রামায়ণ মহাভারতকে যখন জগতের অন্যান্য কাব্যের সহিত তুলনা করিয়া শ্রেণীবদ্ধ করা হয় নাই তখন তাহাদের নাম ছিল ইতিহাস। এখন বিদেশীর সাহিত্য ভাণ্ডারে যাচাই করিয়া তাহাদের নাম দেওয়া হইয়াছে এপিক। আমরা ‘এপিক’ শব্দের বাংলা নামকরণ করিয়াছি মহাকাব্য। এখন আমরা রামায়ণ মহাভারতকে মহাকাব্যই বলিয়া থাকি।
মহাকাব্য নামটি ভালোই হইয়াছে। নামের মধ্যেই যেন তাহার সংজ্ঞাটি পাওয়া যায়। ইহাকে আমরা কোনো বিদেশী শব্দের অনুবাদ বলিয়া এখন যদি না স্বীকার করি তাহাতে ক্ষতি হয় না।
অনুবাদ বলিয়া স্বীকার করিলে পরদেশীয় অলঙ্কার শাস্ত্রের ‘এপিক’ শব্দের লক্ষণের সহিত আগাগোড়া না মিলিলেই মহাকাব্যনামধারীকে কৈফিয়ৎ দিতে হয়। এরূপ জবাবদিহীর মধ্যে থাকা অনাবশ্যক বলিয়া মনে করি।
মহাকাব্য বলিতে কি বুঝি আমরা তাহার আলোচনা করিতে প্রস্তুত আছি, কিন্তু এপিকের সঙ্গে তাহাকে আগাগোড়া মিলাইয়া দিব এমন পণ করিতে পারি না। কেমন করিয়াই করিব? প্যারাডাইস লস্টকেও তো সাধারণে এপিক বলে, তা যদি হয় তবে রামায়ণ মহাভারত এপিক নহে—- উভয়ের এক পংক্তিতে স্থান হইতেই পারে না।
মোটামুটি কাব্যকে দুই ভাগ করা যাক। কোনো কাব্য যা একলা কবির কথা, কোনো কাব্য বা বৃহৎসম্প্রদায়ের কথা।
একলা কবির কথা বলিতে এমন বুঝায় না যে তাহা আর কোনো লোকের অধিগম্য নহে, তেমন হইলে তাহাকে পাগলামি বলা যাইত। তাহার অর্থ এই যে, কবির মধ্যে সেই ক্ষমতাটি আছে, যাহাতে তাহার নিজের সুখদুঃখ, নিজের কল্পনা, নিজের জীবনের অভিজ্ঞতার ভিতর দিয়া বিশ্বমানের চিরন্তন হৃদয়াবেগ ও জীবনের মর্মকথা আপনি বাজিয়া উঠে।
এই যেমন এক শ্রেণীর কবি হইল তেমনি আর এক শ্রেণীর কবি আছে, যাহার রচনার ভিতর দিয়া, একটি সমগ্র দেশ একটি সমগ্র যুগ আপনার হৃদয়কে– আপনার অভিজ্ঞতাকে ব্যক্ত করিয়া তাহাকে মানবের চিরন্তন সামগ্রী করিয়া তোলে।
এই দ্বিতীয় শ্রেণীর কবিকে মহাকবি বলা যায়। সমগ্র দেশের সমগ্র জাতির সরস্বতী ইহাদিগকে আশ্রয় করিতে পারেন–ইহারা যাহা রচনা করেন, তাহাকে কোনো ব্যক্তিবিশেষের রচনা বলিয়া মনে হয় না। মনে হয়, যেন তাহাবৃহৎ বনস্পতির মতো দেশের ভূতল জঠর হইতে উদ্ভূত হইয়া সেই দেশকেই আশ্রয়চ্ছায়া দান করিয়াছে। কালিদাসেরশকুন্তলা– কুমারসম্ভবে বিশেষভাবে কালিদাসের নিপুণ হস্তের পরিচয় পাই– কিন্তু রামায়ণ মহাভারতকে মনে হয় যেন জাহ্নবী ও হিমাচলের ন্যায় তাহারা ভারতেরই, ব্যাস বাল্মীকি উপলক্ষ্য মাত্র।
বস্তুতঃ ব্যাস বাল্মীকি তো কাহারো নাম ছিল না। ও তো একটা উদ্দেশ্য নামকরণ মাত্র। এত বড়ো বৃহৎ দুইটি গ্রন্থ; আমাদের সমস্ত ভারতবর্ষ জোড়া দুইটি কাব্য তাহাদের নিজের রচয়িতা কবিদের নাম হারাইয়া বসিয়া আছে, কবি আপন কাব্যের এতই অন্তরালে পড়িয়া গিয়াছে।
আমাদের দেশে যেমন রামায়ণ, মহাভারত, প্রাচীন গ্রীসে ও রোমে তেমনি ইলিয়ড, এনিড় ছিল। তাহারা সমস্ত গ্রীস ও রোমের হৃল্পদ্মসম্ভব ও হৃল্পদ্মবাসী ছিল। কবি হোমার ও ভাজ্জিল আপন আপন দেশকালের কণ্ঠে ভাষা দান করিয়াছিলেন। সেই কাব্য উৎসবের মতো স্ব স্ব দেশের নিগুঢ় অন্তঃস্থল হইতে উৎসারিত হইয়া চিরকাল ধরিয়া তাহাকে প্লাবিত করিয়াছে।
আধুনিক কোনো কাব্যের মধ্যেই এমন ব্যাপকতা দেখা যায় না। মিল্টনের প্যারাডাইস্ লস্টের ভাষায় গাম্ভীর্য্য, ছন্দের মাহাত্ম্য, রসের গম্ভীরতা যতই থাক না কেন, তথাপি দেশের ধননহে,—তাহা লাইব্রেরির আদরের সামগ্রী।
অতএব এই গুটিকয়েক মাত্র প্রাচীন কাব্যকে এক কোঠায় ফেলিয়া এক নাম দিতে হইলে মহাকাব্য ছাড়া আর কি নাম দেওয়া যাইতে পারে ? ইহারা প্রাচীনকালের দেবদৈত্যের ন্যায় মহাকায় ছিলেন—ইহাদের জাতি এখন লুপ্ত হইয়া গিয়াছে।
প্রাচীন আর্য সভ্যতার এক ধারা য়ুরোপে এবং এক ধারা ভারতে প্রবাহিত হইয়াছে। য়ুরোপের ধারা দুই মহাকাব্যে এবং ভারতের ধারা দুই মহাকাব্যে আপনার কথা ও সঙ্গীতকে রক্ষা করিয়াছে।
আমরা বিদেশী, আমরা নিশ্চয় বলিতে পারিনা গ্রীস ও রোম্ তাহার সমস্ত প্রকৃতিকে তাহার দুই কাব্যে প্রকাশ করিতে পারিয়াছে কি না, কিন্তু ইহানিশ্চয় যে ভারতবর্ষ রামায়ণ মহাভারতে আপনার আর কিছুই বাকি রাখে নাই।
এই জন্যই, শতাব্দীর পর শতাব্দী যাইতেছে, কিন্তু রামায়ণ মহাভারতের স্রোত ভারতবর্ষে আর লেশমাত্র শুষ্ক হইতেছেনা। প্রতিদিন। গ্রামে গ্রামে ঘরে ঘরে তাহা পঠিত হইতেছে— মুদীর দোকান হইতে রাজার প্রাসাদ পর্যন্ত সর্বত্রই তাহার সমান সমাদর। ধন্য সেই কবিযুগলকে, কালের মহাপ্রান্তরের মধ্যে যাঁহাদের নাম হারাইয়া গেছে, কিন্তু যাঁহাদের বাণী বহন করিতেছে, শত শত প্রাচীন শতাব্দীর পলি-মৃত্তিকা অহরহ আনয়ন করিয়া ভারতবর্ষের চিত্তভূমিকে আজিও উব্বরা করিয়া রাখিয়াছে।
এমন অবস্থায় রামায়ণ মহাভারতকে কেবলমাত্র মহাকাব্য বলিলে চলিবে না, তাহা ইতিহাসও বটে; ঘটনাবলীর ইতিহাস নহে, কারণ সেরূপ ইতিহাস সময় বিশেষকে অবলম্বন করিয়া থাকে— রামায়ণ মহাভারত ভারতবর্ষের চিরকালের ইতিহাস। অন্য ইতিহাস কালে কালে। কতই পরিবর্তিত হইল, কিন্তু এ ইতিহাসের পরিবর্তন হয় নাই। ভারতবর্ষের যাহা সাধনা, যাহা আরাধনা, সঙ্কল্প তাহারই ইতিহাস এই দুই বিপুল কাব্যহৰ্ম্মের মধ্যে চিরকালের সিংহাসনে বিরাজমান।
এই কারণে, রামায়ণ মহাভারতের যে সমালোচনা তাহা অন্য কাব্য সমালোচনার আদর্শ হইতে স্বতন্ত্র। রামের চরিত্র উচ্চ কি নীচ, লক্ষ্মণের চরিত্র আমার ভালো লাগে কি মন্দ লাগে এই আলোচনাই যথেষ্ট নহে। স্তব্ধ হইয়া শ্রদ্ধার সহিত বিচার করিতে হইবে সমস্ত ভারতবর্ষ অনেক সহস্র বৎসর ইহাদিগকে কিরূপ ভাবে গ্রহণ করিয়াছে। আমি যত বড় সমালোচকই হই না কেন একটি সমগ্র প্রাচীন দেশের ইতিহাস প্রবাহিত সমস্ত কালের বিচারের নিকট যদি আমার শির নত হয়, তবে সেই ঔদ্ধত্য লজ্জারই বিষয়।
রামায়ণে ভারতবর্ষ কি বলিতেছে, রামায়ণে ভারতবর্ষ কোন্ আদর্শকে মহৎ বলিয়া স্বীকার করিয়াছে, ইহাই বর্তমান ক্ষেত্রে আমাদের সবিনয়ে বিচার করিবার বিষয়।
বীররস প্রধান কাব্যকেই এপি বলে এইরূপ সাধারণের ধারণা, তাহার কারণ যে দেশে যে কালে বীররসের গৌরব প্রাধান্য পাইয়াছে, সে দেশে সে কালে স্বভাবতই এপি বীররস প্রধান হইয়া পড়িয়াছে। রামায়ণেও যুদ্ধব্যাপার যথেষ্ট আছে, রামের বাহুবলও সামান্য নহে, কিন্তু তথাপি রামায়ণে যে রস সৰ্ব্বাপেক্ষা প্রাধান্য লাভ করিয়াছে তাহা বীররস নহে। তাহাতে বাহুবলের গৌরব ঘোষিত হয় নাই—যুদ্ধঘটনাই তাহার মুখ্য বর্ণনার বিষয় নহে।
দেবতার অবতারলীলা লইয়াই যে এ কাব্য রচিত তাহাও নহে। কবি বাল্মীকির কাছে রাম অবতার ছিলেন না, তিনি মানুষই ছিলেন পণ্ডিতেরা ইহাই প্রমাণ করিবেন। এই ভূমিকায় পাণ্ডিত্যের অবকাশ নাই; এখানে এইটুকু সংক্ষেপে বলিতেছি যে কবি যদি রামায়ণেনর-চরিত্র বর্ণনা না করিয়া দেবচরিত্র বর্ণনা করিতেন, তবে তাহাতে রামায়ণের গৌরব হ্রাস হইত— সুতরাং তাহা কাব্যাংশে ক্ষতিগ্রস্ত হইত। মানুষ বলিয়াই রামচরিত্র মহিমান্বিত।
আদিকাণ্ডের প্রথম সর্গে বাল্মীকি তাহার কাব্যের উপযুক্ত নায়ক সন্ধান করিয়া যখন বহু গুণের উল্লেখ করিয়া নারদকে জিজ্ঞাসা করিলেন—
“সমগ্রা রুপিণী লক্ষ্মীঃ কমেকং সংশ্ৰিতা নরং।”
কোন্ একটি মাত্র নরকে আশ্রয় করিয়া সমগ্র লক্ষ্মীরূপ গ্রহণ করিয়াছেন?
—তখন নারদ কহিলেন— “দেবেহপি ন পশ্যামি কশ্চিদেভিগু নৈর্যূতং।
শ্ৰয়তাং তু গুণৈরেভির্ষো যুক্তো নরচন্দ্ৰমাঃ॥”
এত গুণযুক্ত পুরুষ তো দেবতাদের মধ্যেও দেখি না, তবে যে। নরচন্দ্রমার মধ্যে এই সকল গুণ আছে তাহার কথা শুন।
রামায়ণ সেই নরচন্দ্রমারই কথা, দেবতার কথা নহে। রামায়ণে দেবতা নিজেকে খর্ব করিয়া মানুষ করেন নাই, মানুষই নিজগুণে দেবতা হইয়া উঠিয়াছেন।
মানুষের চরম আদর্শ স্থাপনার জন্য ভারতের কবি মহাকাব্য রচনা করিয়াছেন। এবং সে দিন হইতে আজ পর্যন্ত মানুষের এই আদর্শ চরিত বর্ণনা ভারতের পাঠকমণ্ডলী পরমাগ্রহের সহিত পাঠ করিয়া আসিতেছে।
রামায়ণের প্রধান বিশেষত্ব এই যে তাহা ঘরের কথাকেই অত্যন্ত বৃহৎ করিয়া দেখাইয়াছে। পিতাপুত্রে, ভ্রাতায় ভ্রাতায়, স্বামী স্ত্রীতে যে। ধৰ্ম্মের বন্ধন, যে প্রীতি ভক্তির সম্বন্ধ, রামায়ণ তাহাকে এত মহৎ করিয়া তুলিয়াছে যে তাহা অতি সহজেই মহাকাব্যের উপযুক্ত হইয়াছে। দেশ জয়, শত্রুবিনাশ, দুই প্রবল বিরোধী পক্ষের প্রচণ্ড আঘাত সংঘাত এই সমস্ত ব্যাপারই সাধারণত মহাকাব্যের মধ্যে আন্দোলন ও উদ্দীপনার সঞ্চার করিয়া থাকে। কিন্তু রামায়ণের মহিমা রাম রাবণের যুদ্ধকে আশ্রয় করিয়া নাই— যে যুদ্ধ ঘটনা রাম ও সীতার দাম্পত্য প্রীতিকেই উজ্জ্বল করিয়া দেখাইবার উপলক্ষ্য মাত্র। পিতার প্রতি পুত্রের বশ্যতা, ভ্রাতার জন্য ভ্রাতার আত্মত্যাগ, পতি পত্নীর মধ্যে পরস্পরের প্রতি নিষ্ঠা ও প্রজ্ঞার প্রতি রাজার কর্তব্য কতদূর পর্যন্ত যাইতে পারে রামায়ণ তাহাই দেখাইয়াছেন। এইরূপ ব্যক্তি বিশেষের প্রধানত ঘরের সম্পর্কগুলি কোনো দেশের মহাকাব্যে এমন ভাবে বর্ণনীয় বিষয় বলিয়া গণ্য হয় নাই।
ইহাতে কেবল কবির পরিচয় হয় না, ভারতবর্ষের পরিচয় হয়। গৃহ ও গৃহধর্ম যে ভারতবর্ষের পক্ষে কতখানি ইহা হইতে তাহা বুঝা যাইবে। আমাদের দেশে গার্হস্থ্য আশ্রয়ের যে অত্যন্ত উচ্চস্থান ছিল এই কাব্য তাহা সপ্রমাণ করিতেছে। গৃহাম আমাদের নিজের সুখের জন্য সুবিধার জন্য ছিল না—গৃহাশ্রম সমস্ত সমাজকে ধারণ করিয়া রাখিত ও মানুষকে যথার্থভাবে মানুষ করিয়া তুলিত। গৃহাশ্ৰম ভারতবর্ষীয় আৰ্য সমাজের ভিত্তি। রামায়ণ সেই গৃহাশ্রমের কাব্য। এই গৃহাশ্রম-ধৰ্ম্মকেই রামায়ণ বিসদৃশ অবস্থার মধ্যে ফেলিয়া বনবাস দুঃখের মধ্যে বিশেষ গৌরব দান করিয়াছে। কৈকেয়ী-মন্থরার কুচক্রান্তের কঠিন আঘাতে অযোধ্যার রাজগৃহকে বিশ্লিষ্ট করিয়া দিয়া তৎসত্ত্বেও এই গৃহধৰ্ম্মের দুর্ভেদ্য দৃঢ়তা রামায়ণ ঘোষণা করিয়াছে। বাহুবল নহে, জিগীষা নহে, রাষ্ট্রগৌরব নহে, শান্তরসাস্পদ গৃহধর্মকেই রামায়ণ করুণার অশ্রুজলে অভিষিক্ত করিয়া তাহাকে সুমহৎ বীর্য্যের উপরে প্রতিষ্ঠিত করিয়াছে।
শ্রদ্ধাহীন পাঠকেরা বলিতে পারেন, এমন অবস্থায় চরিত্রবর্ণনা অতিশয়োক্তিতে পরিণত হইয়া উঠে। যথাযথের সীমা কোত্থানে এবং কল্পনার কোন্ সীমা লঙ্ঘন করিলে কাব্যকা অতিশয়ে গিয়া পৌঁছে এ কথার তাহার মীমাংসা হইতে পারে না। বিদেশী যে সমালোচক বলিয়াছেন যে রামায়ণে চরিত্রবর্ণনা অতি প্রাকৃত হইয়াছে তাহাকে এই কথা বলিব যে, প্রকৃতিভেদে একের কাছে যাহা অতিপ্রাকৃত, অন্যের কাছে তাহাই প্রাকৃত। ভারতবর্ষ রামায়ণের মধ্যে অতি প্রাকৃতের আতিশয্য দেখে নাই।
যেখানে যে আদর্শ প্রচলিত তাহাকে অতিমাত্রায় ছাড়াইয়া গেলে সেখানকার লোকের কাছে তাহা গ্রাহ্যই হয় না। আমাদের শ্রুতিযন্ত্রে আমরা যতসংখ্যক শব্দতরঙ্গের আঘাত উপলব্ধি করিতে পারি তাহার সীমা আছে, সেই সীমার উপরের সপ্তকে সুর চড়াইলে আমাদের কর্ণ তাহাকে গ্রহণই করে না। কাব্যে চরিত্র এবং ভাব উদ্ভাবন সম্বন্ধেও সে কথা খাটে।এ যদি সত্য হয়, তবে একথা সহস্র বৎসর ধরিয়া প্রমাণ হইয়া গেছে যে রামায়ণ-কথা ভারতবর্ষের কাছে কোনো অংশে অতিমাত্র হয় নাই। এই রামায়ণ-কথা হইতে ভারতবর্ষের আবালবৃদ্ধবণিতা আপামর সাধারণ কেবল যে শিক্ষা পাইয়াছে তাহা নহে— আনন্দ পাইয়াছে, কেবল যে ইহাকে শিরোধার্য্য করিয়াছে তাহা নহে—ইহাকে হৃদয়ের মধ্যে রাখিয়াছে, ইহা যে কেবল তাহাদের ধর্মশাস্ত্র তাহা নহে— ইহা তাহাদের কাব্য।
রাম যে একই কালে আমাদের কাছে দেবতা এবং মানুষ, রামায়ণ যে একই কালে আমাদের কাছে ভক্তি এবং প্রীতি পাইয়াছে, ইহা কখনই সম্ভব হইত না, যদি এই মহাগ্রন্থের কবিত্ব ভারতবর্ষের পক্ষে কেবল সুদূর কল্পলোকেরই সামগ্রী হইত, যদি তাহা আমাদের সংসার-সীমার মধ্যেও ধরা না দিত।
এমন গ্রন্থকে যদি অন্যদেশী সমালোচক তাহাদের কাব্যবিচারের আদর্শ অনুসারে অপ্রাকৃত বলেন, তবে তাহাদের দেশের সহিত তুলনায় ভারতবর্ষের একটি বিশেষত্ব আরো পরিস্ফুট হইয়া উঠে। রামায়ণে ভারতবর্ষ যাহা চায়, তাহা পাইয়াছে।
রামায়ণ এবং মহাভারতকেও আমি বিশেষতঃ এই ভাবে দেখি। ইহার সরল অনুষ্ঠুচ্ছন্দে ভারতবর্ষের সহস্র বৎসরের হৃৎপিণ্ড স্পন্দিত হইয়া আসিয়াছে।
সুহৃদ্ধর শ্রীযুক্ত দীনেশচন্দ্র সেন মহাশয় যখন তাহার এই রামায়ণ চরিত্র সমালোচনার একটি ভূমিকা লিখিয়া দিতে আমাকে অনুরোধ করেন, তখন, আমার অস্বাস্থ্য ও অনবকাশ সত্ত্বেও তাহার কথা আমি অমান্য করিতে পারি নাই। কবিকথাকে ভক্তের ভাষায় আবৃত্তি করিয়া তিনি আপন ভক্তির চরিতার্থতা সাধন করিয়াছেন। এইরূপ পূজার আবেগ-মিশ্রিত ব্যাখ্যাই আমার মতে প্রকৃত সমালোচনা—এই উপায়েই এক হৃদয়ের ভক্তি আর এক হৃদয়ে সঞ্চারিত হয়। অথবা যেখানে পাঠকের হৃদয়েও ভক্তি আছে, সেখানে পূজাকারকের ভক্তির হিল্লোল। তরঙ্গ জাগাইয়া তোলে। আমাদের আজকালকার সমালোচনা বাজার দর যাচাই করা— কারণ সাহিত্য এখন হাটের জিনিস। পাছে ঠকিতে হয় বলিয়া চতুর যাচনাদারের আশ্রয় গ্রহণ করিতে সকলে উৎসুক। এরূপ যাচাই ব্যাপারের উপযোগিতা অবশ্য আছে, কিন্তু তবু বলিব যথার্থ সমালোচনা পূজা—সমালোচক পূজারি পুরোহিত—তিনি নিজের অথবা সর্বসাধারণের ভক্তিবিগলিত বিস্ময়কে ব্যক্ত করেন মাত্র।
ভক্ত দীনেশচন্দ্র সেই পূজামন্দিরের প্রাঙ্গণে দাঁড়াইয়া আরতি আরম্ভ করিয়াছেন। আমাকে হঠাৎ তিনি ঘণ্টা নাড়িবার ভার দিলেন। একপার্শ্বে দাঁড়াইয়া আমি সেই কাৰ্য্যে প্রবৃত্ত হইয়াছি। আমি অধিক আড়ম্বর করিয়া তাঁহার পূজা আচ্ছন্ন করিতে কুণ্ঠিত। আমি কেবল এই কথাটুকু মাত্র জানাইতে চাহি যে, বাল্মীকির রামচরিত কথাকে পাঠকগণ কেবলমাত্র কবির কাব্য বলিয়া দেখিবেন না, তাহাকে ভারতবর্ষের রামায়ণ বলিয়া জানিবেন। তাহা হইলে রামায়ণের দ্বারা ভারতবর্ষকে ও ভারতবর্ষের দ্বারা রামায়ণকে যথার্থভাবে বুঝিতে পারিবেন। ইহা স্মরণ রাখিবেন যে, কোনো ঐতিহাসিক গৌরবকাহিনী নহে, পরন্তু পরিপূর্ণ মানবের আদর্শ চরিত ভারতবর্ষ শুনিতে চাহিয়াছিল এবং আজ পর্যন্ত তাহা অশ্রান্ত আনন্দের সহিত শুনিয়া আসিতেছে। এ কথা বলে নাই যে বড় বাড়াবাড়ি হইতেছে— এ কথা বলে নাই যে এ কেবল কাব্যকথা মাত্র। ভারতবাসীর ঘরের লোক এত সত্য। নহে—রাম, লক্ষ্মণ, সীতা তাহার যত সত্য। পরিপূর্ণতার প্রতি ভারতবর্ষের একটি প্রাণের আকাঙ্ক্ষা আছে। ইহাকে সে বাস্তব-সত্যের অতীত বলিয়া অবজ্ঞা করে নাই, অবিশ্বাস করে নাই। ইহাকেই সে যথার্থ সত্য বলিয়া স্বীকার করিয়াছে এবং ইহাতেই সে আনন্দ পাইয়াছে। সেই পূরিপূর্ণতার আকাঙ্ক্ষাকেই উন্মোচিত ও তৃপ্ত করিয়া রামায়ণের কবি ভারতবর্ষের ভক্ত-হৃদয়কে চিরদিনের জন্য কিনিয়া রাখিয়াছে।
যে জাতি খণ্ড-সত্যকে প্রাধান্য দেন, যাঁহারা বাস্তব-সত্যের অনুসরণে ক্লান্তি বোধ করেন না, কাব্যকে যাঁহারা প্রকৃতির দর্পণমাত্র বলেন, তাঁহারা জগতে অনেক কাজ করিতেছেন—তাঁহারা বিশেষভাবে ধন্য হইয়াছেন—মানবজাতি তাহাদের কাছে ঋণী। অন্যদিকে, যাঁহারা। বলিয়াছেন “ভূমৈব সুখং। ভুমাত্বের বিজিজ্ঞাসিতব্যঃ” যাঁহারা পরিপূর্ণ পরিণামের মধ্যে সমস্ত খণ্ডতার সুষমা, সমস্ত বিরোধের শান্তি উপলব্ধি করিবার জন্য সাধনা করিয়াছেন, তাঁহাদেরও ঋণ কোনোকালে পরিশোধ হইবার নহে। তাহাদের পরিচয় বিলুপ্ত হইলে, তাহাদের উপদেশ বিস্মৃত হইলে মানব-সভ্যতা আপন ধূলিধূসমাকীর্ণ কারখানাঘরের জনতামধ্যে নিশ্বাসকলুষিত বদ্ধ আকাশে পলে পলে পীড়িত হইয়া কৃশ হইয়া মরিতে থাকিবে। রামায়ণ সেই অখণ্ড অমৃতপিপাসুদেরই চিরপরিচয় বহন করিতেছে। ইহাতে যে সৌভ্রাত্র, যে সত্যপরতা, যে পাতিব্ৰত্য, যে প্রভূভক্তি বর্ণিত হইয়াছে, তাহার প্রতি যদি সরল শ্রদ্ধা ও অন্তরের ভক্তি রক্ষা করিতে পারি, তবে আমাদের কারখানাঘরের বাতায়ন মধ্যে মহাসমুদ্রের নির্মলবায়ু প্রবেশের পথ পাইবে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
(দীনেশচন্দ্র সেনের রামায়ণী কথার রবীন্দ্রনাথ লিখিত ভূমিকা)
2019-07-19