সিটিজেনশিপ অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্ট (CAA) বা নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন নিয়ে লাগাতার মিথ্যা প্রচার চালানো হচ্ছে। এর কারণটাও পরিষ্কার। পূর্ববঙ্গে হতভাগ্য উদ্বাস্তুদের জন্য বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার যা করেছে, স্বাধীনতার পর এত বড় উপকার কেউ করেনি। না কংগ্রেস, না বামেরা। আজ পশ্চিমবঙ্গে প্রতিটি ধান্দাহীন বাস্তববুদ্ধি সম্পন্ন মানুষ সিএএ কে সমর্থন করছে। যাঁরা পূর্ববঙ্গে হিন্দু হওয়ার জন্য দশকের পর দশক অত্যাচারিত হয়েছেন, তাঁরা বাধ্য হয়ে পালিয়ে এসেছেন। তাঁদের নাগরিকত্ব প্রদান করা তো একান্ত মানবিক কাজ। অত্যাচারিত মানুষ সুস্থ ভাবে, সম্মান নিয়ে বাঁচবে আমাদের দেশে এতে কার কী ক্ষতি? তাই যারা পার্কসার্কাসে মুর্শিদাবাদে হামলাকারীদের মদত দিয়েছিলেন, যারা পয়সা দিয়ে লোক লাগিয়ে কোটি কোটি টাকার সরকারি সম্পত্তি নষ্ট করিয়েছেন, যারা না বুঝে জনজীবন স্তব্ধ করেছিলেন, যে সব তথাকথিত কর্তাভজা বুদ্ধিজীবী মধুর লোভে ‘কা কা’ করেছেন, রাজ্যের আবালবৃদ্ধবনিতা আজ তাদের ‘ছি ছি’ করছেন।
যারা রাজনীতির ব্যবসা করেন, তাঁরা এসব তাড়াতাড়ি বোঝেন। নাগরিকত্ব নিয়ে পূর্ববঙ্গের হতভাগ্য হিন্দু উদ্বাস্তুদের সঙ্গে তাদের হৃদয়হীন নিষ্ঠুর রসিকতা যে রাজ্যবাসী ভালোভাবে নেয়নি, তা তাঁরা বুঝেছেন। তাই অন্য ভাবে উদ্বাস্তুদের বিভ্রান্ত করার কাজ শুরু হয়েছে। বলা হচ্ছে যে আজ ২০১৯ সালে নাগরিক হলে উদ্বাস্তুদের আগে কেনা সম্পত্তি বা জমিজমার মালিক হতে পারবেন না।
এই বিভ্রান্তি সম্পূর্ণ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও অসত্য। ভারতবর্ষের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন যে নাগরিকত্ব ঘোষণার সময় উদ্বাস্তু মানুষটি যবে থেকে ভারতে এসেছেন বলে জানাবেন তিনি সেইদিন থেকে নাগরিক হিসেবে গণ্য হবেন। মানে ২০২০ সালে একজন পূর্ববঙ্গের উদ্বাস্তু অসীম চন্দ্র বিশ্বাস নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনে ঘোষণা করলেন যে তিনি ১৯৯৫ সালে বাংলাদেশ থেকে ভারতে এসে বসবাস করছেন, তাহলে ভারত সরকার তাঁকে ১৯৯৫ সাল থেকে দেশের নাগরিক হিসেবে গণ্য করবে। অসীমবাবু ১৯৯৬ সালে ঠাকুরনগরে জমি ও পুকুর কিনে থাকলে তিনি এই নতুন আইন পাশ হবার পরে ওই জমি ও সম্পত্তির বৈধ মালিক। তাই কোনও হিন্দু উদ্বাস্তুর সম্পত্তি হারাবার ভয় নেই। এতদিনে পূর্ববঙ্গে একজন অত্যাচারিত বিতাড়িত মানুষ ভারতবর্ষে সম্মানজনক নাগরিক হলেন। আর কোনও অসাধু পুলিশ বা রাজনৈতিক দল তাকে আর ভয় দেখাতে পারবে না।
সেই ১৯৪৬ সাল থেকেই পূর্ববঙ্গে হিন্দুরা অত্যাচারিত হয়েছে, সেই সঙ্গে পার্বত্য চট্টগ্রামের মতো বহুস্থানে বাঙালি বৌদ্ধরা এবং সেখানে স্থানে স্থানে থেকে যাওয়া খ্রিষ্টানরাও। ১৯৪৭, ১৯৪৮, ১৯৬৪, ১৯৬৯, ১৯৭০, ১৯৭১, ১৯৮৮, ২০০১ এমন দুঃস্বপ্নের বছরগুলিতে দৈনিক হাজার হাজার হিন্দু ওপার বাংলা থেকে এপারে এসেছেন। এই বছরগুলিতে মায়ের সামনে মেয়ে, মেয়ের সামনে মা ধর্ষিতা হয়েছেন। একই বাড়ির সব সদস্যকে এক এক করে হত্যা করা হয়েছে, বাড়ির অভিভাবকদের সামনে যুবতী মেয়েকে টেনে নিয়ে যাওয়া হয়েছে এই বছরগুলির ভয়াবহতা সারা পৃথিবীর মানুষকে শিউড়ে দিয়েছিল। কিন্তু বাকি বছরগুলিতেও কমবেশি অত্যাচার চলেছে। বাংলাদেশের প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ ড. আবুল বরকত সাহেব তাঁর গবেষণাগ্রন্থে বলেছেন, গড়ে প্রতিদিন বাংলাদেশ থেকে ৬৩২ জন হিন্দু অত্যাচারিত হয়ে ভারতবর্ষে পালিয়ে আসে।
এ রাজ্যে নিজের ধান্দার ক্ষুদ্র স্বার্থের বাইরে বের হওয়ার সাহস নেই, তাই বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য কোনও কবি সত্যি কথা বলার সাহস করেননি, কোনও ঔপন্যাসিক একটা অ্যানা ফ্র্যাঙ্কের ডাইরি লেখার কথা ভাবেননি, কোনও বিপ্লবী ছাত্র আন্দোলন ২০০১ সালে বাংলাদেশে সংখ্যালঘু হিন্দু, বৌদ্ধ বা খ্রিষ্টানদের উপর নারকীয় অত্যাচারের প্রতিবাদে রাস্তা বন্ধ করেনি। তারা ইরাকে মার্কিন হানার বিরুদ্ধে করেছে, গাজা ভূখণ্ডে ইজরায়েলের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে করেছে কিন্তু মাত্র কয়েক কিলোমিটার দূরে যে কী ভীষণ অত্যাচার চলেছে ধর্ষিতা ক্ষত বিক্ষত মানুষগুলো যে বাংলাভাষায় আর্তনাদ করতে করতে মারা যাচ্ছে, সেই বেদনাটুকুও স্পর্শ করেনি কোনও বুদ্ধিজীবীকে।
সেই পাপেরই প্রায়শ্চিত্ত হবে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনে। পূর্ববঙ্গ থেকে আসা সংখ্যালঘু উদ্বাস্তুদের দশা দেখে যে কোনও বিবেকবান মানুষেরই চেতনা হওয়া উচিত। বহু বামপন্থী নেতা উদ্বাস্তুদের সম্মানজনক নাগরিকত্বের কথা আগেও বলেছেন। ২০১২ সালে সিপিআইএম দলের সাধারণ সম্পাদক প্রকাশ কারাত তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং–কে চিঠি লিখে এই অত্যাচারিত উদ্বাস্তুদের বিশেষভাবে নাগরিকত্বের কথা বলেন। সেখানে অর্থনৈতিক কারণে নয়, কেবল অত্যাচারের জন্য এদেশে যারা আসছেন তাদের কথা বলা হয়েছিল। আজকের সিএএ–তে ঠিক সেই কথাই বলা আছে। পার্থক্য হল, আজ বিজেপি কেন্দ্রীয় সরকারে থেকে প্রকাশ কারাতের দাবিকে আইনে পরিণত করেছে।
প্রকাশ কারাতের চিঠিতে বলা হয়েছিল, ‘যারা তদানীন্তন পূর্ববঙ্গ থেকে উদ্বাস্তু হয়ে এখানে এসেছেন তাদের বিষয়ে আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। বাংলাদেশ তৈরি হওয়ার পরেও যে পরিস্থিতি হয়ে আছে তার উপর তাদের কোনও নিয়ন্ত্রণ নেই যারা কেবলমাত্র অর্থনৈতিক কারণে এখানে আসছেন তাদের থেকে এই অত্যাচারিতদের সমস্যা সম্পূর্ণ ভিন্ন।’ আজ সিপিএম সিএএ–র বিরোধিতা করছে। সত্যি রাজনীতি বড় বালাই।
ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী)–র সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক প্রকাশ কারাত ২০১২ সালে বাংলাদেশ থেকে অত্যাচারিত হয়ে আসা শরণার্থীদের অর্থনৈতিক কারণে এদেশে আসা অনুপ্রবেশকারীদের থেকে আলাদা করতে বলেছিলেন। কিন্তু অর্থনৈতিক কারণ ছাড়াও আর একটি ভয়ানক দিক ২০১৪ সালে খাগড়াগড় বিস্ফোরণের সঙ্গে উঠে এল। তা হল এরাজ্যে বাসা বাঁধা জেহাদি সন্ত্রাসবাদ। যার মূলটা এখানে, সার জলও এরাজ্যের। কিন্তু শাখাপ্রশাখা মেলে মহীরুহ হয়ে উঠেছে বাংলাদেশে।
শাকিল আহমেদ একজন বাংলাদেশী অনুপ্রবেশকারী। সে নদীয়ার করিমপুরে এসে রাজনৈতিক মদতে ভোটার কার্ড তৈরি করে। এরপর এরাজ্যে রাজনৈতিক পালাবদল হয়। শাকিলও নিজের জেহাদি কাজের জন্য বর্ধমানকে বেছে নেয়। এরপর সিমুলিয়ার মতো মাদ্রাসাগুলির মাধ্যমে ভারতীয় গরীব মুসলমান মেয়েদের সংগ্রহ করে স্লিপার সেল তৈরি করতে থাকে। এই স্লিপার মেয়েরা ভয়ঙ্কর বিস্ফোরক বানিয়ে বাংলাদেশে নাশকতার জন্য পাঠাতো।
এখন কথা হল সিএএ অনুসারে বাংলাদেশে ধর্মীয় কারণে অত্যাচারিতদের আগে ভারতের নাগরিকত্ব দেওয়া হবে বলা হয়েছে। এই হতভাগ্যদের সঙ্গে অর্থনৈতিক কারণে বা জেহাদ সংগঠিত করতে আসা অনুপ্রবেশকারীদের এক করা হয়নি। কিন্তু বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলি অত্যাচারিত শরণার্থীদের সঙ্গে এদেরও নাগরিকত্ব চান। কিন্তু কেন? ২০০৫ সালে এই রাজনৈতিক প্রচেষ্টার তথ্যনিষ্ঠ ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন মাননীয়া মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি সেসময় ভারতের ভোটার লিস্ট এবং বাংলাদেশের ভোটার লিস্ট এবং বাংলাদেশের ভোটার তালিকা নিয়ে সংসদে দেখিয়েছিলেন। তিনি দেখিয়েছিলেন কীভাবে শাসকদল ভোটে জেতার জন্য বেআইনি বাংলাদেশী অনুপ্রবেশকারীদের ভোটার বানাচ্ছে। সেদিন সংসদে তাঁকে এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে বলতে দেওয়া হয়নি। তিনি অসন্তুষ্ট হয়ে স্পিকার মহোদয়ের দিকে কাগজ নিক্ষেপ করেছিলেন এবং পরে ২০০৬ সালে তাঁর ‘স্লটার অব ডেমোক্রেসি’ বইতে সবিস্তারে বলেছেন। আজ ২০১৯ সালে চিত্রটা একেবারে পাল্টে গেল!
কলকাতা শহরে হাওড়া, হুগলি, মুর্শিদাবাদ ও মালদার মতো জায়গায় রাজনৈতিক দল মৌলবাদীদের কাজে লাগিয়েছে। তারা রেল স্টেশন পুড়িয়েছে, সরকারি বেসরকারি বাস পুড়িয়েছে। বর্তমান সরকার ‘মেন্টেনেন্স অব পাবলিক অর্ডার’ আইনকে খুব গুরুত্ব দিয়ে ব্যবহার করেছেন গত বছরগুলিতে। বিরোধী দল কখনও আধঘণ্টার জন্য রাস্তা অবরোধ করলেও এই আইনে জামিন অযোগ্য ধারায় গ্রেফতার হয়েছে, আদালতে সরকার ক্ষতিপূরণ আদায় করেছে। এবার সংসদের দুই কক্ষে পাশ হওয়া একটি আইনের বিরুদ্ধে ক্যামেরার সামনে এত নাশকতা হয়েছে অথচ পুলিশ প্রশাসন কোনও ব্যবস্থা নেয়নি।
অতীতে সঠিক সংবাদ পরিবেশন করার জন্য একাধিক জনপ্রিয় ও নামী সংবাদপত্রকে জরিমানা করা হয়েছিল। আজ সন্ত্রাসীদের ছবি দিয়ে সত্যি কথা ছাপানোর মুরদও কারো নেই, তাই জরিমানার কোনও প্রশ্নও ওঠে না।
মতামত সম্পুর্ণত লেখকের নিজস্ব