বর্তমানে আমাদের দেশে জাতীয়তাবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা নিয়ে আলোচনার জন্য বিভিন্ন সংগঠন ও সংস্থা বিতর্ক সভার আয়োজন। করে নানা জন নানাভাবে সমালোচনা করে তাদের মতামত ব্যক্ত করেন।তবে ইদানীং কালে জাতীয়তাবাদকে এক শ্রেণীর মানুষ অতি জাতীয়তাবোধ বলে কটাক্ষ করছেন।আর সাম্প্রদায়িকতাকে দাঁড় করাচ্ছেন এক তরফা ভাবে।সাম্প্রদায়িকতাকে ত্যাগ ও ঘৃণা করার জন্য আরেকটি সম্প্রদায় তৈরী হয়ে নতুন সাম্প্রদায়িকতার জন্ম দিয়ে ফেলছেন বোধকরি আচ্ছা, আমাদের দেশে আধুনিককালে প্রথম জাতীয়তাবাদ কথাটা কে উচ্চারণ করেছিলেন বা এই শব্দটির আমাদের দেশে কীভাবে আগমণ ঘটলো ? এ বিষয়ে তত্ত্ব তালাশ করলে দেখা যায়,এই শব্দটি প্রথম প্রয়োগ করেছিলেন জওহরলাল নেহরু ।এ বিষয়ে একটু ইতিহাসের দিকে চোখ বোলান দরকার।
ইউরোপে উনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকে জাতীয়তাবাদের প্রসার ঘটতে থাকে।সঙ্গে সঙ্গে জাতীয়তাবাদ নিয়ে চলতে থাকে তাত্ত্বিক আলোচনাও । অটোম্যান সাম্রাজ্য থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে কিছু কিছু জাতীয়বাদী রাষ্ট্রের জন্ম হয় ।এইমত এক সময়ে জওহরলালের কৈশোর চলছিল।জওহরলালের পিতা মতিলাল ছাত্রজীবন থেকেই মানসিকতায় ছিলেন বিলিতি।তিনি কলেজের শিক্ষা অসম্পূর্ণ রেখেই আইন ব্যাবসায়ে আগমণ করে প্রভূত অর্থ রোজগার করেন।একমাত্র পূত্র জওহরলালকে বিলিতি ভাবধারাতে মানুষ করার জন্য শিক্ষা দীক্ষার প্রয়োজনে ‘ব্রুক’ নামক একজন ইংরেজ শিক্ষক নিযুক্ত করেন।1905 সালে ব্রুকের শিক্ষা পদ্ধতির ওপর বীতশ্রদ্ধ হয়ে মতিলাল সপরিবারে ইংল্যান্ড চলে যান।তখন জওহর লালের বয়স পনের বছর।এই সময় তাঁকে ভর্তি করা হলো লন্ডনের বিখ্যাত ‘হ্যারো’ বিদ্যালয়ে। প্রবেশিকায় পাশ করে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করলেন।এরপর বিলেতপ্রীতি ও মূল্যবোধ সহ ইনার টেম্পলের ব্যারিস্টার ও কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাইপোস হয়ে 1912 সালে দেশে ফিরলেন।বিলিতি মূল্যবোধ বলতে তখন বোঝাত পশ্চিমী জাতীয়তাবাদ,গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস ।
জওহরলাল যখন দেশে ফিরলেন,তখন দেশে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী আন্দোলন চলছে। জওহর লাল তখন এই আন্দোলনকে প্রথম বললেন ‘জাতীয়তাবাদী আন্দোলন’।নেহরুর চিন্তা ভাবনায় পশ্চিমী ছাপ থাকলেও ভারত নামক দেশটা তো আর পশ্চিমী দেশ নয় ! ভারতে ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, পারস্য বা তুরস্কের মত একজাতীয় সমাজ কখনোই ছিলনা।সমকালীন ভারতীয় জনগণের এক চতুর্থাংশ ছিল মুসলিম।জওহরলালের জাতীয়তাবাদ এখানেই মুখ থুবড়ে পড়ে।তবে যাই হোক,ভারতবর্ষে জাতীয়তাবাদ শব্দটির প্রথম আগমণ ঘটে জওহরলাল নেহরুর মুখ নিসৃত হয়ে,একথা না মানার কোনও কারণ নেই ।
এবার দেখা যাক জাতীয়তা বাদের সংজ্ঞা কি? পৃথিবীর বহু বিখ্যাত ব্যাক্তি জাতীয়তাবাদের সংজ্ঞা দিয়েছেন নিজের মত করে। আমার মতে তারমধ্যে সবচাইতে সুন্দর এবং অল্প কথায় সম্পূর্ণ যুক্তিসঙ্গত ব্যাখ্যা দিয়েছন ম্যাৎসিনী।ইতালীর এই বরেণ্য নেতা জাতীয়তাবাদের সংজ্ঞায় বলেছেন, ‘ একটি জাতি হলো জৈবিক সমগ্রতায় আবদ্ধ এক জন গোষ্ঠী, যারা কতকগুলি উপাদানের ব্যাপারে সহমত।এই উপাদানগুলির মধ্যে আছে জাতিগোষ্ঠী,দেশের ভৌগলিকতা,ঐতিহাসিক পরম্পরা,বৌদ্ধিক বিশেষত্ব, ক্রিয়াকর্মের উদ্দেশ্য ইত্যাদি ।’ অর্থাৎ ম্যাৎসিনীর মতবাদ হিসেবে উপরোক্ত বিষয় তথা একত্রীভূত হতে আরও অন্য কিছু বিষয় সম্পর্কে চিন্তা করার নামই হলো জাতীয়তাবাদ।আর যাঁরা এইমত মতবাদের পক্ষপাতী তাঁরাই জাতীয়তাবাদী, একথা মানতেই হয়।
এবার বলতে হয় যাঁরা আমাদের দেশে জাতীয়তাবাদকে আরও এক কাঠি বাড়িয়ে অতি জাতীয়তাবাদ বলে চলেছেন,তাঁদের সম্পর্কে জাতীয়তাবাদ হলো সম্পূর্ণ এক বিষয় মাত্র । জাতীয়তাবাদের অর্থই হলো জাতীয়তাবাদ,এর কোনও বিকল্প হয়না,কম বা বেশীও হতে পারেনা।একটা ভরা কলসীকে কি আরও ভর্তি করা যায়? যায় না । আবার একটা কলসী আংশিক খালি থাকলে কি তাকে ভরা কলসী বলা সম্ভব? ব্যাকরণগত ভাবেই সম্ভব নয়। জাতীয়তাবাদ এমনই এক বিষয় যেটা অতি হতেও পারেনা,আবার কম হতেও পারেনা। ঠিক ভরা কলসীর মতো। সুতরাং যাঁরা জাতীয়তাবাদের সাথে ‘অতি’ জুড়ে অতি জাতীয়তাবাদ বলে চালাতে চাইছেন,তাঁরা প্রথমেই ব্যাকরণগত ভুল করে ফেলেছেন অনেকে হিটলার, মুসোলিনি,তোজো’কে অতি জাতীয়তাবাদী সাজিয়ে জাতীয়তাবাদ কথাটাকে অপমান করতে চান।স্মরণ করিয়ে দিতে চাই জাতীয়তাবাদ শুধুমাত্র নিজের জাতির কল্যাণার্থে, অপর জাতির ধ্বংসের জন্য নয় । এই তিনজন অন্য জাতিকে ধ্বংসকামী হওয়ায় জাতীয়তাবাদের প্রাথমিক সংজ্ঞাটাই লঙ্ঘন করায় নিজের জাতি ধ্বংসমূখী হয়ে পড়ে। নিজের জাতির ধ্বংসের কারণ হওয়ার জন্য এরা কখনোই জাতীয়তাবাদী হতে পারেনা। সুতরাং দেশপ্রেমিক কোনও ব্যাক্তি,দল বা শ্রেণীকে অতি জাতীয়তাবাদী বলার আগে বিরুদ্ধগোষ্ঠী জাতীয়তাবাদ নিয়ে প্রথমে জেনে নেবেন আশা করি।
এবার সাম্প্রদায়িকতার প্রসঙ্গ। সাম্প্রদায়িকতা বলতে কি বুঝায় বা সাম্প্রদায়িকতার সংজ্ঞা কি?এসম্পর্কে ড.রুদ্র প্রতাপ চট্টোপাধ্যায় সংজ্ঞা হিসেবে বলেছেন, ‘সাম্প্রদায়িকতা মানুষের রক্তগত চেতনা।মানুষ যে মানসিকতা নিয়ে আপন পূত্র কন্যার শ্রীবৃদ্ধি কামনা করে, সেই মানসিকতাই বিস্তারিত রূপে আপন সম্প্রদায়ের শ্রীবৃদ্ধি কামনা করে-তা সে সম্প্রদায় ভাষাভিত্তিক হোক,ধর্ম ভিত্তিক হোক বা অন্য কোনও সমচেতনা ভিত্তিক হোক। নিজের সম্প্রদায়ের এই শ্রীবৃদ্ধি কামনার নামই সাম্প্রদায়িকতা।’ ড.চট্টোপাধ্যায়ের সাম্প্রদায়িকতার সংজ্ঞাটি কিন্তু যুগোপযোগী ও হৃদয়গ্রাহী,একথা মানতেই হয়।
তাহলে দেখা যাচ্ছে সাম্প্রদায়িকতা খারাপ কিছু নয়।আপন সম্প্রদায়ের উন্নতি তথা শ্রীবৃদ্ধি কামনা বা সেই বিষয়ে প্রচেষ্টা করা কখনও খারাপ হতে পারেনা শুধু নয়,বরং অবশ্য কর্তব্য আর সেটাও যদি বলা হয় অন্যায়,তাহলে রামমোহন,বিদ্যাসাগরদের কার্যক্রমকেও খারাপ বলতে হয়।কারণ এঁরাও নিজের সমাজের উন্নতিকল্পে অনেক অনাচার দূর করেছিলেন আপন সমাজ থেকে।সুতরাং আপন সমাজের উন্নতির জন্য যে কোনও কাজ কখনোই খারাপ হতে পারেনা,তা সে যতই সাম্প্রদায়িক বলে উপহাস বা গালি দেওয়া হোক না কেন ? এবার প্রশ্ন হয়,তাহলে কেন সাম্প্রদায়িকতাকে গালপাড়া হবে?
এখানেই মূর্ত হয়ে ওঠে বিবেকানন্দর সেই অমোঘ বক্তব্যটি।তিনি বলেছেন, ‘ভূমধ্যসাগর থেকে প্রশান্ত মহাসাগর পর্যন্ত যে রক্তের বন্যা বইয়ে দেওয়া হয়েছে,তারজন্য দায়ী ইসলাম।’ রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘একটি ধর্মমত শুধু নিজ ধর্ম পালন করেই সন্তুষ্ট নয়,অন্য ধর্মমত সংহার করতে উদ্যত।’ মধ্যযুগে ইউরোপ থেকে মূর্তি পূজকদের উচ্ছেদ করতে খ্রিস্টানরা যত হত্যা করেছিল,ততটা হত্যা অন্য কোনও সম্প্রদায় এখনও পর্যন্ত করে উঠতে পারেনি।নিজের সম্প্রদায়ের উন্নতির জন্য কাজ করাকে যদি সাম্প্রদায়িকতা বলা হয়,তাহলে ধর্মের অছিলায় অন্য সব ধর্মকে উচ্ছেদের জন্য কাজ করাটাকে বা হত্যাকাণ্ড ঘটানোকে কি বলা হবে ? খুব ভাল ভাবে বিচার করলে দেখা যায়,এই খুনি দলকে সাম্প্রদায়িক না বলে বলা উচিত ‘সাম্প্রদায়িক খুনি’।সুখের বিষয় ভারতের সংখ্যাগুরু জনগণ নিজের ধর্ম ও সমাজের উন্নতিকল্পে কখনও পরধর্মমতকে উচ্ছেদ করণে হত্যালীলা সংগঠিত করেনি। তাই এই শ্রেণীটাকে শুধুই সাম্প্রদায়িক বলাটা অন্যায় নয়।কারণ হলো এরা নিজেদের জন্য যা কিছু করেছে সেটা কখনোই পরধর্মমত বিনষ্ট করার জন্য নয়।
এবার কিছু কথা বলতে হয় সাম্প্রদায়িকতার রাজনৈতিক প্রসঙ্গে।যদি শ্রেণীর উন্নয়ন প্রসঙ্গে বলতে হয়,তাহলে রাজনৈতিক মতাদর্শগতভাবে রাজনীতিবিদগণও এক একটা শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত এই রাজনৈতিক দল বা তাদের সদস্যগণও কি তাদের দল বি মতাদর্শের উন্নতি চায়না? অবশ্যই চায়।হিসেব মতো এইসব দলগুলোও এক একটা সাম্প্রদায়িকতা বহনকারী সংস্থা । তখনই এরাও সাম্প্রদায়িক খুনি হয়ে ওঠে যখন দেখা যায় এদের চেলারা বিরোধী দলকে দাবিয়ে রাখার জন্য মারপিট, দাঙ্গা-হাঙ্গামা ও খুন-খারাপিতে জড়িয়ে পড়ে। ছয়ের দশকে আমরা শ্রেণীশত্রু উৎখাতের নামে অবিরত হত্যালীলা প্রত্যক্ষ করেছি।বাম আমলে দেখেছি 56000 মানুষের হত্যাকাণ্ড।আর এখন দেখছি ভোট হলেই মৃত্যু মিছিল।সুতরাং এই সব খুনি রাজনৈতিক দলকে ‘সাম্প্রদায়িক খুনি’ বলা হবেনা কেন?
শেষ পর্বে একটাকথা বলতে চাই।কথাটা হলো দেশপ্রেমিক ব্যাক্তি বা দলকে এইসব সাম্প্রদায়িক খুনি দলের নেতা নেত্রীরা সাম্প্রদায়িক বলে গালি দেয়, তখন আমাদের মত সাধারণ জনগণের তামাশা ছাড়া আর কিছু মনে হওয়ার কারণ থাকেনা । এইসব খুনি দল গুলোর বিরুদ্ধে এখনই জনগণের এদের বিরুদ্ধে গর্জে ওঠা উচিত।