ন’বছরের মোদি সরকারের উন্নয়ন বিষয়ক মূল মন্ত্র হচ্ছে, “সবকা সাথ, সবকা বিকাশ, সবকা বিশ্বাস, সবকা প্রয়াস।” অর্থাৎ সকলকে নিয়ে চলা, সকলের সঙ্গে চলা, সকলের বিশ্বাস ও আস্থা অর্জন করা এবং সকলকে উন্নয়নের কর্মযজ্ঞে সামিল করা। ভারতবর্ষের অধিকাংশ কৃষকই গরীব এবং তারা গ্রাম-ভারতে অবস্থান করেন। এই গরীব ও প্রান্তিক মানুষের জন্য সেবা, সুশাসন এবং গরীব কল্যাণের যে যে কর্মসূচী মোদি সরকার সম্যকভাবে বিগত নয় বছর ধরে গ্রহণ করে এসেছেন, তার সুফল আরও অধিক কৃষকের কাছে পৌঁছে দেবার নামই হবে যথার্থ উন্নয়ন। কৃষক-কেন্দ্রিক প্রকল্প রূপায়ণে কোনো রাজ্য সরকারের গড়িমসি, মিথ্যাচার, বিরোধিতা মোটেই কাম্য নয়।

দরিদ্র মানুষের পাশে —
একনজরে দেখে নেবো গরীব মানুষের জন্য মোদি সরকারের সাফল্য কোথায়। তার এক ডজন সাফল্যের খতিয়ান এখানে রইলো।
১. আশি কোটি মানুষ বিনামূল্যে খাদ্যশস্য পেয়েছে প্রধানমন্ত্রী গরীব কল্যাণ অন্ন যোজনায়।
২. প্রায় বারো কোটি বাসিন্দার কাছে পৌঁছে গেছে কলের জল।
৩. তিন কোটির অধিক মানুষ গ্রামে ও শহরে প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনায় গৃহলাভ করেছেন।
৪. প্রায় বারো কোটি টয়লেট তৈরি হয়েছে স্বচ্ছ ভারত প্রকল্পে।
৫. প্রায় পয়ত্রিশ লক্ষ রাস্তার হকার PM SVANidhi প্রকল্পে ঋণ পেয়েছেন।
৬. প্রায় চল্লিশ কোটি ঋণ আবেদন মুদ্রা যোজনার মাধ্যমে খুদ্র উদ্যোগপতিদের জন্য মঞ্জুর করা হয়েছে।
৭. সাংবিধানিক স্ট্যাটাস দেওয়া হয়েছে ন্যাশানাল কমিশন অফ ব্যাকোয়ার্ড ক্লাসকে।
৮. প্রায় কুড়ি কোটি মহিলার কাছে করোনা পরিস্থিতিতে অর্থ পৌঁছে দেওয়া হয়েছে।
৯. স্ট্যাণ্ডআপ ইণ্ডিয়া প্রকল্পের মাধ্যমে ৭৩৫১ কোটি টাকা তফশিলি জাতি ও উপজাতি সম্প্রদায়ের মানুষ পেয়েছেন।
১০. বর্তমান ভারতবর্ষে ৬০% মন্ত্রী এস.সি, এস.টি বা ওবিসি সম্প্রদায়ভুক্ত।
১১. ২০১৪ সালের আগে যত না একলব্য আবাসিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, তার চাইতে ৫ গুণ বেশি বিদ্যালয় তৈরি হয়েছে ২০১৪ সালে মোদি সরকার আসার পর।
১২. বিভিন্ন প্রদেশ মিলিয়ে ১১৭ টি অ্যাসপিরেশনাল জেলা গঠিত হয়েছে উন্নয়নের নিরিখে।

প্রান্তিক জনগণের কল্যাণ সাধন —
কীভাবে প্রান্তিক মানুষের উন্নয়নকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে তার একটি প্রাসঙ্গিক তালিকা দেওয়া হল —
১. যেসমস্ত দরিদ্র কৃষক প্রধানমন্ত্রী ফসল বীমা যোজনার আওতায় আছেন, তার ৭১% কৃষক ই এস.সি/এস.টি/ওবিসি সম্প্রদায়ভুক্ত।
২. পিএম কিষাণ প্রকল্পের মাধ্যমে উপকৃত ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষীদের মধ্যে ৮০ % এস.সি/এস.টি/ওবিসি সম্প্রদায়ভুক্ত।
৩. যে গৃহ যেগুলি PMAY(G) প্রকল্পে নির্মিত হয়েছে তার ৪৫.৪৫ % এস.সি অথবা এস.টি।
স্কলারশিপ গ্রহীতাদের ৫৮% এস.সি/এস.টি/ওবিসি সম্প্রদায়ভুক্ত।
৪. চল্লিশ কোটি মুদ্রা যোজনায় সুবিধাপ্রাপ্ত মানুষের ৫১% এস.সি/এস.টি/ওবিসি সম্প্রদায়ভুক্ত।

কৃষকের মঙ্গলের জন্য নিয়োজিত এই সরকারের যদি বিগত দিনের কাজ ও বর্তমান সময়ের পরিকল্পনার হদিশ করি, তবে দেখবো কত বৃহৎ ও ব্যাপক উন্নয়নের প্রচেষ্টা করেছে মোদি সরকার।

১. ২০১৩-১৪ সালের চাইতে ২০২২-২৩ বর্ষে ৫.৭ গুণ বাজেট বরাদ্দ কৃষিখাতে বেড়েছে।
২. কৃষি ইনফ্রাস্টাকচার ফাণ্ডে অর্থ বরাদ্দ হয়েছে ১ লক্ষ কোটি টাকা।
৩. ১১ কোটির অধিক কৃষক পিএম কিষান প্রকল্পে উপকৃত হয়েছেন।
৪. প্রায় ২৩ কোটি সয়েল হেল্থ কার্ড বা মৃত্তিকা স্বাস্থ্যের বিবরণী নথি বিতরণ করা হয়েছে, যা থেকে মাটির গুণগত মান জানতে পারবেন কৃষকেরা এবং তার ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় সার প্রয়োগ করতে সমর্থ হবেন।
৫. ২০১৩-১৪ সালের চাইতে ২০২১-২২ অর্থবর্ষে নন-বাসমতি চাল রপ্তানি ১০৯.৭ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।
৬. তৈলবীজের ক্ষেত্রে মিনিমাম সাপোর্ট প্রাইস কৃষকদের প্রদান করে যে সংগ্রহ অভিযান চলেছে, তা ১৫০০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে৷ এতে দেশে তৈলবীজ উৎপাদন প্রভূত বৃদ্ধি পেয়েছে।
৭. ডালশস্যের ক্ষেত্রে মিনিমাম সাপোর্ট প্রাইস কৃষকদের প্রদান করে যে সংগ্রহ অভিযান চলেছে, তা ৭৩৫০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে৷ এতে দেশে প্রোটিন সমৃদ্ধ আহার ডালচাষ বৃদ্ধি পেয়েছে।
৮. ২০২১-২২ এর চাইতে ২০২২-২৩ বর্ষে সারে ভর্তুকি বেড়েছে ৫০০ শতাংশ।
৯. ২০২৩-২৪ বর্ষে কৃষি খাতে ঋণদানের লক্ষ্যমাত্রা ধার্য করা হয়েছে ২০ লক্ষ কোটি টাকা।
১০. প্রধানমন্ত্রী ফসল বীমা যোজনা খাতে ১.৩৩ লক্ষ কোটি টাকার দাবী মঞ্জুর করা হয়েছে। ফলে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক বীমার টাকা পেয়ে ক্ষতি সামলাতে পেরেছেন।
১১. চাষ করতে লাগে জল। ২০২১-২৬ এই পাঁচ সালের জন্য প্রধানমন্ত্রী কৃষি সিঁচাই যোজনা বা সেচের জল যোগানের পরিকল্পনায় ৯৩,০৬৮ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে।
১২. ই-নাম (eNAM) প্রকল্পের আওতায় ১,২৬০ টি মাণ্ডি এসেছে এবং কৃষি সামগ্রী বেচাকেনা কাজে গতি এসেছে।

মনে রাখবার মতো কাজ —
কৃষি উন্নয়নের নিরিখে নরেন্দ্র মোদি সরকারের যে কথাগুলি মানুষ মনে রাখবে, তা হল:
১. ঝুঁকি নেওয়ার ক্ষেত্রে কৃষককে রক্ষা করা ও আগলে রাখার মানসিকতা এই সরকারে পুরোদমে রয়েছে।
২. MSP বা মিনিমাম সাপোর্টিং প্রাইস বৃদ্ধি করেছে এই সরকার। খরচের ৫০% -এর বেশি বৃদ্ধি করে ধার্য করা হয়েছে ফসল বিক্রির ন্যুনতম মূল্য, যাতে অভাবী বিক্রি করে দিতে বাধ্য না হয় চাষী, ফসল চাষ করে ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সে।
৩. পিএম কিষান প্রকল্পে ১১ কোটির বেশি কৃষক প্রত্যেকে বছরে ৬ হাজার টাকা পাবার জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের কাছ থেকে আশ্বস্ত হয়েছে। এ বড় কম কথা নয়। চাষ করে, ফসল বিক্রি করে লাভ তো আছেই, বীমা করা আছে ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হলে, তার উপর বছরে এই অতিরিক্ত নিশ্চিত টাকা কৃষককে চাষের মধ্যে থাকতে আশ্বস্ত করেছে।
৪. শাস্ত্রে আছে “কৃষিমিৎ কৃষস্ব” অর্থাৎ চাষই কেবল করো। এটাই কৃষককে সম্মান জানানোর জন্য সরকারি প্রচেষ্টা। ফসল বীমার যে বন্দোবস্ত কেন্দ্রীয় সরকার করেছে, তারজন্য প্রিমিয়ামের পরিমাণ যৎসামান্য। অথচ ফসল ফলাতে গিয়ে নানাভাবে চাষ মার খেলে কৃষক তার প্রাপ্য টাকা ফসল বিক্রি ছাড়াই পেয়ে যাবেন। ইতোমধ্যে প্রধানমন্ত্রী ফসল বীমা যোজনা খাতে ১.৩৩ লক্ষ কোটি টাকা কৃষকের দাবী সরকার মেনে নিয়েছে। বীমার টাকা পাবার পথ আরও সহজ ও সাধাসিধে হয়েছে।


৫. একটি প্রবাদ আছে ‘আশায় মরে চাষা’, বৃষ্টির জন্য প্রকৃতির দিকে চেয়ে থাকতে হত। সব জায়গায় তো আর বড় নদী পরিকল্পনায় সেচের জলের সুবিধা নেই! বৃষ্টির উপর থেকে নির্ভরতা কমিয়ে দিতে পেরে কৃষিকাজকে নিশ্চিত করেছে এই সরকার। যদিও অন্য পরিকল্পনায় বর্ষার জল ধরা ও জল ভরার প্রাকৃতিক প্রকল্পের সদ্ব্যবহারও রয়েছে। মোট ৭৭,৫৯৫ কোটি টাকা নিয়োজিত করে ৯৯ টি ইরিগেশন প্রকল্প হাতে নিয়েছে এই সরকার, যা কৃষিক্ষেত্রে ক্ষুদ্র সেচ প্রকল্পে যুগান্তকারী উদ্যোগ।
৬. সর্বকালের জন্য সবচেয়ে বেশি খাদ্যশস্য উৎপাদিত হয়েছে এই আমলেই। ২০১৩-১৪ সালে যেখানে ২৬৫.০৫ মিলিয়ন মেট্রিক টন খাদ্যশস্য উৎপাদিত হয়েছিল, ২০২২-২৩ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩২৩.৫৫ মিলিয়ন মেট্রিক টন। খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ একটি রাষ্ট্র হয়ে উঠেছে ভারতবর্ষ। কৃষিক্ষেত্রে সর্বোত্তম গরিমাময় একটি দেশ।
৭. কৃষকের এখন আয় বৃদ্ধির নানান পথ খুলে দেবার চেষ্টা করছে এই সরকার। ব্যারেন ল্যাণ্ড বা পতিত অকর্ষিত জমিতে সৌর প্যানেল বসিয়ে সৌর বিদ্যুৎ উৎপাদনের ব্যবস্থাকে উৎসাহিত করা হচ্ছে।
৮. চেষ্টা চলছে দুধ উৎপাদন বাড়িয়ে চাষীর আয় বাড়াতে। ২০১৪-১৫ সাল থেকে ২০২১-২২ সালে বার্ষিক দুধ উৎপাদন বেড়েছে ৫১.০৫ শতাংশ।
৯. মৎস্য উৎপাদন বাড়াতে পৃথক মন্ত্রক তৈরি হয়েছে। যথার্থ ‘নীল বিপ্লব’ (Blue Revolution) আসবে এই মৎস্য উৎপাদন বাড়িয়ে।
১০. বিগত নয় বছরে মধুর উৎপাদন বেড়েছে তা নয়, বিদেশে রপ্তানির পরিমাণ দ্বিগুণ হয়েছে। একেই বলা যায় মিষ্টি বিপ্লব (Sweet Revolution)।
১১. ২০১৩-১৪ সালের চাইতে ২০২১-২২ সালে কৃষিক্ষেত্রকে কাজে লাগিয়ে ইথানল তৈরির পরিমাণ ৩৮ কোটি লিটার থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪৩৪ কোটি লিটার।


১২. রাষ্ট্রসঙ্ঘ ২০২৩ সালকে International Year of Millets বা আন্তর্জাতিক মোটাদানা শস্যের বছর বা শ্রীঅন্ন বছর বলে চিহ্নিত করেছে। এই কোর্স গ্রেইন বা মোটা দেশীয় দানাশস্যের মধ্যে প্রভূত পুষ্টিমূল্য রয়েছে, যা দেশের পুষ্টি নিরাপত্তার জন্য একটি দারুণ উৎস। এগুলি আম-জনতার ফসল, এগুলিকে বিশ্বের বাজারে ছড়িতে দিতে প্রচেষ্টা গ্রহণ করেছে নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে কেন্দ্রীয় সরকার। ভারতবর্ষ এই উদ্যোগের একটি উল্লেখযোগ্য দেশ। কারণ বহু বিচিত্র মোটাদানার শ্রীঅন্ন যেমন জোয়ার, বাজরা, রাগী, কোদো, মারুয়া ভারতে উৎপন্ন হয়। এই প্রস্তাব রাষ্ট্রসঙ্ঘে ২০২১ সালের মার্চ মাসে ভারতই উত্থাপিত করে এবং ৭২ টি দেশ তা সমর্থন করে। এভাবেই ২০২৩ সালে পালিত হচ্ছে মিলেট বর্ষ বা শ্রীঅন্ন বর্ষ। গরীব মানুষকে তাদের হাতের নাগালে থাকা পুষ্টিকর শস্য-সম্পদে ভরিয়ে দিতে হবে গোলা।

কৃষি আইন, যা সম্ভব হল না, কৃষির দালালরাজের বিরোধিতায় —
যে কৃষি আইনের বিরোধিতা করেছিল বিরোধীরা, তা বলবৎ হলে পশ্চিমবঙ্গের কৃষকেরা কতটা উপকৃত হতেন, সে বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করবো। ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে কৃষি বিষয়ক তিনটি বিল লোকসভা ও রাজ্যসভায় পেশ ও উত্তীর্ণ হয়ে, ভারতের রাষ্ট্রপতির অনুমোদন পেয়ে আইনরূপে বলবৎ হয়েছিল। পরে তা কেন্দ্রীয় সরকার কর্তৃক প্রত্যাহৃত হয়। আইনগুলি ছিল — ১. কৃষি পণ্য ব্যবসা-বাণিজ্য (উৎসাহ ও প্রতিশ্রুতি) আইন বা FPTC Act; ২. কৃষক (ক্ষমতায়ন ও রক্ষা) মূল্য নিশ্চিতকরণ এবং কৃষি পরিষেবা আইন বা FAPAF Act; এবং ৩. অত্যাবশ্যকীয় পণ্য (সংশোধনী) আইন বা ECA Act। এই আইনগুলি চালু হলে বাজারের প্রথাগত প্রাঙ্গনের বাইরে বাধাহীন হতো অন্তর্রাষ্ট্রীয় এবং আন্তর্রাষ্ট্রীয় বাণিজ্য। কৃষকদের সরাসরি বিপণনে জড়িত হতে সাহায্য করতো এই আইন, মধ্যস্থতাকারীদের অবস্থানও দূর করতো, ভারতের কৃষিভিত্তিক অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতো। কৃষি বিপণন ব্যবস্থায় এক ব্যাপক পরিবর্তনের ফলে পরিকাঠামোগত বেসরকারি বিনিয়োগের সম্ভাবনা প্রবল হতো। গ্রামে গ্রামে কোল্ড স্টোরেজ, গুদামঘর ইত্যাদি তৈরি হতো এরই ফলশ্রুতিতে। আর প্রতিযোগিতার মাধ্যমে এপিএমসিগুলি বা Agricultural Produce Market Committee গুলি কৃষকদের আরও সুবিধার বন্দোবস্ত করতে বাধ্য হতো।

প্রতিক্রিয়াশীল এবং দেশবিরোধী চক্র কৃষি আইনের বিরোধিতা করছিল। যে কৃষি বিল চাষীর জন্য আশীর্বাদ হতে পারতো, তার বিরোধিতা কেন করা হল? বিষয়টি দাঁড়িয়ে ছিল দুটি মূল প্রতিপাদ্য বিষয়ের উপর, কেউ কৃষকের স্বার্থ দেখছেন, না মধ্যসত্ত্বভোগীদের স্বার্থের কথা ভাবছেন। কৃষকের জন্য কেউ কেউ মায়াকান্না কেঁদে দালালদের জন্য কৃত্রিম প্রেম দেখিয়েছিলেন। তারা দেশের ক্ষুদ্র-প্রান্তিক চাষীর কথা ভাবেন নি, জোতদার শ্রেণির কৃষকের কথা ভেবেছেন। তারা দুই এক বিঘা জমির মালিক এমন কৃষকের জন্য কুম্ভীরাশ্রু ফেলে কয়েকশো বিঘা যাদের তাদের স্বার্থ দেখেছেন এবং কৃপাদৃষ্টি করেছেন। বাংলায় একটি প্রবাদ আছে, তা হল, “সে কহে অধিক মিছে যে কহে বিস্তর।

সেই কৃষি আইনে কৃষিপণ্য ব্যবসা-বাণিজ্যে এমন একটি তন্ত্র রচনার বন্দোবস্ত ছিল যেখানে কৃষক ও ব্যবসায়ী কৃষিপণ্যের ক্রয়বিক্রয় সংক্রান্ত যাবতীয় স্বাধীনতা ভোগ করতে পারতেন, আগে যেটা ছিল না। মাণ্ডিতে ফসল বিক্রি করতে গিয়ে যদি কৃষক মনে করতেন তিনি প্রতারিত হচ্ছেন, যথাযথ দাম পাচ্ছেন না, তাহলে বিকল্প ব্যবস্থা তার জন্য খোলা ছিল। প্রতিযোগিতার এক নতুন ও অন্যতর মার্কেটিং চ্যানেল তৈরির সুযোগ ছিল। ছিল দক্ষ, স্বচ্ছ ও বাঁধাহীন প্রণালী। কৃষিপণ্যের অন্তর্রাজ্য ও আন্তর্রাজ্য বাণিজ্য সম্ভব ছিল। দৃশ্যমান বাজারের বাইরে বাজার-সদৃশ্য স্থল রচনা হতো। সম্ভব হতো বৈদ্যুতিন বাণিজ্য। আইনের মূল লক্ষ্যটি ছিল, সারা দেশের জন্য সুসংহত ও অভিন্ন একটি বাজার গড়ে তোলা — ‘এক দেশ এক হাট’। কেন্দ্র সরকার চান নি, কৃষক ও আমজনতার মধ্যে কাটমানি-খোর মধ্যসত্ত্বভোগীরা এঁটুলি পোকার মতো লাভের গুড় খেয়ে ফেলুক। সেই আইনে কৃষক ফসল থেকে বেশি দাম পেতো, লাভবান হতো। তেমনই সাধারণ মানুষ তুলনায় কমদামে ফসল কিনতে পেরে লাভবান হতেন। অর্থাৎ এটি ছিল যেমন কৃষক-বান্ধব আইন, তেমনই আম-জনতার সহায়ক আইন। তবে দালালদের সন্তুষ্টির আইন এটি ছিল না। কৃষিতে লাভ হয় না বলে, যে কৃষক চাষ ছেড়ে দিচ্ছেন; তার বিপ্রতীপে এই আইন কৃষককে জমি-জিরেতের অভিমুখী করে তুলতো। মাণ্ডিতে বিক্রি করার জন্য যে শুল্ক লাগতো, এই আইনের ফলে আর লাগতো না। কেউ যদি মনে করতেন, তিনি লেভি দিয়ে মাণ্ডিতেই ফসল বিক্রি করবেন, তার সুযোগ কেড়ে নেওয়া হয় নি। অর্থাৎ যারা বলছেন, মাণ্ডি উঠে যাচ্ছে, তা কিন্তু নয়।

দ্বিতীয়ত, কৃষি সুরক্ষা আইন ছিল চাষের চুক্তি সংক্রান্ত একটি জাতীয় ফ্রেমওয়ার্ক। কৃষককে ক্ষমতাশালী করাই ছিল তার লক্ষ্য। কৃষি এক শিল্পের পর্যায়ে যাচ্ছে, একটি ভৌমশিল্প যেন। নতুন আইনের ফলে ব্যবসায় জড়িত হতেন কৃষক। জড়িত হতেন ব্যবসায়ী ফার্মের সঙ্গে, প্রক্রিয়াকরণ কোম্পানির সঙ্গে, পাইকারি বিক্রেতার সঙ্গে, কিংবা খুচরো ব্যবসায়ীর সঙ্গে। বীজ বোনার আগেই চুক্তি হতে পারতো, কিন্তু চুক্তির এক্তিয়ারটি আসতো ফসল পাকার পর, কেবলমাত্র উৎপাদিত পণ্য বিক্রির জন্য। এটি আদৌ জমির বন্ধক সংক্রান্ত কোনো চুক্তি ছিল না। কখনই জমি হাতছাড়া হবার সম্ভাবনা ছিল না। একেবারে ঝকঝকে পরিচ্ছন্ন একটি পদ্ধতির কথা ছিল আইনে। কৃষকের লাভজনক দাম পাবার কথা ছিল। চাষের শুরুতেই কৃষক লাভের ব্যাপারে স্থিরচিত্ত হতে পারতেন এই আইনে।

তৃতীয়, অত্যাবশ্যকীয় পণ্য (সংশোধনী) আইনে বলা হয়েছিল যে কেন্দ্র সরকার কেবলমাত্র যুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ, সহসা ও মাত্রাতিরিক্ত মূল্যবৃদ্ধির পরিস্থিতি তৈরি হলে তবেই খাদ্যশস্য, ডালশস্য, আলু, তৈলবীজ ও পেঁয়াজের মতো কৃষিপণ্য সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ করবে। পচনশীল ও অ-পচনশীল কৃষি-উদ্যান ফসলের দাম কত শতাংশ বৃদ্ধি পেলে সরকার মজুতদারি নিয়ন্ত্রণ করবে এবং কীভাবে তা করবে, তা সুস্পষ্ট বলা ছিল এই আইনে। কোনোভাবেই অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের বেলাগাম আইন এটি ছিল না। সিমেন্ট, ইস্পাতও পূর্বে অত্যাবশ্যকীয় পণ্য আইনের আওতার বাইরে চলে এসেছিল, তাতে মানুষের ধরাছোঁয়ার বাইরে কিন্তু ইস্পাত ও সিমেন্ট যায় নি। ১৯৫৫ সালে যখন এই আইন লাগু হয় তখন আজকের মতো কৃষি উন্নয়নের পরিস্থিতি ছিল না। আজ দেশে কৃষি উৎপাদন ও তার হার অনেক বেড়েছে। দেশ আজ কৃষিতে সাবলম্বী। তাই ৬৫ বছর আগেকার কৃষি নীতি আজকের নীতি হতে পারে না। এই আইনের সংশোধনী সম্পর্কে সেন্ট্রাল ডিপার্টমেন্ট অফ কনজিউমার অ্যাফেয়ার্স শ্রীমতী লীনা নন্দন জানিয়েছিলেন, “Essential Commodities Act was conceptualised in the era of food shortage…we have moved from scarcity to food security.” নতুন আইনের ফলে রপ্তানি বাণিজ্য থেকে আয়ের সম্ভাবনা যেমন বাড়বে, তেমনই দেশে সংরক্ষণ ও শস্যাগার নির্মাণ-শিল্পের সুযোগ ব্যাপক বৃদ্ধি পাবে। ফসলের অপচয় রোধ করাও সম্ভব হবে।

কিন্তু বিল পেশের সঙ্গে সঙ্গে রাজনৈতিক বিতর্ক শুরু করে দিল মানুষের দ্বারা প্রত্যাখ্যাত বিরোধী দলগুলি। বিরোধিতা গণতন্ত্রের পক্ষে সুলক্ষণ। তবে এই বিরোধিতার যুক্তি ও ধরণ ছিল আলাদা। যারা আইন বিরোধিতার নামে বসে রইলেন, তাদেরকে কৃষক বলে চেনা যায় নি। আন্দোলনে যাদের মুখ দেখা গেছে, তাদের রণকৌশল কী, শ্লোগান কী, ব্যানার-পোস্টারে কী লেখা হচ্ছে — সবকিছু বিচার বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায়, ভারতবিরোধী নানান বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তি অন্তরালে থেকে কিছু কৃষককে সামনে এগিয়ে দিয়েছে। যারা মোটেই সামগ্রিক কৃষকের যথার্থ প্রতিভূ নয়। যারা বাজার-দালালী করে কৃষকের হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রমের ফসলে নিজেদের পরিপুষ্টি ঘটায়, কাটমানিতে ফুলেফেঁপে উঠে, তাদেরই একটি সঙ্গবদ্ধ প্রয়াস ছিল এই আন্দোলন। তারা দেশের কৃষকের নামে তা চালানোর অন্যায় চেষ্টা করে। আন্দোলনের নামে অসত্য ও অর্ধসত্য বিবৃতি দেয় মানুষের সমর্থন পাবার আশায়।।

মানুষ বুঝেছিল, কিছু মানুষকে ভাড়া করে সামনে এগিয়ে দিয়েছেন আর একদল মানুষ! দামী গাড়ি ও এলাহি আয়োজন নিয়ে উপস্থিত হওয়া একদল মানুষ। তারা শতশত বিঘা জমির মালিকানা ভোগ করেন। তারা মাণ্ডির আড়তদার? তারা বাজার কমিটিতে জাঁকিয়ে বসে থাকা রাজনৈতিক দলের প্রতিভূ। প্রয়োজন ছিল চালচিত্র খুঁটিয়ে দেখা। খোঁজার দরকার ছিল বৈদেশিক যোগাযোগের তথ্যতালাশ। আর এক অভূতপূর্ব ষড়যন্ত্রের আখ্যানও পাওয়া গেছে।

কৃষিপণ্যের বাজার এবং বাজারের যাবতীয় প্রণালীর প্রতি রাজ্যের কৃষি বিপণন দপ্তরের সংঘটিত ও পরিকল্পিত ভূমিকা নেই। তার ফলে কৃষিতে প্রত্যাবর্তন কম, কৃষকের আয় বেশি নয়। বাজারের সুযোগ গড়ে ওঠে নি বলেই গ্রীষ্মের মাসগুলিতে ভিণ্ডির পাইকারি দর কেজিতে মাত্র দু টাকা এসে দাঁড়ায়, শীতের সময় ফুলকপি এক টাকা। এই দামে বেচলে কৃষকের দুঃখ কখনও ঘুচবে না। এই দাম পেলে ফসল তোলার খরচও উঠবে না। ধান গম আলু আনাজের মতো ফসলে বিঘা প্রতি খরচ দশ-বিশ হাজার টাকা। প্রকৃতির খামখেয়ালিপনায় তা শেষ হয়ে গেলে কয়েক মাস বাদে কৃষকের হাত শূণ্য হয়ে যায়। আর ফলন ভালো হলেও রক্ষা নেই, কৃষকের কপাল পোড়ে, ফড়ের পোয়া বাড়ে। এদিকে রাসায়নিক চাষে খরচ বেশি। সার, কীটনাশক, আগাছানাশকের খরচ, সবকিছুই ধরতে হবে। উচ্চফলনশীল জাতের বীজ কেনার খরচ আছে। কিন্তু যদি ফলনের কথা চিন্তা করি, তবে প্রাথমিকভাবে উচ্চ ফলন দিলেও, সবমিলিয়ে চাষের লাভজনক আয় চাষীকে দিতে সক্ষম হবে না। রাসায়নিক চাষের ফলে মাটির অণুজীবের সংখ্যা সাংঘাতিকভাবে কমে যায়, মাটির স্বাস্থ্য নষ্ট হয়। জল, বায়ু দূষিত হয়। স্বাস্থ্যসঙ্কট দেখা দেয়, মানুষ অপুষ্টিতে ভোগে। সবমিলিয়ে কৃষক দীন দরিদ্র হয়ে পড়ে।
বিরোধীদের জবাবে সেদিন কৃষিমন্ত্রী জানিয়েছিলেন, এই বিল চাষীকে বীজ বোনার সময়েই ফসলের দামের গ্যারান্টি দেবে৷ বিক্রয় চুক্তি কেবলমাত্র উৎপাদনের উপর, তার সঙ্গে কৃষিজমির কোনো উল্লেখ নেই। কৃষক চুক্তি থেকে সরে আসতে পারে, ব্যবসায়ী পারবে না। কৃষক ও তার কৃষিজমি পুরোপুরি সুরক্ষিত। তিনি বিরোধীদের কাছে প্রশ্ন তুলেছেন, কোনোদিনই কি ফসলের ন্যুনতম সহায়ক মূল্য আইনের অঙ্গ ছিল? কংগ্রেস তো ৫০ বছর শাসন করেছে। তারা কেন তা আইনের অঙ্গীভূত করে নি? বিরোধীরা কৃষিবিলকে রাজনৈতিক ইস্যু করেছে, যেহেতু এই বিলের বিরুদ্ধে সমালোচনার আর কোনো জায়গা নেই তাই। ন্যূনতম সহায়ক মূল্য সবসময় ভারত সরকারের একটি প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত ছিল এবং আগামী দিনে থাকবে। নতুন আইনে কৃষক দেশ জুড়ে যেকোনো কৃষিজ পণ্য বিক্রি করতে পারতেন। এই আইন কৃষককে পণ্য বিক্রির সুযোগ বাড়াতে সহায়তা দিত। মান্ডি বা কৃষি-বাজারে যেভাবে কৃষকেরা আর্থিকভাবে শোষিত হয়, মানসিকভাবে প্রতারিত হয়, তা থেকে মুক্তির সম্ভাবনা তৈরি করত এই আইন৷

আন্দোলনকারীরা ছিলেন নাছোড়। সরকার আন্দোলনকারীদের সঙ্গে বারে বারে কথা বললেও, তারা সমাধান চান নি। দেশে আন্দোলনের নামে অস্থিরতা তৈরি করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞা ছিলেন। প্রশ্ন উঠেছিল, বিচ্ছিন্নতাবাদীরা আন্দোলনকে হাইজ্যাক করেছে। যে দাবীমঞ্চে খালিস্তানপন্থী, নকশালবাদী, উগ্র কাশ্মীরি, শাহীনবাগ, ও ভারতবিরোধী মুসলিম নেতাদের দেখা যায়, সেই আন্দোলন আসলে কী! যে আন্দোলন চলাকালীন স্লোগান ওঠে — “মোদী তেরি কবর খুদেগী, আজ নেহি তো কাল!” “ইন্দিরাকো ঠোক দিয়া, মোদী কেয়া হে!” “পাকিস্তান হামারা দুশমন নেহি হে, দিল্লি হামারা দুশমন হে!” “কৃষি বিল ইজ অ্যান্টি শিখ!” সেখানে যাবতীয় আশঙ্কার বাতাবরণ তৈরি হয় বৈকি! কৃষিবিল নিয়ে এই কট্টর বিরোধিতা কেনই বা কেবলমাত্র পঞ্জাব, হরিয়ানা, পশ্চিম উত্তর প্রদেশের মতো স্থানে জন্ম নিল! কেনই বা অবশিষ্ট ভারতে তার প্রভাব নেই? যে অঞ্চলের মানুষ আন্দোলন করলেন, সেই রাজ্যের কৃষকের গড় পারিবারিক আয় অন্য রাজ্য গুলি থেকে অনেক বেশি।

রাজ্যের কৃষকের মূল ছবি —
এদিকে এ রাজ্যে ৯৬ শতাংশ ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষী নিজেদের মাথার ঘাম পায়ে ফেলে খাদ্য উৎপাদন করলেও, তাদের গড়পড়তা বার্ষিক আয় মোটে আটচল্লিশ হাজার টাকা। ভারতীয় কৃষকের গড় আয় আটাত্তর হাজার টাকাও পশ্চিমবঙ্গের চাইতে বেশি। পশ্চিমবঙ্গের কৃষকের আয় ওড়িশা এবং ঝাড়খণ্ডের চাইতে কম। রাজ্যে ফসল কাটার পর ব্যবস্থাপনার বিস্তর অভাব আছে, বিপণনের পরিকাঠামোগত সুযোগ নগণ্য। কৃষকের আয় দ্বিগুণ করা সম্ভব হবে, যদি নতুন কৃষি আইন দ্রুত চালু করে ফসলের সুনিশ্চিত দাম পাইয়ে দেওয়া যায়। সেই সঙ্গে রাজ্যের কৃষি ও আনুষঙ্গিক বিভাগগুলিকে সুষ্ঠু ও সমন্বিতভাবে কাজ করানো যায়। ফসল-প্রাণীসম্পদ-মৎস্য ভিত্তিক চিরায়ত কৃষিকর্মের পরিকল্পনা গ্রহণ করা যায়। হাজার হাজার ফার্মাস প্রোডিউসিং অর্গানাইজেশন তৈরি হলে কৃষকদের একত্রিত করে ফসলের দাম পেতে দর কষাকষি সম্ভব হত। এফপিও তৈরি করিয়ে কেন্দ্রীয় সরকার সেই কাজটিই করতে চলেছেন। ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকের দারিদ্র্য মোচন এবং অর্থনৈতিক উন্নয়ন সাধন তখনই হবে, যখন ফসলের বাজার তৈরি করা যাবে, ফসলের দাম পাওয়ার ব্যবস্থা হবে, ফসল লাগানোর সময়েই চুক্তিচাষে নিশ্চিত হওয়া যাবে কতটা মূল্য সে পেতে পারেই। কৃষি আইনে সে সুযোগ ছিল।

পশ্চিমবঙ্গের কৃষকসমাজের পরিচয় গ্রহণ করে নেওয়া যাক। এ রাজ্যের বড় অংশের মানুষের জীবনপথ হচ্ছে কৃষিকর্ম। খাদ্যোৎপাদন ও জীবনচর্যায় কৃষিই তাদের আশা, চাষাবাদই তাদের ভরসা। জমির মালিকানা আছে এমন কৃষকের পাশাপাশি গ্রামের হাজার হাজার ভূমিহীন-শ্রমিক কৃষিকাজকে জীবন ও জীবিকার জন্য বেছে নিয়েছেন। রাজ্যের জমির পরিমাণ এক হেক্টর বা সাড়ে সাত বিঘার কম এমন কৃষক রয়েছেন ৮২.১৬ শতাংশ, যাদের বলা হচ্ছে প্রান্তিকচাষী। ৫২.৪৭ শতাংশ ব্যবহারযোগ্য জমি-জিরেতের মালিকানা তাদেরই হাতে। ১৩.৭৬ শতাংশ কৃষক মোটের উপর ক্ষুদ্রচাষী। তাদের মাথাপিছু জমির গড় পরিমাণ এক থেকে দুই হেক্টর। এরা রাজ্যের মোট চাষযোগ্য কৃষিজমির ২৮.২৫ শতাংশ দখল করে আছে। সবমিলিয়ে ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষক ৯৫.৯২ শতাংশ, তারা মোট ৮১ শতাংশ কৃষিজমির মালিক। ২০১০-১১ সালের জনগণনা অনুসারে ৭২ লক্ষ কৃষক পরিবার এ রাজ্যে বসবাস করেন৷ ধীরে ধীরে তাদের মাথাপিছু জমির পরিমাণ কমছে এবং চাষ থেকে আয়ের পরিমাণও কমে যাচ্ছে। রাজ্যের শস্য নিবিড়তা ১৮৫ শতাংশ। অর্থাৎ রাজ্যে গড়পড়তায় দুটি ফসলও চাষ হয় না। সেচের সুবিধাযুক্ত কৃষিভূমি মাত্র ৫৪ শতাংশ।। শতাংশের উপর কৃষক পরিবারের বার্ষিক আয় ২.৪ লক্ষ টাকার বেশি! রাজ্যের একটি বড় এলাকা খরাপ্রবণ পশ্চিমাঞ্চলের অন্তর্গত। সেখানে ভূমিক্ষয় বড় সমস্যা। মাটির উর্বরা শক্তি একেবারেই কম। বৃষ্টিপাত কম এবং অনিশ্চিত। এদিকে সুন্দরবন একটি পশ্চাৎপদ ব-দ্বীপ এলাকা। সেখানে সতেজ ও বিশুদ্ধ জলে সেচ দেওয়া মুস্কিল। পার্বত্য ও তরাই অঞ্চলের মাটি ক্ষয়িষ্ণু এবং অম্লধর্মী। তার উৎপাদিকা শক্তি কম। সেচের সুবিধা অপ্রতুল। ফলে এইসব অঞ্চলে প্রতিকূলতার জন্য দশকের পর দশক কৃষিকাজে ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে। এইসব অঞ্চলের অধিকাংশ কৃষককে খাদ্যের নিশ্চয়তা এবং জীবন-জীবিকার নিরাপত্তা দেওয়া এক প্রবল সমস্যা। কেন্দ্রের বিকাশধর্মী রথের চলায় পশ্চিমবঙ্গ যদি সাড়া না দেয়, তবে রাজ্য সরকার বদল করা প্রয়োজন।

ব্বিশে সোনার ভারত আর রাজা নরেন্দ্র কেন চাই?

‘সোনা’ বলতে কী বুঝি? সোনা মানে ‘উত্তম’, সোনা মানে ‘শ্রেষ্ঠ’৷ চর্যাপদে পাচ্ছি — “সোনা ভরিতী করুণা নাবী/রূপা থোই নাহিক ধাবী।” আমার সোনায় নৌকো ভরেছে, রূপার জন্যও আর স্থান নেই। আমরা বলি ‘সোনার ছেলে’, ‘সোনার মেয়ে’। ছড়ায় শিশু হয়ে যায় ‘সোনা’। সেরকমই সোনার মাটি, সোনার ফসল, সোনার গৌর। “হৃদ্ মাঝারে রাখবো ছেড়ে দেবো না।” তেমনই ‘সোনার দেশ’, ‘সোনার ভারত’। এক সমৃদ্ধ ভারত, জগৎ সভার এক শ্রেষ্ঠ আসন লাভ।

এই সোনার দিব্যানুভূতি বুঝতে গীতাঞ্জলির ‘কৃপণ’ কবিতার আশ্রয় নেবো —
“আমি ভিক্ষা করে ফিরতেছিলেম
গ্রামের পথে পথে,
তুমি তখন চলেছিলে
তোমার স্বর্ণরথে।
অপূর্ব এক স্বপ্ন-সম
লাগতেছিল চক্ষে মম–
কী বিচিত্র শোভা তোমার,
কী বিচিত্র সাজ।
আমি মনে ভাবতেছিলেম,
এ কোন্‌ মহারাজ।”
স্বর্ণরথে চলেছেন তিনি। ভাবলাম আজ আমার কী ভাগ্য! তিনি ধনধান্য ছড়িয়ে দেবেন, আর আমি কুড়িয়ে নেবো। আমাকে দ্বারে দ্বারে ভিক্ষা করতে হবে না। আমার কাছে এসে সেই রথ থেমে গেল। দেবতা নামলেন। ‘আমায় কিছু দাও গো’ বলে হাত বাড়িয়ে দিলেন। আমি মাথা নিচু করে রইলাম। কারণ বাংলাকে গুজরাট হতে দেবো না। বাংলাকে সমৃদ্ধ হতে দেবো না। বরং বাংলা সুভিক্ষ স্থান হোক, বাংলা ভর্তুকির আতুরঘর হোক৷

@ নরেন্দ্র, তোমার কী-বা অভাব? কোন দীনতা? অগত্যা ঝুলি থেকে ছোট এক কণা তুলে দিলাম তাঁকে। তারপর ঘরে ফিরলাম।
“যবে পাত্রখানি ঘরে এনে
উজাড় করি– এ কী!
ভিক্ষামাঝে একটি ছোটো
সোনার কণা দেখি।
দিলেম যা রাজ-ভিখারীরে
স্বর্ণ হয়ে এল ফিরে,
তখন কাঁদি চোখের জলে
দুটি নয়ন ভরে–
তোমায় কেন দিই নি আমার
সকল শূন্য করে।”

এবার ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের আবহে চিত্রকল্পটি স্মরণ করুন। এক সন্ততুল্য রাষ্ট্রনায়ক উন্নয়নের দিগ্বিজয়ের রথ নিয়ে বিশ্বজয় করে রাজ্যে রাজ্যে প্রবেশ করছেন। উন্নয়নহীন ‘বিশ্ববাংলা’-য় এসে ১০০ দিনের ভিক্ষা পাওয়া বাঙালি, চালের ভিক্ষার ঝুলি ভরানো বাঙালি, পরিযায়ী শ্রমক্লিষ্ট বাঙালি চালচোরেদের দ্বারে দ্বারে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। উন্নয়ন না করে বাংলার শাসক ভিখারী বানানোর তোড়জোড় করেছে। রাজ্যে শিক্ষা নেই, উন্নয়ন নেই, কর্মসংস্থান নেই, শিক্ষান্তে চাকরি নেই, শিল্প নেই, সংস্কৃতি নেই, ঘুষের দামে মেধার মূল্য নেই। বেকারি, বে-রোজগারের অন্ধ ভিখারিরা চারিদিকে গিজগিজ করে বেড়াচ্ছে। চোখে ‘জয় বাংলা’ হয়েছে মানুষের। আক্রান্ত চোখে সত্যকে দেখতে না পেয়ে ন্যাবা রোগ ধরেছে রাজ্যকে। ঘুষপেটি রোহিঙ্গার দল আগাছার মতো ঢুকেছে মালঞ্চে। কুসুমোদ্যানে অবৈধ অনুপ্রবেশে ছারখার বঙ্গভূমি। চারিদিকে ভয়ানক জতুগৃহ, ফতোয়ার ফন্দি। খাগড়াগড় বিস্ফোরণ, দেগঙ্গা, উস্থি, মন্দিরবাজার, কালিয়াচক, জুরানপুর, হাজিনগর, ধূলাগড়, অসংখ্য নাম। মা-বোনেদের লাঞ্ছনা। রাজ্যের মানুষ অজানার ভয়ে ভীত সন্ত্রস্ত। এমনই ভিক্ষালব্ধ ধনে প্রতিপালিত হতে বাধ্য হওয়া চারিদিকে ভিখারি-নাগরিক। বাংলার ভিখারি ভাবছে, ভর্তুকির স্বর্ণরৌপ্য মুঠো মুঠো ছড়িয়ে দেবেন গোল্ডেন চ্যারিওটের সেই দেবতা, নরেন্দ্র। ‘স্টিকার দিদি’ বাংলার নামে নিজের লেবেল বসিয়ে কাউকে কাউকে উপঢৌকন দেবেন। ভিখারি বিনা আয়েসে, খেলামেলার সরকারের দাক্ষিণ্য কুড়িয়ে নেবে বঙ্গভূমে বসেই।
কিন্তু না! সেই ঐশীরথ ভিখারির পাশে এসে থেমে গেল। সাধু নামলেন। বিশ্ববরেণ্য নেতার পদে আসীন তিনি। সাংগঠনিক শক্তির অপরূপ সৌকর্য, মনের সৌন্দর্য তাঁর মধ্যে। রাজভিখারী নরেন্দ্র এসে বাংলার বোধ হারানো, বিবেক হারানো, বিকিয়ে যাওয়া মনের কাছে ভিক্ষা চাইলেন। দেশ গড়ার ভিক্ষা, উন্নয়নের যজ্ঞ সংঘটিত করার ভিক্ষা। অন্যায় অবিচার দূর করার ভিক্ষা। অপশাসন দূর করার ভিক্ষা।

এটাই কী ভোট ভিক্ষা! যদি মনে করেন সমগ্র দেশের সঙ্গে বাংলাকেও রিকনস্ট্রাকশন করার ভিক্ষা, তবে তাই! যদি মনে করেন বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকা বাঙালি প্রজাতির দিল্লি যাত্রার শুল্ক, তবে তাই! অন্তরকে পুরোপুরি দান না করলে সোনার ভারত হবে না। সোনার বাংলাও হবে না। অন্তর উজার করে সবটুকু দিতে না পারলে দেশ সোনার হয় না। জয় বাংলার জীবাণুতে আক্রান্ত চোখ নিয়ে এই ভিক্ষার সংজ্ঞা-স্বরূপ-বৈশিষ্ট্য ধরতে পারবো না। বুঝতে পারবো না স্বর্ণবঙ্গ করে দেবার জন্যই আমার কাছে হাত পেতেছেন ভারত-সম্রাট। ২০২১-এ আমরা ভিক্ষা দিই নি। তার ফল আমরা হাতে গরম পেয়েছি। ক্ষণিকের দ্বিধায়, কুড়ি টাকার পাউচের নেশায়, ৫০০ টাকার ভিক্ষাশ্রীতে, ভোটপর্বের ডিম্ভাতে যদি আকুল হই, তবে ভুল হয়ে যাবে আমার জীবন, আমার পরবর্তী প্রজন্ম, আমার উত্তরাধিকার, আমার ঐতিহ্য, আমার লোকসংস্কৃতি।

তাই চাকরি চুরি, কয়লা চুরি, গরুচুরির রাজ্যে ২০২৪-এর লোকসভা ভোটে সমস্ত ভিক্ষাকণাগুলি অর্থাৎ আমাদের মতদানগুলি সোনা করে নেবার সুযোগ আমি হাতছাড়া করবো না। সরকার গড়তে দিল্লিগামী-শকটে আমার সাংসদ, আমার সামর্থ্য, আমার অন্তরাত্মা, আমার আকাঙ্খা, আমার শক্তি যোগদান করবে ভারত-নির্মাণে। আর এটাই হবে প্রকৃত ‘যোগদান মেলা’। রাজা নরেন্দ্র উন্নয়নের এক নাম।

কল্যাণ গৌতম।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.