যে অমূল্য উপহার দিয়ে গেলেন নিবেদিতা, গিফ্টবক্স খুলে কি দেখেছি?

সিস্টার নিবেদিতা হচ্ছেন ভারতবাসীর কাছে ‘The gift unopened’. তাঁর জীবনকালে এবং পরবর্তী সময়ে বিবিধ প্রেক্ষাপটে মূল্যায়ন হলেও, বস্তুবাদী ভারতবাসী তাঁকে বালিকা বিদ্যালয়ের এক শিক্ষিকার বেশি ভাবেন না। ভাববাদী মানুষের জগতেও প্রকৃত অবস্থানে ততটা উচ্চে নেই, যেমনটি তিনি ছিলেন, যেমনটি তাঁর দর্শন এবং কর্মকৃত্য ছিল। ১৩ অক্টোবর নিবেদিতার প্রয়াণ দিবসে তাঁকে স্মরণ-মনন করছিলাম আমরা। আমাদের মনে হয়েছে, হিমশৈলের চূড়ার মতন তাঁকে খানিকটা আমরা দেখতে পেয়েছি। না জানার পরিধি বহুগুণ বেশি। তিনি প্রচার করে তো ভারতবর্ষকে ভালোবাসেন নি! অন্তরাত্মার ডাকে তিনি এসেছেন। গুরুদেব স্বামী বিবেকানন্দের নির্দেশে তাঁর ভারত-জীবন শুরু হয়েছে। বিশ্বের ঠাকুরঘরে ভারত-যাপন করতেই তিনি এলেন। ইহকাল-পরকাল ভারত সম্পৃক্ত হয়ে রইলো। নিবেদিত-প্রাণ এই পুণ্যাত্মা এখনও ভারতবর্ষের পুণ্যভূমির মধ্যেই বিচরণ করছেন, থাকবেনও চিরকাল। এটাই বোধহয় গুরুর নির্দেশ!

১৮৯৮ সালের ২৮ শে জানুয়ারি ইংল্যান্ড থেকে ভারতবর্ষে এলেন। তখন অভুক্ত অথচ অতুল্য ভারতবর্ষ। বুভুক্ষু, মুমুর্ষু মানুষকে সেবার কাজ তো করলেনই, তার সঙ্গে নবজাগরণের অঙ্গরাগে ভারতবর্ষের মেধার জগতকে নাড়িয়ে গেলেন। রাজনীতি, সমাজ, শিল্প, শিক্ষা, বিজ্ঞান সবদিকেই তিনি বাঙালির চেতনাকে ‘Green Manure’-এর মতো সার-জল যোগালেন। জৈবকৃষিতে ‘সবুজ সার’ কথাটা আমরা শুনেছি। নিবেদিতার জীবনবোধটি সবুজ সারের একটি খাঁটি উদাহরণ। তিনি দেশভক্তির সমার্থক। তাঁর সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে কবি মোহিতলাল মজুমদার বলেছিলেন, বাংলার নবজাগরণের মাটিতে হলকর্ষণের পর বীজবপন হল, বৃষ্টিপাতও হল। দিকে দিকে নতুন অঙ্কুর দেখা দিল। তারই মধ্যে একটি বীজ সকলের থেকে দূরে এক কোণে অঙ্কুরিত হল। নিজেকে ফুলে-ফলে বিকশিত করবার জন্য নয়। অন্য ফসলের সার হিসাবে ব্যবহার হবার জন্য। এই ফসল বাজার পর্যন্ত পৌঁছায় না। কেবল সার হবার ফসল। পরাধীন ভারতবর্ষে অনেক দেশহিতৈষী মানুষ, সাধুসন্ত, বিপ্লবী মানুষ ভারত মা-কে শৃঙ্খল মোচনের জন্য সবুজ সার হয়েছেন। নিজেরা নিঃশেষ হয়ে দেশসেবা করেছেন। তেমনই এক ঋষিকা হলেন সিস্টার নিবেদিতা।

তিনি ভারতবর্ষকে মুক্তির পথ দেখানোর জন্য যে বিস্তৃত ক্ষেত্র খুঁজে পেলেন, তা স্বরাজ ভাবনারই সর্বোত্তম দর্শন। কেবল রাজনৈতিক স্বাধীনতা নয়, ভারতকে ভেতর থেকে জাগাতে হলে, অন্তরাত্মায় যে উৎকৃষ্ট সম্পদ অবহেলায় রয়েছে তার জাগরণে উদ্যোগী হতে হবে। সাহিত্য-শিল্প-বিজ্ঞান, সমস্ত ক্ষেত্রেই তিনি সমন্বয় করলেন মাণিক্য ভাণ্ডারের মনীষীদের। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, অরবিন্দ ঘোষ, জগদীশ চন্দ্র বসু, রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়, দীনেশচন্দ্র সেন, মতিলাল ঘোষ, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, নন্দলাল ঘোষ, অসিত কুমার হালদার, ডা. মহেন্দ্রলাল সরকার, মোহিনী মোহন চ্যাটার্জী, গোপালকৃষ্ণ গোখেল প্রমুখ মানুষের সঙ্গে নানান বিদগ্ধ আলোচনায় ব্রতী হলেন।

ভারতবাসী হিসাবে আমরা নিবেদিতার শিক্ষাদর্শে ঋণী। জাতীয় শিক্ষার পরিকল্পনায় অগ্রদূত ছিলেন নিবেদিতা। ভারত-বোধ সম্পন্ন শিক্ষাই যে আমাদের প্রকৃত ভারতীয় করে তোলে, ইউরোপীয় শিক্ষা নয়, এটা পরিস্কারভাবে জানতে পারলাম নিবেদিতার তত্ত্বে ভর করে। স্ত্রী শিক্ষার উজ্জ্বল ভূমিকায় তিনি অবতীর্ণ হলেন। তাঁর স্থাপিত বিদ্যালয় জাতীয় ধারায় নির্মিত প্রথম বিদ্যালয়। অনেকে বলবেন, নারী শিক্ষার ব্যবস্থা তো ইউরোপীয় মিশনারীরাও করেছেন, করেছেন ব্রাহ্ম চিন্তাবিদেরা। তাহলে নিবেদিতা নতুন কী করলেন? নিবেদিতা নারীশিক্ষার সুরটি বেঁধে দিলেন ভারতীয় সুকুমারী-আদর্শের সঙ্গে ইউরোপীয় দৃঢ়তায় ও দৃষ্টিভঙ্গিতে। এই উদ্যোগ কেবল কর্তব্যবোধের মধ্যে শেষ হবার নয়। ভারতবাসীর জন্য গভীর প্রেম ও অন্তরীণ ব্যাকুলতা থাকতে হবে শিক্ষাদর্শনের পরতে পরতে, তবেই না কর্মক্ষেত্রে গিয়ে মানুষের জন্য কাজ করতে পারবো আমরা! জ্ঞানদান কেবল শিক্ষার সীমা নয়। কর্মকান্ডের অন্দরমহলে তার ব্যাপ্যতা চাই। নইলে সে জ্ঞান শুষ্ক জ্ঞান। নিবেদিতা তাই সচেষ্ট হলেন বাগবাজারের অখ্যাত এক গলির মধ্যে এক অনন্য শিশুতীর্থ গড়ে তুলতে। ছাত্রীরা তাঁর কাছে ‘My Child’. পড়া পড়া খেলা, হিন্দু সংস্কৃতি ও রীতিনীতিকে বজায় রেখে চলা, এক দেশীয় হৃদয়ের উত্তাপ। তোতাপাখির খাঁচা সেটা নয়, এক বিরাটের কাকলি। ভারত পাখির নারী-পক্ষ, যা কাটা হয়েছিল ইসলামিক শাসন থেকে, অপরিসীম আনন্দে সেই পাখনা জুড়ে দেওয়ার কাজ শুরু হল।

ভারতবর্ষের দুঃখ দারিদ্রকে উপেক্ষা করে, গ্রীষ্মপ্রধান জলবায়ুকে সহ্য করে, ইউরোপীয় সুখস্বাচ্ছন্দ্যকে দূরে সরিয়ে রেখে তিনি ভারতবাসীর সেবা করলেন, এরকম দৃষ্টান্ত কোথায়? ১৮৯৯ সালে কলকাতায় প্লেগরোগ নিবারণে তাঁর কাজ কি আজও ভোলা যাবে? স্বেচ্ছাসেবকদের নিয়ে তিনি নিজেই ঝাঁটা হাতে রাস্তার ময়লা পরিষ্কার করতে নামছেন। মুমূর্ষু রোগীদের নিজেই সেবা করছেন। বানভাসি জলে, মন্বন্তরে বাংলার গণ্ডগ্রামে ছুটে যাচ্ছেন। হত দরিদ্র মানুষের প্রতি সহমর্মিতা জানাচ্ছেন, একাত্ম হচ্ছেন, এটা প্রকৃত ভারতবোধ না থাকলে হতে পারে?

নিবেদিতা ছিলেন ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের এক আপোষহীন সংগ্রামী। রাষ্ট্রগুরু সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর ‘A Nation is Making’ গ্রন্থে লিখছেন, শুধু আন্দোলনের জোয়ারে অবগাহন নয়, অর্থনীতিকে স্বাবলম্বী করতে স্বদেশী পণ্য উৎপাদন ও ব্যবহারের জন্যও মানুষকে প্রভাবিত করেছিলেন তিনি। রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় মন্তব্য করেছিলেন, “প্রয়োজন বিশেষে বা স্থলবিশেষে বলপ্রয়োগ ও যুদ্ধ তিনি আবশ্যক মনে করতেন।” তিনি বিপ্লবীদের উৎসাহ দিয়েছেন, বই দিয়েছেন, গোপন তথ্যও দিয়েছেন। দিয়েছেন বিপ্লবী কাজের অনুমোদন। সকল তথ্য হয়তো এখনও আমাদের হাতে এসে পৌঁছায় নি। তখন আমরা হিমশৈলের তলদেশ খুঁজে পাবো।

অরিত্র ঘোষ দস্তিদার এবং কল্যাণ চক্রবর্তী।
(ছবি এঁকেছেন শীর্ষ আচার্য )

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.