স্বামীজী ট্রেনে চলেছেন গাজীপুর থেকে কাশী । একটি তৃতীয় শ্রেণির টিকিট ছাড়া তাঁর কাছে আর যা আছে তা হল, একটা কম্বল, পরনে গেরুয়া আলখাল্লা আর হাতে একটি দণ্ড । কানাকড়ি নেই সঙ্গে । তিনি যে কামরায় এক কোণে বসে আছেন তার সবটুকু দখল করে চলেছে এক অর্থবান
বেনে । সঙ্গে তার কিছু ইয়ারবন্ধু ।
তারা স্বামীজীকে দেখেই বুঝল, এই তরতাজা সন্ন‍্যাসী না খেয়ে আছে । কিনে ছোলা খাবারও পয়সা নেই তার । বড়লোক বেনে বেশ মজা পেল স্বামীজীর এই দুর্দশা দেখে । সে তার ইয়ারদের নিয়ে স্বামীজীকে দেখিয়ে – দেখিয়ে নানা সুখাদ‍্য খেতে লাগল ।
খাওয়া–দাওয়া সেরে এবার তো জল খেতে হয়। স্টেশন থেকে জল কিনে খেল সেই বেনে আর তার বন্ধুরা ।
তেষ্টায় গলা শুকিয়ে গিয়েছে বিবেকানন্দের । তৃষ্ণার্ত সন্ন‍্যাসীকে দেখিয়ে– দেখিয়ে জল পান করার পর সুখ লাভ করল ধনী সহযাত্রী ।
ট্রেন বেশ কিছুক্ষণের জন‍্য থামল তাড়িঘাট স্টেশনে ।
সবাই নেমে গেল ট্রেন থেকে ।
স্বামীজীও নামলেন‍ । বসতে গেলেন প্ল‍্যাটফর্মে ছায়ার নীচে । চৌকিদার এসে তাড়িয়ে দিল । কী করবেন স্বামীজী ? তিনি প্ল‍্যাটফর্মের বাইরে কম্বলটি পেতে একটি খুঁটিতে হেলান দিয়ে চুপ করে বসে রইলেন ।
উত্তর ভারতীয় সেই বেনে স্বামীজীকে সহজে ছাড়বার পাত্র নয় । সে স্বামীজীর কাছেই একটি ছাউনির নীচে দামি সতরঞ্চি বিছিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে মজলিস করে বসে আবার ক্ষুধার্ত সন্ন‍্যাসীকে দেখিয়ে দেখিয়ে রীতিমতো ভোজ শুরু করে দিল ।।
এতেও সেই বেনের যথেষ্ট আহ্লাদ হল না । তখন সে বিবেকানন্দকে শুনিয়ে – শুনিয়ে বলতে লাগল, ওহে দেখছ ? এত সব খাবার–দাবার কেমন মজা করে খাচ্ছি ! আর তোমার কাছে তো জল কেনারও পয়সা নেই । এই ঠান্ডা জল যদি তুমি পেতে তোমার খিদে না যাক, তেষ্টা তো মিটত । এই দ‍্যাখো, আমি কেমন আরাম করে জল খাচ্ছি । রোজগার করতে জানতে হয়, বুঝলে ? রোজগারের ক্ষমতা নেই, তাই সন্ন‍্যাসী হয়েছ । এখন বোঝো পয়সার কী ক্ষমতা । ইচ্ছে করলেই আমি কিনে খেতে পারি । তোমার মতো খিদেয় জ্বলতে হয়
না ।
এসব কথা শুনেও বিবেকানন্দ এতটুকু রেগে গেলেন না । কোনও ক্ষোভ নেই তাঁর মুখে । যেন অন‍্য কিছু, অন‍্য কারও কথা ভাবছেন তিনি । তাঁর দৃষ্টি দূরের আকাশে—-যেন মনে- মনে কাউকে ডাকছেন ।
‘নরেন !’
সামনে দাঁড়িয়ে এক অতি সাধারণ মানুষ ।
কিন্তু মুখে তাঁর সেই হাসি ! শ্রীরামকৃষ্ণের হাসি মনে পড়ল বিবেকানন্দের ।
ইনিই কি ডাকলেন ‘নরেন’ বলে ! এ তো শ্রীরামকৃষ্ণের কণ্ঠস্বর !
সম্পূর্ণ অপরিচিত সেই মানুষটি তাঁর থলে থেকে বার করলেন নরেনের সব প্রিয় খাবার, ডাল, রুটি, তরকারি । একটি মাটির পাত্রে কত যত্নে সাজিয়ে দিলেন তিনি ! পাশে রাখলেন ঠান্ডা জল !
বিবেকানন্দর চোখ ঝাপসা হয়ে গেল কান্নায় ।
তাঁর কণ্ঠস্বর কান্নায় ঢাকা পড়ে গেল ।
বড় তৃষ্ণার্ত তিনি, হাত বাড়ালেন জলের দিকে ।
এ কী !
তাঁর ঝাপসা দৃষ্টির সামনে ক্রমে মিলিয়ে গেলেন সেই সম্পূর্ণ অপরিচিত মানুষটি !
বিবেকানন্দ কী করে ধরে রাখবেন তাঁর অবেগ, তাঁর কান্না ? তাঁর সমস্ত মনপ্রাণ বলে উঠল, হে রামকৃষ্ণ, কত বছর তুমি নেই, তবু আমাকে ছেড়ে যাওনি, ভুলে যাওনি ! কেন এত ভালবাসো আমাকে তুমি ?
ঠাকুর, আমি কেমন করে হব তোমার প্রেমের যোগ‍্য ?
মাঝে মাঝে মনে হয়, এ পৃথিবী বড় নিষ্ঠুর, এখানে ভালোবাসা নেই । হে রামকৃষ্ণ, তুমি ফিরে-ফিরে এসে মনে করিয়ে দাও, পৃথিবীতে ভালোবাসার মরণ নেই ।
বিবেকানন্দ বিস্মিত হয়ে তাকালেন মাটির থালা ভরতি খাবারের দিকে ।
এ তো দক্ষিণেশ্বরের ভবতারিণীর প্রসাদ !
সেই একই সুবাস—-ভবতারিণীর প্রসাদের সুগন্ধ নাকে লেগে আছে বিবেকানন্দর ।
তারিঘাট স্টেশনে দক্ষিণেশ্বরের ভবতারিণীর মহাপ্রসাদ !
সমস্ত প্ল‍্যাটফর্ম জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে সেই সৌরভ !
হৃদয়গহনে বিবেকানন্দ স্পষ্ট শুনলেন শ্রীরামকৃষ্ণের স্নেহময় কণ্ঠ, নরেন, খেয়ে নে । দেরি করিসনি । গাড়ি ছাড়বে এখুনি । কাশী এখনও অনেক দূর নরেন !

প্রণাম নাও ঠাকুর 🙏🏼🙏🏼🙏🏼
সংগৃহীত।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.