১৯৮৬ সালে আমেদাবাদ পৌর নির্বাচনে প্রথমবার জেতে বিজেপি এবং এই জয়ের অন্যতম রূপকার ছিলেন নরেন্দ্র মোদীই। সে সময় সমাজতাত্ত্বিক আশিস নন্দী ও অচ্যুত যাজ্ঞিক মোদীর একটি সাক্ষাৎকার নেন। আশিস নন্দী লিখেছিলেন, “আমি কেঁপে উঠেছিলাম। সাক্ষাৎ শেষে বেরিয়ে এসে আমি যাজ্ঞিককে বলেছিলাম, এই প্রথম আমি ধ্রুপদী এক ফ্যাসিস্তের সঙ্গে কথা বললাম, সম্ভবত এক ঘাতক, সম্ভবত ভবিষ্যতের এক গণহত্যাকারীর সঙ্গে আমি কথা বললাম। ফ্যাসিস্ত শব্দটা আমি গালিগালাজ হিসেবে ব্যবহার করছি না, মতাদর্শ এবং সেই মতাদর্শকে প্রেক্ষাপটে রেখে ব্যক্তিত্বের বৈশিষ্ট্য ও উদ্দেশ্যের ধরন যুক্ত করেই বলছি।”সাংবাদিক নীলাঞ্জন মুখোপাধ্যায় মোদী সম্পর্কে তার প্রায় গবেষণাগ্রস্থ নরেন্দ্র মোদী :দ্য ম্যান, দ্য টাইমস’ গ্রন্থে একটা ইঙ্গিত দিয়েছেন, প্রশ্ন করা যাবে না, এটাই মোদীর চরিত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। একথা মোদীর সঙ্গে যাঁরা কাজ করেছেন তারা প্রায় সকলেই জানেন। শ্রীমুখোপাধ্যায় লিখছেন : “গুজরাটে ঘোরার সময় এটি সবচেয়ে ভালোভাবে সামনে এসেছে। এই বইয়ের জন্য গবেষণা করতে গিয়ে আমি যাঁদের সঙ্গে কথা বলছি, সকলেই একটাই অভিমত দিয়েছেন—নিজের দৃষ্টিভঙ্গি ছাড়া অন্য কোনও ধারণার কথা মোদী শুনতে পছন্দ করেন না। স্বৈরতন্ত্রী, তিনি তার সহকর্মীদের কাউকে উত্থানের সুযোগ দেন না যাতে কেউ তার সামান্যতম বিপদও ঘটাতে না পারে। অধিকাংশ মানুষই বলেছেন, তিনি মূলগতভাবে একটা নিরাপত্তার অভাবে ভোগেন। এটাতার চরিত্রের অন্যতম ত্রুটি। আর ভোগেন বলেই তার চারপাশের মানুষজনদের কাছ থেকে তিনি অনুগত্য দাবি করেন, আনুগত্য অর্জনও করেন। আমি যাঁদের সঙ্গে কথা বলেছি, তাঁদের অধিকাংশই একটা ব্যাপারে একমত যে ‘মোদী সবচেয়ে কম গণতান্ত্রিক নেতাদের অন্যতম।
তৎকালীন জি নিউজ চ্যানেলে কর্মরত সাংবাদিক সুধীর চৌধরী ২০১২ সালের গুজরাট গণহত্যার পর গান্ধীনগরের সার্কিট হাউসে মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর দশ মিনিটের সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন এবং প্রচার করেছিলেন মোদীর বক্তব্যের একটি অংশ : ‘ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া কি চেন চল রহি হ্যায়’। বাঙ্গলায় যার অনুবাদ করা হয়েছিল সব ক্রিয়ারই একটা প্রতিক্রিয়া হয়। সেটাই চলছে। অর্থাৎ বোঝানো হয়েছিল, গুজরাটের গোধরায় ৫৯ জন হিন্দু করসেবককে ট্রেনের কামরায় পুড়িয়ে মারার প্রতিক্রিয়াই হলো ২০১২-র দাঙ্গা।
আন্তর্জাতিক পুরস্কারে ভূষিত বিখ্যাত লেখিকা এবং সমাজকর্মী অরুন্ধতী রায় তখন প্রচার করেছিলেন, এক অন্তঃসত্তা মুসলমান মহিলাকে খুন করে তার পেট চিরে জঠরস্থ জ্বণটিকে বার করে টুকরো টুকরো করে চিরে রাস্তায় ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল।
নরেন্দ্র মোদীর বিরুদ্ধে এই একচেটিয়া প্রচারগুলি কতটা ঠিক আর কতটা বেঠিক তা গবেষণার সময় বোধহয় গবেষকরা পাননি। এবং সেই সম্পূর্ণ একপেশে মতামত ও তথ্যগুলিকে সামাল দিতে হয়েছিল নরেন্দ্র মোদীকে তার শক্ত চোয়াল, নির্নিমেষ চাহনি এবং ক্ষুরধার মস্তিষ্কের তীব্র ঝলকানি দিয়েই।
যেমন সুধীর চৌধরীর ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার কাহিনি। সেদিনের সাক্ষাৎকারে আসলে মোদী কী বলেছিলেন ? দেখে নেওয়া যাক। গোটা বাক্যটি ছিল এরকম : ‘ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া। (‘A chain of actionreaction is going on. We want that both should stop, neither action, nor reaction should continue.’ Role প্রচার হয়েছিল শুধু প্রথম বাক্যটিই। উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবেই।
অরুন্ধতী রায়ের কাহিনি আরও মারাত্মক। অভিযোগ নিয়ে তদন্তের সময় যখন কোনও প্রমাণই মিলল না, তখন তদন্তে সাহায্য করার জন্য পুলিশ অরুন্ধতী রায়ের সাহায্য চান। তিনি তখন তার আইনজ্ঞদের দিয়ে উত্তর পাঠান, পৃথিবীর কোনও শক্তিই তাকে জোর করে পুলিশের ডাকে সাড়া দেওয়াতে পারবে না। এমনকী তিনি আরও অভিযোগ করেছিলেন— দাঙ্গায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত গুলবার্গ আবাসনে এহসান জাফরির সঙ্গে তার দুই মেয়েকেও খুন করা হয়েছে। পরে আমেরিকা নিবাসী জাফরি-পুত্র চিঠি লিখে জানিয়েছিলেন, এহসান জাফরির কন্যা সন্তান একটিই এবং তিনি আমেরিকায় তার কাছে নিরাপদেই আছেন। অরুন্ধতী রায় তখনও নির্বাক থেকেছেন।
সমাজতাত্ত্বিক আশিস নন্দী যে অভিযোগ এনেছিলেন, তার কি আদৌ কোনও যুক্তিগ্রাহ্য বাস্তবতা আছে। যদি সত্যিই তাই হতো, তাহলে ‘ধ্রুপদী ফ্যাসিস্ত’নরেন্দ্র মোদী তার আমলাদের ডেকে বলতেন না, ‘Don’t bother about punishment, in my office there will be no punishment. You have to take risk, you have to perform. If any problem arises, I am responsible.” বলতেন না,” “Gentlemen, there are no bad soldiers, only bad officers.”
2019-07-26