দেশের স্বাধীনতার ৭৫ বছর বা তাঁর জীবনের ১২৫ বছরে সুভাষচন্দ্র বসুর ছায়া যথেষ্ট দীর্ঘ বইমেলা জুড়ে। কিন্তু তা বলে এমন জায়গায় তাঁকে দেখা যাবে, তা সম্ভবত কেউই কল্পনা করেননি।
বিশ্ব হিন্দু পরিষদের স্টলের গায়ে সঙ্ঘ পরিবারের অন্যতম প্রাণপুরুষ গোলওয়ালকর, হেডগেওয়ারের পাশেই রয়েছেন সুভাষচন্দ্র। সুভাষের অন্য পাশে শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়।
যাঁরা এ নিয়ে নেতাজীকে আপাদমস্তক সেকুলার প্রমাণিত করতে চান তাঁরা কি নেতাজীর আধ্যাত্মিক দিকটি কোনো দিন অধ্যয়ন করেছেন?
“দেখ মা, ভারতে যাহা চাও সবই আছে– প্রচণ্ড গ্রীষ্ম, দারুণ শীত, ভীষণ বৃষ্টি আবার মনোহর শরৎ ও বসন্তকাল, সবই আছে। দাক্ষিণাত্যে দেখি– স্বচ্ছসলিলা, পুণ্যতোয়া গোদাবরী দুই কূল ভরিয়া তর তর কল কল শব্দে নিরন্তর সাগরাভিমুখে চলিয়াছে– কী পবিত্র নদী! দেখিবামাত্র বা ভাবিবামাত্র রামায়ণে পঞ্চবটীর কথা মনে পড়ে, তখন মানসনেত্রে দেখি সেই তিনজন– রাম লক্ষ্মণ ও সীতা, সমস্ত রাজ্য ও সম্পদ ত্যাগ করিয়া, সুখে, মহাসুখে, স্বর্গীয় সুখের সহিত গোদাবরীতীরে কালহরণ করিতেছেন–আর এদিকে আমরা সাংসারিক দুঃখানলে নিরন্তর পুড়িতেছি।… দেখি, পুণ্যসলিলা জাহ্নবী সলিলভার বহন করিয়া চলিয়াছে– আবার রামায়ণের একটি দৃশ্য মনে পড়ে। তখন দেখি বাল্মীকির সেই পবিত্র তপোবন– দিবারাত্র মহর্ষির পবিত্র কণ্ঠোদ্ভূত পূত বেদমন্ত্রে শব্দায়িত– দেখি বৃদ্ধ মহর্ষি অজিনাসনে বসিয়া আছেন– তাঁহার পদতলে দুইটি শিষ্য– কুশ ও লব– মহর্ষি তাহাদিগকে শিক্ষা দিতেছেন। পবিত্র বেদধ্বনিতে আকৃষ্ট হইয়া ক্রূর সর্পও নিজের বিষ হারাইয়া, ফণা তুলিয়া নীরবে মন্ত্রপাঠ শুনিতেছে… রামায়ণে সমস্তই পবিত্র– সামান্য তৃণের বর্ণনা পর্য্যন্তও পবিত্র, কিন্তু হায়! সেই পবিত্রতা আমরা ধর্ম্মত্যাগী বলিয়া আর এখন বুঝিতে পারি না।”
পৃ: ১৬-১৭। পত্রাবলী (১৯১২-৩২), সুভাষচন্দ্র বসু। নেতাজী রিসার্চ ব্যুরো, এম সি সরকার অ্যাণ্ড সনস প্রাইভেট লিমিটেড।
দোষটা আপনাদের নয়। আসলে এই ধরনের তথ্যগুলি এতদিন মানুষের কাছে তুলে ধরা হয়নি। সেই ইতিহাসই জানতে দেওয়া হয়েছে, যে ইতিহাস জানিয়ে কোনো রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় থাকতে পারে বছরের পর বছর।
তৎকালীন হিন্দু মহাসভা হিন্দু যুবকদের দৈহিক ও মানসিক উন্নতির প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে হিন্দু যুবকদের সৈন্যদল গঠন করেন পরাধীন ভারতে। প্রচুর যুবক এই সেনাবাহিনীতে যোগ দেয়। হিন্দু যুবকদের এই মিলিটারাইজেশন পদ্ধতি ভালোমতো প্রসার লাভ করেছিলো সারা ভারতে। এদের অস্ত্রশিক্ষাও দেওয়া হতো। এর ফলে সৈন্যদল একটা সময়ে এসে ইংরেজদেরও চক্ষুশূল হয়ে উঠেছিলো।
এই সৈন্যদলকে বিভিন্ন বিভাগেও ভাগ করা হয়েছিলো, যেমন “রাম সেনা”, “বাল সেনা” ইত্যাদি। বাল সেনার পোশাকের সাথে RSS এর পোশাকের মিল লক্ষ্য করার মত।
১৯৪৪ সালের ২৫ এ জুন রাত্রে সিঙ্গাপুর থেকে একটি বেতারবার্তায় নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু এবং রাসবিহারী বসু সাভারকরের এই পদক্ষেপের ভূয়সী প্রশংসা করেন, এবং ইচ্ছাপ্রকাশ করেন যে তিনি এই হিন্দু যুবকদের সেনাবাহিনী থেকে সৈন্য নিয়ে তাঁর ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মি বা আজাদ হিন্দ ফৌজে সংযোজন করবেন।
নীচের লিঙ্কে পশ্চিমবঙ্গের অগ্রগণ্য ঐতিহাসিকদের অন্যতম নিখিলেশ গুহর উক্ত বিষয় সম্পর্কে বিস্তারিত বক্তব্য বিশেষ আলোকপাত করছে।
নিখিলেশ গুহ (Nikhilesh Guha):
কল্যানী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ড. নিখিলেশ গুহ বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গের অগ্রগণ্য ঐতিহাসিকদের অন্যতম। আধুনিক ভারতের বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাঁর কৌতুহল প্রসারিত। ইংরেজিতে রামমোহনের সমগ্ৰ ব্রহ্মসঙ্গীতের অনুবাদ একমাত্র তিনিই যেমন করেছেন সেরকম ঠাকুরবাড়ির “লক্ষ্মীবাঈ” গ্ৰন্থে কিশোর রবীন্দ্রনাথের মনে সভার মহাবিদ্রোহ কিরকম ছাপ ফেলে গিয়েছিল তা-ও তাঁর গবেষণার মাধ্যমে আমরা জানতে পেরেছি। বিভিন্ন জায়গায়, বিক্ষিপ্ত জাতীয়তাবাদী মারাঠী স্বদেশপ্রেমিক সখারাম গণেশ দেউস্করের বাংলা রচনা এবং আচার্য যদুনাথ সরকারের ঐতিহাসিক প্রবন্ধগুলি তাঁরই প্রযত্নে ও সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়েছে। ইংরেজি ভাষায় তাঁর গ্ৰন্থ “Shyamaprasad Mukharjee in the eyes of his content poravies” একটি উল্লেখযোগ্য প্রকাশনা হিসাবে সম্বর্ধিত হয়েছে। তাঁর সম্পাদনায় এপ্রিল ২০২২-এ ইমপ্রিন্ট প্রকাশন সংস্থা থেকে প্রকাশিত হতে চলেছে ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দোপাধ্যায়ের অধুনা বিস্মৃত গ্ৰন্থ ‘শিবাজী মহারাজ’ ।