রেনকোজির সেই মন্দিরে ‘নেতাজীর অস্থি’

১৯৪৫-এর ১৮ অগাস্ট জাপানে বিমান দুর্ঘটনায় আদৌ কি মৃত্যু হয়েছিল বীর বিপ্লবী সুভাষচন্দ্র বসুর? দীর্ঘকাল ধরেই এই নিয়ে বিতর্ক এবং নানা রকম তদন্ত চলেছে। 

নেতাজি সুভাষচন্দ্রের মৃত্যুরহস্য ভেদ করতে ১৯৫৬ সালে ভারত সরকার শাহানওয়াজ কমিশন গঠন করে। সেই কমিশনের প্রতিবেদন অনুযায়ী নেতাজির মৃত্যু হয়েছিল বিমান দুর্ঘটনাতেই। ১৯৭০ সালে গঠন করা বিচারপতি জিডি খোসলা কমিশনও সেই মতকে সমর্থন করে। 

জিডি খোসলা কমিশন জানায়, ১৯৪৫ সালে বিমান দুর্ঘটনার পর ১৮ আগস্টই তাইহোকু সেনা হাসপাতালে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর মৃত্যু হয়। নেতাজির দেহভস্ম অন্তিম সংস্কারের জন্য জাপানের টোকিও শহরের রেনকোজি মন্দিরে নিয়ে যাওয়া হলে মন্দিরের প্রধান মোচিজুকি মন্দিরের তত্ত্বাবধানে ওই দেহভস্ম রাখতে রাজি হন। নেতাজির শেষকৃত্য সম্পন্ন হয় ১৯৪৫ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর। 

তাইহোকু বিমানবন্দরে নেতাজির সঙ্গে প্লেনে উঠেছিলেন তাঁর এডিসি কর্নেল হাবিবুর রহমান। তিনি দাবি করেছিলেন যে নেতাজির একটি সোনায় বাঁধানো দাঁত ছিল, যে দাঁত মৃতদেহের সঙ্গে জ্বলে যায়নি। ভারতীয় বিদেশ মন্ত্রকের দুই অফিসার জানিয়েছিলেন, ২০০২ সালে তাঁরা রেনকোজি মন্দিরে নেতাজির দেহভস্মের সঙ্গে দেখতে পেয়েছিলেন সেই দাঁত।

বিতর্কের নিরসনে অনেক দিন ধরেই নেতাজীর চিতাভস্মের ডিএনএ পরীক্ষার দাবি উঠেছে। তাকে স্বাগত জানিয়েছেন নেতাজির পৌত্র সুগত বসুও। কিন্তু তাঁর মতে, ‘‘রেনকোজি মন্দিরে রাখা চিতাভস্ম আদৌ ডিএনএ পরীক্ষার যোগ্য কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। ওই ভস্মের আধার জওহরলাল নেহরু, শিশিরকুমার বসু ও মনোজ মুখোপাধ্যায় কমিশনের উপস্থিতিতে তিন বার খোলা হয়েছিল। মনোজ মুখোপাধ্যায় কমিশন আধার থেকে চিতাভস্ম বের করে পরীক্ষাও করে। তার ফলেও ভস্মের গুণমান কমে গিয়েছে কিনা সেই প্রশ্ন রয়েছে।’’ 

সুগতবাবুর মতে, তিনি নিজে যা তথ্যপ্রমাণ পেয়েছেন তাতে ব্যক্তিগত ভাবে তাইহোকু দুর্ঘটনায় নেতাজির মৃত্যু নিয়ে তাঁর কোনও সন্দেহ নেই। তবে ডিএনএ পরীক্ষায় আরও নিশ্চিত প্রমাণ পাওয়া গেলে তাঁর আপত্তি নেই। সুগতবাবুর মতে, ‘‘অনেকে অবশ্য যুক্তির চেয়ে আবেগকে বেশি গুরুত্ব দেন। তাঁরা ডিএনএ পরীক্ষার ফলকেও হয়তো গুরুত্ব দেবেন না।’’

সুভাষচন্দ্র বসু ও এমিলি শেঙ্কলের মেয়ে অনিতা মনে করেন, তাইহোকু বিমান দুর্ঘটনায় সুভাষচন্দ্রের মৃত্যুর সম্ভাবনাই সব চেয়ে বেশি। তবে তাঁর মৃত্যু নিয়ে বিতর্ক মেটাতে টোকিওর রেনকোজি মন্দিরে রাখা চিতাভস্মের ডিএনএ পরীক্ষা করা উচিত বলে মনে করেন তিনি। ওই চিতাভস্ম আদৌ নেতাজির নয় বলে দাবি অনেক শিবিরের। অনিতার মতে, ‘‘ডিএনএ পরীক্ষা হলে কিছু প্রমাণ পাওয়া যেতে পারে। তবে হাড় যদি বেশি পুড়ে গিয়ে থাকে তা হলে ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করা সম্ভব নাও হতে পারে।’’

জিডি খোসলা কমিশন লিখেছিল, “From the evidence discussed above, I am convinced beyond all reasonable doubts that the wooden casket lodged in the Renkoji Temple at Tokyo contains Bose’s ashes and these ashes were placed in the box at Taipei after the cremation of his dead body। “

১৯৯৯ সালে গঠিত বিচারপতি মনোজ কুমার মুখার্জির নেতৃত্বে মুখার্জি কমিশন অবশ্য সিদ্ধান্তে পৌছয় যে তাইপে বিমান দুর্ঘটনায় নেতাজির মৃত্যু হয়নি এবং রেনকোজি মন্দিরে রাখা সেই দেহভস্ম নেতাজির নয়। তবে নেতাজির মৃত্যু কীভাবে হয়েছিল বা নেতাজি এখনও বেঁচে আছেন কিনা সেই ব্যাপারে মুখার্জি কমিশন কোনও আলোকপাত করতে পারেনি। 

নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু সংক্রান্ত একাধিক ফাইল প্রকাশ করেছে কেন্দ্রীয় ও পশ্চিমবঙ্গ সরকার। সেই সব ফাইলে নেতাজি অন্তর্ধান রহস্যের কিনারা হওয়ার মতো কোনও তথ্যই মেলেনি। হতাশ হন সুভাষচন্দ্র বসুর পরিবার ও আমজনতা। এর পর বসু পরিবারের পক্ষ থেকে দাবি করা হয় নেতাজির চিতাভস্মের ডিএনএ পরীক্ষার। একইসঙ্গে জাপান সরকারের কাছে নেতাজি সংক্রান্ত তিনটি অপ্রকাশিত ফাইল সামনে আনারও দাবি জানান নেতাজির প্রপৌত্র চন্দ্র বসু।

বসু পরিবার জাপানের রেনকোজি মন্দিরে রক্ষিত চিতাভস্ম নিয়ে একটা সিদ্ধান্তে আসতে চান। চন্দ্র বসু বলেন, “আমরা পরিবারের পক্ষ থেকে একটি চিঠি দিয়েছি প্রধানমন্ত্রীকে। যে চিতাভস্ম রেনকোজি মন্দিরে রাখা আছে, বলা হয় ওই চিতাভস্ম নেতাজির। কিন্তু এখনও পর্যন্ত তার কোনও প্রমাণ সামনে আসেনি। এখন বিজ্ঞান অনেক উন্নত হয়েছে। আমরা প্রধানমন্ত্রীর কাছে অনুরোধ করেছি যাতে ওই চিতাভস্মের ডিএনএ পরীক্ষার ব্যবস্থা করা হয়। তাতে ওই চিতাভস্ম আদৌ নেতাজির কিনা তার ইঙ্গিতও মিলতে পারে।”

তিনি বলেন, “নেতাজি-কন্যা অনিতা বসু পাফ, ভাইপো দ্বারকানাথ বসু ও অর্ধেন্দু বসু যৌথভাবে প্রধানমন্ত্রীর কাছে এই পত্র পাঠিয়েছেন। আমি সেই চিঠি পৌঁছে দিয়েছি।” এরকম বিতর্কের মধ্যেই প্রশ্ন ওঠে, রেনকোজি মন্দির ১৯৮৯ সালে আগুনে ভস্ম হয়ে গিয়েছে। সেক্ষেত্রে সেখানে রক্ষিত নেতাজির তথাকথিত “চিতাভস্ম” আজও সুরক্ষিত থাকে কিভাবে?

কিন্তু চন্দ্রবাবুর কথায়, “আমার দাদা সূর্য বসু ২০১৯-এর শেষদিকে জাপানে গিয়ে রেনকোজি মন্দিরের পুরোহিতের সঙ্গে কথাও বলেছেন। মন্দিরের পুরোহিত বলেছেন তাঁদের চিতাভস্ম দিতে কোনও আপত্তি নেই। অনিতা পাফ বলেছেন, সরকার যদি উদ্যোগ নিতে চায়, আমরা বসু পরিবার নিজেদের খরচায় ডিএনএ পরীক্ষার ব্যবস্থা গ্রহণ করব।” উল্লেখ্য, প্রথা অনুযায়ী জাপানীদের শেষকৃত্যের সময় সম্পূর্ণভাবে দাহ করা হয় না। সেক্ষেত্রে ভস্ম থেকে ডিএনএ-র উপাদান মিললেও মিলতে পারে।

চন্দ্রবাবুর ধারনা, “১৯৪৫ -এ বিমান ভেঙে পড়েছিল। কিন্তু তাতে নেতাজির মৃত্যু হয়নি। তিনি হাসপাতালে গিয়ে সুস্থ হয়েছিলেন। রাশিয়া যাওয়ার পরিকল্পনাও করেছিলেন। তখন তাঁকে হত্যা করা হয়েছিল।”

 মার্চ ৮, ২০০৭ তারিখে ডিএনএ (ইংরেজি দৈনিক) লিখছে, “MEA has informed Delhi-based Mission Netaji that the alleged ashes and remains of the freedom fighter are still in Tokyo’s Renkoji temple….In a letter dated March two this year, Additional Secretary Ajai Choudhary of the external affairs ministry informed Mission Netaji that “as far as the ministry was aware the alleged ashes and remains are still at the Renkoji temple।“

নেতাজীর বিমান দুর্ঘটনার এই রকম দীর্ঘ বিতর্কে প্রতি ২৩ জানুয়ারি একটা মাত্রা বৃদ্ধি পায়। এবারে নেতাজীর ১২৫ বছরে বিষয়টি নিয়ে আরও আলোচনা হচ্ছে। কিন্তু এই তদন্তে আদৌ কোনও দিন সমাধান হবে কিনা, হলে কবে তাতে দাঁড়ি পড়বে, তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে ওয়াকিবহাল মহলের।

ঋণ— ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস (২৩-১-২০২০), বাংলা, আনন্দবাজার পত্রিকা (২৭-১-২০১৬), বঙ্গদর্শন (১৮-৮-২০১৯)। 

অশোক সেনগুপ্ত

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.