শিবত্ব এবং তান্ডব রূপী নটরাজ

    

“The whole thing is there, you see. The world of space and time, and matter and energy, the world of creation and destruction, the world of psychology…We (the West) don’t have anything remotely approaching such a comprehensive symbol, which is both cosmic and psychological, and spiritual.”

―Aldous Huxley, 1961

মানুষ যখন বাঁচার তাগিদে অরণ্যে বা পার্বত্য অঞ্চলে দাবানল, নদীতটে বন্যা, ঝড়-ঝঞ্ঝা, কিংবা সমতলে অগ্ন্যুৎপাত, ভূমিকম্প প্রভৃতি প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়ে মোকাবিলা করত, সেই ভয় ও ত্রাসের মধ্যে তাদের মনে প্রকটিত হয়েছিল এক সংহারকারী সর্বশক্তিমান মহামানবের অস্তিত্বের বোধ।ভারতবর্ষে বৈদিক কাল থেকেই আধ্যাত্মিকতা বিরাজমান , তার প্রমাণ গুহাবাসী আদিম সভ্যতা থেকে পাওয়া গেছে। আমাদের সৃষ্টি অখন্ড মন্ডলাকার । বিন্দু থেকে শুরু করে সম্পূর্ণ সৃষ্টি কে চালনাকারী অনন্ত শক্তির যে পরমেশ্বর তত্ব , সেই পর্যন্ত সহজ সম্বন্ধ  আছে।সনাতন হিন্দু ধর্ম একেশ্বরবাদী হলেও সত্যদ্রষ্টা মুনিঋষিগণ তাঁদের হৃদয়বেদিতে অভিষিক্ত করেছেন বিভিন্ন সাকার বিগ্রহ কিংবা লিঙ্গমূর্তিকে।উপনিষদে তাঁকে বলা হয়েছে ‘শান্তং শিবং অদ্বৈতম্‌’অর্থাৎ নির্বিকার অদ্বিতীয় শিব চৈতন্যস্বরূপ পরমাত্মা রূপে, আবার সশক্তিকে প্রকাশে বর্ণিত করা হয়েছে, ‘তমীশ্বরানাং পরমং মহেশ্বরং, তং দেবতানাং পরমং চ দৈবতম্‌’’ পরমদেবতারূপে। প্রকৃতপক্ষে ‘শিব’শব্দটি হল পরম মঙ্গলের পরিচায়ক। তিনিই আবার সর্বসংহারকারী ধ্বংসের দেবতা রুদ্ররূপেও বন্দিত হয়েছেন বেদ-উপনিষদে।যজুর্বেদের মহীধর ভাষ্যে আছে, ‘‘যিনি সত্যনিষ্ঠকে জ্ঞানদান করেন, কিন্তু পাপীগণকে দুঃখভোগের মাধ্যমে ক্রন্দন করান, তিনিই রুদ্র।
           ’’ রবণং রুৎ জ্ঞানং… রোদয়তি রুদ্রঃ’’

ধ্বংসেরই অদৃষ্ট নিয়ন্তার কর্মধারার বাহ্যিক প্রকাশের অন্তরালেই রয়েছে নতুন সৃষ্টির উদ্বোধন প্রক্রিয়া। অর্থাৎ ধ্বংসের মধ্যেই নিহিত রয়েছে সৃষ্টির বীজ।প্রলয়ান্তে যে নবীন সৃষ্টির ধারা, সেটি তো ধ্বংসের মধ্য দিয়েই উন্মীলিত হয়। সুতরাং, ধ্বংস ও সৃষ্টি অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। প্রলয়ের উৎস যিনি, সৃষ্টির উৎসও অলক্ষ্যে অবশ্যই তিনি। তাই পালনও তাঁর দ্বারাই হয়ে থাকে।
সৃষ্টির ঘটনা একপ্রকারের নৃত্যশৈলী , অর্থাৎ সৃষ্টির পর্যায়ক্রম অনুসারে দুটি কণার সংঘর্ষের ঘটনাকে নৃত্যের কিছু ক্রমবিন্যাসের সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে।নৃত্য প্রদর্শনী দেখলে মানুষ তার যোগাযোগের বিভিন্ন আঙ্গিকের সঙ্গে তুলনা করে। কেননা নৃত্য এবং ভাষা কাজ করে একসূত্রে।আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানীরা এই ধরনের শব্দ ব্যবহার করছেন – তারা বলেন সৃষ্টিকে অনুভব করলে দেখা যাবে , এক অদ্ভুত ভঙ্গিমার নৃত্যশৈলী , এই বিষয়ে
কোয়ান্টাম মেকানিক্স এর অন্তর্ভুক্ত, এতে পরে আসছি। শিব ঠাকুরের ত্রিশূলে বাঁধা ডমরু  তাঁর উপদেশের প্রতীক যা আমাদের জীবনে এগিয়ে চলার রাস্তা দেখায়৷মহাদেবের ত্রিশূল তিনটি শক্তির প্রতীক- জ্ঞান, ইচ্ছা এবং সম্মতি৷তিনি এই তিনটি জ্ঞান তার নিয়ন্ত্রণে রাখেন।শিবের গলায়-মাথায় নাগের উপস্থিতি সর্বদা দেখা যায়, যা পুরুষের অহংকারের প্রতীক বলে মনে করা হয়৷রুদ্রাক্ষ আসলে শুদ্ধতার প্রতীক৷ অনেকক্ষেত্রে তাঁর হাতে রুদ্রাক্ষমালা থাকে যা ধ্যানমুদ্রার সূচক বলে জানা যায়৷শিল্প কলা বিশেষত নৃত্যের সঙ্গে শিবের গভীর সম্পর্ক রয়েছে। কথিত আছে নৃত্য ও সঙ্গীত শিবের সৃষ্টি, তিনিই এই নৃত্যকলার প্রবর্তক। যাইহোক, যে রূপটি বা মূর্তিটি নিয়ে আজ  আমরা আলোচনা করব, তা আমরা  সবচেয়ে ভালভাবে চিনতে পারি নবম বা দশম শতাব্দীর কাছাকাছি। এই রূপটি হল ভগবান শিবের আনন্দ তান্ডব বা আনন্দময় নৃত্য। ভগবান শিবের নৃত্যের নাম হল তাণ্ডব ও দেবী পার্বতীর নৃত্যকে বলে লাস্য। তাণ্ডব ধ্বংসাত্মক পৌরুষেয় নৃত্য; স্বয়ং শিবই কাল-মহাকাল বেশে বিশ্ব ধ্বংসের উদ্দেশ্যে এ নৃত্য করেন। লাস্যকে তাণ্ডবের নারীসুলভ বিকল্প বলে ধরা হয়। তাণ্ডব ও লাস্য হল  যথাক্রমে ধ্বংস ও সৃষ্টির রূপ। কথিত আছে রুদ্রের এই উগ্ররূপটি দেখেছিলেন একমাত্র অশ্বত্থামা। গভীর রাতে ঘুমন্ত পঞ্চপাণ্ডবকে হত্যা করার জন্য তিনি যখন পাণ্ডবদের শিবিরদ্বারে কাপুরুষের মতো উপস্থিত হয়েছিলেন তখন তিনি এক অতিকায় ভয়ানক দেবমূর্তিকে দণ্ডায়মান দেখে স্তম্ভিত হয়েছিলেন।  সেই অতিকায় তীব্র দীপ্তি-সমন্বিত পুরুষের পরিধানে ছিল রক্তাক্ত ব্যাঘ্রচর্ম, কৃষ্ণাজিন ও কণ্ঠে নাগোপবীত। তাঁর দেহাঙ্গ অগ্নিমুখ সর্প দ্বারা বেষ্টিত ছিল। মহাভারতে বলা হয়েছে, বিগ্রহ নির্মাণ করেই অশ্বত্থামা শিব পূজা করতেন। সুতরাং মহাভারতীয়যুগ থেকেই মূর্তি গড়ে শিবপুজোর প্রচলন ছিল।চতুর্দশ উল্লাসে শিব শব্দের অর্থ- মঙ্গলময় বলে আ্যখ্যা করা হয়েছে।শিবের দেহকান্তি বন্ধুকপুষ্পের ন্যায় , ত্রিনেত্র হাস্যবদন , ললাটে শশীকলা বিদ্যমান।শিব চরিত্রের বিবর্তনের ধারায় দেখা যায়, শিবের সবচেয়ে উগ্ৰরূপ হল বীরভদ্র। সতীর প্রাণত্যাগের পর ক্রোধে উন্মত্ত মহাদেবের মুখ থেকে ,মতান্তরে ক্রোধাগ্নি থেকৈ ক্রোধান্বিত শিবের ছিন্ন জটা থেকে প্রবল পরাক্রান্ত বীরভদ্রের জন্ম। শিবের পাঁচটি মুখের নাম উল্লিখিত রয়েছে তৈত্তিরীয় আরণ্যকে। এই নামগুলি হল—সদ্যোজাত, বামদেব, অঘোর, তৎপুরুষ ও ঈশান। নির্বাণতন্ত্রের মতে, ‘সদ্যোজাত’ মুখটি শুদ্ধস্ফটিকের মতো শুক্লবর্ণ—সেটি পশ্চিমে, ‘বামদেব’ পীতবর্ণ সৌম্য মনোহর—সেটি উত্তরে, ‘অঘোর’ কৃষ্ণবর্ণ ভয়ংকর—সেটি দক্ষিণে; ‘তৎপুরুষ’ রক্তবর্ণ দিব্য মনোরম—সেটি পূর্বে; এবং ‘ঈশান’ শ্যামল সর্বদেব-স্বরূপ শিব সেটি ঊর্ধ্বে। কথিত আছে, শিবের এই পঞ্চমুখ থেকেই ২৮টি আগম (তন্ত্র) রচিত হয়েছে। সর্বোচ্চ স্তরে ভগবান শিবকে সর্বোৎকর্ষ, অপরিবর্তনশীল পরম ব্রহ্ম মনে করা হয়। শিবের অনেকগুলি সদাশয় ও ভয়ঙ্কর মূর্তিও আছে।সদাশয় রূপে তিনি একজন সর্বজ্ঞ যোগী, এবং  কৈলাস পর্বতে সন্ন্যাসীর জীবন যাপন করেন। আবার গৃহস্থ রূপে তিনি দেবী পার্বতীর স্বামী। তাঁর দুই পুত্র বর্তমান। এঁরা হলেন গণেশ ও কার্তিক। ভয়ঙ্কর রূপে তাঁকে
দৈত্যবিনাশী রূপে প্রত্যক্ষ করা যায়। ভগবান মহাদেব সনক প্রভৃতি সিদ্ধগণকে উদ্ধার করার উদ্দেশ্যে নৃত্যশেষে নবপঞ্চবার অর্থাৎ চতুর্দশবার ডমরু বাজিয়েছিলেন।সনকাদি সিদ্ধগণকে উদ্ধারের জন্যে শিবের ডমরু থেকে উৎপন্নজাত ১৪টি শিবসূত্র হল:

১. অ ই উ ণ্
২. ঋ ৯ ক্
৩. এ ও ঙ্
৪. ঐ ঔ চ্
৫. হ য ৱ র ট্
৬. ল ণ্
৭. ঞ ম ঙ ণ ন ম্
৮. ঝ ভ ঞ
৯. ঘ ঢ ধ ষ্
১০. জ ব গ ড দ শ্
১১. খ ফ ছ ঠ থ চ ট ত ৱ্
১২. ক প য্
১৩. শ ষ স র্
১৪. হ ল্

এ চোদ্দটি শিবসূত্র বা মাহেশের সূত্র থেকেই পাণিনির অষ্টাধ্যায়ীতে ‘অণ্’ থেকে ‘হল্’ পর্যন্ত ৪১ টি প্রত্যাহার সূত্র তৈরি হয়। শিবের ডমরু থেকে উৎপন্ন চতুর্দশ শিবসূত্র থেকেই ব্যাকরণ সহ সকল বিদ্যার উৎপত্তি।

ভগবান শিবের তাণ্ডব নৃত্য প্রধানত সাত প্রকারের। আনন্দতাণ্ডব, সংহারতাণ্ডব এ প্রত্যেকটি নামের মধ্যেই সুস্পষ্ট সেই তাণ্ডবের রূপ এবং প্রকৃতি।

১. আনন্দতাণ্ডব
২. সন্ধ্যাতাণ্ডব
৩. কলিকাতাণ্ডব
৪. ত্রিপুরাতাণ্ডব
৫. গৌরিতাণ্ডব
৬. উমাতাণ্ডব
৭. সংহারতাণ্ডব

সদাশিব যেমন অল্পতেই তুষ্ট হন এবং তেমনি অল্পতেই রুষ্ট হন ; তাই তাঁর নাম আশুতোষ ।তাঁর নৃত্যছন্দে ব্রহ্মাণ্ড স্পন্দিত হয়। জগতের আদি পিতামাতা শিব এবং শক্তি একইসাথে তাণ্ডব এবং লাস্য নৃত্য করেন। শিব এবং শক্তি অভেদ, ব্রহ্মাণ্ডের সকল শক্তির উৎস। এ কারণেই বেদে বিশেষ করে কৃষ্ণ যজুর্বেদীয় তৈত্তিরীয় আরণ্যকের দশম প্রপাঠকে একা ভগবান শিব নয় অম্বিকাপতি, উমাপতিকেও বন্দনা করা হয়েছে-

“নমো হিরণ্যবাহবে হিরণ্যবর্ণায় হিরণ্যরূপায়
হিরণ্যপতয়ে অম্বিকাপতয় উমাপতয়ে
পশুপতয়ে নমো নমঃ।।”

“অম্বিকাপতি,উমাপতি, পশুপতি, হিরণ্যাদি সর্বনিধির পালক,তেজোময়, হিরণ্যবাহু, হিরণ্যবর্ণ,হিরণ্যরূপ পরমেশ্বর শিবের উদ্দেশ্যে নমস্কার।”নাট্যশাস্ত্রেরও আদি প্রবক্তা নটরাজ শিব। তিনি প্রথম নাট্যশাস্ত্র প্রজাপতি ব্রহ্মাকে দিয়েছিলেন। ব্রহ্মা ভরত মুনিকে দিলেন, ভরত তা পৃথিবীতে প্রচার করলেন। ভরত মুনির নামে এর নাম হয় ভরতের নাট্যশাস্ত্র। নাট্যশাস্ত্রের সাথে সাথে ভরত মুনি এক অনন্য নৃত্যশৈলী জগতে প্রচার করেন। সেই অপূর্ব মনোহর নৃত্যশৈলীর নাম ‘ভরতনাট্টম্’।সংগীত নৃত্যশিল্পের তরঙ্গদল যে নটরাজের প্রলয়ঙ্কারী নৃত্যে আবির্ভূত হয়ে দুলে উঠল, তা অত্যন্ত সুন্দর করে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর একটি সংগীতে ব্যক্ত করেছেন।

” প্রলয়-নাচন নাচলে যখন আপন ভুলে
হে নটরাজ, জটার বাঁধন পড়ল খুলে॥
জাহ্নবী তাই মুক্তধারায় উন্মাদিনী দিশা হারায়,
সঙ্গীতে তার তরঙ্গদল উঠল দুলে॥
রবির আলো সাড়া দিল আকাশ-পারে।
শুনিয়ে দিল অভয়বাণী ঘর-ছাড়ারে।
আপন স্রোতে আপনি মাতে, সাথি হল আপন-সাথে,
সব-হারা সে সব পেল তার কূলে কূলে॥”

যখন আমরা নটরাজ এর চিন্তা করছি , তখন আমরা কোন একক নৃত্যের কথা বলছি না।হয়ত লক্ষ্য করে থাকবেন যে নটরাজের বর্ণনায় তাঁর পিছনে  চারপাশে একটি বৃত্ত রয়েছে।   গ্রহ, চন্দ্র, সূর্য, এই সবই বৃত্ত। বৃত্ত হল প্রতিরোধের আকারের প্রতিমূর্তি স্বরূপ। তাই, নটরাজের চারপাশের বৃত্তটি মহাজগতের প্রতীকি স্বরূপ।নটরাজ রূপে ভগবান শিবের ডানহাতে থাকে অভয় মুদ্রা , বামহাতে থাকে অনির্বাণ অগ্নি। ভগবানের বাম চরণ স্পর্শ করে রয়েছে দক্ষিণ চরণকে । রুদ্ররূপে নটরাজ ভগবান নীলকণ্ঠ শঙ্কা তিরোহিত করে জ্ঞান প্রদান করেন। একেই মুক্তি বা ‘মোক্ষ’ নামে আখ্যায়িত করা হয় । নটরাজ শিবের হাতে আগুণ হল প্রলয়ঙ্কারী ধ্বংসের প্রতীক। অন্য হাতে ডমরু হল, অনাহত নাদ ॐ এবং চতুর্দশ মাহেশ্বর সূত্রের প্রতীক জ্ঞান।

দক্ষিণ ভারতের নটরাজ মূর্তি আনন্দ তাণ্ডব নৃত্যের প্রতিমূর্তি। বাংলা তথা সারা উত্তরভারতে পাই বীণাধর নটরাজের মূর্তি। বাংলায় এই নটরাজের নামই নর্তেশ্বর। এই রূপমূর্তির দশটি বা বারোটি হাত থাকে।  বারো হাতের দুই হাত মাথার উপরে তুলে তাল রাখছেন তিনি,  নিচে নন্দী ষাঁড়। নন্দীর পৃষ্ঠের উপর তিনি তান্ডব নৃত্য করছেন। এই তান্ডব নৃত্যটি ললিত আনন্দ তান্ডব ভঙ্গিমা যুক্ত। হিমালয়ের কৈলাস থেকে শুরু করে একেবারে দক্ষিণ পর্যন্ত সারা ভারতবর্ষে অসংখ্য শিবমন্দির বিরাজিত। এর মধ্যে পবিত্র দ্বাদশ শিবলিঙ্গ আছে,তাদের দ্বাদশ জ্যোতির্লিঙ্গ বলে।তবে আশ্চর্যের বিষয় রামেশ্বর কেদারনাথ এ স্বয়ম্ভুলিঙ্গ সহ শিবের সাতটি প্রাচীন মন্দির রয়েছে একই সরলরেখায়। মন্দিরগুলোর দ্রাঘিমাংশ একই ; প্রত্যেকটি মন্দিরই ৭৯ ডিগ্রি ৪১ মিনিট ৫৪ সেকেন্ড পূর্বে অবস্থিত।”কণ কন মে ঈশ্বর হে “অর্থাৎ  “প্রতিটা কনাতেই ঈশ্বর আছেন”-‘কথাটা প্রায় সবাই শুনেছি। তাহলে কি এই কণা? আর এই ঈশ্বর টাই কি বা কে ?
শিব হল মূর্তি রূপে শক্তি যা প্রতিটা কণায় সর্বত্র অবস্থিত। অর্থাৎ সর্বত্রই শিব অবস্থিত।  এই শক্তিকে প্রকাশ করার একটা রূপ হলো নটরাজ।  আ্যটমই হল সেই কণা,যার অস্তিত্ব আজ থেকে  বছর আগেও আমাদের পূর্বপুরুষ রা জানতেন। শুধু সেই বিষয় তারা ব্যাখ্যা করে গিয়েছিলেন অতি সাধারণ ভাবে ও একটু অন্য রকম ভাবে।আ্যটম  এর মধ্যে থাকা সাব আ্যটমিক পার্টিকেল গুলো কখনই স্থির নই। তারা  ভাইব্রেশন ও মোশন এর মধ্যে রয়েছে। Quantum Theory যা আধুনিক বিজ্ঞানের ভিত্তি, যা অনুযায়ী পার্টিকেল  হল ওয়েভ এর এক রূপ অর্থাৎ পার্টিকেল ও ওয়েভ আলাদা কোনো সত্ত্বা নয়, তারা দুটি রূপেই অবস্থান করে এবং সেই দুটি রূপ ই হল শক্তির এর ভিন্ন রূপ । আর এই শক্তি কেই প্রাচীন ভারতীয় গ্রন্থে শিব নামে অভিহিত করা হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর ভাষায় –
                                তৃষ্ণার শান্তি,
সুন্দরকান্তি,
তুমি এলে নিখিলের সন্তাপভঞ্জন।
আঁকো ধরাবক্ষে
দিক্‌বধূচক্ষে
সুশীতল সুকোমল শ্যামরসরঞ্জন।
এলে বীর, ছন্দে–
তব কটিবন্ধে
বিদ্যুৎ-অসিলতা বেজে ওঠে ঝঞ্ঝন।
তব উত্তরীয়ে
ছায়া দিলে ভরিয়ে
তমালবনশিখরে নবনীল-অঞ্জন।
ঝিল্লির মন্দ্রে
মালতীর গন্ধে
মিলাইলে চঞ্চল মধুকরগুঞ্জন।
নৃত্যের ভঙ্গে
এলে নবরঙ্গে,
সচকিত পল্লবে নাচে যেন খঞ্জন॥

পদার্থবিজ্ঞানী ফ্রিটজফ ক্যাপরা “দ্য টাও অফ ফিজিক্সে” ব্যাখ্যা করেছেন: “শিবের নৃত্য সমস্ত অস্তিত্বের ভিত্তির প্রতীক। একই সময়ে, শিব আমাদের মনে করিয়ে দেন যে পৃথিবীতে বহুগুণ রূপগুলি মৌলিক নয়, বরং মায়াময় এবং নিত্য পরিবর্তনশীল। আধুনিক পদার্থবিজ্ঞান দেখিয়েছে যে সৃষ্টি এবং ধ্বংসের ছন্দ কেবল মায়ার খেলা  এবং সমস্ত জীবের জন্ম ও মৃত্যুর মধ্যেই প্রকাশ পায় না, বরং এটি অজৈব পদার্থের মূল উপাদানও। “আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানীদের জন্য, শিবের নৃত্য হল উপ -পারমাণবিক পদার্থের নৃত্য, সমস্ত অস্তিত্ব এবং সমস্ত প্রাকৃতিক ঘটনার ভিত্তি।
কোয়ান্টাম ফিল্ড তত্ত্ব অনুসারে, সৃষ্টি এবং ধ্বংসের শিল্পকলা বস্তুর অস্তিত্বের ভিত্তির উপর নির্ভর করে।
২০০৪ সাল,ইউরোপ , সুইজারল্যান্ড এর জেনেভা  তে অবস্থিত পৃথিবীর সবচেয়ে বড় নিউক্লিয়ার রিসার্চ অর্গানাইজেশন , Particle Physics Lab, CERN এর বাইরে ২ মিটার উচ্চতার নটরাজ মূর্তি স্থাপিত হল। মূর্তিটি ভারতের পক্ষ থেকে একটি উপহার, যা সার্নের ভারতের সাথে দীর্ঘ সম্পর্ককে জোরালো করে যা ১৯৬০ -এর দশকে শুরু হয়েছিল । এটি উন্মোচন করেন ডিরেক্টর জেনারেল ডঃ রবার্ট আয়মার, মহামান্য মিঃ কে এম চন্দ্রশেখর, রাষ্ট্রদূত (ডব্লিউটিও-জেনেভা) এবং ডঃ অনিল কাকোদকার, পারমাণবিক শক্তি কমিশনের চেয়ারম্যান এবং সচিব, পরমাণু শক্তি বিভাগ, ভারত।
বিষয়টি অবাক করার মতো না ? 
বর্তমান সময়ে যেখানে আমরা ধর্মের সাথে বিজ্ঞানের কোনো যোগ আছে এটা শুনেই মুখভঙ্গি করি,সেখানে সারা পৃথিবী চমকে দিয়ে এই বৈজ্ঞানিক সংগঠনে এক হিন্দু দেবতা কি করে ! আসলে সবই দৃষ্টিকোণের পার্থক্য। আমাদের দেশে লোক ধর্ম নিয়ে দ্বন্দ্ব করছে আর পশ্চিমের লোকেরা সেই ধর্ম থেকেই লুকিয়ে থাকা বিজ্ঞানের রসদ শুষে নিয়েছে। বিগ ব্যাং তত্ত্ব অনুযায়ী সৃষ্টির আদিতে সমগ্র ব্রহ্মাণ্ড একটি মাত্র বিন্দুতে সীমিত ছিল,তখন সময় বা জায়গা এর কোনো অস্তিত্ব ছিল না। এরপর এই বিন্দুর মধ্যে শুরু হয় বিশৃঙ্খলা বা কম্পন যার ফলে এই বিন্দুটি ভেঙে যায় এবং তা প্রসারিত হয়ে সমগ্র ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টি হয় এবং উৎপত্তি ঘটে সময় ও স্থানের। এই vibration বা বিশৃঙ্খলা কেই Cosmic Dance রূপে অবিহিত করা হয়। এখন নটরাজ এর সম্পূর্ণ মূর্তি যদি এই বিন্দু হয় তাহলে তার মধ্যে উৎপন্ন হওয়া কম্পন হল নটরাজ এর নৃত্য এবং তার চারপাশের অগ্নীবলয় দ্বারা ঘেরা ক্ষেত্রে বন্দী ছিল সময় আর স্থান । এর আগে সময়ের কোনো অস্তিত্ব ছিল না ,যা সম্পূর্ণ বৈজ্ঞানিক সমর্থিত। অগ্নিবলয় টি ভালো ভাবে দেখলে বোঝা যায় সেটা বাইরের দিকে প্রগতিশীল অর্থাৎ তা ব্রহ্মাণ্ডের প্রসারণ বোঝায়। এই উৎপত্তির ফলেই শব্দ এর জন্ম হয় যাকে ব্রহ্মাণ্ডের প্রথম শব্দ বলা হয় এবং তা নটরাজ এর হাতে থাকা ডমরু এর মাধ্যমে বোঝানো হয়।এর থেকে উৎপন্ন নাদ বা ধ্বনি হল ব্রহ্মাণ্ডের উৎপত্তির প্রথম শব্দ। CERN-এর এক গবেষকের ব্যাখ্যা হল, শিবের এ নৃত্য আসলে মনে করিয়ে দেয়, জগতে সবকিছুই পরিবর্তনশীল। কোনও কিছুই স্থির নয়। বিজ্ঞানী কার্ল সাগানও এই প্রসঙ্গে বলেন, “হিন্দু ধর্ম হল বিশ্বের অন্যতম এক প্রাচীন ধর্ম, যারা বিশ্বাস করে, বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে জন্মও মৃত্যু বৃত্তাকারে ঘুরে চলছে।” আমরা যাকে মৃত্যু, ধ্বংস বলে অবিহিত করি, বেদান্তে বলে রূপ পরিবর্তন। শক্তির ক্ষয় নেই, সৃষ্টিও নেই, শুধুই রূপান্তরিত হয়।এ কথা বিজ্ঞান বলে, একইকথা বেদান্তও বলে। শিবের নটরাজ এ সত্যকেই আমাদের সামনে দৃশ্যমান করেছে। মূল অব্যক্ত ক্ষেত্র স্থির হয়েও রূপ থেকে রূপান্তরিত হচ্ছে প্রতিক্ষণ। বিজ্ঞানীরা বলছেন, আদি ক্ষেত্র অব্যক্ত কারণ সেখানে আকাশ নেই, সময় নেই। কথাগুলো ঋগ্বেদের পরমাত্মা সূক্তেও  বলা আছে। সেখানে বলা আছে, আদিতে কোন অস্তিত্ব বা অনস্তিত্ব কিছুই ছিলনা; কোন বায়ুমণ্ডলও ছিল না।” এ অব্যক্ত অবস্থায় জগতের স্রষ্টা ধ্যানস্থ শিবরূপে কল্পিত। মহান বিজ্ঞানী যেমন Nikola Tesla,Bohr , Heisenberg, Carl Sagan স্বীকার করেছেন যে তাদের অধিকাংশ খোঁজই ভারতের প্রাচীন বৈদিক গ্রন্থের উপর আধারিত।  আধুনিক বিজ্ঞান এই সাব আ্যটমিক পার্টিকেল গুলোর মোশন বা গতি পর্যবেক্ষণ করে আ্যটম  এর যে চিত্র আবিষ্কার করেছেন তা শত শত বছর আগে ভারতীয় শিল্পীরা ব্রোঞ্জ এর তৈরি নটরাজ মূর্তি এবং শিবের আরও নানান নৃত্য শৈলীর এর মাধ্যমে দেখিয়ে গেছেন।

সন্ন্যাসী  যে জাগিল ঐ, জাগিল ঐ, জাগিল।

“হাস্যভরা দখিনবায়ে

অঙ্গ হতে দিল উড়ায়ে

শ্মশানচিতাভস্মরাশি, ভাগিল কোথা, ভাগিল। 

মানাসলোকে শুভ্র আলো

চূর্ণ হয়ে রঙ জাগাল,

মদির রাগ লাগিল তারে,

হৃদয়ে তার লাগিল।

আয় রে তোরা, আয় রে তোরা, আয় রে।”

শিব একাধারে সকল অস্তিত্বের আধার, আবার সকল অস্তিত্বের বিলয়। সৃষ্টি বিলয়ের দুটি ভাবই নটরাজে দেখা যায়। নটরাজ পায়ের নিচে দলিত করছেন অপস্মার নামক এক দৈত্যকে। অপস্মার হলেন, মোহ অজ্ঞতা, অন্ধকার এবং অবিদ্যার প্রতীক। তাই অপস্মরাকে নাশ করে অন্ধকার বিদূরিত করতে হয়।নোবেল বিজয়ী বিজ্ঞানী রুডলফ জোসেফ আলেক্সান্ডার শ্রডিঞ্জার (১৮৮৭-১৯৬১) ঘোষণা করেন, বিজ্ঞানীদের যে দ্বন্দ্ব দেখা যায় পদার্থ ও চেতনা নিয়ে এর সমাধান লুকিয়ে আছে উপনিষদের প্রাচীন প্রজ্ঞায়। তিনি বেদান্ত দর্শন বিশেষ করে উপনিষদের দ্বারা প্রচণ্ডভাবে প্রভাবিত ছিলেন। তিনি উপনিষদে বর্ণিত অখণ্ড চেতনায় বিশ্বাসী ছিলেন। বিষয়গুলো নিয়ে শ্রডিঞ্জার এর পরবর্তীতে গবেষণা করেছেন পৃথিবীর অনেক শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানীরা। বোহম, উইগনার, ওপেনহাইমার, জোসেফসন, সাগান, হুইলার, হেগ্লিস, বেলিজ প্রমুখ। তাঁরা বললেন, উপনিষদ কথিত চেতনাই শ্রেষ্ট উত্তর  কম্পনশীল
বিশ্বব্রহ্মান্ড ও ক্ষুদ্রতম কণার। ওপেনহেমার বললেন, “আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানে  যা পাওয়া যাচ্ছে তা প্রাচীন হিন্দু প্রজ্ঞারই প্রতিফলন।” তাই আধুনিক বিজ্ঞানের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা কেন্দ্র CERN-এর সামনে বিজ্ঞানীরা স্থাপন করলেন নটরাজের মূর্তি।বহু ভারতীয় বিজ্ঞানীরই অভিজ্ঞতা, রাতে বিরাট চত্বরে সেই মূর্তির ছায়া যেন গায়ে কাঁটা দেয়!নটরাজ সর্বদা অনন্তকাল ধরে অজ্ঞতা, লোভ এবং স্বার্থপরতার প্রতীক ক্ষুদ্র দানব অপস্মারকে পা দিয়ে পদদলিত করে দমন করে আমাদের লোকশিক্ষা দিচ্ছেন।

“এই নেমেছে চাঁদের হাসি

এইখানে আয় মিলবি আসি,

বীণার তারে তারণ-মন্ত্র

শিখে নে তোর কবির কাছে।

আমি নটরাজের চেলা

চিত্তাকাশে দেখছি খেলা,

বাঁধন খোলার শিখছি সাধন

মহাকালের বিপুল নাচে।

দেখছি, ও যার অসীম বিত্ত

সুন্দর তার ত্যাগের নৃত্য,

আপনাকে তার হারিয়ে প্রকাশ

আপনাতে যার আপনি আছে।

যে-নটরাজ নাচের খেলায়

ভিতরকে তার বাইরে ফেলায়,

কবির বাণী অবাক মানি

তারি নাচের প্রসাদ যাচে।”

।।সপ্তর্ষি ভট্টাচার্য্য।।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.