ভারতের প্রতিটি সংসদীয় নির্বাচনের সময়েই আবেগের এক তুঙ্গি বিস্ফোরণ ঘটে থাকে। এবারের গ্রীষ্মকালীন গণতন্ত্রের এই উৎসবেও তার কোনো ব্যতিক্রম হবে না। তবুও গণস্ফুর্তি স্বভাবতই যেহেতু দ্রুত বিস্মরণ পথচারী এবং সঙ্গে মিডিয়ার তিলকে তাল করে তোলা কর্ণভেদী প্রচার রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতাকে আজকাল প্রাচীন গ্রিক গ্লাভিয়েটরদের পারস্পরিক মরোন্মুখ লড়াইয়ের পর্যায়ে এনে ফেলেছে। রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে এমন এক মেরুকরণের আবহ তৈরি করা হয়েছে যাতে মনে হতে পারে এমন হয়তো অতীতে কখনও হয়নি। এর ফলস্বরূপ যে সমস্ত ছোটোখাটো মতপার্থক্য যুক্তিসঙ্গত ভাবে মিটে যেতে পারত সেগুলি উল্টে নতুন বিভেদের জন্ম দিল। বাহ্যিক স্তর থেকে অন্তত এটা নিশ্চিত করে বলা যায় সমসাময়িক ভারতের একটা বিশেষ অংশ নিজের মতামতের প্রতিধ্বনি-ঘরে বসবাসে স্বাচ্ছন্দ্য অনুভব করে। সেখানে নিশ্ছিদ্র ব্যবস্থা ও বিরোধী মতের ‘প্রবেশ নিষেধ’ বোর্ড ঝুলছে। তারা অনেকটাই স্বয়ম্ভূ প্রজাতির। এই উদারবাদীদের জীবনশৈলী অবিসংবাদিত ভাবে বিশ্ব নাগরিকের হাবভাবে ভরা। এঁরা কিন্তু ১০০ শতাংশ মতৈক্যে পৌঁছেছেন যে, ভারতবাসী যেন এবার কায়মনোবাক্যে মোদীকে হারানোর জন্য ভোট দেয়। মোদীকে তাড়ানোর জন্য এই যে বিপুল উদ্দীপনা তা কিন্তু তার বিকল্প হিসেবে কোন নড়বড়ে জোট উঠে আসবে তা নিয়ে চিন্তা করার ব্যাপারে আদৌ নজরে পড়ছে না। তারা পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে দেশে যে-কোনো ধরনের অস্থিরতাকে মেনে নিতে সর্বাংশে রাজি যদি তাদের চোখে এই দানবকে হটানো যায়। মূল বিষয়টি হলো, এদের যে যূথবদ্ধ ‘ভারত কল্পনা’ (আইডিয়া অব ইন্ডিয়া) তা আজ নিদারুণ সংকটাপন্ন প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠে এসেছে ‘হিন্দু ভারত কল্পনা’। পিঠ বাঁচাতে তারা যে সংবিধান রক্ষার দোহাই দিচ্ছেন বা দেশের বিভিন্ন ঐতিহ্যমণ্ডিত প্রতিষ্ঠানগুলিকে ধ্বংসের হাত থেকে সংরক্ষণের আর্তনাদ করছেন তা আদতে উল্লেখিত দুটি ধারণা যে কোনোদিনই মিলতে পারে না তারই সংকেত। তারা তাই চান এসপার-ওসপারের লড়াই।
উল্টো দিকে যুযুধান চৌকিদারের সৈন্যদল ও তার বিশাল ভক্তবাহিনী, যারা বিশ্বাস করে তাদের নেতা মোদীর নেতৃত্বে ভারত আজ এক মহান উচ্চতার শিখর স্পর্শের সন্ধিক্ষণে। সে কারণে ২০১৪ সালে যে সমস্ত পরিকল্পনাগুলি শুরুর পর আজ বেগবতী হয়ে উঠছে। তিনি না থাকলে সেগুলি সবই স্তব্ধ হয়ে যাবে। দেশ হয়ে পড়বে পশ্চাদপদ। বিগত পাঁচ বছরের অর্জিত কর্মক্ষমতা ও সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যের অভিমুখ উধাও হয়ে যাবে।
এঁরা দৃঢ় বিশ্বাস করেন মোদীর পুনর্নির্বাচন একটি জাতীয়তাবাদী প্রকল্প যার সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িয়ে আছে ভারতের ক্রমোন্মোচিত নিয়তি। এই নির্দিষ্ট অবধারণার পশ্চাৎপট হিসেবে গণমানসে কাজ করছে এক অনাস্বাদিত মুক্তির অনুভব। হাজার বছরের দাসত্বের তন্তুজাল ছিঁড়ে অবশেষে নিজেকে আবিষ্কার করার মধ্যে যে পূর্ণতার অনুরণন প্রবহমান তাকে অটুট রাখতে ও লালন করতে এই গরিষ্ঠাংশ আজ মরিয়া।
এর মধ্যে আবার একটি শ্রেণীগত ও সংস্কৃতিগত দিক রয়েছে। এই সূত্রে ১৯৬৭ সালে পণ্ডিত নীরদচন্দ্র চৌধুরী তাঁর একটি পর্যবেক্ষণ দিয়েছিলেন। তিনি ঐতিহ্যগতভাবে হিন্দু মধ্যবিত্ত শ্রেণীর ওপর এক প্রজাতির নবীন বুদ্ধিজীবীদের আধিপত্যবাদের সূচনা লক্ষ্য করেছিলেন। অবলোকনটি ছিল তাঁর কথায় ‘মধ্যবিত্ত শ্রেণীরই নবীন বুদ্ধিজীবী গোষ্ঠী প্রাচীনপন্থীদের সম্পর্কে ছিলেন সম্পূর্ণ অজ্ঞ। তাঁদের এই অজ্ঞতা কেউ ধরিয়ে দিলে তাঁরা অন্যদের তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিতেন।’ হয়তো …এমনটা মনে হয় যে এই নবীন বুদ্ধিজীবীরা নিরন্তর চেষ্টা করে দেশের চিরন্তন মধ্যবিত্ত শ্রেণী সম্পর্কে একটি বাহ্যিক মূল্যায়ন করেছিলেন। ঠিক যেমন কোনো ইউরোপীয় বা মার্কিনি আমাদের দেশে বসবাস করলে সাধারণত তাদের ওপর করে থাকে। এর পরিণতিতে নবীন বুদ্ধিজীবীদের ঘোষিত ধ্যানধারণাগুলি প্রত্যাশিত ভাবেই চিরায়ত প্রাচ্য দেশীয়দের চিন্তাদর্শের কাছে দুর্বোধ্য থেকে গেছে। তাঁরা এই পাশ্চাত্য ঘরানার ভারতীয়দের নিজ সংস্কারচ্যুত বা তস্কর প্রজাতির মনে করতেই পারে।
নীরদবাবুর এই পর্যবেক্ষণ পুনর্মূল্যায়নের দাবি রাখে। আজকে নরেন্দ্র মোদীকে যেভাবে তুমুল মেরুকরণের পুরোধা হিসেবে দাগিয়ে দেওয়া হচ্ছে তা অত্যন্ত সুবিধাবাদী অবস্থান। দেশের অভ্যন্তরে সংস্কৃতিগত বিভাজন বিগত ৫০ বছর ধরে দিব্যি বিদ্যমান ছিল। মোদীর উত্থানে যেটা হয়েছে যে নবীন বুদ্ধিজীবীদের উল্লেখ নীরদবাবু করেছিলেন তারাই কালক্রমে প্রচলিত তথা প্রবীণ বুদ্ধিজীবী ও মতামত নিয়ন্ত্রকের ভূমিকা নেওয়ায় আজ হতবুদ্ধিকর অবস্থায় পড়ে গেছেন। অসহায় বোধ করছেন।
অতীতের সেই স্বর্ণিল সময়ে যখন তারা একই সঙ্গে রাজনৈতিক ক্ষমতাধর হয়ে উঠে দেশের ধুতি পরিহিত শ্রেণীকে তীব্র ঘৃণার চোখে দেখতেন তারাই আজ যেনতেনপ্রকারেণ এটা বোঝাতে আলুথালু হয়ে যাচ্ছেন যে তারাও আসলে দেশের নাড়ির সঙ্গে সংযুক্ত। এই তীব্র হতাশা ও তার নিদান হাতড়াতে এক ভাই-বোনের জুড়িকে হিন্দু মন্দিরগুলিতে ঝাঁপিয়ে পড়তে দেখা যাচ্ছে।
দ্বিতীয়ত, ১৯৯১ সালে শুরু হওয়া সংস্কার প্রক্রিয়ার ফলস্বরূপ দ্রুত অর্থনৈতিক বৃদ্ধি ও সমৃদ্ধি হস্তগত হওয়া শুরু হওয়ায় চিরাচরিত হিন্দু ঐতিহ্যবাদের মধ্যে এসেছে নাটকীয় পরিবর্তন। এর মধ্যে সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ হলো উপযুক্ত সুযোগ পাওয়ার কারণে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর বাড়বৃদ্ধি বা প্রসারণ। নবীন হিন্দু প্রজন্মের প্রতিনিধিরা অত্যাধুনিক পেশার চাকরিতে সফল ভাবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেছে। সর্বাধুনিক প্রযুক্তির প্রতি তাদের বিপুল আগ্রহ। একই সঙ্গে তাঁরা দেশের চিরন্তন মূল্যবোধগুলির প্রতি দায়বদ্ধ ও জাতীয়তাবাদী চিন্তাধারার প্রতি আস্থাশীল।
এই ঐতিহ্যগত দায়বদ্ধতা ও জাতীয়তাবাদী মানসিকতা তাদের গভীরভাবে আত্মবিশ্বাসী করে তুলেছে। মোদী এই নবোত্থানেরই মুখ। কী বেঙ্গালুরুর আনকোরা প্রযুক্তিবিদদের কাছে, কী সেই অকুতোভয় দেশীয় ১৩১ জন চাটার্ড অ্যাকাউন্টেটের কাছে যারা সদর্পে ঘুরে দাঁড়িয়ে ১০৮ জন তথাকথিত অর্থনীতিবিদদের তথ্য ও তত্ত্বকে লহমায় নস্যাৎ করে বলেছিলেন ‘এঁরা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে বিশ্বের কাছে ভারতের বিশ্বাসযোগ্যতাকে নষ্ট করে দেশকে কালিমালিপ্ত করতে চায়। এটিই মোদীইফেক্ট।
তার নিবন্ধের উপসংহারে নীরদবাবু এই দ্বিপাক্ষিক বিরোধের (পশ্চিমি ধ্যানধারণার বুদ্ধিজীবী ও দেশীয় মধ্যবিত্ত শ্রেণীর ঐতিহ্যবাদীদের) পরিণতির একটি সম্ভাব্য ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন। তিনি বলেছেন লড়াইয়ের পরিসমাপ্তি তখনই ঘটবে–‘could be brought about only by the complete subordination of the one to the other.’
এই প্রসঙ্গে ১৯৬৭-র সাধারণ নির্বাচনের পর তিনি উল্লেখ করেছিলেন ঐতিহ্যবাদীরা ক্রমশ শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। তার মনে হয়েছিল কালক্রমে ভারতীয় জনজীবনে এই মতাবলম্বীরাই নির্ণায়ক হয়ে ওঠার সম্ভাবনাময়।
এই নির্ণায়ক শক্তি হয়ে উঠতে খুব বেশি সময় যে লাগবে না তাও তার লেখায় এসেছিল। বলা দরকার, ১৯৪৭ সালে শুরু হওয়া বৌদ্ধিক যুদ্ধের মীমাংসা একটি সাধারণ নির্বাচনে হওয়া সম্ভব নয়। তবে, এটা নিশ্চিত মোদী দ্বিতীয় দফা ক্ষমতায় ফিরলে দেশের বৌদ্ধিক চর্চার পরিমণ্ডলে পরিবর্তন ঘটবে এবং বিগত পাঁচ বছর ধরে চলা অন্তহীন একপেশে ধারাভাষ্য বন্ধ হবে।
স্বপন দাশগুপ্ত