ভারতীয় শিল্পকে আলোকিত করেছে নন্দলাল বসুর আঁকা ‘দুর্গা’

নন্দলাল বসুর আজীবনের শিল্পচর্চা সমগ্র ভারতবাসীকে আলোকিত করেছে। পথ দেখিয়েছে নিত্য নতুন। আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল, শিল্পচর্চা কোন পথে চলবে তার হদিশ দিয়েছেন। সে পথ বিবিধ। তাই তাঁর শিল্পাচরণের আঙ্গিকও ভিন্ন ভিন্ন। সে জন্যেই তিনি আচার্য। এই স্বল্প পরিসরে নন্দলাল বসুর দুর্গা আঁকার গুটিকয় রকম স্মরণ করবো, যাতে করে তার এই প্রতিমা-রূপ কল্পনার একটা দিক নির্দেশ পাওয়া যায়।

নন্দবাবুর দুর্গা আঁকার পাশাপাশি স্মরণ করবো ভাস্কর সুনীল পালের দুর্গা-রূপ ভাবনার কিছু কথা। বাংলায় বহু শিল্পীরাই দুর্গা নিয়ে কাজ করেছেন। তবে প্রতিমা ভাবনার গোড়ার কথা, শিল্পীর নিজস্ব বোঝাপড়া নিয়ে অকপট স্বীকারোক্তি খুব কমই পাওয়া যায়। ‘কিছু স্মৃতিকথা কিছু শিল্প ভাবনা’ শীর্ষক লেখায় সুনীল পাল মহাশয়ের কথা স্মরণ করি – “আমাদের হিন্দু সমাজে দেবদেবীর প্রচলন আছে। শিব, শক্তি, বিদ্যা, শ্রী প্রভৃতি জীবনের এক এক আইডিয়ার, এক এক মহিমার, এক এক প্রতিমা, মানুষের জীবনে এই পূজা-পার্বণ, এই প্রাণের আনন্দ, এই ঋতু উৎসব, মানুষে মানুষে এই কাছে আসাআসি, সবই  শিল্পের সমারোহ। প্রতিমা গার্হস্থ্য শিল্পের অঙ্গ। শিল্প তার চরিত্র, রূপ নিয়ে সমাজ সংসারে ফিরে আসুক, এই কামনা নিয়েই আমি প্রতিমা গড়েছি।” –এই লেখা সুনীলবাবুর শিল্পসাধনার উপলব্ধির কথা। কিন্তু এরও একটা প্রাকসূত্র আছে।

সুনীলবাবুর গড়া পাথরের মূর্তির মতো, একেবারে যাকে বলে ক্লাসিক গড়ন, সেই ঢঙের দুর্গা প্রতিমার ছবি দেখে শিল্পগুরু অবনীন্দ্রনাথ মোটেই প্রসন্ন হননি। বলেছিলেন, “এ তো আর্ট ওয়ার্ক হল, প্রতিমা হল কই!” সুনীলবাবুর লেখনীতেই আছে, “পঁয়তাল্লিশ সালে ভবানীপুর কাঁসারিপাড়া অঞ্চলে আমি এক দুর্গা প্রতিমা গড়ি। পাথরের মুর্তি বলে লোকের ভ্রম হয়েছিল। দর্শকদের জন্য সাত দিন প্রতিমা প্যান্ডেলে রেখে দেওয়া হয়েছিল। অথচ তারই ফটো দেখে অবনীন্দ্রনাথ এক কথায় নাকচ করে দিলেন, নিরুৎসাহীত করলেন। আসলে আমার চোখ খুলে দিলেন। বুঝেছিলাম, কুমোরেরা যা করে তাই ঠিক। পার্বনে ক্লাসিক মূর্তি আড়ষ্ট বলে মনে হয়। পার্মানেন্ট ভ্যালু এক্ষেত্রে আর্টকে ভারাক্রান্ত করে তোলে।”

ঋজু এবং ভাস্কর্য সুলভ যে রেখাপাত নন্দবাবুর কাজে আমরা দেখি, তা ভারতীয় ভাস্কর্যকে গভীরভাবে নিরীক্ষণের ফল। পৌরাণিক মূর্তি আঁকার ক্ষেত্রেও, বিশেষ করে দুর্গা মূর্তি আঁকার সময়ে তা বিশেষ ভাবে দেখা যায়।

এই উপলব্ধির পর পর আমরা ওঁর অসামান্য প্রতিমাশিল্পের সঙ্গে পরিচয় লাভ করি। সেকথা পরে আলোচনা করা যাবে। নন্দবাবু এখন করেন কী, তা দেখার আছে। অবন ঠাকুর তো তাঁরও শিল্পগুরু। ভারতশিল্পের বা তথাকথিত ওরিয়েন্টাল আর্টের নবন্মেষের জন্য হ্যাভেল সাহেবের অনুরোধে ১৯০৫ সালে অবন ঠাকুরের যোগদান তৎকালীন গভর্নমেন্ট আর্ট স্কুলে। তিনি ডেকে নেন পুত্রবৎ প্রিয় শিষ্য নন্দলালকে। সেই শুরু। তারপর ১৯০৯ সালে ল্যাডি হ্যারিং হ্যামের আমন্ত্রণে অজন্তা যাত্রা। নন্দলালের সেই অজন্তা যাত্রা তাঁর শিল্পচর্চায় এক দীঘল ছায়া রচনা করে। চর্চায়, বোধে, দর্শনে, যাপনে ভারতশিল্প তার স্বমহিমায় বিকশিত হতে থাকে। ঋজু এবং ভাস্কর্য সুলভ যে রেখাপাত নন্দবাবুর কাজে আমরা দেখি, তা ভারতীয় ভাস্কর্যকে গভীরভাবে নিরীক্ষণের ফল। পৌরাণিক মূর্তি আঁকার ক্ষেত্রেও, বিশেষ করে দুর্গা মূর্তি আঁকার সময়ে তা বিশেষ ভাবে দেখা যায়। ইলোরার মূর্তি, মহাবলীপূরমের দুর্গা, অজন্তার অলংকার সবেরই ছায়া তাঁর দুর্গারূপ ভাবনায়। কম্পোজিশনে, দেহভঙ্গিমায়, অলংকারে ক্লাসিক আর্টের সম্মেলন যেন।

শিল্পচর্চার প্রবাহে ১৯৩৮ এক উল্লেখযোগ্য সময়। ওই বছর নন্দবাবু বাপুজির আমন্ত্রণে গুজরাটের হরিপুরায় কংগ্রেসের এক মিটিংয়ের জন্য প্যাভেলিয়নের নকশা করেন। ততদিনে ক্লাসিক আর্ট চর্চা নবরূপে বিকশিত হয়েছে তাঁর কাজে। রেখায়, রঙে সরলীকরণের ভাব। সে পৌরাণিক চরিত্রে হোক বা ম্যুরাল আঁকায় হোক। এই রূপ ভঙ্গিমা তাঁর দুর্গা আঁকাতেও ছায়াপাত ঘটায়। ভারতীয় ক্লাসিক আর্টকে বুনিয়াদ করে কীভাবে নবধারার জন্ম দেওয়া যায় নন্দবাবু তাঁর অন্যতম নিদর্শন। যে ভাবনা ভেবেছিলেন শিল্পগুরু অবনীন্দ্রনাথ, যে উপলব্ধি থেকে সুনীলকুমার পালের ক্লাসিক দুর্গামূর্তি নাকচ করেছিলেন, চোখ খুলে দিয়েছিলেন প্রতিমা রূপকল্পনার, তারই সার্থক বিচার যেন দেখি নন্দবাবুর দুর্গা আঁকায়। লেখার সঙ্গে কিছু চিত্র-নিদর্শন যুক্ত করলাম। পাঠক লক্ষ্য করবেন নন্দবাবুর মূর্তি অঙ্কনের সরলীকরণের ক্রমান্বয়।

শিল্পচর্চার প্রবাহে ১৯৩৮ এক উল্লেখযোগ্য সময়। ওই বছর নন্দবাবু বাপুজির আমন্ত্রণে গুজরাটের হরিপুরায় কংগ্রেসের এক মিটিংয়ের জন্য প্যাভেলিয়নের নকশা করেন। ততদিনে ক্লাসিক আর্ট চর্চা নবরূপে বিকশিত হয়েছে তাঁর কাজে। রেখায়, রঙে সরলীকরণের ভাব।

শেষে আর একটি ঘটনার উল্লেখ করি – এটা সুনীলবাবুর লেখা থেকে পাওয়া, পাশাপাশি আমাদের ক্ষেত্রসমীক্ষায় মিলিয়ে নেওয়া। “পঁয়তাল্লিশ সাল নাগাদ যখন প্রতিমা গড়ার অনুরোধ এল, সে সময় কুমারটুলির কাজ পড়ে এসেছে, বারোয়ারি পূজার ঘটায় শিল্পীদের চেয়ে খরিদ্দারের ফরমাশেই কাজ হচ্ছে। স্বভাবতই শিল্পরুচি ক্রমশ বাজারে হয়ে পড়েছিল। এই অবনতি রোধ করবার মানসে নিজে প্রতিমার দৃষ্টান্ত রচনা করবো এমন একটা অহংকার বা উৎসাহ জেগেছিল।”

শিল্পী জিতেন পাল নন্দবাবুর ড্রয়িং কেন্দ্র করে ভবানীপুরের ২৩ পল্লির প্রতিমা নির্মাণ করেন এবং নন্দবাবুর ড্রয়িং অনুসারে যে তা করা হয়েছে, সে কথা লিখে রাখেন প্রতিমার বেদিতে।

পরবর্তী ঘটনা, অর্থাৎ অবন ঠাকুরের নাকচ করার কথা আমরা জানি। পাশাপশি ওই কুমোরটুলিরই এক শিল্পী জিতেন পাল মনে করেছিলেন যে, পরম্পরা আশ্রিত শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে, আচার্যের স্মরণাপন্ন হতে হবে। তার নিদর্শনে তিনি নন্দবাবুর ড্রয়িং কেন্দ্র করে ভবানীপুরের ২৩ পল্লির প্রতিমা নির্মাণ করেন এবং নন্দবাবুর ড্রয়িং অনুসারে যে তা করা হয়েছে, সে কথা লিখে রাখেন প্রতিমার বেদিতে। এই ভাবেই নন্দবাবুর নির্দেশিত, আচরিত শিল্প ভারতশিল্পকে পথ দেখিয়ে আসছে বারংবার। তাঁর দুর্গারূপ কল্পনা সেই শিল্প যাত্রারই অন্যতম নিদর্শন।

©পার্থ দাশগুপ্ত

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.