ও সি গাঙ্গুলি’ : পিকাসো, ব্রাক, শাগাল-এর মতো শিল্পীদের পাশাপাশি রাখা হয় যাঁর কাজ

Story image

প্রত্যেক শিল্পীরই নিজস্বতা থাকে। তবে, কেউ কেউ হয়ে ওঠেন বিশেষ। আর সেইসব ‘বিশেষ’ শিল্পীদের মধ্যে অন্যতম  অরুণকুমার গঙ্গোপাধ্যায় ওরফে ‘ও সি গাঙ্গুলি’ – গত বছরই নিঃশব্দে চলে গিয়েছে যাঁর জন্মশতবার্ষিকী। বিজ্ঞাপনের জগতে তিনি আবার শুধুমাত্র ‘ও সি’ নামেই প্রসিদ্ধ। শুধু ভারত নয়, বিজ্ঞাপন-জগতে তাঁর বিশ্বজোড়া খ্যাতি। তাঁর কাজের নমুনাগুলি এখনও রয়ে গিয়েছে আন্তর্জাতিক প্রকাশনাগুলিতে। শুধু বিজ্ঞাপন নয়, গ্রাফিক্স, ফাইন আর্ট, সিনেমা বিভিন্ন ধারায় তাঁর অবদান রেখে গিয়েছেন ও সি। নিজের কাজের জন্য আটবার পেয়েছেন রাষ্ট্রপতি পুরস্কার। এমনকি তাঁর কাজগুলিকে পিকাসো, ব্রাক, শাগাল –এঁদের মতো শিল্পীদের পাশাপাশি রাখা হয়। অথচ, ‘বিজ্ঞাপনের লোক’ ছাড়া তাঁর যেন কোনও স্বীকৃতিই নেই! সর্বোপরি ভারতীয় তথা বাঙালিদের সাংস্কৃতিক চর্চায় আজ তিনি ব্রাত্য।

তাঁর সম্বন্ধে আলোচনা নিতান্তই কম, কালেভদ্রে একআধটা প্রদর্শনী, এটুকুই। অনেকে আবার ‘শিল্প সমালোচক’ ও সি গাঙ্গুলির সঙ্গে গুলিয়ে ফেলেন তাঁকে। শিল্পী ও সি গাঙ্গুলি’র জন্ম ১৯২০ সালের ১৬ আগস্ট। ২০২১-এর শুরুতেই তাঁর জন্ম শতবর্ষ উপলক্ষে একাদেমি অফ ফাইন আর্টস-এ একটি প্রদর্শনীর আয়োজন করেছিল M-VEACY (Museum cum visual education with art and culture affairs for youth), প্রদর্শিত হয়েছিল ও সি’র বহু মূল্যবান সব কাজ। বেশ কিছু কাজ নষ্ট হওয়া থেকে বাঁচিয়ে সংরক্ষণ করেছে এই প্রতিষ্ঠান।  

আর্ট ইনস্টিটিউশন-এর প্রথাগত শিক্ষা-শংসাপত্র কোনওটাই তাঁর ছিল না। ছোটবেলায় যে সময়টা ছবি আঁকার করণ-কৌশল শিখলেই হয়তো তাঁকে বেশি মানাত, সেই সময়টা তিনি ট্রামের চাকার তলায় ভাঙা শিশি বোতলের কাঁচ গুঁড়িয়ে তাই দিয়ে ঘুড়ির মাঞ্জা তৈরি করার নানা মোক্ষম পদ্ধতি নিয়ে গবেষণা করে আর ফুটবল খেলে কাটিয়েছিলেন। শিল্পী হিসেবে পরিচিত হওয়ার পরও তিনি মণীন্দ্র মেমোরিয়াল শিল্ড ফাইনালে খেলেছিলেন।

সত্যজিৎ-এর স্কেচে ও সি গাঙ্গুলি

ও সি’র দাদা ভগবান গাঙ্গুলি ছবি আঁকতেন। প্রাথমিক পরীক্ষায় পাশ করে তাঁর দাদা আর্ট স্কুলে ভর্তি হয়েছিলেন আর ও সি ফেল করে ফিরে এসেছিলেন। নন্দলাল বসু যখন সন্ন্যাসী গগেন মহারাজের বাড়িতে থাকতেন সেই সময় তাঁর দাদা নন্দলালের কাছে ছবি আঁকার তালিম নিতে যেতেন। সেই সূত্রে ও সি-ও যাতায়াত করতেন দাদার সঙ্গে ফাউ হিসাবে। কিন্তু ছবি আঁকার ব্যাপারটা তখনও আয়ত্তে আনতে পারতেন না। 

নন্দলালের মতো একজন শিল্পীর সংস্পর্শেই বোধহয় তিনি নিজের ভিতর শিল্পের উদ্ভাস টের পেয়েছিলেন। এছাড়া তিনি অবনীন্দ্রনাথের সংস্পর্শেও এসেছিলেন এবং বেশ কিছুদিন ছবিও এঁকেছিলেন তাঁর কাছে। এই প্রাথমিক শিক্ষার প্রভাব পড়েছিল তাঁর শিল্পীজীবনে তা ঠিকই, তবে, প্রভাবমুক্ত স্বতন্ত্র ‘ফর্ম’ও সৃষ্টি করতে পেরেছিলেন তিনি। 

চল্লিশের দশকে ও সি নির্মিত ডানলপ এবং লিপটন চা কোম্পানির বিজ্ঞাপনগুলি চিরস্মরণীয় হয়ে থাকার। এই বিজ্ঞাপনী ক্যাম্পেইনগুলিতে ভারতীয় ঘরানার গ্রাফিক্স প্রবর্তন করেছিলেন তিনি; আর অগ্রণী প্রচেষ্টক হিসাবে এই কাজগুলির অনুপ্রেরণা তিনি পেয়েছিলেন মূলত অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং যামিনী রায়ের কাছ থেকেই।

ও সি’র প্রথম চাকরিজীবন শুরু হয়েছিল ১৯৩৭ সালে, কলকাতার ‘স্ট্রোনাক অ্যাডভারটাইজিং’-এ। কাজ ছিল ফরমায়েশ মতো কাগজ কাটা এবং মক্কেলদের কাছে ডিজাইন পাঠানোর জন্য পোর্টফোলিও তৈরি করে দেওয়া। বেতন চল্লিশ টাকা। একমাস চাকরি করার পর সাহেব জানিয়ে দিয়েছিলেন যে, পরের মাস থেকে তাঁকে আর কষ্ট করে অফিসে আসার দরকার নেই। ও সি’র মতো লোক দিয়ে কোম্পানি চলবে না। সুতরাং, তাঁর চাকরির মেয়াদ ছিল এক মাস। ১৯৩৯ সালে সমর দে (তখন স্ট্রোনাক-এর আর্ট ডিরেক্টর) আবার অদ্বির তদারক করে ও সি-কে স্ট্রোনাকে চাকরি দেন। কাজ হলো একটি বিজ্ঞাপনের বিভিন্ন অংশগুলি আঠা দিয়ে কাগজে সেঁটে বিজ্ঞাপনের চেহারায় দাঁড় করানো অর্থাৎ কমার্শিয়াল আর্টের পরিভাষায় যাকে বলে ‘অ্যাসেমব্লিং’। কিন্তু, ১৯৪১ সালে যুদ্ধের বাজারে স্ট্রোনাক কোম্পানির দরজায় তালা পড়ে। আবার বেকার হন ও সি।

ওই বছরই যুধাজিৎ চক্রবর্তী ও বারীন ঘোষ স্ট্রোনাক অ্যাডভারটাইজিং-এর টেবিল চেয়ার নিলামে কিনে নিয়ে ‘সার্ভিস অ্যাডভারটাইজিং’ নামে একটি এজেন্সি খোলেন। তাঁরাই ও সি-কে সেখানে নিয়ে যান। সেই সময় আর্ট-ইন-ইনডাস্টির প্রদর্শনীতে ও সি’র করা একটি মলাটের ডিজাইন দেখে শিল্পী অন্নদা মুন্সীর মনে ধরে এবং ও সি-কে ডি জে কিমার (বিজ্ঞাপনী সংস্থা, ‘পথের পাঁচালি’ বানানোর অনেক আগে যেখানে সত্যজিৎ রায়ও কাজ করেছিলেন)-এ আনবার জন্য তৎকালীন ম্যানেজার পিটার ব্রুমকে অনুরোধ করেন। সার্ভিস অ্যাডভারটাইজিং-এ মাত্র একদিন চাকরি করার পর তিনি ডি জে কিমার-এ চাকরি পান। 

কিন্তু, সারাদিন ধরে কাটাকুটি আর জোড়া লাগানো, দীর্ঘদিন ধরে একটানা এই নীরস বুদ্ধিহীন কাজ করে ও সি’র মনে একধরনের হীনমন্যতা জন্মে ছিল। তাঁর ধারনা হয়ে গিয়েছিল যে, আজীবন তাঁকে হয়তো এই কাজই করে যেতে হবে। ১৯৪৫-এ ও সি’র জীবনের মোড় ঘুরে যায়। ঠিক ওই বছরই সত্যজিৎ রায় কিমার-এ চাকরি পান। কাজের ফাঁকে ফাঁকে শিল্প সম্বন্ধে নানা আলোচনা, ভাবনার আদান-প্রদানের মধ্য দিয়ে তাঁদের দুজনের মধ্যে অকৃত্রিম বন্ধুত্ব তৈরি হয়। সেই বন্ধুত্ব ও সি’র শিল্পজীবনকে সমৃদ্ধ করেছিলো।  কিমারে চাকরি করার সময়ই ও সি তাঁর বিখ্যাত বিজ্ঞাপন ক্যাম্পেনগুলি তৈরি করেছিলেন। অন্যদিকে, দীর্ঘদিন ধরে বিদেশি বিজ্ঞাপন শিল্পের ধারায় কাজ করতে করতে ও সি ক্রমশ অনুভব করেন যে, ড্রইং ট্রিটমেন্ট এবং কম্পোজিশন রীতিতে দেশের ভাবনা থাকাটা দরকার। এ কথার তাৎপর্য হলো, সেসময় বিজ্ঞাপনে মেমসাহেবদের শুধু শাড়ি পরিয়েই ভারতীয় করার চেষ্টা করা হত। ‘হিজ মাস্টার্স ভয়েস’-এর শারদীয় বিজ্ঞাপনে ও সি আঁকেন আকাশে লঘু মেঘ, আঁকাবাঁকা নদীপথে মাঝি নৌকা বেয়ে আসছে, শিউলি গাছের তলায় শিউলিফুল বিছিয়ে আছে, মেয়েরা আঁচলে করে সেগুলি কুড়িয়ে নিচ্ছে। ও সি’র শিল্পজীবনে শুরু হয় নবপর্যায়।

ফাইন আর্ট-এর ক্ষেত্রে শিল্পী একেশ্বর। বিজ্ঞাপন শিল্পে শিল্পীকে হাজার নিয়মকানুন বাধানিষেধের মধ্যে থাকতে হয়। ততদিনে নিছক ছবি আঁকার দিকেও ও সি’র প্রচুর আগ্রহ তৈরি হয়েছে এবং অবসর মতো প্রচুর ছবিও আঁকছেন তিনি। ছবির প্রদর্শনী করবার ইচ্ছেও প্রবল। স্বনামধন্য শিল্পী আর্টিজান-এর পরামর্শে ও সি রোজ রাত্রে বাড়ি ফিরে গিয়ে শোবার আগে সারা দিনের যে কোনও একটি ঘটনা মেমরি থেকে স্কেচ করার অভ্যাস তৈরি করেছিলেন। 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.