Story image

কোদালিয়ার বসুবাড়ির প্রতিমা

“আমরা মা-কে চাই কেন? তার কারণ এই যে, মা-কে বাদ দিয়ে কোনও পূজাই হয় না। আমাদের সমাজের ইতিহাসে যখনই বিপদ-আপদ জুটিয়াছে, তখনই মা-র আবাহন করিয়াছি। আমাদের অন্তরের যাহা কিছু পাইয়াছি, তাহা লইয়াই মাতৃমূর্তি রচনা করিয়াছি। …মানুষ জীবনে এমন একটি স্থান চায় যেখানে তর্ক থাকবে না—বিচার থাকবে না—বুদ্ধি বিবেচনা থাকবে না, থাকবে শুধু ‘ব্লাইন্ড ওরশিপ’। তাই বুঝি ‘মা’-র সৃষ্টি। ভগবান করুন যেন আমি চিরকাল এই ভাব নিয়ে মাতৃপূজা করে যেতে পারি…”

চিত্তরঞ্জন দাশের স্ত্রী বাসন্তী দেবীকে এই কথাগুলোই লিখেছিলেন একটি চিঠিতে লিখেছিলেন নেতাজি (Netaji)। দেবী দুর্গা তাঁর কাছে দেশমাতৃকা, প্রচণ্ড শক্তির আধার। তাঁর দেশভক্তির সঙ্গে সকলেই পরিচিত হলেও মাতৃভক্তির ব্যাপারে অনেকেই জানেন না।

দুর্গাপুজোকে আসলে তিনি কীভাবে দেখতেন তার আন্দাজ পাওয়া যায় ‘ভারত পথিক’-এ। যে বইয়ে তিনি লিখেছিলেন কীভাবে দেশি পুজো পার্বণের মধ্যে দিয়ে দলকে গড়ে তোলার এক পরীক্ষায় নেমেছিলেন। আমাদের পুজো-পার্বণ চিরকালই গোটা সমাজের উৎসব এবং তা কীরকম দেখতে লাগে তার একটা রূপরেখা পাওয়ার জন্য কোদালিয়ায় তাঁর পৈতৃক ভিটেতে দুর্গাপুজো দেখার অনুরোধ জানান। সেই সময় মানুষকে স্বদেশি চেতনায় উদ্বুদ্ধ করতে এর চেয়ে ভালো আর কী হতে পারতো!

দক্ষিণ শহরতলির সোনারপুর (Sonarpur) স্টেশনের পরবর্তী স্টেশন সুভাষগ্রাম (Subhasgram)। সেখান থেকে রিকশা, অটো করে দু কিলোমিটার পথ গেলেই কোদালিয়া (Kodalia), সুভাষচন্দ্রের পৈতৃক ভিটে। হরনাথ লজ (Haranath Lodge)। দুই শতাব্দী পার করে আজও অমলিন কোদালিয়ার এই বাড়ির শারদোৎসব। ইতিহাসের গন্ধ আর বিপ্লবীদের বীরগাথা গায়ে মেখে বসু পরিবারের ভিটেতে প্রচলিত দুর্গাপুজোর ঘ্রাণ নিতে তাই ভিড় জমান ভিনদেশের বাসিন্দারাও। এলাকার মানুষ সোনারপুর কোদালিয়ার বসু পরিবারের এই পুজোকে প্রাচীন পুজো বলে জানেন।

মাহিনগর ছেড়ে ১৭০৭ সাল থেকে বসু পরিবার কোদালিয়ায় বসবাস শুরু করে। ১৮২০ সালে প্রথম বার দুর্গাপুজোর আয়োজন করা হয় বসুবাড়িতে। গৃহকর্তা যাদবচন্দ্র বসুর স্বামীহারা বোনের অনুরোধেই পারিবারিক এই পুজোর সূত্রপাত। বংশানুক্রমে সেই পুজোর দায়িত্বভার গ্রহণ করেন উত্তরসূরি জানকীনাথ বসু। জানা যায়, নেতাজি পারিবারিক এই পুজোয় অংশ নিয়েছিলেন মাত্র তিন বার— ১৯২৮, ১৯৩৭ ও ১৯৩৯ সালে। বেশ কয়েক বছর পুজোর আয়োজন করেন গোবিন্দ চৌধুরী— তিনি বিবাহসূত্রে বসু পরিবারের মেয়ের বংশধর।

পুরোনো ভিটে

সাবেকি একচালা মাতৃমূর্তির কাঠের মাচার বয়স দু’শো বছর। প্রথা মেনে ওই কাঠামোতেই তৈরি হয় প্রতি বছরের প্রতিমা। প্রথম দিকে পাঁঠা বলি দেওয়া হলেও, অনেক বছর হল তা বন্ধ হয়ে গিয়েছে। জানকীনাথের বাবা হরনাথ বৈষ্ণব ধর্মে দীক্ষিত হওয়ার পর থেকেই পশুবলির জায়গায় শসা, আখ ও ছাঁচিকুমড়ো বলি হয়।

বসু পরিবারের যারা শরিক বেঁচে রয়েছেন তাঁদের বেশিরভাগ হয় কলকাতায় কিংবা বিদেশে থাকেন। তবে সবাই চেষ্টা করেন অষ্টমীর দিন কোদালিয়ায় নেতাজির পৈতৃক ভবনে একত্রিত হয়ে সন্ধি পূজায় অংশগ্রহণ করার। এই ঠাকুরদালানেও নেতাজি তাঁর জীবনের বেশ কিছুটা মূল্যবান সময় কাটিয়েছেন বলে জানা যায়। প্রতি বছরের মতো মাতৃ আরাধনা হবে এবছরও।

২০২১ সালে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর ১২৫তম জন্মদিনের প্রাক্কালে নতুন ভাবে সেজে ওঠে নেতাজির পৈতৃক ভিটে। বসুবাড়ির হেরিটেজ অক্ষুণ্ণ রেখেই নেতাজির পৈতৃক বাসভবনকে সাজিয়ে তোলা হয়েছে। নেতাজির ১২৫ তম জন্মদিনেই সুভাষগ্রামের কোদালিয়ার এই বাসভবনকে দেখতে পাওয়ার সুযোগ পান দর্শনার্থীরা। নেতাজির স্মৃতি বিজড়িত সংগ্রহশালাও দেখতে পাবেন সাধারণ মানুষ। তবে, কোভিড বিধি মেনে, মুখে মাস্ক পরে নির্দিষ্ট সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে এক সঙ্গে ৫ জন সংগ্রহশালায় প্রবেশ করতে পারবেন।

২০১৯ সালের দুর্গাপুজোয় হরনাথ লজ

২০১৫ সাল থেকে ২০১৯ পর্যন্ত চলে এই সংস্কারের কাজ। ৯০% কাজ শেষ হলেও ২০২০ সালে কোভিডের জন্য বাকি কাজ শেষ করা যায়নি। বসু পরিবারের সম্মতি নিয়েই জানকীনাথ বসু বাড়িটিকে যে ভাবে তৈরি করেছিলেন ঠিক সেই আদল বজায় রেখেই সংস্কারের কাজ করা হয়েছে। সেই কড়ি-বড়গা, কাঠের জানলা, টালির চাল, ইট বিছানো পথ সব কিছুই নিপুণ ভাবে করা হয়েছে। বাড়ির একটি বা দু’টি ঘরে পর্যটকদের জন্য অতিথি নিবাস করার পরিকল্পনা করেছিল সরকার। কিন্তু কোভিডের জন্য সেই কাজ স্থগিত রয়েছে বলে জানান নেতাজি কৃষ্টি সংসদের সম্পাদক তথা রাজপুর-সোনারপুর পুরসভার প্রশাসক পল্লব দাস।

প্রসঙ্গত, শতবর্ষ উত্তীর্ণ বাগবাজার সর্বজনীন দুর্গোৎসবের সঙ্গে তাবড় তাবড় ব্যক্তিত্বের নাম জড়িয়ে রয়েছে। এই পুজো-প্রতিষ্ঠানের সভাপতি তালিকা অবাক করার মতো। যে সভাপতির নাম সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ভাবে জড়িয়ে রয়েছে, তিনি সুভাষচন্দ্র বসু। ১৯৩৮-৩৯ সাল পর্যন্ত তিনি বাগবাজার সর্বজনীনের সভাপতির পদে ছিলেন। ১৯৩৮-এর প্রদর্শনীতে সার্টিফিকেট অব মেরিট পেয়েছিল ‘ক্যালকাটা কলাপসিবল গেট কোম্পানি লিমিটেড’, সুভাষচন্দ্রের সই-করা সেই শংসাপত্রের কপি সযত্নে রাখা আছে পুজোকর্তাদের কাছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.