জালিয়ানওয়ালা বাগের গনহত্যালীলার সমুচিত প্রতিশোধ নিয়ে দেশমাতৃকার চরন ধৌত করেছিলেন যে বীর তাঁর নাম শহীদ উধম সিং (Udham Singh)। এই বিস্মৃত এবং উপেক্ষিত বীরকে প্রনতি জানাতেই তাঁর বলিদান দিবস বার্ষিকীতে আজকে আমার কলম ধরা।
১৮৯৯ সালের ২৬ শে ডিসেম্বর পান্জাবের সাঙ্গরুর জেলার সুনাম গ্রামে জন্ম নিয়েছিলেন এই বীর সন্তান। খুব অল্প বয়সেই পিতা মাতাকে চিরতরে হারিয়ে দাদার সাথে অমৃতসরের এক অনাথ আশ্রমে গিয়ে থাকতে হয়। সেই সময়ে সারা দেশসহ পান্জাবের রাজনৈতিক বাতাবরন উত্তপ্ত ও অশান্ত হয়ে উঠেছিল। এই অস্থিরতা ও পরিবর্তনের মাঝেই বেড়ে উঠতে থাকেন কিশোর উধম সিং ।
১৯১৯ সালে বৃটিশদের দ্বারা সেনাবাহিনীতে নিস্ঠুর এবং বলপূর্বক নিয়োগ এবং বিশ্বযুদ্ধ -১ এর জন্য জুলুম করে অর্থসংগ্রহের কারনে সারা পান্জাবে তীব্র অসন্তোষ শুরু হয় এবং তা উধম সিংয়ের মনে গভীর রেখাপাত করে । এর সাথে সাথেই বৃটিশরা Rowlatt Acts (ফেব্রুয়ারি ১৯১৯) আইনসিদ্ধ করেন যার দ্বারা যেকোনো সন্দেহভাজন ভারতীয়কে কোনো বিচার বিভাগীয় পদ্ধতি ছাড়াই অন্তরীন করা যেত – যা মুলত একটি দমন মুলক নীতিরই নামান্তর ছিল। এর প্রতিবাদে মহাত্মা গান্ধী সারা ভারতব্যাপী হরতালের ডাক দিলেন এপ্রিলের ৬ এবং ৯ তারিখে এবং বিশেষ করে পান্জাব থেকে ব্যাপক সাড়া পাওয়া গেল। অমৃতসরে লে: গভর্নর মাইকেল’ও’ ডায়ারের নেতৃত্বাধীন বৃটিশ প্রশাসন আতঙ্কিত হয়ে পড়লো।
Rowlatt Act ধারায় ১০ ই এপ্রিল ১৯১৯ তারিখে সত্য পাল ও সইফুদ্দিন কিচলুকে গ্রেফতার করা হলো। এই গ্রেফতার সমগ্র পান্জাব প্রদেশে ব্যাপক ক্ষোভ এ অসন্তোষের উদ্রেক করে। বিশেষত অমৃতসরে জনগনের সঙ্গে বৃটিশ বাহিনীর দাঙ্গা শুরু হয়। আইন নিরাপত্তা ও শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব ও বিশাল বাহিনীর নিয়ন্ত্রন পান্জাব প্রদেশের গভর্নর ইংরেজ সেনানায়ক ব্রিগেডিয়ার রেগিনাল্ড এডওয়ার্ড হ্যারি ডায়ারের হাতে সঁপে দিলেন। শহরে কোনো ধরনের জনসভা নিষিদ্ধ করেন তিনি।
এরপর তিনি বৃটিশদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধে জড়িয়ে পড়েন যা কিনা দেশের ভিতরে ও বাইরে অহরহ সংঘটিত হচ্ছিল। ১৯২০ সালের প্রথম দিকে পূর্ব আফ্রিকায় চলে গিয়ে এক সাধারন শ্রমিক হিসেবে কাজ শুরু করেন।তারপর আমেরিকায় চলে যান এবং সান ফ্রানসিসকোতে প্রথম গদর পার্টির সংস্পর্শে আসেন। বহুজাতিক এই দলের প্রতিষ্ঠা হয় ১৯১৩ সালে। প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন সোহন সিং বাকনা। এ দলের সদর দফতর ছিল ক্যালিফোর্নিয়ায়।মুলত দেশের বাইরে কাজে আসা পান্জাবী ও শিখদের ছিল এই সংগঠন আর ভারত থেকে ব্রিটিশদের উৎখাত করাই ছিল ‘গদর পার্টির’ লক্ষ্য। শ্রী ভগৎ সিং এর নির্দেশে ১৯২৭ সালে একটি ভারতগামী জাহাজে কাঠের কারিগর রূপে কাজ করতে করতে আবার তিনি পান্জাবে ফিরে আসেন। সে বছরেই বেআইনি অস্ত্র রাখা ও “গদর দি গুন্জ” নামে এক পত্রিকা প্রকাশনার অভিযোগে তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। চার বছর কারাবাসের পর ১৯৩১ সালে তিনি মুক্তি পান কিন্তু ভগৎ সিংয়ের হিন্দুস্তান সোসালিস্ট রিপাবলিকান এসোসিয়েশনের সঙ্গে ঘনিষ্টতার কারনে বৃটিশ পুলিশ তাঁকে সর্বদা নজরবন্দী করে রাখে।এরপর তিনি কাশ্মীর যাত্রা করেন এবং সেখান থেকে পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে অন্য নাম ব্যবহার করে জার্মানি পৌঁছন।শেষ পর্যন্ত ১৯৩৪ সালে উধম সিং লন্ডন যান জেনারেল ও ডায়ারকে হত্যা করতে। ডায়ারের মতে জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকান্ড ছিল “Correct action” ।স্বাভাবিক ভাবেই ও ডায়ারকেই এই হত্যাকাণ্ডের জন্য দায়ী করেছিলেন উধম সিং।
লন্ডনে গিয়ে উধম সিং কাঠ মিস্ত্রী, মটর মেকানিক ও সাইন বোর্ড পেইন্টার এরকম বিভিন্ন পেশায় কাজ করতে শুরু করেন। এমনকি তিনি নায়ক আলেকজান্ডার কোর্ডার অতিরিক্ত শিল্পী হিসাবে – Elephant Boy ( ১৯৩৭) ও The Four Feathers (১৯৩৯) নামে দুটি চলচিত্রে অভিনয়ও করেছিলেন।
কিন্তু আসল লক্ষ থেকে তিনি এক চুলও বিচ্যুত হননি। ডায়ারের প্রাণ নেবার জন্য তিনি তাঁর রিভলবার একটা মোটা বইয়ের ভিতরের পাতাগুলি রিভলবারের আকারে কেটে তার মধ্যে লুকিয়ে রেখেছিলেন।
১৯৪০ সালের ১৩ মার্চ কাক্সটন হিলসের রয়্যাল সেন্ট্রাল এশিয়ান সোসাইটিতে ইস্ট ইন্ডিয়া অ্যাসোসিয়েশনের এক বৈঠকে ও ডায়ারের উপর উধম সিং লুকোন রিভলবার থেকে গুলি চালান। তখনই তাঁকে গ্রেফতার করে ব্রিক্সটন জেলে নিয়ে যাওয়া হয়। জেলে উধম সিং ৩৬ দিন অনশন করেন। পুলিশের কাছে বিবৃতিতে এবং আদালতে, তিনি নিজেকে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে হিন্দু-মুসলিম-শিখ সৌভ্রাতৃত্বের প্রতীক হিসেবে নিজের নাম বলেন মহম্মদ সিং আজাদ। উধম সিংয়ের মৃত্যুদণ্ড হয়। ১৯৪০ সালের ৩১ জুলাই পেন্টনভিল জেলে তাঁর ফাঁসি হয় , দেশমাতৃকার শৃংখলমুক্তির জন্য এক বীরসন্তানের বীরগতি প্রাপ্ত হয়। ১৯৭৪ সালে নিজের গ্রাম সুনামে তাঁর দেহাবশেষ সমাধিস্থ করা হয়। অমর শহীদ ভগৎ সিং, রাজগুরু,সুকদেবের মতই তাঁর দেহভশ্ম পবিত্র সুতলেজ নদীতেও ভাসিয়ে দেওয়া হয়। তাঁরই নামে আজকের উত্তরাখণ্ডের উধম সিং নগর জেলার নামকরণ করা হয়েছে।উধম সিংয়ের মতো অগ্নিযুগের বীরপুত্রদের মরণপণ এই আন্দোলনের মাধ্যমে ভারতীয় উপমহাদেশে বৃটিশ ঔপনিবেশিক কর্তৃত্ব এবং অন্যান্য ঔপনিবেশিক প্রশাসন শেষ হয়।
সৌমিত্র সেন (Soumitra Sen)।