্বেচ্ছাসেবকেরা পাড়ার বিভিন্ন প্রান্তে মোতায়েন হলেন, যাতে কী ঘটছে বা না ঘটছে তার খবর সত্ত্বর জানা যায়।
সন্ধ্যা এলো। চারিদিক শ্মশানের স্তব্ধতা। পাড়ার তরুণদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছিলো কোনো শ্লোগান না দিতে বা প্ররোচনাদায়ক কোনো কর্ম থেকে বিরত থাকতে, কারণ আমাদের পাড়ার পিছনে ছিল মুসলমান বসতি। সন্ধ্যাবেলা হঠাৎ আমাদের পাড়া ঘিরে ফেললো মশালধারী মুসলমানেরা। আমরা সবাই উত্তেজনায় অস্থির, হাতে হাতে ইঁটপাটকেল তুলে নিলাম, শ্বাস-প্রশ্বাস চেপে অপেক্ষা করতে লাগলাম পরবর্তী আক্রমণের। কিন্তু আমরা কোনো শ্লোগান দিলাম না। মশালধারী জনতা কয়েক মিনিট অপেক্ষা করল, তারপর শেষে চলে গেল। আমরাও স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। আমাদের ত্রিতল বাড়ির চিলেকোঠা ছিল আমাদের পাড়ার নজরদারির স্থল। এখান থেকে স্বেচ্ছাসেবকেরা নজর রাখছিল নিশার আকাশের দিকে। এই অধমও ছিল সেই দলে। আমাদের পাড়া ছিল নগরীর পূর্ব প্রান্তে এবং হুগলী নদী ছিল পশ্চিম প্রান্তে। নগরীর জনবহুল অঞ্চল ছিল পূর্বে আপার সার্কুলার রোড এবং পশ্চিমে হুগলী নদীর মাঝামাঝি অঞ্চলে। নিশাতেও যে দিবাভাগের অরাজকতা একভাবে সমানে চলেছে, তার প্রমাণ রাত্রির আকাশে ছিল সর্বব্যাপী। নগরীর প্রাণকেন্দ্রগুলি আলোকিত হয়ে উঠেছিল দিগন্তবিস্তৃত অগ্নিশিখার কবলে। মনে হয়, মুসলমান অগ্নিপ্রদানকারীদের প্রভাব ছিল অপ্রতিহত, বসবাসের বাড়িঘর আর কলকারখানায় তীব্রভাবে চলছিল অগ্নিপ্রদান। ঠিক কোন কোন অঞ্চলে অগ্নিদাতারা সক্রিয় ছিল, তা সঠিকভাবে চিহ্নিত করা আমাদের পক্ষে অবশ্য সম্ভবপর হয়নি।
মুসলমানদের উৎসবের রমজান মাস চলছিল এবং তাঁরা রোজা রাখছিলেন। পরের দিন, ১৭ই আগষ্ট, সকালবেলা ছিল শান্ত, প্রধান রাস্তাটি যদিও ছিল জনহীন। যানচলাচলও শুরু হয়নি। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আমি অনুভব করছিলাম যে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে উঠছে। বাস্তবিক ফিরে দেখলে বুঝি, এই দ্বিতীয় দিনটি ছিল প্রথম দিনের (১৬ই আগস্ট) চেয়েও বেশি ঘটনাবহুল। দুপুর ১২ টার সময়, এক তরুণ প্রতিবেশী ছুটে এসে আমাকে খবর দিল যে এক মুসলমান গুন্ডা বর্শা নিয়ে আমাদের পাড়ার ভগ্নপ্রায় দরজায় অপেক্ষা করছে। আমি দরজার সামনে গিয়ে দেখলাম বর্শার ফলাটি রোদে ঝিক্মিক্ করছে। বর্শা হাতে দাঁড়িয়ে এক ষণ্ডাগণ্ডা পেশোয়ারী গুন্ডা, সে চেষ্টা করছে পাড়ায় ঢুকতে। মুসলিম লীগ নেতা সোহরাওয়ার্দী সারা ভারতের থেকে মুসলমান গুন্ডাদের কলকাতায় আনিয়ে রেখেছিলেন প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবসের আগেই। আমার প্রতিবেশী এবং আমি হাতে ইঁট নিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলাম। আমাদের কাছে এ ছিল এক কঠিন মুহূর্ত। পেশোয়ারীটি কিছুক্ষণ ইতস্ততঃ করল এবং শেষে রণে ভঙ্গ দিল।
এক ঘন্টা বাদে, আমরা দূর থেকে শ্লোগান শুনতে পেলাম। ১৬ ই আগষ্টের পরে প্রথমবার কানে এলো ‘জয় হিন্দ’ এবং ‘বন্দেমাতরম্’। বোঝা গেলো, অবস্থার পরিবর্তন হচ্ছে। এতক্ষণ যা ছিল একতরফা মুসলমান আক্রমণ, এবার সেখানে জন্ম নিয়েছে হিন্দু প্রতিরোধ। মনে হল লড়াই মির্জাপুর স্ট্রীট এবং হ্যারিসন স্ট্রীটের (বর্তমান মহাত্মা গান্ধী রোড) সংযোগস্থলে পূরবী সিনেমা হলের সামনে হচ্ছে। পরে জানতে পেরেছিলাম যে এক মুসলমান জনতা হিন্দু আবাসিকদের এক হস্টেলে হামলা করে। কিন্তু হিন্দু বাসিন্দারা প্রত্যাঘাত করে এবং তাদেরকে দূরে সরিয়ে দিতে সক্ষম হয়। যে শ্লোগান আমরা শুনতে পেয়েছিলাম, তা প্রতিরোধকারী হিন্দুদের আওয়াজ। বেলা পড়তে আপার সার্কুলার রোডে আবির্ভাব হল একটি ট্রাকে করে একদল শিখের, পাগড়িবিহীন, কিন্তু হাতে তাদের খোলা তরবারি। মুসলমানরা আতঙ্কিত হল এবার। রাজাবাজারের মুসলমান গুন্ডাদের দেখাসাক্ষাৎ মিলল না। বরং পাশের মুসলমান পাড়ার বাসিন্দারা হাতে ইঁট-পাটকেল নিয়ে নিজের নিজের সদর দরজায় আত্মরক্ষায় তৈরী হল। এই শিখরা এসেছিল দক্ষিণ কলিকাতা থেকে, হিন্দুদের দুর্ভাগ্যপূর্ণ অবস্থা খতিয়ে দেখতে, হিন্দুদের অবস্থা নিয়ে বহুবিচিত্র রটনায় উদ্বিগ্ন হয়ে। তাঁরা মুসলমান অঞ্চলের মধ্য দিয়ে এইজন্যেই উদ্দেশ্যপূর্ণভাবে গিয়েছিলেন। শিখদের নিয়ে ট্রাকটি রাজাবাজারের সায়েন্স কলেজ অবধি গিয়ে আবার ফিরে গেল। যে মুহূর্তে ট্রাক ফিরে গেল, মুসলমান গুন্ডার দল বেরিয়ে এল এবং চলে যাওয়া ট্রাকটির দিকে বিকৃত অঙ্গভঙ্গি করতে লাগল। আমাদের এক প্রৌঢ় প্রতিবেশী, এক পুলিশ অফিসার, তাঁর রিভলভার যুক্ত বেল্ট সমেত ইউনিফর্ম পরে সাহসের সঙ্গে সামনের বড় রাস্তায় এগিয়ে গেলেন এবং সুসংবাদ আনলেন যে মিলিটারী ট্যাঙ্ক প্রহরা দিতে আপার সার্কুলার রোডে শীঘ্রই বেরোবে, যাতে বড় রাস্তায় কোন সমস্যা না থাকে।
দ্বিতীয় দিন সন্ধ্যা এল। আমরা লাউড স্পীকারে শুনলাম মুসলমান নেতাদের ঘোষণা। তাঁরা আমাদের অঞ্চলের মুসলমানদের রাস্তায় না বেরোতে সতর্ক করে দিচ্ছিলেন, কারণ সৈন্যদের দেখামাত্র গুলি চালানোর আদেশ দেওয়া হয়েছে। সন্ধ্যাবেলা আমরা অবাক হয়ে গেলাম যখন জনতার শ্লোগান শুনতে পেলাম। আমরা আশঙ্কা করলাম যে আমাদের পিছনের মুসলমান অঞ্চল থেকে আক্রমণ আসন্ন। কিন্তু কিছুক্ষণ দেখার পর আমরা বুঝলাম যে মুসলমানরা গুলি খাওয়ার ভয়ে লুঠপাটের উদ্দেশ্যে আর বেরোয়নি বরং তাদের নিজ নিজ ছাদ থেকে শ্লোগান দিচ্ছে। শ্লোগানগুলি ছিল ‘আল্লাহ্ হো আকবর’, ‘কায়েদ-এ-আজম জিন্দাবাদ’, ‘লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান’, ‘নারা-এ-তকবীর’। আমরা ধীরে ধীরে নিরন্তর শ্লোগানের আওয়াজকে স্বাভাবিক ধরে নিলাম এবং তাকে গুরুত্ব দেওয়া বন্ধ করলাম। ইতিমধ্যে মিলিটারী ট্যাঙ্কগুলি সামনের বড় রাস্তায় টহল দেওয়া শুরু করেছে। ট্যাঙ্কের চালক আমাদের ইঙ্গিতে আমাদের পাড়ার সামনে দাঁড়ালেন। ট্যাঙ্কের প্রধান কর্তা ছিলেন এক বৃটিশ সৈন্য, আমাদের অনুরোধে তিনি আমাদের কানাগলিতে ঢুকলেন এবং আমাদের বাড়ির চিলেকোঠায় এলেন। তাঁর সাথে ছিল তিনজন গাড়োয়ালী সৈন্য। আমরা পিছনের মুসলমান বসতিটি দেখালাম, যেখান থেকে আমরা আক্রমণের আশঙ্কা করছিলাম। গাড়োয়ালী সৈন্যরা তাদের বন্দুক উঁচিয়ে মুসলমান বসতির দিকে তাক করল। আমরা তাদের ভাবভঙ্গি দেখে আশ্বস্ত হলাম এবং ট্যাঙ্কের কর্তাকে আমাদের সুরক্ষার জন্য পাড়ায় সারারাত্রি ধরে সৈন্য মোতায়েন করার অনুরোধ জানালাম। ট্যাঙ্কের কর্তা আমাদের অনুরোধ মানতে তাঁর অপারগতা জানালেন, কিন্তু আশ্বাস দিলেন যে রাত্রিতে ঘন্টায়-ঘন্টায় ট্যাঙ্কটি আমাদের পাড়ার সামনে দাঁড়াবে এবং তিনি নিজে আমাদের অবস্থা সরেজমিনে দেখে যাবেন। এই ১৭ই আগস্টের রাত্রি এরপর মসৃণভাবে পেরিয়ে গেল কোনো ঘটনা ছাড়াই।
পরের দিন ১৮ ই আগস্ট, তৃতীয় দিনের সকাল নিয়ে এল এক সুবার্তা। রিলিফের গাড়ি দক্ষিণ কলিকাতা থেকে দাঙ্গাপীড়িত উত্তর-পূর্ব এবং মধ্য কলিকাতায় এলো গত দুইদিন যাবৎ বিছিন্ন অবরুদ্ধ হিন্দু বাসিন্দাদের সুরক্ষিত জায়গায় নিয়ে যাওয়ার জন্য। আপার সার্কুলার রোডে আমাদের পাড়ার কানাগলির সামনে দাঁড়াল দু’টি বাস। সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো যে মহিলা ও শিশুদেরকে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে। প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষদের পালা তার পর আসবে। বাসদুটি দ্রুত বোঝাই হয়ে গেলো এবং দক্ষিণ কলকাতার উদ্দেশ্যে রওনা দিলো। আমি আমাদের দুর্ভাগা পাড়ার বাকি পুরুষদের সঙ্গে রয়ে গেলাম। দিনভর মিলিটারী ট্যাঙ্ক প্রহরা দিল সামনের রাস্তায়। আমরা একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম এবং কোন দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা ছাড়াই অতিবাহিত হল তৃতীয় দিনটি। আমরা তবু প্রতি মুহূর্তে নজর রাখছিলাম আমাদের পাড়ার পিছনের মুসলমান বসতির দিকে।
চতুর্থ দিন, ১৯ শে আগষ্ট সকালে আমরা আমাদের বাড়িঘর ছেড়ে রিলিফ বাসের অপেক্ষায় বসে রইলাম। বাস এলো এবং আমরা সবাই জড়ো হলাম এক জায়গায়, নিশ্চিন্ত হলাম যে কেউ পড়ে নেই এই পরিত্যক্ত পাড়ায়। গত তিনদিন আমরা ছিলাম প্রকৃতপক্ষে বাইরের জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন। বাসগুলি রওনা দিলো রাজাবাজারের উদ্দেশ্যে দাঙ্গা-বিধ্বস্ত অঞ্চলের মধ্য দিয়ে। দেখতে পেলাম করুণ হৃদয়বিদারক দৃশ্যাবলী। ঠেলাগাড়িতে করে শবদেহের স্তূপ প্রত্যেক ছোটবড় গলির মুখে রাখা আছে। এই চতুর্থ দিনেও কোনো কোনো জায়গায়, যেমন রাজাবাজারের কাছে, পড়ে আছে অর্ধদগ্ধ মৃতদেহ। বুঝলাম আমাদেরও এই গণহত্যার ব্যাপকতা সম্বন্ধে কোন ধারণাই ছিল না। বাসে যেতে যেতে আমরা অনুভব করলাম যে আমরা কত সৌভাগ্যবান যে গত তিনদিন ধরে কলকাতায় চলা এই বীভৎস হত্যাকাণ্ডের প্রকোপ থেকে রক্ষা পেয়েছি। আমাদের বাসও দক্ষিণ কলিকাতা যাবার পথে স্থানে স্থানে দাঁড়ালো, যাতে বিচ্ছিন্ন বাসিন্দাদের তুলে নিতে পারে।
আমার দাদা ছিলেন শিবপুরের বেঙ্গল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের ছাত্র। তাঁর সঙ্গে আমার দেখা হয় কয়েক দিন পরে। তাঁর কাছে আমি চতুর্থ দিনে মেটিয়াবুরুজে (হুগলী নদীর ধারের এক মুসলমান অঞ্চল) যে গণহত্যা হয়েছে, তার ব্যাপারে জানতে পারলাম। হুগলী নদীতে মেটিয়াবুরুজের ঠিক বিপরীতেই দাদার শিবপুরের কলেজ। সেখানে উড়িষ্যার ৫০০ শ্রমজীবী মানুষ এক বস্তিতে বাস করত। সেখানে তারা নিজেদের তালা চাবি দিয়ে রেখে চাবিটা সদর দরজার বাইরে ফেলে দিয়েছিলো, যাতে বাইরের সবাই ভাবে যে বস্তি ফাঁকা। মুসলমানেরা কিন্তু তাদের উপস্থিতি ধরে ফেলে এবং তাদের সবাইকে হত্যা করে মৃতদেহগুলি হুগলী নদীতে ফেলে দেয়। আমার দাদা ও তাঁর সহছাত্ররা দেখেছিলো ঐসব ফুলে যাওয়া নদীতে ভাসা শবদেহগুলি। এই গণহত্যাটি হয়েছিল চতুর্থ দিনেই।
কলকাতা নগরী আস্তে আস্তে ২০ শে আগস্ট থেকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরতে লাগলো। নগরী এই চারদিন ছিল পুরোপুরি পক্ষাঘাতগ্রস্ত। ট্রেন চলেনি, খবরের কাগজ বেরোয়নি, পৌরসেবা ছিল বন্ধ। চারদিন পরে আবার প্রকাশিত হল ‘দ্য স্টেটসম্যান’ পত্রিকা। তার সম্পাদকীয়ের শিরোনাম ছিল ‘The Great Calcutta Killing’।”
১৯২৭ সালের কথা। গ্রীষ্মের এক রাতে সাহিত্যিক সৈয়দ মুজতবা আলী নামলেন পেশোয়ার স্টেশনে। গন্তব্য কাবুল। যাত্রাপথে পেশোয়ার শহরের সি. আই. ডি. অফিসার আহমেদ আলীর গৃহে তিনি কয়েকদিন অবস্থান করেন। খাইবার পাখতুন প্রদেশের পেশোয়ার তখন ইংরেজদের কড়া নজরে, স্বাধীনতা সংগ্রামীরা না ওখানে ঘাঁটি বানায়! পেশোয়ার স্টেশন থেকে আলী সাহেব যখন বার হলেন, তখন তাঁর বাঙ্গালী চেহারা ইংরেজদের নজর এড়ায়নি। তারা স্থানীয় গোয়েন্দা হিসাবে সেই আহমেদ আলীকেই দায়িত্ব দিল লোকটার উপর নজর রাখতে। আহমেদ আলী সহাস্যে সেই কথা জানালেন মুজতবা আলীকে। তারসাথে বললেন, ‘ইংরেজ ভাবে, বাঙ্গালী মাত্রেই বোম মারে”।
এত কথার অবতারণা একটিই কারণে, বাঙ্গালী বীরের জাত। মার খেলে পাল্টা দিয়ে এসেছে চিরকাল। স্বাধীনতা সংগ্রামীদের মধ্যে তাই বাঙ্গালীর সংখ্যা নজরকাড়া। ‘দ্য গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং’ শুরু হতেই ঘর গোছানোর সামান্য সময় নেওয়ার পর তাই বাঙ্গালী পাল্টা দিয়েছিল পাকিস্তানের দাবীদারদের। গোপাল মুখার্জী, যুগল ঘোষ, হরেন ঘোষ শুধু নয়, শিখদের সাথে হাতে হাত রেখে সর্বস্তরের বাঙ্গালী রাস্তায় নেমেছিলো সেদিন, পাকিস্তানকামী সোহরাওয়ার্দীর চেলাদেরকে সবক শেখানোর জন্যে। সোহরাওয়ার্দী ভাবতেও পারেনি সেই প্রতিক্রিয়ার কথা। কালীক্ষেত্র কলকাতাকে পাকিস্তানের দখলে পাওয়ার স্বপ্ন ধূলিসাৎ হয়ে গিয়েছিল সেদিন।