তিব্বতে যখন চীনের সেনা অভিযান চলছে, সেই সময় পন্ডিতজি ব্যস্ত থাকেন চীন আর যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্কের উন্নতির প্রয়াসে। মাঞ্চুরিয়ায় মার্কিন যুদ্ধবিমানের আনাগোনার প্রসঙ্গ তুললেন দিল্লির মার্কিন রাষ্ট্রদূত এলিনর রুজভেল্টের কাছে। পানিক্করকে চৌ এন লাইএর কাছে তাঁর উদ্বিগ্নতা জানাতে বললেন। চৌ এন লাই এই ব্যাপারে পানিক্করের সঙ্গে কথা বলতে আগ্রহী হলেও তিব্বত প্রসঙ্গে ভারতীয় স্বার্থের সাধারণ সমস্যা নিয়ে আলোচনা করার ব্যাপারে রইলেন আশ্চর্যজনক ভাবে নীরব।
আসলে চীন সেই সময় তিব্বতে নিজেদের অবস্থান ক্রমশ আরো শক্তিশালী করে তুলছিল। পন্ডিতজী অবশ্য বিবৃতি দেন ” তিব্বতে চীনের সেনা সমাবেশ খুব অল্প সময়ের জন্য হয়েছিল। তাঁরা সমস্যার অনুপুঙ্খ আলোচনা করেন নি। চৌ এন লাইএর অভিযোগ চীন কে দোষী সাব্যস্ত করে না “।
১৯৫২ র ৫ই এপ্রিল চৌ এন লাইন পানিক্কর কে তিব্বতে চীনা বাহিনীর জন্য ভারতকে ” নিত্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী ” পাঠাতে অনুরোধ করেন। মে মাসে নেহরু ৫০০ টন খাদ্যশস্য পাঠাতে রাজী হন। নেহেরুর বিবৃতি অনুসারে “স্থায়ী অথবা আংশিক স্থায়ী ব্যবস্থাদি চীনে আমাদের স্বার্থ প্রতিষ্ঠার অংশ হিসেবে আলোচিত হতে পারে।”
অবশ্য ১৯৫৩ সালের এপ্রিলে চীনে ভারতের নতুন রাষ্ট্রদূত এন রাঘবন এক প্রতিবেদনে জানান ভারতীয় স্বার্থের ব্যাপারে চীনের মনোভাব “এখনও পর্যন্ত শীতল। ” আসলে চীন অপেক্ষা করছিল উপযুক্ত সময়ের জন্য যা তার পক্ষে একান্ত লাভজনক ছিল। ১৯৫৩ সালের ডিসেম্বরে, কোরিয়া সংকট নিরসনের পর চীন ভারতের সঙ্গে সমঝোতা করতে রাজী হয়। যার ফল হল পঞ্চশীল চুক্তি।
প্রেমিকার থেকে সামান্যতম ইঙ্গিত পেলে যেমন প্রেমিকের প্রেমোচ্ছাস বাঁধভাঙা জলোচ্ছ্বাসের আকার ধারণ করে, পরবর্তীতে নেহেরুর চীন প্রীতির ক্ষেত্রে ঠিক সেই উদাহরণ দেওয়া যায়। নেহেরু তিব্বতে চীনা সেনার উদ্দেশ্যে শুধু খাদ্যশস্য নয়, পেট্রোল, ডিজেল ইত্যাদি সামগ্রী পাঠানোর অনুমতি দেন। এই প্রেমোচ্ছাসের ফল কি হয়েছিল আমরা দেখব, কিন্তু তার আগে পঞ্চশীল চুক্তি টি কি একবার দেখা যাক।
কোরিয়া সংকটের অবসানের মুখে চীন ভারতের সঙ্গে চুক্তি করতে রাজী হয়, যদিও তা এক দিনে হয়নি। আলোচনা শুরু হয় ১৯৫৩ সালের ২৩ ডিসেম্বর এবং শেষ হয় ১৯৫৪ সালের ২৯শে এপ্রিল।
এই পঞ্চশীল চুক্তি অনুযায়ী –
১) ভারত ও চীন – দুই দেশ পরস্পরের স্বাধীনতা ও অখন্ডতা স্বীকার করবে।
২) একে অন্যের প্রতি কোন সামরিক অভিযান থেকে বিরত থাকবে।
৩) একে অন্যের আভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করবে না।
৪) একে অন্যের ক্ষতি করবে না।
৫) দুই দেশ শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান করবে।
নেহেরু প্রস্তাব দিয়েছিলেন যে চুক্তির মেয়াদ হোক পঁচিশ বছর, কিন্তু চীন পাঁচ বছরের বেশী মেয়াদ বাড়াতে রাজী ছিল না। অত্যন্ত পীড়াপীড়িতে চীন পাঁচ বছরের জায়গায় আট বছরে রাজী হয়। এই চুক্তিটি হওয়ার পর ব্রিটেন ১৯০৪ সালে চীনের থেকে সীমা বহির্ভূত যেসব সুযোগ সুবিধা আদায় করে নিয়েছিল তা ভারত ছেড়ে দেয়। তিব্বতে ভারত সরকার নিয়ন্ত্রিত যেসব ডাক ব্যবস্থা, তার ব্যবস্থা, টেলিফোন এবং গেস্ট হাউজের সুবিধা ছিল ভারত তা বিনামূল্যে দিয়ে দেয়, যদিও চীন তার ন্যায্য মূল্য দিতে রাজী ছিল। নেহেরুর বক্তব্য অনুযায়ী এর ফলে ভারত ও চীনের মধ্যে যে সম্পর্কের ভিত তৈরি হবে, তার দাম অনেক বেশি।
কিন্তু চুক্তির একমাস যেতে না যেতেই চীন বদ্রীনাথের উত্তর পূর্বে বারাহোতি নামে এক জায়গা নিজেদের অধিকৃত বলে দাবি করে বসল।
চুক্তি সই করার দুই মাস পর নেহেরুর আমন্ত্রণে চৌ এন লাই তিন দিনের ভারত সফরে আসেন। এই সময় চৌ এন লাইএর সঙ্গে নেহেরুর এক দীর্ঘ বৈঠক হয়। চৌ এন লাই পশ্চিম এশীয় দেশগুলো, এমনকি শ্রীলঙ্কা, ইন্দোনেশিয়া প্রভৃতি দেশের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করার জন্য নেহেরুর সাহায্য প্রার্থনা করেন। এবং নেহেরুকে অক্টোবরে চীন সফরের আমন্ত্রণ জানিয়ে যান। নেহেরুর উদ্যোগে এশিয়া আর আফ্রিকার ২৯টি দেশের সম্মেলন ঠিক হয় ইন্দোনেশিয়ার জাভার বান্দুং শহরে। যদিও পাকিস্তান আর শ্রীলঙ্কা চীনকে আমন্ত্রণের বিরোধী ছিল, কিন্তু এই বান্দুং সম্মেলনে প্রথম পাকিস্তান এবং চীন, একে অন্যের সন্নিকটে আসে এবং উভয়ের মধ্যে এক নতুন সম্পর্কের সূচনা হয়, যার দাম ভারতকে এখনও দিয়ে যেতে হচ্ছে।
পিকিং সফরে দশ লক্ষ মানুষ নেহেরুকে রাস্তার দুধারে দাঁড়িয়ে অভ্যর্থনা জানিয়েছিল। মাও সে তুং আর তাঁর সহযোগী, যেমন চু তে, লিউ শাও চি, চৌ এন লাই, সুং চিং লিং দের সঙ্গে দুই দেশের অর্থনৈতিক উন্নতি, ভূমি সমস্যা, বন্যা নিবারণ, পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা হয়। কিন্তু চীনে প্রকাশিত কিছু মানচিত্রে নেহেরু দেখেন নেপাল, ভূটান, অসমের বেশ কিছু অংশ ( অরুণাচল প্রদেশ) , লাদাখ এইগুলো চীনের অধিকারভুক্ত। নেহেরুকে এই বলে চুপ করানো হয় যে ম্যাপগুলো পুরোনো। চীন সরকার এখনো এইসব খুঁটিয়ে দেখার সময় পায়নি।
১৯৫৫ র গ্রীষ্মে চীন আবার বর্তমান উত্তরাখন্ডের উত্তরে বারাহোতি আর নীতি গিরিপথ আর হিমাচলের শিপকিলা গিরিপথে হানা দেয়। যদিও এইসব তুচ্ছ ব্যাপার নেহেরুর বান্দুং সম্মেলনে অংশগ্রহণ এবং চু এন লাইএর সঙ্গে দাদাগিরি দেখানোর ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি করতে পারেনি।
ক্রমশঃ