প্রাচীন নববর্ষ

নতুন বছর , নববর্ষ …. দেশ কালের গন্ডি ছাড়িয়ে পৃথিবীর  প্রতিটি জাতি ,উপজাতি তাদের মত করে একটি নববর্ষ পালন করেন। সবাই চায় এই নববর্ষ হোক শুভ , মঙ্গল ময়। নববর্ষ পালন প্রথাটি বহু প্রাচীন।

ভাষার মধ্যে যতই প্রভেদ থাক,প্রভেদ থাক যতই পোশাক,সংস্কৃতি কিংবা ভূমিরূপে, ভারতবর্ষের শরীর দিয়ে সেই কোন যুগ যুগান্তের আদিম ভোর থেকে ঐক্যের যে অর্ন্তলীন স্রোত আবহমান কাল ধরে তার শিরা,তার ধমনীর মধ্যে দিয়ে বয়ে চলেছে তার শব্দ হয়তো শোনা যায় না,কিন্তু তার অন্তহীন গতিপথ ঠিক বোঝা যায় ভারতবর্ষের ধর্মীয় উৎসব গুলির উৎসমুখে এসে দাঁড়ালে।

 জানেন সমগ্র ভারতে কত রকমের নববর্ষ হয়? 

চৈত্র মাসের শুক্ল পক্ষের প্রথম দিন টা কাশ্মীরি পণ্ডিতরা নববর্ষ হিসেবে পালন করে “নভ্রেহ্” ।কাশ্মীরি পণ্ডিতরা মনে করেন কাশ্মীরি সপ্তর্ষি যুগ ৫০৭৯ বছর আগে এই চৈত্র মাসের শুক্ল পক্ষের প্রথম দিন থেকেই শুরু হয়।

সাজিবু চেইরোবা বা সাজিবু নোংমা পানমা হল মনিপুরের প্রাচীন নববর্ষ উৎসব।

 অসমে বিহু উৎসব হল নববর্ষ উৎসব। 

অহমিয়া প্রথায় প্রথম মাস হল ‘বোহাগ’।‘বোহাগ’ মাসের প্রথম দিনে এই উৎসব হয় বলে একে ‘বোহাগ বিহু’ বলে।

বঙ্গের “পয়লা বৈশাখ “

আমারা সবাই জানি। চরমতম শুভ ও মঙ্গলময় হয় এই দিনটি আপামর বঙ্গবাসীর নিকট। 

প্রাচীন বঙ্গের রাজা শশাঙ্কের শাসন কাল ছিল ৫৯০-৬২৫ খৃস্টাব্দ। এ সময় তিনি শকাব্দ অনুসরণে বঙ্গাব্দ বা বাংলা সনের প্রচলন করেন। এ সময় তিনি চৈত্র মাসের পরিবর্তে বৈশাখ মাসে নববর্ষ শুরু করেন এবং দিন ও মাসের নাম অপরিবর্তীত রাখেন। 

পশ্চিমবঙ্গ,  আসাম এবং বিহার পর্যন্ত তার বিশাল সাম্রাজ্য বিস্তৃত ছিল। জুলিয়ান ক্যালেন্ডার অনুসারে ১২ এপ্রিল ৫৯৪ খ্রিস্টাব্দ সোমবার এবং গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার অনুসারে ১৪ এপ্রিল ৫৯৪ খ্রিস্টাব্দ হতে তার এ বিশাল সাম্রাজ্যে বঙ্গাব্দ গণনা শুরু হয়।

এভাবে শকাব্দ ও হিন্দু বৈদিক যুগের লুনি-সোলার ক্যালেন্ডার অনুসরণে সৌরসিদ্ধান্তের ওপর ভিত্তি করে শশাঙ্কের রাজত্বকালে বঙ্গাব্দ প্রবর্তিত হওয়ায়, গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার অনুসারে মধ্য এপ্রিল মাসে বাংলা বঙ্গাব্দ শুরু হয়, যা অনেক হিন্দু সৌর ক্যালেন্ডার থেকে স্বতন্ত্র। মিথিলা, আসাম, বার্মা, কম্বোডিয়া, কেরালা, মণিপুর, নেপাল, উড়িষ্যা, শ্রীলংকা, তামিল  ও থাইল্যান্ডে বঙ্গাব্দের মতো একই সময়ে নববর্ষ উৎসব উদযাপিত হয়।

তবে মকর সংক্রান্তির পরের দিন বাংলার রাঢ় অঞ্চলে সমস্ত আদিবাসী সম্প্রদায়ের মধ্যে পালিত হয় নববর্ষ। 

মকর সংক্রান্তির পর দিন নানান অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে পালিত হচ্ছে ‘এখ্যান যাত্রা’। প্রাচীন রীতি মেনে আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষ বছরের এই বিশেষ দিনটিকে ‘নববর্ষ’ হিসেবে পালন করেন ।

আদিবাসীদের পাশাপাশি সাধারণ মানুষের কাছেও দিনটি খুবই পবিত্র। অনেকে বিশ্বাস করেন, এই দিনে কোন কাজ করলে শুরু করলে তা সফল হয়।
এছাড়াও একই সঙ্গে এই দিনে বিভিন্ন গ্রাম দেবতা বা ‘গেরাম সিনী’র পুজো হয়। মনে করা হয়, এই সব গ্রাম দেবতা একাধারে যেমন শস্যের দেবী তেমনি নানান বিপদ-আপদ থেকে গ্রামের মানুষকে রক্ষা করবেন এই সব দেবতারা, এমনটাই বিশ্বাস সাধারণ মানুষের।

একই সঙ্গে মকর সংক্রান্তির দিন থেকে বাঁকুড়ার বিভিন্ন অংশে শুরু হয় তিন দিনের আদিবাসী উত্‍সব। এই তিন দিন নিজেদের মতো করে পালন করেন এঁরা। দক্ষিণ বাঁকুড়ার বিভিন্ন গ্রামে আদিবাসী সমাজের তির নিক্ষেপ প্রতিযোগিতা শুরু হয়। যা এই এলাকায় ‘ভেজাবিধাঁ’ নামে পরিচিত।

ত্রিপুরায় আদিবাসীদের নিকট বৈসাবি ও গারোদের নিকট ওয়ানগালা নামে নববর্ষ পরিচিত।

ওড়িশার অধিবাসীদের নববর্ষ হল আবার ‘পানা সংক্রান্তি’। বেলের পানা পান করে শুভ বৎসরের সূচনা হয় মকর সংক্রান্তির দিন ওড়িশায়।

কর্ণাটক, অন্ধ্রপ্রদেশ ও তেলেঙ্গানা এই তিন দক্ষিণী রাজ্যে নববর্ষ উৎসবের নাম “উগাড়ি”। উগাড়ি কথাটা এসেছে যুগ আর আদি মিলিয়ে। যুগ + আদি – যুয়াদি , অপভ্রংশ হল উগাড়ি। চৈত্র শুক্লাড়িও বলে ।

তামিল নববর্ষ এর নাম “পুথান্ডু” ।তামিল প্রথার প্রথম মাস ‘চিথিরাই’ এর প্রথম দিনটি তামিলরা তাদের নববর্ষ হিসেবে পালন করে।একে “ভারুদা পিরাপ্পু” নামেও ডাকা হয়। এই দিনেই সেই বিখ্যাত তামিল আলপনা কোলাম দেওয়া হয় সব তামিল গৃহে।

কেরলে নববর্ষ কে “বিশু” বলে।মালয়লাম নিয়মে ‘মেদাম’ মাসের প্রথম দিন হয় বিশু।

চৈত্র মাসের দ্বিতীয় দিন সিন্ধ্রি সম্প্রদায় এর মানুষরা নববর্ষ  “চেট্টি চাঁদ” পালন করেন। এইদিন তাদের ইষ্টদেবতা ‘ঝুলেলাল’  এবং পৃথিবীর জীবন ধারনের অন্যতম উপাদান জল এর আরাধনা করা হয়।

গুজরাটি নিয়ম অনুসারে প্রথম মাস হল কার্তিক মাস। এই মাসের প্রথম দিন টি গুজরাটি নববর্ষ মনে যার নাম হল “বেস্তু বরস”..পার্সি সম্প্রদায় পালন করেন নওরোজ…

মাড়োয়াড়ি মত অনুসারে চৈত্র মাসের প্রথম দিন টা নববর্ষ।রাজস্থানে একে “থাপনা” বলে।

মহারাষ্ট্রে এবং গোয়ায় এই নববর্ষের নাম গুঢ়ি পড়বা।চৈত্র মাসের প্রথম দিনে এটি পালিত হয়।পড়বা কথাটা এসেছে সংস্কৃত প্রতিপদ থেকে। গুঢ়ি বা দণ্ড হল মরাঠি আচারের বৈশিষ্ট্য….

পাঞ্জাব এবং হরিয়ানাতে এপ্রিল মাসের ১৪ তারিখ নানাকসাহি মতে দ্বিতীয় মাসের প্রথম দিন,সেই দিনটিকে শিখরা তাদের নববর্ষ হিসেবে পালন করে….

নতুন বছর কে বরণ করে নেওয়ার মধ্যে দিয়ে আশার যে প্রদীপ জ্বালানো হয় তার প্রকারভেদ এক এক রাজ্যে হয়ত এক একেকরকম, কিন্তু দিনের শেষে একটা জায়গায় এসে আমরা সবাই এক হয়ে যাই. . . এক অকৃত্রিম বিশ্বাসে।এ প্রদীপ অনির্বাণ থাকুক বছরভর…

দুর্গেশনন্দিনী

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.