৬০ র দশকে ভারত-চীন দ্বন্দ্ব, নেহেরুর বকচ্ছপ নীতিসমূহের সুবিশাল পতন এক যুগান্তকারী প্রভাব বিস্তার করেছিল যা আজও ভারতবর্ষের রাজনৈতিক-সামাজিক সত্তা তথা কাঠামোয় যথেষ্ট ক্রিয়াশীল রয়েছে। যাঁরা ইতিহাসকে এক পুরানো, বাতিল ইতিবৃত্ত রূপে আখ্যায়িত করেন তাঁরা এক অতিশয় গন্ডমুর্খ – সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই, থাকা উচিতও নয়। একটি ঘটনা সৃষ্টি করে আর একটি; সেটি আর একটি – এই ভাবেই ইতিহাস এগিয়ে চলে।

একজন বাস্তব জ্ঞানহীন ব্যক্তিকে যদি রাষ্ট্রনায়ক করা হয়, তাহলে সেই রাষ্ট্রকে বছরের পর বছর ধরে সেই ভুলের মাসুল গুণতে হয়। যেমনটা ভারত করে চলেছে।  নেহেরুর ভুলের মাসুল আরো কত প্রজন্ম ধরে আমাদের দিতে হবে জানা নেই।

চীনের কুয়োমিনতাং আমলের শেষ রাষ্ট্রদূত ছিলেন পানিক্কর, এবং তিনিই কমিউনিস্ট চীনে ভারতের প্রথম রাষ্ট্রদূত। পানিক্করের কমিউনিস্ট প্রেম এবং কমিউনিস্ট চীনের প্রতি সমর্থন সুবিদিত ছিল, কমিউনিস্ট চীন সম্পর্কে নেহেরুর কাছে তাঁর পাঠানো রিপোর্ট বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই নিরপেক্ষ হতো না। কিন্তু বলা বাহুল্য নেহেরু এই অভিযোগকে পাত্তা দেওয়ার প্রয়োজন মনে করতেন না।

পানিক্করের প্রতি সর্দার প্যাটেল অবশ্য নেহেরুর মত অন্ধ ছিলেন না। মৃত্যুর পাঁচ সপ্তাহ আগে প্যাটেল নেহেরুকে চীনের তিব্বত নীতি নিয়ে একটি চিঠি লেখেন। পানিক্করের ভারতের হয়ে চীন সরকারের কাছে বিনা কারণে হাত কচলানো সর্দারকে যথেষ্ট বিরক্ত করেছিল। তিব্বতে ইঙ্গ-মার্কিন চক্রান্তে চীনের ক্ষতি হতে পারে, সেটা কোন সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষের বক্তব্য হতে পারে না। ভারত রাষ্ট্রসঙ্ঘে চীনের ন্যায়সঙ্গত দাবির পক্ষে প্রচেষ্টা করছে।  কিন্তু চীন তবুও ভারতকে সন্দেহ করছে এবং তিব্বতে চীনা বাহিনীর প্রবেশের বিরুদ্ধে ভারতের প্রতিবাদকে উড়িয়ে দিয়েছে – তা কোন বন্ধুর ভাষা নয়, তা শত্রুর।

ভবিষ্যৎদ্রষ্টা প্যাটেল আরো লেখেন, কমিউনিজম সাম্রাজ্যবাদের প্রতিষেধক নয়, বরং সাম্যবাদের মোড়কে এক নব সাম্রাজ্যবাদ। উত্তর এবং উত্তরপূর্বে একটি  নতুন বিপদাশঙ্কা শুরু হয়েছে; চীন শুধু তিব্বত গ্রাস করেই থেমে থাকবে না, তার নজর সিকিম, দার্জিলিং এবং অসমের উপজাতি এলাকা (বর্তমান অরুণাচল প্রদেশ)। এসব জায়গায় যোগাযোগ দুর্বল, অবিচ্ছিন্ন প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা নেই, পুলিশি ব্যবস্থা উপযুক্ত নয়, আর অনুপ্রবেশের অবাধ সুযোগ।

প্যাটেল আরও একটি আশঙ্কার কথা উল্লেখ করে বলেন যে তিব্বত দখল করার ফলে চীনের সীমানা অনেক কাছে চলে এসেছে, যার ফলে সুবিধা হবে ভারতীয় কমিউনিস্টদের। তারা সহজেই চীনের কমিউনিস্টদের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করতে পারবে।  ভারতীয় কমিউনিস্টদের গোলাবারুদ, অস্ত্র সরবরাহ চীনের পক্ষে সুবিধাজনক হবে। তিনি চিঠির সঙ্গে তৎকালীন তাঁর অধীনস্থ স্টেটস মন্ত্রকের একটি সার্ভে রিপোর্ট পাঠান। সেখানে উল্লেখ ছিল  সোভিয়েত রাশিয়া মনে করছে  ভারতীয় কমিউনিস্টরা রাশিয়ার  থেকে চীনের দ্বারা বেশি প্রভাবিত হতে পারে। মাও সে তুং স্ট্যালিনের থেকেও  বেশী প্রভাবশালী হয়ে উঠবেন। ইতিমধ্যে পিকিং এ একটি লিয়াজোঁ ব্যুরো প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, ভারতের বিষয়ে মাওকে নির্ধারকের ভূমিকা দেওয়া হয়েছে, ভারতীয় কমিউনিস্টদের বিভিন্ন পত্র পত্রিকা দ্ব্যর্থহীন ভাবে চীনের পথ অনুসরণ করতে বলেছে। অবশ্যই এর ফল ভারতীয় সংহতির পক্ষে লাভজনক হবে না।

এই অবস্থা মোকাবিলা করার জন্য পটেল একটি কর্মসূচির প্রস্তাব করেন। কর্মসূচির কতগুলো উল্লেখযোগ্য দিক হল,
১) এই সময় ভারতের চীনের রাষ্ট্রসঙ্ঘে অন্তর্ভুক্তির দাবি সমর্থন করাটা হয়তো ঠিক নাও হতে পারে।
২) উত্তর এবং উত্তর পূর্ব ভারতের নিরাপত্তা চূড়ান্ত করার জন্য উপযুক্ত ও দ্রুত রাজনৈতিক এবং প্রশাসনিক ব্যবস্থা নিতে হবে।
৩)  নেপাল, ভূটান, সিকিম, দার্জিলিং এবং অসমের উপজাতি অঞ্চলকে এই ব্যবস্থার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
৪) সীমান্ত অঞ্চলের দেশের আভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা সুদৃঢ় করতে হবে।
৫) সীমান্ত সংলগ্ন রাজ্য, যেমন উত্তর প্রদেশ, বিহার, পশ্চিমবঙ্গ আর অসমের নিরাপত্তা বাড়াতে হবে।
৬) তিব্বতের লাসাতে ভারতের  দূতাবাস, গিয়াংসে আর ইয়াতুঙ ভারতীয় অফিস এবং তিব্বতে কর্মরত ভারতীয় রক্ষীদের ভবিষ্যৎ স্থির করতে হবে।
৭)  ম্যাকমেহন লাইন সম্পর্কে নীতি স্থির করতে হবে।

প্যাটেলের চিঠির উত্তরে নেহেরু প্যাটেলকে একটি নোট পাঠান। নোটে উল্লেখ করেন তিব্বতকে বাঁচানো ভারতের পক্ষে সম্ভব নয়। ভারত হস্তক্ষেপ করলে তিব্বতের জটিলতা আরো বেড়ে যেতে পারে। তবে তিব্বতকে তার স্বশাসনের অধিকার রক্ষা করতে ভারত সাহায্য করতে পারে।

নেহেরু এটাও জানান, অদূর ভবিষ্যতে চীনের থেকে কোন সামরিক আক্রমণের সম্ভাবনা নেই, কেননা তা বিশ্বযুদ্ধে পরিণত হতে পারে। ভারতের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা মূলত পাকিস্তানের আক্রমণের কথা মনে রেখে স্থির করা হয়েছে। চীনের বিরুদ্ধে সেইরকম ব্যবস্থা নিলে ভারতের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা দুর্বল হয়ে পড়বে।

১৫ই ডিসেম্বর, ১৯৫০ সালে প্যাটেলের মৃত্যু হয়। ফলে নেহেরুকে তাঁর চীন নীতি থেকে নিরস্ত করার কেউ রইল না।

১৯৫০ এর ডিসেম্বরে,লোকসভায় পন্ডিত নেহেরু তাঁর এই পাণ্ডিত্যপূর্ণ বক্তব্য রাখেন।  বিরোধী নেতৃবৃন্দ, যেমন অধ্যাপক এন জি রাঙা, ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, শ্রী এম  আর মাসানি নেহরুকে চীনের আগ্রাসনের ব্যাপারে সাবধান করে দেন।  এর মধ্যে সবচেয়ে কঠোর ছিলেন মাসানি, তিনি মনে করিয়ে দেন “নিউ চায়না নিউজ এজেন্সি”  বিবৃতি প্রকাশ করেছে “তিব্বত অধিকারের জন্য অ্যাংলো আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদীরা আর তাদের এজেন্ট নেহরু লাসায় আঘাত হানছে। ” এবং ইতিমধ্যে ভারতীয় সীমান্তে চীন গেরিলা বাহিনী পাঠিয়েছে। নিউ চায়না নিউজ এজেন্সি সমানে প্রচার চালিয়ে যাচ্ছে পিপলস লিবারেশন আর্মি হিমালয়ের ওপর লাল পতাকা উত্তোলন করবে।

পন্ডিতজি অবশ্য তাঁর মতামত পরিবর্তন করেননি। একটি দীর্ঘ বক্তৃতায় তিনি জানান যে ভারতের মত দরিদ্র দেশের পক্ষে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ঢেলে সাজানো সম্ভব নয়। বিরোধী নেতৃবৃন্দকে তিনি বলেন “বাস্তববিরোধী”, এবং তাদের যুক্তিতর্ক  ” একেবারেই সময়োপযোগী নয়। ” অন্যদিকে, ১৯৫১ র মার্চ মাসে বন্যার মতো তিব্বতে চীনা সেনার অনুপ্রবেশ ঘটে। নেহরু চীনে চিঠির পর চিঠিতে “মৈত্রীপূর্ণ আর নিঃস্বার্থ উপদেশ” পাঠাতে থাকেন। ঐদিকে মাও সে তুংয়ের রণহুংকার  শোনা  যায় “পূর্ব দিকে তাকিয়ে তারস্বরে চিৎকার করে পশ্চিম দিকে আঘাত হানো।”

এইসময় একটি প্রেস কনফারেন্সে তিব্বতে চীনা সেনার উপস্থিতি ভারতের স্বার্থের পরিপন্থী হতে পারে কি না জিজ্ঞাসা করলে পন্ডিতজি উত্তর দেন, “ঘটনাগুলি সেনাদলের  উপস্থিতির সাপেক্ষে যথেষ্টই অস্পষ্ট। কি মাত্রায় তারা বাধার সৃষ্টি করবে তা স্পষ্ট নয়।

ক্রমশঃ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.