আজ ১৫ই আগস্ট, ভারতবর্ষের ৭৪ তম স্বাধীনতা দিবস। প্রতিবছরই এই পুণ্যলগ্নে আমরা স্মরণ করে থাকি সেই সব মহাপ্রাণ দের, সেইসব জাতীয়তাবাদী বিপ্লবীদের, যাদের আত্মত্যাগ, কষ্টসহিষ্ণুতা এবং আত্মবলিদানকে আমরা উপস্থাপন করি আগামী প্রজন্মের কাছে শুধুমাত্র তাঁদের দেশাত্মবোধ জাগিয়ে তোলার লক্ষ্যে। তবে ব্যক্তিগতভাবে আমি আজও বিশ্বাস করি পরাধীন ভারতে ব্রিটিশ রাজের বুকে যে হিমশীতল ভীতির সঞ্চার হয়েছিল, তা শুধুমাত্র চরমপন্থী বিপ্লবের ফলে। স্বাধীনতার প্রাক্কালে একদল মানুষ পরিশ্রমের চেয়ে পারিশ্রমিক বেশি নিতে গিয়ে দেশবাসীকে প্রচন্ড মানষিক আঘাত করলেন।দেশ ভাগাভাগীর দর কষাকষিতে সেই শ্রেণি, দল ভারী করতে ব্রিটিশ রাজের দালালদের হাত ধরতেও এতটুকু কুণ্ঠাবোধ করেনি। আমি সন্দিহান। তাঁদের ত্যাগের উজ্জ্বলতা স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে আর কতদিন বজায় থাকে তা গভীর প্রশ্নের বিষয়। আমি ব্যক্তিগতভাবে বিশ্বাস করি শুধুমাত্র গান্ধীজীর অহিংস আন্দোলনের ফলে ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আসেনি।যেমন বিশ্বাস করি, নেহেরু ও জিন্নার দুটি ভাগকে অক্ষত রাখতেই এই বাংলা ভাগ। সেটিও ছিল স্বাধীনতা আন্দোলনের একটি পর্যায়।বাংলার বিপ্লবীরা স্বাধীনতা আন্দলনে যে ভূমিকা পালন করেছেন তা আর অন্য কোন জাতির পক্ষে সম্ভব হয়নি।সেই বাঙালী আজও সমানভাবে বঞ্চিত।লালা লাজপত রায় থেকে বিপিন চন্দ্র পাল এমনকি সর্বশেষ সুভাষ চন্দ্র বোস, ব্রিটিশরা যাদের ভয়ে এ দেশ ছাড়তে একপ্রকার বাধ্য হয়েছিল তাঁরা সকলেই ছিলেন চরমপন্থী। ভারতবর্ষের শিক্ষিত সমাজের যেকোন ব্যক্তিকে আজও যদি দেশের প্রথম দশজন স্বাধীনতা সংগ্রামীর নাম বলতে বলা হয়, আমি নিশ্চিত স্বাধীনতার ৭৪ বছর পরও যাদেরকে জনমনের ইচ্ছার বিরুদ্ধে পুজা করান হল তাঁরা কেউ সেই তালিকায় স্থান পাবেন না।সেই কথা মাথায় রেখেই এই সকল চরমপন্থী নেতাদের স্থান হয়েছিল ভারতবর্ষ থেকে হাজার হাজার কিলোমিটার দূরে কোন এক অন্ধকার কারাগারে। এই চরমপন্থীদেরই ব্রিটিশরা পরিকল্পিতভাবে স্বাধীনতাত্তোর ভারতবর্ষ গঠনের থেকে অনেক দুরে সরিয়ে রেখেছিল। স্বাধীনতা আন্দোলনে অংশগ্রহনকারী চরমপন্থীদের প্রায় ৯০ শতাংশ বিপ্লবী হয় ফাঁসীর দড়ি গলায় পরেছেন নয় কারাগাড়ে অবশিষ্ট জীবন ব্যয় করেছেন। সেই ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিলেন অনেক রাঘব বোয়াল। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ যে চিন্তা মাথায় রেখে বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি কে ভাগ করেছিল তা শুধুমাত্র চরমপন্থীদের প্রতি প্রতিশোধ নেওয়া এবং বাংলাকে দুর্বল করা। তারা যেন কোনভাবেই স্বাধীনতা-উত্তর ভারতবর্ষে ক্ষমতাসীন না হতে পারেন।সেই উদ্দেশ্যকে সফল করাই দেশভাগের একমাত্র লক্ষ্য্য। আমি আজ ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে সেই চরমপন্থীদের বন্দনা করছি যারা দেশের স্বাধীনতার জন্য হাসতে হাসতে মৃত্যুবরন করেছিলেন বা অন্ধকারে নির্বাসিত হয়েছিলেন । আমাকে যদি মৃত্যূর পরে ঈশ্বর প্রশ্ন করেন তুমি বাঙালী হয়ে পুনরায় কেন জন্মাতে চাও? আমি উত্তর দেবো, সেই মাটিতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর,স্বামী বিবেকানন্দ, ঋষি অরবিন্দ ও সুভাষ চন্দ্রবসু জন্মেছিলেন বলে। ভারতবর্ষের চরমপন্থী আন্দোলনের প্রবাদপ্রতিম পুরুষ ঋষি অরবিন্দ। আজকের এই পূণ্য লগ্নেই এই মহাপ্রানের ধরায় আগমন। তাঁকে নিয়েই কিছু সংগৃহীত তথ্য তুলে ধরলাম পরবর্তী প্রজন্মের কাছে। আমি জানিনা তাঁকে ঋষি, সন্ন্যাসী, যোগী, দার্শনিক ,ভাষাবিদ, আধ্যাত্মবাদী কি বলা উচিত ! আমি জানিনা! কারণ হিমালয়য় সম জ্ঞানের আধার ও অগ্নী সম তেজ ও ১২টি উচ্চমার্গের বিশ্ব সমাদৃত বইএর লেখককে মাপার ক্ষমতা আমার হবেনা কোনদিন। যেহেতু শৈশব থেকে আমার বয়োঃজ্যেষ্ঠরা তাঁকে ঋষি বলে সম্বোধন করতে শিখিয়েছেন। তাই আমি তাকে ঋষি বলেই মানি।
ঋষি অরবিন্দের (Sage Arvind) জীবন বৃত্তান্ত একটি দুঃসাহসিক অভিযানসম। পিতা কৃষ্ণধন ঘোষ খুলনার প্রখ্যাত শল্যচিকিৎসাবিদ।ব্রাক্ষ্মসমাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত দেশপ্রেমিক। বিশ্বাস করতেন ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে লড়তে গেলে এদেশের শিক্ষিত যুবকদের ইউরোপিয়ান শিক্ষায় শিক্ষিত হতে হবে। তাই শৈশবেই অরবিন্দকে শিক্ষার জন্য দার্জিলিং লরেটো কনভেন্ট স্কুলে ভর্তি করেছিলেন।মাত্র সাত বছর বয়সে পাশ্চাত্য শিক্ষা গ্রহণের উদ্দেশ্যে তাঁকে ইংল্যান্ডের ম্যাঞ্চেস্টার শহরে পাঠানো হয়। শৈশব কাল থেকে অরবিন্দের গড়ে ওঠা আর পাঁচটি বাঙালি পরিবারের শিশুর থেকে সম্পূর্ণ পৃথক। সেখানে ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত হতে প্রথমেই প্রয়োজন হয়ে পড়ে ল্যাটিন ভাষার। ইংল্যান্ডের এক দুর সম্পর্কিত বন্ধু ডাব্লু এইচ ড্রিউইটের কাছে অরবিন্দ ও তাঁর অপর দুই জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা কেও শিক্ষা গ্রহণ করার জন্য পাঠিয়ে ছিলেন পিতা কৃষ্ণধন ঘোষ। অপেক্ষাকৃত বয়স কম হওয়ার জন্য অরবিন্দ সেবার ভর্তি হতে পারলেন না। এই সময় তিনি ড্রিউইইটের কাছে লাতিন, ফ্রেঞ্চ, ভূগোল ও গণিতের শিক্ষা গ্রহণ করেন। বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ পিটার হিস্ এর মতে অরবিন্দ ঘোষ মোট ১২টি ভাষা আত্মস্থ করতে পেরেছিলেন। তার মধ্যেছিল বাংলা, হিন্দি,সংস্কৃত, ইংরেজি , গ্রীক ,মারাঠি, জার্মান ,ফরাসী,ইতালিয়ান এবং স্প্যানিশ ভাষা। অতঃপর সেন্ট পলস্ স্কুল। সেখানে তিনি শিখেছিলেন গ্রিক ভাষা তার সঙ্গে জার্মান ও ইতালিয়ান ভাষা।শৈশবেই তিনি খ্রিস্টীয় নিয়ম-কানুন এবং রীতিনীতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। যদিও ধর্মের প্রতি তিনি ছিলেন উদাসীন।
সে সময় নিয়ম অনুযায়ী সিভিল সার্ভিস অফিশিয়াল হতে গেলে একজন প্রতিযোগীকে শুধু সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেই হতো না। ছাত্রদের দু’বছর কোন ইংলিশ ইউনিভার্সিটি শিক্ষানবিশ হতে হতো। পিতার চরম আর্থিক সংকটের মধ্যেই অরবিন্দ পেয়ে গেলেন কেমব্রিজের কিংস কলেজের স্কলারশিপ। তাঁর পিতাও কিংস কলেজ থেকেই চিকিৎসা বিদ্যায় ডিগ্রি লাভ করেছিলেন। পরবর্তীকালে সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় স্থান অধিকার করলেও সেটি ছিল তার পিতার ইচ্ছাপূরণ মাত্র। এই চাকরিতে যোগদান করার কোন ইচ্ছা তাঁর না থাকায় তিনি হর্স রাইডিং এর প্র্যাকটিক্যাল পরীক্ষায় স্বেচ্ছায় অকৃতকার্য হলেন। হঠাৎ একদিন ইংল্যান্ডে সাক্ষাৎ হয় গুজরাটের মহারাজা শিবাজী রাও গায়কোয়াড় এর সঙ্গে। প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী অরবিন্দ যোগদান করেন বরোদার স্টেট সার্ভিস এ। তখনই ইংল্যান্ড ছেড়ে ভারতবর্ষে গমন। দীর্ঘদিন পর ফিরে আসার আনন্দে তার পিতা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলেন তার জন্য। কিন্তু বোম্বে থেকে একটি ভুল মৃত্যু সংবাদ সব এলোমেল করে দেয়। খবরটি ছিল পর্তুগালের কোন একটি উপকূলে তাঁদের জাহাজের সলিল সমাধি ঘটেছে। ঘটনার আকস্মিকতা সহ্যকরতে না পেরে পিতা কৃষ্ণধন ঘোষ মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। বড়দায় প্রথমে সেটেলমেন্ট, পরে কোষাগার হয়ে সচিবালয়ে বিভাগে তিনি কর্মরত ছিলেন। এরই পাশাপাশি বরোদা কলেজের ফরাসি ভাষার শিক্ষক হিসাবে অধ্যাপনাও শুরু করেন।
ভারতবর্ষের ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সারাদেশ তখন আন্দোলিত। মহারাজার অধীনে স্থলাভিষিক্ত থেকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করাটা নিয়মবিরুদ্ধ হয় তাই তিনি তার জন্মস্থান বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি এবং মধ্যপ্রদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত বিভিন্ন নেতৃত্বের সঙ্গে যোগাযোগ করতে শুরু করেন। যোগাযোগ ঘটে মারাঠি নেতা বালগঙ্গাধর তিলক এর সঙ্গে। বালগঙ্গাধর তিলকই বাংলার বুদ্ধিজীবীদের গোপন কাজ সম্বন্ধে তাকে অবহিত করেন এবং তাতে যোগদানের জন্য অনুরোধও করেন।অরবিন্দ প্রতিনিয়ত যোগাযোগ রাখতে থাকেন বাংলা এবং মহারাষ্ট্রের বিশিষ্ট সমাজের সঙ্গে। শুরু হল প্রিয়জনেদের সঙ্গে তাঁর সেঁতুবন্ধন গড়া।
তিনি ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনের সক্রিয় অংশগ্রহণের স্থির সিদ্ধান্ত গ্রহন করেন। ১৯০৫ সালে বঙ্গ ভঙ্গ আন্দোলনের পর তিনি ‘বন্দেমাতরম’ পত্রিকার সম্পাদকের দায়িত্ব ভার গ্রহণ করেন। এই সময়ে তাঁর লেখা কলকাতার বাঙালি সমাজ কে বিশেষভাবে আকৃষ্ট করে। তার এই দার্শনিক চিন্তাধারার মাধ্যমে দেশাত্মবোধ ও স্বাধীনতা বিষয়ক চিন্তা এক নতুন মাত্রায় উন্নীত হয়। এর ফলে অনেক জাতীয়তাবাদী মানুষ তাঁর সঙ্গে বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত হতে ইচ্ছা প্রকাশ করেন। বাংলার বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত গুপ্ত সংগঠন গুলির মধ্যে অন্যতম ছিল অনুশীলন সমিতি। এটি প্রতিষ্ঠিত হয় সতীষচন্দ্র বসু ও ব্যারিষ্টার প্রমথনাথ মিত্রের সহচর্যে একটি শরীরচর্চার কেন্দ্র বা আখড়া গঠনের মধ্য দিয়ে। এর অপর শাখাটি ছিল ঢাকা শহরে।পরবর্তীকালে এই আখড়াই হয়ে ওঠে চরমপন্থী আন্দোলনের প্রধান কেন্দ্র। জ্যোতিন্দ্রনাথ ব্যানার্জীর সহযোগিতায় গড়ে ওঠা ‘যুগান্তর’ দল ও তাঁদের তৈরী ‘যুগান্তর’ পত্রিকাটি স্বাধীনতা আন্দোলনের পথিকৃৎ সংবাদপত্র হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছিল। এই যুগান্তর দলের সংবাদপত্রের কাজ সামলাতেন তাঁরই কনিষ্ঠ ভ্রাতা বারীন্দ্রকুমার ঘোষ।
গোপন সংগঠনের কাজ নিঃশব্দে চালানোর জন্য বারীন্দ্র কুমার ঘোষকে পাঠানো হল কলকাতার শহরতলিতে একটি বাড়ি কেনার খোঁজে। বারীন্দ্র তৎকালীন মানিকতলা শহরের উপকন্ঠে মুরারিপুকুর অঞ্চলে একটি পুরনো বাগানবাড়ি খুঁজে বের করেন এবং সেখানেই মা ভবানীর মন্দির প্রতিষ্ঠা হয় এই গোপন সংগঠনের কর্মকাণ্ড চালানোর জন্য। সবকিছু চিন্তা ভাবনার পর অরবিন্দ বেঙ্গল প্রেসিডেন্সিতে প্রতিরোধ বাহিনী গড়ে তুলতে মনোনিবেশ করেন। তিনি সর্বদা ব্রিটিশ রাজের বিরুদ্ধে অসহযোগ এবং নিষ্ক্রিয় বাধাদান প্রক্রিয়ায় বিশ্বাস করতেন। গোপন বিপ্লববাদ কোনভাবে ব্যর্থ হলে তিনি সরাসরি আক্রমণের পক্ষে ছিলেন। বাংলার চরমপন্থী আন্দোলনের অবিসংবাদিত নেতা বিপিনচন্দ্র পালের ছায়ায় অরবিন্দ তার গুপ্ত সংগঠনের বিস্তারে সচেষ্ট হয়েছিলেন। এরই মধ্যে সুরাট কংগ্রেসের বার্ষিক সভায় গান্ধীর অহিংস আন্দোলনের বিরুদ্ধে একদল মত প্রকাশ করলেন। শুরু হয় মধ্যপন্থা ও চরমপন্থী বিপ্লবীদের মতপার্থক্য। ফলে মানসিক ভাবে ভেঙে যায় জাতীয় কংগ্রেস। রবীন্দ্রনাথ নিজে বহুবার বিপিনচন্দ্র পালের পূর্ণ স্বরাজ এবং স্বদেশী আন্দোলনকে সমর্থন করেছিলেন এবং কলকাতার বিভিন্ন প্রেক্ষাগৃহে তার সমর্থনে তিনি সভাও করেছিলেন। বাংলা ভাগের ঘোর বিরোধী ছিলেন বিপিনচন্দ্র পাল এবং রবীন্দ্রনাথ। অন্যদিকে মহারাষ্ট্রে চরমপন্থী মতবাদের পথপ্রদর্শক বালগঙ্গাধর তিলক, সেন্ট্রাল ইন্ডিয়ার প্রভিন্সিয়াল কংগ্রেসের জেনারেল সেক্রেটারি বি, এস. মুঞ্জেকে প্রেরণ করেন কলকাতার অনুশীলন সমিতির কর্মপদ্ধতি পরিদর্শনে। অরবিন্দর মডেলেই মারাঠায় গড়ে উঠেছিল “গণপতি” এবং “শিবাজী” উৎসব। শোনা যায় অনুশীলন সমিতির অন্যতম সদস্য হয়েছিলেন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের প্রতিষ্ঠাতা কেশব বল্লীরাম হেডগেওয়ার। বালগঙ্গাধর তিলকের অন্যতম শিশ্য স্বাধীনতা সংগ্রামী বি. এস. মুঞ্জে তাঁকে কলকাতায় মেডিকেল সাইন্স পড়তে ও গুপ্ত সমিতির কর্মকাণ্ড শেখার জন্য পাঠিয়ে ছিলেন।
অনুশীলন সমিতির সংঘটিত বিভিন্ন ঘটনাবলীর মধ্যে অন্যতম মানিকতলা ষড়যন্ত্র বা আলিপুর বোমা মামলাটি সারা ভারতবর্ষ ব্যাপী এমনকি বর্হিবিশ্বেও প্রবল আলোড়ন তুলেছিল। সে সময় আলিপুর কোর্টের বিচারক ডগলাস কিংসফোর্ড স্বাধীনতা আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত চরমপন্থী নেতাদের দেশের বিভিন্ন প্রান্তে এবং দেশের বাইরে যাবজ্জীবন নির্বাসনের জন্য পাঠাচ্ছেন। এমনিতেই বঙ্গভঙ্গ কোন ভাবেই মেনে নিতে পারেনি বাংলার চরমপন্থী বিপ্লবীরা । প্রচণ্ড হতাশা এবং তীব্র ঘৃণা ও ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ দেখা যায় তাঁদের বিভিন্ন চরমপন্থী কার্যকলাপে। বঙ্গভঙ্গের দিন সারা শহরে স্বতস্ফূর্তভাবে ধর্মঘট আর অরন্ধন পালন করা হল। সকালবেলায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উদ্যোগে শোভাযাত্রা বেরিয়েছিল। গঙ্গা স্নানের পর একে অপরকে রাখি পরিয়ে নিজেদের সৌহার্দ্য প্রকাশ করেছিলেন। তখন জনতার উৎসাহ দেখবার মত। বিকেলে একটি সভা ডাকা হয়েছিল আপার সার্কুলার রোডে। উপস্থিতি ৫০ হাজার ছাড়িয়ে গিয়েছিল। এরই মধ্যে ঘটে যায় এক কান্ড! মিনার্ভা থিয়েটারে পূর্বনির্ধারিত স্বদেশী সভায় রবীন্দ্রনাথের বক্তব্য রাখার কথা। থাকবেন বিপিন চন্দ্রও। সভাঘরে সেদিন যে পরিমাণ ভীড় হয়েছিল তাতে জায়গা দেওয়া যায়নি বহু মানুষকে। সেই বক্তব্য শুনতে উদগ্রীব হয়েছিলেন একদল যুবক। তাঁরা বিভিন্ন মাধ্যম দ্বারা বারবার চেষ্টা করছিল হলের মধ্যে প্রবেশ করতে।শেষ পর্যন্ত অনেক অনুরোধেও কাজ না হওয়ার ফলে তাঁরা স্বেচ্ছাসেবকদের সঙ্গে বাকবিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়েন এবং সবশেষে সেটি একটি ভয়ংকর মারামারির পর্যায়ে পৌঁছে যায়। এই দলের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন উল্লাসকর দত্ত নামে হাওড়ার একটি যুবক। তাকে পুলিশ গ্রেফ্তার করে। ছেলেটি চরমপন্থী নেতা বিপিনচন্দ্র পালের স্নেহধন্য। এই উল্লাসকর দত্তের উপরই পরবর্তীকালে অনুশীলন সমিতির গুরুত্বপূর্ণ কার্যভার তুলে দেওয়া হয়।
অরবিন্দর নেতৃত্বে শুরু হলো কিংসফোর্ডকে হত্যা করার ষড়যন্ত্র।এছাড়াও সমিতি সিদ্ধান্ত নিল বিভিন্ন ব্রিটিশরাজের অফিসিয়াল দের উপরে এমন দৃষ্টান্তমূলক আক্রমণ করতে হবে যেন ব্রিটিশ সরকারের হৃৎপিণ্ড কম্পিত হয়ে পড়ে।এই কাজকে সফল করার জন্য দুজন বিপ্লবীকে ফ্রান্সে পাঠানো হলো বোমা বাধার শিক্ষানবিশের কাজে। তারা বিশেষ শিক্ষা নিয়ে দেশে ফিরলে মুরারিপুকুর এর বাগান বাড়িতে বোমা বানানোর কাজ শুরু হয়। বারীন্দ্রকুমার সহ আরো কয়েকজন চরমপন্থী বিপ্লবী কর্মকাণ্ডে যুক্ত হন। মুরারিপুকুর এর এই বাগানবাড়িটিকেই নিজেদের স্থায়ী আস্তানা গড়ে নিয়েছিলেন। উল্লাসকর দত্ত যে বোমা বানিয়ছিলেন তাতে ডিটোনেটর ব্যবহার করা হয়েছিল। তার প্রথম বোমাটি চারুচন্দ্র দত্তের পরাক্রমে গভর্নর অ্যান্ড্রু ফ্রেসারের উপর পরীক্ষামুলকভাবে নিক্ষেপ করা হলেও দুটি চেষ্টাই ব্যর্থ হয়। তৃতীয়বার মেদিনীপুরের নারায়ণগড়েও চেষ্টা ব্যর্থ হয়। অতঃপর উল্লাসকর শিবপুর কলেজের ল্যাবরেটরি থেকে বোমা বানানোর উদ্দেশ্যে সংগ্রহ করলেন পিকরিক অ্যাসিড। প্রাথমিকভাবে বিস্ফোরণ ঘটানো হলো দেওঘরে। একজন বিপ্লবী মৃত্যুবরণ করলেন তাতে। অবশেষে এলো ডগলাস কিংসফোর্ডের পালা। ১৯০৭ সাল, মুজফফরপুর শহরে ক্ষুদিরাম বসু প্রফুল্ল চাকি সেই বোমা নিক্ষেপ করলেন ডগলাস কিংসফোর্ডের ফিটন গাড়িতে। দুঃখজনকভাবে ফিরে আসার সময় সেই গাড়িতে কিংসফোর্ড না থাকার দরুন কেনেডি পরিবারের অন্য দুজন মহিলা এবং শিশু বিস্ফোরণে মারা যান।একথা আমরা প্রত্যকে জানি যে ব্রিটিশের চরদের হাতে ধরা পড়ে যান প্রফুল্ল চাকী। কিন্তু ব্রিটিশের কাছে আত্মসমর্পণ করবেন না বলে নিজের রিভলবারের গুলিতে তিনি আত্মহত্যা করেন।পরে ক্ষুদিরাম বোস গ্রেপ্তার হলেন। ফাঁসির দড়ি পড়ে নতুন ইতিহাস গড়লেন। তদন্তের জাল গুটিয়ে আনতে গিয়ে বিস্ফোরণের সঙ্গে জড়িত বারীন্দ্রকুমার ঘোষ সমেত আরো ৩৬ জন বিপ্লবীকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। হ্যারিসন রোড থেকে পাওয়া গেল বোমার মসলা ভর্তি পাঁচটি ব্যাগ। মুরারিপুকুর বাগানাবাড়ি থেকে পাওয়া গেল বোমা তৈরীর যন্ত্রপাতি,পিকরিক অ্যাসিড, পটাশিয়াম ক্লোরেট ও বোমা তৈরীর ম্যানুয়াল। এই মামলায় মূল ষড়যন্ত্রী হিসেবে অরবিন্দ ঘোষের নামে উঠে আসে। মামলার রাজসাক্ষী হয়েছিলেন নরেন্দ্রনাথ গোস্বামী। কিন্তু অপর দুই বিপ্লবী কানাইলাল দত্ত এবং সত্যেন বসু জেলের মধ্যে খুন করেন নরেন্দ্রনাথকে। চিত্তরঞ্জনের প্রখর বুদ্ধিমত্তায় সে যাত্রায় ব্রিটিশরা পেরে উঠলো না।অরবিন্দ,দেবব্রত সহ সতেরজন বেকসুর খালাস। বারীন, উল্লাসকর, উপেন্দ্র, ঋষিকেশ ,বীরেন, ইন্দ্রনাথ ,বিভূতি, সুধীর, ইন্দু, অবিনাশ ,শৈলেন আর হেমচন্দ্রের যাবজ্জীবন দ্বীপান্তর।নিরাপদ ,শিশির ,পরেশ ,সুনীল ,বালাকৃষ্ঞ ,কৃষ্ঞজীবনের তিন বছরের দ্বীপান্তর ।
জেল থেকে বেড়িয়ে এলেন অরবিন্দ। বেরিয়ে এসে অরবিন্দ বলেছিলেন যে জেলে থাকাকালীন তাঁর স্বামী বিবেকানন্দের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়েছিল।।
“ এটা সত্যি যে, আমি তার কণ্ঠস্বর শুনতে পেয়েছিলাম প্রায় ১৫দিন ধরে। আমার এই নির্জন স্থানে তিনি আমাকে সর্বদা নির্দেশ দান করে গেছেন।“
কিন্তু জেলের বাইরে বেড়িয়ে আসা অরবিন্দ এক অন্য মানুষ।সার্বিক আত্মোপলব্ধি তাঁকে অন্য জগতে নিয়ে গেল। যা শুধু আধ্যাত্মবাদে মোড়া ছিল না । ছিল তলেতলে চরমপন্থীদের বিরুদ্ধে সে সময় বৃটিশ দালালরাজের সক্রিয়তার মোড়ক।
তিনি বলেছিলেন, এতদিন যাদের পরামর্শ এবং অনুপ্রেরণায় আমি দেশের কাজ করছিলাম, জেলের বাইরে বেরিয়ে এসে তাদের খুঁজে না পেয়ে আমি এক প্রকার হতাশ হয়ে পড়ি।এর চেয়েও বেশি ছিল আমি যখন কারাগারে গিয়েছিলাম তখন পুরো দেশ যেন বন্দে মাতরমের আর্তনাদে বেঁচে ছিল। একটি জাতির আশা নিয়ে বেঁচে ছিল, লক্ষ লক্ষ পুরুষের প্রত্যাশা যা নতুনভাবে অবক্ষয়ের মধ্য দিয়ে উঠেছিল। আমি যখন জেল থেকে বের হয়ে এসেছি তখন আমি সেই কান্না শুনতে পেলাম না। কিন্তু পরিবর্তে সেখানে একটি নীরবতা ছিল। কিন্তু সে নীরবতায় আমি হতাশ হইনি কারণ এক বছর কারাগারে থাকাকালীন নিরবতার সঙ্গে আমার পরিচয় ঘটেছিল অনেক আগেই। আমি শুধু ভেবে নিয়েছিলাম সর্বশক্তিমান ঈশ্বর এই কান্নার স্রষ্টা তাই তিনি নিজেই এই নীরবতা উত্থাপন চারদিক থেকে প্রশ্ন এসেছিল, “আমরা কী করব? আমরা কী করতে পারি ?” আমিও কোন পথে চলাফেরা করতে হবে জানতাম না, আমিও জানতাম না যে কি করা হবে। তবে একটি জিনিস আমি জানতাম যে, সর্বশক্তিমান ঈশ্বরই সেই কান্না উত্থাপন করেছিলেন। আশা, তাই তিনিই সেই নীরবতাটি প্রেরণ করেছিলেন। জানতাম যে এটি আমার বিরতি ছিল আমি আমার কারাগারে তার সাথে পূর্বেই পরিচিত হয়েছি।
উত্তরপাড়ার সভায় তিনি বলেছিলেন আজ এটি কোন রাজনৈতিক সভা নয়। আজ এটি আমাদের একটি ধার্মিক সভা। জেল থেকে বেরিয়ে এসে আপনারাই প্রথম আমাকে কোন একটি সভার মাধ্যমে কিছু বলার সুযোগ করে দিলেন।দীর্ঘ বারো মাস কারাবাসের সময় যে জ্ঞান তিনি আমাকে দিয়েছিলেন, সেই তিনিই আমাকে এই কারামুক্ত করে আপনাদের সামনে পাঠিয়েছেন সেই সব কথা বলার জন্য।
জেলের মধ্যে ঘটে যাওয়া প্রতিটি ঘটনা বর্ণনার পর তিনি সেই ধার্মিক সভায় গীতার কথা উত্থাপন করেন।
যখন আপনাদের বার্ষিক সভায় আমাকে কথা বলতে বলা হয়েছিল, তখন আমার উদ্দেশ্য ছিল আজকের জন্য নির্বাচিত বিষয়টি, হিন্দু ধর্মের বিষয় সম্পর্কে কিছু কথা বলব। আমি জানি না যে আমি সেই উদ্দেশ্যটি পূরণ করব কিনা। আমি এখানে বসে থাকার সময় আমার মনে একটি শব্দ এসেছিল যা আমি আপনাদের বলতে চাইছিলাম। একটি কথা যা আমাকে পুরো ভারতীয় জাতির কাছে বলতে হবে। এই কথাটি কারাগারেই প্রথমে আমার সাথে কথা হয়েছিল, তাই আমি আমার লোকদের সাথে কথা বলতে কারাগার থেকে বেরিয়ে এসেছি। একবছর আগেও এখানে এসেছি। আমি যখন এসেছিলাম তখন আমি একা ছিলাম না। জাতীয়তাবাদের অন্যতম শক্তিশালী ভাববাদী আমার পাশে বসেছিলেন। এখন সে অনেক দূরে, হাজার হাজার মাইল দূরে আমাদের থেকে বিচ্ছিন্ন।
যিনি সর্বদা আমার পাশে ছিলেন এবং আমার কাজে যুক্ত ছিলেন তিনি আজ বার্মায় বন্দী; অন্য একজনকে আটকানো হয় দেশের উত্তর প্রান্তে।
বিপিন চন্দ্র পাল কারাগার থেকে বেরিয়ে আসার সময় একটি বার্তা নিয়ে এসেছিলেন এবং এটি একটি অনুপ্রেরণামূলক বার্তা ছিল। তিনি এখানে যে ভাষণটি দিয়েছিলেন তা আমার মনে আছে। এটি এমন বক্তৃতা ছিল যার যতটা ধর্মীয় উদ্দেশ্য ছিল ততটা রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ছিল না। তিনি কারাগারে তাঁর উপলব্ধির কথা স্মরন করিয়েছেন। আমাদের সকলের মধ্যে ঈশ্বরকে, জাতির মধ্যে ঈশ্বরকে খুঁজেছিলেন।
এখন আমিও আবার আপনাদের সাথে দেখা করতে এলাম, আমিও জেল থেকে বেরিয়ে এসেছি এবং আবারও আপনারাই উত্তরপাড়ায় রাজনীতির সভায় নয়, আমাদের ধর্ম রক্ষার জন্য একটি সমাজের সভায় প্রথম আমাকে স্বাগত জানিয়েছেন। বিপিন চন্দ্র পাল যে সংবাদ টি বক্সার জেলে পেয়েছিলেন, ঈশ্বর আমাকে তা আলিপুরে দিয়েছিলেন। যে জ্ঞান তিনি আমার বারো মাসের কারাবাসের সময় দিনের পর দিন দিয়েছিলেন এবং এখনই আমি বেরিয়ে এসেছি বলেই তিনি আমাকে আপনার সাথে সে কথা বলার আদেশ দিয়েছেন।
আমি জানতাম আমি বেরিয়ে আসব। আটকের বছরটি কেবলমাত্র নির্জনতা এবং প্রশিক্ষণের এক বছরের জন্য ছিল। কীভাবে কেউ নিজের উদ্দেশ্যে প্রয়োজনের চেয়ে বেশি সময় আমাকে কারাগারে আটকে রাখতে পারে? তিনি আমাকে কথা বলার এবং একটি কাজ করার জন্য একটি নির্দেশ দিয়েছিলেন এবং সেটি না বলা পর্যন্ত আমি জানতাম যে যতক্ষন না সেই কাজ আমি সমাপ্ত করি ততক্ষন কোনও মানব শক্তিই আমাকে ঠাট্টা করতে পারে না । আমাকে যখন গ্রেপ্তার করা হয়েছিল এবং লালবাজার হাজতে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল তখন আমি কিছুক্ষণের জন্য অবিশ্বাসে কাঁপতে থাকি, কারণ আমি তাঁর অভিপ্রায়টি হৃদয়ে প্রবেশ করাতে পারি নি। তাই আমি এক মুহুর্তের জন্য মুখ ফিরিয়েছিলাম এবং মনে মনে চিৎকার করেছিলাম, “এমটি আমার সাথে কেন হল ?
একটি দিন কেটে গেল এবং দ্বিতীয় দিন এবং তৃতীয় দিনটি যখন আমার ভেতর থেকে একটি কন্ঠস্বর এল, “অপেক্ষা করুন এবং দেখুন।” তারপরে আমি শান্ত হয়ে অপেক্ষা করতে থাকি, আমাকে লাল বাজার থেকে আলিপুরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল এবং পুরুষদের বাদে এক মাসের জন্য নির্জন কক্ষে রাখা হয়েছিল। সেখানে আমি আমার মধ্যে ঈশ্বরের কণ্ঠের জন্য দিনরাত অপেক্ষা করছিলাম। তিনি আমাকে কী বলতে চেয়েছিলেন তা জানতে, আমার কী করতে হবে তা শিখতে।
তখন মনে পড়েছিল যে আমার গ্রেপ্তারের এক মাস বা তারও বেশি আগে, আমার কাছে একটি আহ্বান এসেছিল যাতে সমস্ত ক্রিয়াকলাপ বাদ দেওয়া, নির্জনতা অবলম্বন করতে এবং নিজের দিকে তল্লাশি করার জন্য, যাতে আমি তাঁর সাথে আরও ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠতে পারি। আমি দুর্বল ছিলাম এবং আদেশটি গ্রহণ করতে পারি নি। আমার কাজটি আমার কাছে খুব প্রিয় ছিল এবং আমি মনে মনে অভিমান করেছিলাম যে আমি উপস্থিত না হলে এটি ক্ষতিগ্রস্থ হবে, এমনকি ব্যর্থ হবে এবং বন্ধ হয়ে যাবে সুতরাং আমি এটি ছেড়ে দেব না। আমার তখন মনে হয়েছিল যে তিনি আমার সাথে আবার কথা বলছেন এবং বলেছিলেন, “আপনার বন্ধন ভাঙার শক্তি ছিল না, আমি আপনার জন্যই ভেঙেছি, কারণ এটি আমার ইচ্ছা নয় বা আমার ইচ্ছাও ছিল না যে এই কাজটি চালিয়ে যাওয়া উচিত I আপনাকে আর একটি জিনিস করার জন্য আমি আপনাকে এখানে এনেছি, যা আপনি নিজের জন্য শিখতে পারেন নি তা শেখাতে এবং আমার কাজের জন্য আপনাকে প্রশিক্ষণ দিতে।”
তারপর তিনি আমার হাতে গীতা রাখলেন। তাঁর শক্তি আমার মধ্যে প্রবেশ করেছিল এবং আমি গীতার সাধনা করতে সক্ষম হয়েছি।আমি কেবল বৌদ্ধিকভাবে বুঝতে পারি নি তা বুঝতে পেরেছিলাম অন্যভাবে। শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনের কাছে যা চেয়েছিলেন এবং যাঁরা তাঁর কাজ করতে আগ্রহী হন তাদের কাছে তিনি কী দাবি করেন, বিকৃতি এবং আকাঙ্ক্ষা থেকে মুক্ত হয়ে, ফলের চাহিদা ছাড়াই তাঁর জন্য কাজ করে যাওয়া ও ত্যাগ করে যাওয়া। উচ্চ-নীচু, বন্ধু এবং প্রতিপক্ষের, সাফল্য এবং ব্যর্থতার জন্য সমান হৃদয় অর্জনের জন্য স্ব-ইচ্ছায় তাঁর হাতে একটি নিষ্ক্রিয় এবং বিশ্বস্ত উপকরণ হয়ে ওঠে, তবুও তাঁরা কাজ অবহেলা করে না।আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে হিন্দু ধর্ম বলতে কী বোঝায়। আমরা প্রায়শই বলি আমরা হিন্দু ধর্মাবলম্বী। সনাতন ধর্মের কথা বলি। তবে আমরা কি সত্যই জানি যে সেই ধর্মটি কী। এ ধর্ম শুধু, বিশ্বাস ও পেশা বা ধর্মের ধর্ম নয়। সনাতন ধর্মই জীবন। এটি এমন একটি বিষয় যা জীবদ্দশায় বিশ্বাস করা যায় না।
মানবতা রক্ষার জন্য এই ধর্মই প্রাচীন কাল থেকে এই উপমহাদেশের নির্জনতায় লালিত হয়েছিল। এই ধর্ম প্রসারণের জন্যই ভারত বাড়ছে। অন্য দেশ যখন নিজেরা শক্তিশালী হয় তখন দুর্বলদের পদদলিত করে। তেমন উত্থান এখানে হয় না। ভারত সর্বদা মানবতার জন্য অস্তিত্ব নিয়েছে , নিজের জন্য নয়। তিনি আমাকে হিন্দু ধর্মের কেন্দ্রীয় সত্য উপলব্ধি করিয়েছিলেন। তিনি আমার কারাগারের হৃদয় আমার দিকে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। কারাগারের দায়িত্বে থাকা ইংরেজকে বলেছিলেন, “তিনি তার কারাগারে ভুগছেন; তাকে কমপক্ষে সকালে ও সন্ধ্যায় আধ ঘন্টার জন্য তার ঘরের বাইরে চলতে দেওয়া উচিত।” সুতরাং তার ব্যবস্থাও করা হয়েছিল । এবং আমি যখন হাঁটছিলাম তখন তাঁর শক্তি আবার আমার মধ্যে প্রবেশ করল। আমি সেই জেলটি দেখেছিলাম যা আমাকে বাকী পুরুষদের থেকে আলাদা করে দিয়েছে এবং এটি এখন আর আমাকে উঁচু প্রাচীরের দ্বারা বন্ধ করে রাখা হয় নি। না, আমাকে ঘিরে ছিলেন বাসুদেব। আমি আমার কক্ষের সামনে যে গাছের ডালের নীচে হেঁটেছিলাম। সেটি গাছ ছিল না, আমি জানতাম এটি বাসুদেব, তিনি শ্রীকৃষ্ণ, যাকে আমি সেখানে দাঁড়িয়ে দেখলাম এবং আমার ছায়া ধরে রেখেছিলেন। আমি যে মোটা কম্বল রেখেছিলাম সেটি আমার চারপাশে শ্রী কৃষ্ণের হাতের মতো, আমার বন্ধু এবং প্রেমিকের হাতের মতো অনুভব করেছিলাম। তিনি আমাকে যে গভীর দৃষ্টি দিয়েছিলেন তার এটিই প্রথম ব্যবহার।আমি কারাগারের বন্দি চোর, খুনিদের দিকে তাকালাম এবং ওদের দিকে তাকিয়ে দেখলাম বাসুদেবকে। এই চোর এবং ডাকাতদের মধ্যে এমন অনেকেই ছিলেন যারা তাদের সহানুভূতি, তাদের মমত্ববোধ, মানবতাবোধকে এমন প্রতিকূল পরিস্থিতিতে জয়যুক্ত করে আমাকে লজ্জা দিয়েছিলেন।
আমি তাদের মধ্যে একজনকে বিশেষ করে দেখেছি, যিনি আমার কাছে একজন সাধু, আমার জাতির কৃষক, যিনি পড়তে এবং লিখতে জানেন না, একজন অভিযুক্ত ডাকাতকে দশ বছরের সশ্রম কারাদন্ডে দন্ডিত করা হয়েছিল, তাদের মধ্যে একজনকে দেখিয়ে তিনি আরও একবার আমাকে বলেছিলেন “দেখো এই লোকদের মধ্যে আমি তোমাকে কিছু কাজ করার জন্য প্রেরণ করেছি।“
নিম্ন আদালতে তখন কাউন্সেলিং চলছিল ,আমি তাকিয়ে দেখলাম যিনি ম্যাজিস্ট্রেট আমি তাকে দেখেছি, এটি বাসুদেব, তিনি ছিলেন নারায়ণ যিনি সেখানে বেঞ্চে বসে ছিলেন। আমি প্রসিকিউটিং কাউন্সেলকে দেখেছিলাম এবং এটি আমি যে প্রসিকিউশনের পক্ষ থেকে দেখেছিলাম তা ছিল না। শ্রী কৃষ্ণই সেখানে বসেছিলেন, আমার প্রেমিক এবং বন্ধু সেখানে বসেছিলেন এবং তাকিয়ে হাসলেন। বললেন- “এখন কি ভয় হয়?” তিনি বলেছিলেন, “আমি সকল পুরুষের মধ্যে আছি এবং আমি তাঁদের কাজ এবং তাদের কথাকে উপেক্ষা করেছি তোমার সুরক্ষা এখনও আমার কাছে রয়েছে এবং তুমি ভয় পেয়না।“
আমার প্রতিরক্ষার জন্য যে ব্যবস্থা করা হয়েছিল তা হঠাৎ করে বদলে দেওয়া হয়েছিল এবং আর একজন কাউন্সেল আমাকে রক্ষার জন্য সেখানে দাঁড়িয়েছিল। অপ্রত্যাশিতভাবে এসেছিল, আমার এক বন্ধু, তবে আমি জানতাম না যে তিনি আসছেন। আপনারা সকলেই সেই ব্যক্তির নাম শুনেছেন যিনি তাঁর অন্য সমস্ত চিন্তাভাবনা ত্যাগ করে এবং তাঁর সমস্ত অনুশীলন ত্যাগ করে,যিনি কয়েক মাস ধরে দিনের পর দিন, অর্ধ রাত অবধি জেগে বসে ছিলেন এবং আমাকে বাঁচাতে তাঁর স্বাস্থ্য ভেঙেছিলেন। শ্রীযুক্ত চিত্তরঞ্জন দাশ।আমি যখন তাকে দেখলাম তখন আমি সন্তুষ্ট হয়েছি, তবুও নির্দেশনা লেখার প্রয়োজন মনে করেছি। আমার মধ্যে থেকে এই বার্তা এল, “এই সেই ব্যক্তি যিনি তোমাকে তোমার পায়ের চারপাশে রাখা ফাঁদ থেকে রক্ষা করবেন। এই কাগজপত্রগুলি সরিয়ে রাখো। তুমি তাকে নির্দেশ দেবে না। আমি নির্দেশ দেব তাকে.”সেই সময় থেকে আমি নিজে থেকে আমার কাউন্সেলকে কেস সম্পর্কে কোনও কথা বলিনি বা একটি নির্দেশনাও দিইনি । তিনি আমাকে কি বোঝাতে চেয়েছিলেন আমি সমস্তই জানি, কারণ আমি এটি বারবার শুনেছি, সর্বদা আমি ভিতরে কন্ঠস্বর শুনেছিলাম; “আমি গাইড করছি, অতএব ভয় করো না। নিজের কাজকে ঘুরিয়ে দাও যার জন্য আমি তোমাকে কারাগারে নিয়ে এসেছি এবং যখন তুমি বেরিয়ে আসবে তখন কখনই ভয় করবে না, কখনই দ্বিধা করবে না। মনে রাখবে যে আমিই এগুলি করছি। আমি জাতি এবং এর অভ্যুত্থানে আছি এবং আমি বাসুদেব, আমি নারায়ণ, আর আমি যা করব, তা অন্যের কি হবে তা নয়।যা আমি বেছে নিই, কোনও মানবিক শক্তির তা থাকতে পারে না। “
তিনি আমাকে বললেন, “এই হল তরুণ প্রজন্ম, আমার আদেশ অনুসারে উদ্ভূত নতুন ও শক্তিশালী জাতি। তাঁরা নিজের থেকেও বড় । তুমি কীসের আশঙ্কা করছ?তুমি যদি একপাশে দাঁড়িয়ে থাকো বা ঘুমিয়েও থাকো, তবেও কাজটি এখন শেষ হবে। যদি তোমাকে আগামীকাল একপাশে ফেলে দেওয়া হয়, তবে এখানে অল্প বয়স্ক যুবকরা আছেন যারা তোমার কাজটি গ্রহণ করবেন এবং এটি তোমার চেয়ে বেশি দৃঢ়তার সাথে করবে।“
তারপরে হঠাৎ একটা জিনিস ঘটল। এক মুহুর্তে আমাকে তাড়াতাড়ি একাকী কারাগারের নির্জন জায়গায় নিয়ে যাওয়া হল। এই সময়কালে আমার সাথে যা ঘটেছিল তা বলতে আমি প্ররোচিত হইনা, তবে কেবল সেদিনই তিনি আমাকে তাঁর বিস্ময়কর চিহ্ন দেখিয়েছিলেন এবং হিন্দু ধর্মের সম্পূর্ণ সত্যকে উপলব্ধি করিয়েছিলেন। আমার আগে অনেক সন্দেহ ছিল। আমি বিদেশী ধারণা এবং পুরোপুরি বিদেশী একটি পরিবেশের মধ্যে ইংল্যান্ডে বেড়ে উঠেছি।
হিন্দুধর্মের অনেকগুলি বিষয় সম্পর্কে আমি একবার বিশ্বাস করতে আগ্রহী ছিলাম না । সেগুলি কল্পনা ছিল। কিন্তু এখন দিনের পর দিন মনে মনে বুঝতে পেরেছি, হিন্দু ধর্মের সত্যতা আমি দেহে মনে উপলব্ধি করতে পেরেছি।
‘কর্মযোগীন’ পত্রিকায় তাঁর প্রকাশিত “আমার দেশের মানুষের প্রতি” শীর্ষক লেখায় যা তিনি জেল থেকে বেরিয়ে যে ঘটনাক্রমে অবলোকন করেছিলেন তা তার অন্তরাত্মাকে নাড়িয়ে দিয়েছিল।বিপিনচন্দ্র পালের বার্মার কারাগারে নির্বাসন তিনি মন থেকে মেনে নিতে পারেননি।এবং জেলের বাইরে এসে এমন বহু চরমপন্থী মানুষের এই আন্দোলন থেকে সরিয়ে দেওয়ার বিষয়টি তাকে ভীষণভাবে নাড়া দিয়েছিল।
ব্রিটিশ সরকার তাকে কোনোভাবেই রেয়াত করবেনা এটা বুঝতে পারার পরেই তিনি নিঃশব্দে চন্দননগরে মতিলাল রায়ের বাড়িতে গা ঢাকা দেন । সমস্ত রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড থেকে তিনি নিজেকে অন্তরিত করেন। জেলে থাকাকালীন ‘কর্মযোগীন’-এ প্রকাশিত তাঁর লেখার জন্য ব্রিটিশ সরকার তাকে তখন খুঁজে বেড়াচ্ছে। আবার একটি ওয়ারেন্ট জারি হল পুনরায় গ্রেফতারের জন্য ।
উপায়ন্ত না পেয়ে অরবিন্দ পালিয়ে যান পন্ডিচেরির এক ফ্রেঞ্চ কলোনিতে। তখন সেটি ফরাসী উপনিবেশের দখলে। ফলে ব্রিটিশ সরকারকে তার ওয়ারেন্ট ক্যানসেল করতে হল । সেখানেই তিনি মাত্র ১২৪ জন শিষ্যকে নিয়ে গড়ে তুলেছিলেন তার আশ্রম।আশ্রমের শুরুতেই তিনি “আর্য” নামে একটি পত্রিকার প্রকাশনার মাধ্যমে বিভিন্ন আধ্যত্মিক ঘটনাবলীর বর্ণনা দিয়ে যাচ্ছিলেন। অতঃপর তিনি খুঁজে পেলেন আধ্যাত্ত্ববাদের এক নতুন পথ যাকে “ইন্টেগ্রাল যোগা” বলা হয়ে থাকে।যদিও যোগা র বিশেষ পাঠ শ্রীঅরবিন্দের ছিলনা। তার ভাই বারীন ঘোষ এর যোগাযোগে স্বামী ব্রহ্মানন্দের শিষ্য শ্রী গঙ্গারামনাথের সহচর্যে তিনি কিছু যোগা রপ্ত করেছিলেন। যা তিনি জেলে নির্বাসনের সময় অনুশীলন করতেন। “ইন্টিগ্রাল যোগার” মূলকথা হলো এই চর্চার মাধ্যমে আমাদের চেতনার স্তরকে আরো উন্নত করা এবং আমাদের নিজেদের সম্পর্কে নিজেদের স্পষ্ট ধারণা গড়ে তোলা।এছাড়া তিনি আলোকপাত করেছিলেন “আধ্যাত্মিক বিবর্তন” এর। এটি একটি দার্শনিক ধারণা, যেখানে বলা হয় , প্রকৃতি এবং মানুষ উৎসারিত হয়েছে এক মহাজাগতিক ব্যাপ্তি থেকে। এটি বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের উৎস, বিবর্তন এবং অন্তিম পরিণতি সম্পর্কে বৈজ্ঞানিক পাঠ। “আধ্যাত্মিক বিবর্তন” শুধুমাত্র মানুষের জৈবিক বিবর্তনের সীমাবদ্ধ নয় ।এই বিবর্তনে মানুষের জৈবিক ও শারীর বৃত্তীয় সৃষ্টির পর তার মনস্তাত্ত্বিক,মানসিক ও আধ্যাত্মিক বিবর্তন কে বোঝানো হয়ে থাকে। এই বিষয়টি মানুষের সৃষ্টিশীলতাকে নির্দেশ করে যদিও আধ্যাত্বিক বিবর্তন একটি বৈচিত্র্যপূর্ণ বিষয় । এটির বিস্তৃত রূপে যেমন মহাজগতিক ব্যাখ্যা করা যায় আবার ব্যক্তি স্তরেও ব্যাখ্যা করা যায়। আবার দুটি একত্রে করাও সম্ভব।এই রাস্তাতেই তিনি আগামী ভারতের উত্থান চেয়েছিলেন।
১৯৪৭ সালের ১৫ই আগষ্টের দিন অরবিন্দ পন্ডিচেরী থেকে লিখলেন…….
“The nation will not accept the settled fact as forever settled, or as anything more than a temporary expendient.”
দেশ কখনো এমন কোন একটি তৈরী করা সত্যকে চিরকালীন হিসাবে গ্রহন করবে না , বা এটি সুবিধা ভোগের চেয়ে বেশি কিছু নয়।
(এই শব্দবন্ধ থেকেই শিক্ষিত সমাজকে বুঝে নিতে হবে ঋষি অরবিন্দ কি চেয়েছিলেন ।)
ডঃপ্রদীপ কুমার দে (Dr. Pradeep Kumar Dey)