প্রকৃতির নিয়মে শীত যখন দুয়ারে কড়া নাড়ে- মনে পড়ে বাঁক বোঝায় ধানের পিছনে দৌড়ানোর কথা, ধুলো পথে ধানবোঝাই গরুর গাড়ির মৃদুমন্দ গতি,গরুর পায়ের ছিটানো ধুলো আর তার পিছনে ছুটছি আমরা আদূল গায়ে ধূলা মাখা প্যান্ট পরে। দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত দৌড়ে ঝরা ধানের শীষ কুড়িয়ে বাড়ি বাড়ি ফিরে মায়ের বকুনি খেতাম। বাবা বলতেন আহা বোকঝো কেন? ছেলে তো লক্ষী ঘরে এনেছে।স্নেহের সুরে মাথায় হাত বুলিয়ে বলতেন তোমার কুড়ানো ধানেই নবান্ন হবে। নবান্নের দিন খুব তৃপ্তি করে খেতাম পায়েস ভাত।নবান্ন হল নব – অন্ন। নতুন ধানের অন্ন গ্রহনের আনুষ্ঠানিক অনুষ্ঠান হল নবান্ন। চাষীদের একান্ত নিজের উৎসব, চাষের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা মানুষের প্রাণের উৎসব নবান্ন। যারা জীবিকার প্রয়োজনে গ্রামের বাইরে থাকেন তারাও নবান্নের সময় গ্রামে ফিরে আসেন। নবান্ন উৎসব শুরু হয় পহেলা অগ্রহায়ণ থেকেই। ঐদিন মূলত বাড়ির প্রবীণ সদস্য শুদ্ধ ধূতি পরে মুট আনতে মাঠে যান। নতুন গামছায় মুড়ে ফুল ধূপ দিয়ে মাথায় করে বাড়িতে আনেন। মহিলা রা শঙ্খ বাজিয়ে গ্রহণ করেন। সেই মুটি স্থান পায় ধানের গাদার মাথায়, বা ধানের মড়াই এর ছাউনিতে বা ঠাকুরঘরে। ঐ মুটি ধানের শীষ থেকে হাত দিয়ে ধান ছাড়িয়ে, সেই ধানের পায়েস রান্না হয়। রাজ্যের প্রায় সর্বত্রই নবান্ন উৎসব হয়। আমাদের গ্রাম্য দেবতা মা শীতলা ও বাবা কাশীনাথের পুজো দেয়া হয়। তারপর সেই দিনই সব বাড়িতে নবান্ন উৎসব পালন হয়। আগে বাড়িতে সারা বছরের জন্য ক্ষেতমজুর থাকতো। তারা তাদের বাড়ির সকল সদস্য কে নিয়ে এই অনুষ্ঠানে যোগ দিতেন। একটা সময় ছিল চাষ ই ছিল গ্রামের মানুষের অন্যতম প্রধান জীবিকা। চাষ থেকেই সংসার চলত। সংসারে পারস্পরিক সহযোগিতা, আন্তরিকতা খুব দীর্ঘ ছিল। কৃষিভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থার 4-5 ভাই বোনের হেঁসেল থাকতো একটাই। একে অপরের সাথে জড়িয়ে থাকা, মিশে থাকা, সুখ-দুঃখ ভাগ করে নেয়া ছিল নিয়ম। এখন সভ্যতার বিকাশের সাথে বেড়েছে বিকল্প আয়ের পথ। আর ততোই ভাঙ্গন ধরেছে যৌথ পরিবার গুলিতে, আলগা হয়েছে পরস্পরের বন্ধন, শুধু শহর নয়, গ্রামেও এখন ছোট্ট পরিবার। একে অপরের থেকে দূরে থাকা। কন্টাক্ট এ থাকা কানেকশনে নেই। উৎসব মানে আনন্দ, উৎসব মানে মিলন, একে অপরের কাছে আসা।নবান্ন উৎসব কে কেন্দ্র করে মেলা চলে 4-5 দিন। এই উৎসবে সবার একত্রে মিলন। একসাথে নতুন ধানের ভাত খাওয়া। *বাংলা অভিধান নবান্ন মানে হেমন্তকালীন ধান কাটার পর হিন্দুদের মধ্যে নতুন চালের উৎসব। গ্রামবাংলার মানুষের কাছে এই উৎসব প্রাণের উৎসব, মিলন উৎসব, সম্প্রীতি উৎসব। মনে পড়ে সেই সব দিন কত মধুর, সেই স্মৃতি তৃপ্তি দেয় হৃদয় ভরে।।
মনোরঞ্জন হাজরা (Manoranjan Hazra)