নেতাজীর মৃত্যু প্রচারে চক্রান্তকারীদের নির্লজ্জ প্রয়াস

বিমান দুর্ঘটনায় নেতাজী সুভাষচন্দ্র মৃত এই সম্পূর্ণ মিথ্যাকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য কিছু রাজনৈতিক দল ও ব্যক্তি এখনও প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ২৮ অক্টোবর ২০১৮ তারিখে কলকাতার একটি বহুল প্রচারিত বাংলা দৈনিক পত্রিকায় ‘এবার ফিরিয়ে আনা হােক চিতাভস্ম’ এই শিরােনামে একটি অতি আজগুলি প্রতিবেদনে নেতাজীর ওই দুর্ঘটনায় মৃত্যুর এক অবাস্তব জঘন্য ঘটনাকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য এক অতি সুন্দর নাট্যরূপের বর্ণনায় উপস্থাপিত করা হয়েছে। যার মূল বিষয়বস্তু জাপানের রেনকোজি মন্দিরে রক্ষিত চিতাভস্ম তথাকথিত নেতাজীর এবং সেটা ভারতে আনা হােক। অত্যন্ত পরিতাপের এবং আশ্চর্যর বিষয় যে, সম্প্রতি এক প্রশ্নের উত্তরে সরকারি আর টি আই আধিকারিক নাকি জানিয়েছেন যে ওই চিতাভস্ম নেতাজীর দেহাবশেষ এবং হয়তাে তারই নিরিখে ওই অসাধারণ নাটকীয় মিথ্যা প্রতিবেদনের সৃষ্টি।

১৯৭৮ সালে তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী মােরারজী দেশাই, শাহনওয়াজ কমিটি ও খােসলা কমিশনের নেতাজীর বিমান দুর্ঘটনায় মৃত্যুর রিপাের্ট বিশ্বাস করেননি। তিনি খােলাখুলি ও সুস্পষ্ট ভাষায় ২৮ আগস্ট ১৯৭৮ সালে জানিয়েছিলেন— ‘বিভিন্ন নথিপত্র এবং সাক্ষীদের বয়ানে সন্দেহাতীত ভাবে তার মৃত্যু প্রমাণিত হয়নি এবং সেই কারণে ওই সিদ্ধান্ত সরকারি ভাবে গ্রহণ করা যায় না।’

বিষয়টি কিন্তু এখানেই থেমে থাকেনি। প্রধানমন্ত্রী দেশাইয়ের পর তদানীন্তন কেন্দ্রীয় কংগ্রেস সরকার ‘নরসীমা রাও-প্রণব মুখার্জীর’ সময় নেতাজীর জন্মশতবর্ষে সুভাষচন্দ্রকে ‘মরণােত্তর ভারতরত্ন’ উপাধিতে ভূষিত করার সরকারি আদেশনামা প্রকাশিত হয়েছিল। এ এক অতি সুন্দর কূটনৈতিক কৌশল। একই সঙ্গে নেতাজীর মৃত্যু প্রমাণ করা আর অপরদিকে জনসাধারণের সম্মুখে কেন্দ্রীয় সরকারের নেতাজী সম্বন্ধে এক উচ্চ ভাবমূর্তি তুলে ধরা। কিন্তু কী হলাে শেষ পর্যন্ত? কিছু নেতাজী অনুগামী কলকাতা হাইকোর্টের Writ Petition case No. 834 of 1995 জানতে চাইলেন নেতাজীর মৃত্যু সম্বন্ধে সরকারের কাছে কী তথ্য আছে এবং ভারতরত্নের নির্ধারিত বৈশিষ্ট্য কী? কেন্দ্রীয় সরকার পড়ল বিপাকে। তারা তাদের সুবিধার্থে কেসটি সুপ্রিম কোর্টে স্থানান্তরিত করল। সরকার আশা করেছিল কলকাতার আবেদনকারীরা আর্থিক দিক থেকে দুর্বল এবং বার বার সুপ্রিম কোর্টে হাজিরা দিতে না পারায় পিছিয়ে যাবে। কিন্তু প্রখ্যাত আইনজ্ঞ ফলি এস নরিম্যান ও শ্রীকৃষ্ণ মণি বিনা পারিশ্রমিককে আবেদনকারীদের পক্ষে সওয়াল করতে থাকেন। প্রমাণ অভাবে বিমান দুর্ঘটনায় নেতাজীর মৃত্যু ঘােষণার সরকারি চক্রান্ত ব্যর্থ হলাে। রাষ্ট্রপতি ভবনের ‘মরণােত্তর ভারতরত্ন’ আদেশনামা বাতিল হলাে।

এরপর একটি জনস্বার্থ মামলায় কলকাতা হাইকোর্ট এনডিএ সরকারকে নেতাজীর তথাকথিত অন্তর্ধান সম্বন্ধে অনুসন্ধান কমিটি গঠনের আদেশ দেন। সেই নির্দেশ মতাে সুপ্রিম কোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি শ্রীমনােজ কুমার মুখার্জীর নেতৃত্বে একটি তদন্ত কমিশন গঠন হয় ১৯৯৯ সালে। অনুসন্ধানের উদ্দেশ্যে কমিশন ছয় বছর নিরলস গবেষণা চালিয়েছিল। সদস্যরা সফর করেছিলেন জাপান-রাশিয়া-ইংল্যান্ড প্রভৃতি স্থানে। এই প্রসঙ্গে তাঁরা ১৩১ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ করেন এবং ৩০০টি গুরুত্বপূর্ণ নথি দাখিল করেন। কমিশনে নেতাজী গবেষক অনুজ ধর এক অকাট্য দলিল পেশ করেন। তাতে দেখা যায় জাপান সরকার লিখিত ভাবে জানাচ্ছে ওইদিন তাইহােকুতে কোনাে বিমান দুর্ঘটনা ঘটেনি এবং এই তথ্য তাইওয়ান সরকার ভারত সরকারকে জানিয়ে দিয়েছিল ১৯৫৪ সালে। (কমিশনের পরে প্রাপ্ত অপর একটি প্রামাণ্য দলিল ২৫.১১.১১ তারিখের লােকসভার ডাইরেক্টর শ্রীমতী কল্পনা শর্মার পত্র। তিনি নেতাজী গবেষক রুদ্ৰজ্যোতি ভট্টাচার্যের ২০.১০.১১ তারিখের পত্রের উত্তরে লিখছেন—“কোনও বিমান দুর্ঘটনাতে নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর মৃত্যু হয়নি। ভারত সরকারের কাছে নেতাজীর মৃত্যুর কোনও প্রমাণ নেই।’) বিচারপতি মনােজ মুখার্জী এই গুরুত্বপূর্ণ তথ্যসমৃদ্ধ বিস্তারিত রিপাের্ট ভারত সরকারের কাছে পেশ করলেন ২০০৫ সালের ৮ নভেম্বর। তিনি জানালেন ১৮ আগস্ট ১৯৪৫ সালে বিমান দুর্ঘটনায় নেতাজীর মৃত্যু হয়নি এবং ওই চিতাভস্ম নেতাজীর নয়। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, ভারত সরকার ২০০৬ সালের ১৮ মে পার্লামেন্টে ওই রিপাের্ট অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত এক বিবৃতির মাধ্যমে বাতিল করে দিল।

তথাকথিত বিমান দুর্ঘটনায় নেতাজীর মৃত্যুর প্রামাণ্য সংবাদ ও তথ্যর বিবরণ প্রচারিত হয়েছে। মূলত নেতাজীর সঙ্গে একই বিমানের সহযাত্রী কর্নেল হবিবুর রহমানের বিবৃতি উদ্ধৃতি করে। এই কর্নেল রহমান ছিলেন নেতাজীর একান্ত বিশ্বস্ত সেনানী। বিমান দুর্ঘটনায় মৃত্যুসংবাদ প্রচারের মাধ্যমে নেতাজীর অন্তর্ধানের পরিকল্পনার অন্যতম রূপকার ছিলেন তিনি। নেতাজীর শেষ আদেশ ও মন্ত্রগুপ্তির শপথ অনুসারে ব্রিটিশ-মার্কিন গােয়েন্দাদের বিভ্রান্ত করার জন্য বিভিন্ন ভাবে তিনি এই দুর্ঘটনার গল্পের অভিনয় করে গেছেন অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে। নেহরু পদ ও অর্থ দিয়ে নেতাজীর এই বিশ্বস্ত মানুষটিকে কিনতে পারেননি। ভারত ছাড়তে তাকে প্রায় বাধ্য করা হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত তিনি বাধ্য হয়ে পাকিস্তানের নাগরিকত্ব নেন। সেখানে তিনি ১৯৫৩ সালে সাংবাদিক সম্মেলন করে এই মিথ্যা বিমান দুর্ঘটনার কথা প্রকাশ করে গেছেন।

বেদ মোহন ঘোষ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.