আমার মুক্তি সর্বজনের মনের মাঝে দুঃখ বিপদ তুচ্ছ করা কঠিন কাজে

জোড়াসাঁকোতে প্রথম বিধবা বিবাহ হয় রথীন্দ্রনাথ এবং প্রতিমার। কবিগুরু এরপরে লাবণ্যলেখার বিবাহ দিয়েছিলেন প্রিয় শিষ্য অজিত কুমার চক্রবর্তী সঙ্গে । গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ইচ্ছে ছিল তাঁর নিজের পুত্রবধূ অর্থাৎ গেহেন্দ্রের বিধবা স্ত্রী মৃণালিনীদেবীরও বিবাহ দেওয়া। কিন্তু এব্যাপারে মৃণালিনীদেবীর প্রবল আপত্তি থাকায় সে কার্য সম্পন্ন করা সম্ভব হয়নি। তবে এক্ষেত্রে উদারতা ও এগিয়ে আসার সাহস মস্ত বড় ভূমিকা নেয়। প্রতিমার ক্ষেত্রে যা ঘটেছিল অনেক ক্ষেত্রেই তা সম্ভব হয়নি।

কিশোরী প্রতিমা পূর্ব বিবাহে শ্বশুরগৃহ হতে অপয়া অপবাদ নিয়ে চলে এসেছিলেন। এই ঘটনার পাঁচ বৎসর পর রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিদেশ হতে ফিরে এলে রবীন্দ্রনাথ প্রতিমার পুনর্বিবাহের প্রস্তাব রাখেন। প্রতিমা জোড়াসাঁকো পাঁচ নম্বর বাড়ির দৌহিত্রী ছিলেন। অর্থাৎ ধরতে গেলে অবন- সমর-গগনের ভাগ্নী। কবিপত্নী সৌদমিনীদেবীর এই ফুটফুটে নাতনীটিকে বড় স্নেহ করতেন। আপনা পুত্রবধূ করার বাসনা মনে মনে পোষন করে রেখেছিলেন। তবে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ গোঁড়া ব্রাহ্ম হওয়াতে অন্যরা ঠাকুর বাড়ির সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্ক রাখেন নি। ঠাকুর পরিবারের নিয়ম ছিল নিকট সম্পর্কের কিন্তু রক্তের সম্বন্ধহীন বিবাহ। যাই হোক, কবিপত্নী মৃণালিনীদেবীর মনের সুপ্ত বাসনার কথা রবি ঠাকুর জানতেন এবং পূর্ণ সমর্থন করতেন।

কিন্তু দুঃখের ২২ শে শ্রাবণ কবিপ্রিয়া মৃণালিনীদেবী অকালে চলে গেলেন। প্রতিমা বড় হচ্ছেন। সে সময় তো মেয়েদের ১০ কি ১১ তে বিবাহ দিয়ে দিতেই হতো। প্রতিমার ক্ষেত্রেও তার অন্যথা হল না। উভয় বাড়িই বনেদী। এদিকে রবীন্দ্রনাথ বাল্য বা কৈশোর বিবাহ একেবারেই পছন্দ করতেন না। এদিকে কবিপত্নীর পছন্দের কথা ভেবে প্রতিমার পরিবার বিবাহের বিষয়টি উত্থাপন করেন। কলকাতা তথা বঙ্গের অভিজাত , উচ্চমধ্যবিত্ত এবং মধ্যবিত্ত সমাজে গুজব রটে যায় যে ১৩১০ সনের ফাল্গুন মাসেই রবীন্দ্রনাথ পুত্রের বিবাহ দিচ্ছেন।

রবীন্দ্রনাথ বাল্য বিবাহ দেবেন না যে কথা পরিষ্কার জানিয়ে দিলে, কন্যার পরিবার কবির এই বাক্যকে অসম্মতি সূচক ধরে নিয়ে মেয়ের বিবাহ স্থির করলেন গুণেন্দ্রনাথের ছোট বোন কুমুদিনীর ছোট দৌহিত্র নীলনাথের সঙ্গে। বিবাহের সময় প্রতিমার বয়স ছিল ১১ বৎসর। ফাল্গুন মাসেই প্রতিমার বিবাহ হল। বৈশাখের শুভদিন দেখে প্রতিমার শ্বশুরগৃহের লোকেরা তাঁকে নিয়েও গেলেন। কিন্তু বিধাতার লিখন খণ্ডাতে পারলেন না। কয়েকদিন যেতে না যেতেই নীলনাথ গঙ্গায় সাঁতার কাটতে গিয়ে চিরতরে চলে গেলেন। অপয়া, ডাইনী এসব শুনে প্রতিমা পিতৃগৃহে চলে আসেন।

রবীন্দ্রনাথের মৃণালিনীদেবীর হৃদয়ের বাসনার কথা জানাই ছিল। তাই বিধবা প্রতিমাকে আপন পুত্রবধূ করতে কিঞ্চিৎ দ্বিধা বোধ করেননি। রবীন্দ্রনাথ বাল্য বিধবাদের দুর্বিষহ জীবন নিয়ে বড়ই কষ্ট পেতেন। ঠিক এই সময়ে ঢাকা গুহঠাকুরতা পরবিবারের মেয়ে লাবণ্যলেখাও বিধবা হয়ে ফিরে এলেন।

কন্যাসমা মেয়েগুলির জীবন কি আবার নতুন করে গড়ে দেওয়া যায় না ? মহর্ষিও জীবিত নেই। কবি পূর্ব সংস্কারের অচলায়তন ভাঙ্গবার জন্য প্রস্তুতি নিলেন। তিনি যদি আপন বাসে আপন পুত্রের সঙ্গে বিধবার বিবাহ না দেন তবে সমাজ তা দেবে কেন?

বেজে ওঠে পঞ্চমে স্বর,
কেঁপে ওঠে বন্ধ এ ঘর,
বাহির হতে দুয়ারে কর
কেউ তো হানে না।
আকাশে কার ব্যাকুলতা,
বাতাস বহে কার বারতা,
এ পথে সেই গোপন কথা
কেউ তো আনে না।
তুমি ডাক দিয়েছ কোন্‌ সকালে
কেউ তা জানে না।।

একদিন তিনি গগনেন্দ্রকে তার মনের কথা জানালেন – ” তোমাদের উচিৎ প্রতিমার পুনশ্চ বিবাহ দেওয়া। বিনয়িনীকে বলো যেন কোনরূপ অমত না করেন। মেয়েটার জীবনে কিছুই হল না।এই যে বয়স , তাতে চারিদিকের প্রলোভন কাটিয়ে ওঠা অসম্ভব। এখন মা – বাপ জীবিত, তারপর? ভাইদের সংসারে কৃপাপ্রার্থী হয়ে থাকবে সেইটাই কি তোমাদের কাম্য? না , বিবাহ দেওয়া ভালো, বুঝে দেখ।”

উদার হৃদয় গগনেন্দ্রনাথ তখনই রাজি। কিন্তু সমাজ? তারা কি বলবে? এই সমাজ কি সম্মতি দেবে? বিদ্যাসাগর ১৮৫৬ সালে বিধবা বিবাহকে কাগজে কলমে এবং শাস্ত্রে বৈধ প্রমাণ করে গেছেন। সমাজ সংস্কারের হিড়িকে কিছু বিধবা বিবাহও হয়েছে। কিন্তু সমাজ কি মেনে নিয়েছে? বিনয়িনী হাত জোড় করে রবি ঠাকুরকে বললেন , ” আমাকে সমাজ একঘরে করবে। আমার যে আরো সন্তান আছে। তাদেরও বিয়ে দিতে হবে।”

কিন্তু ভয় পেলেন না গগনেন্দ্র। বললেন , ” তোমাদের ভয় নেই । তোমাদের পিছনে আমি আছি। যদি সমাজ তোমাদের ত্যাগ করে , তবে আমিও সমাজ ত্যাগ করব। তাই বলে একটি বাচ্চা মেয়ের জীবন নষ্ট হতে দেওয়া যায় না। তুমি অমত করো না। এখন প্রতিমার মত নেওয়া দরকার। তাকে বোঝানো প্রয়োজন। “

সংস্কার সকলের মনেই থাকে। প্ৰতিমা প্রথমে রাজি হননি। মনে নানান অজানা আশঙ্কা। গগনেন্দ্র অনেক বুঝিয়ে তাঁকে রাজি করান। বললেন , ” যা তোর সঙ্গে হয়ে গেছে তা স্বপ্ন ভাবিস। তোকে নতুন জীবন আরম্ভ করতে হবে।”

জ্যোতিরিন্দ্রনাথ তাঁর ডায়রিতে লিখেছিলেন , ” সমর, গগনদের সঙ্গে রথীর বিবাহ নিয়ে কথা হল – ওরা এবার খুব সাহস দেখিয়েছে।”

এই শুভ বিবাহে বহু বাঁধা এসেছিল।আপত্তি জানিয়েছিলেন কুমুদিনীর পরিবার। পরবর্তীকালেও পারিবারিক কোনো ভোজসভায় তাঁরা প্রতিমাকে দেখলেই সেখান থেকে তাচ্ছিল্য ভরে চলে যেতেন। সমাজকে অগ্রাহ্য করেই গগনেন্দ্রনাথ এবং রবীন্দ্রনাথ দাঁড়িয়ে থেকে এই বিবাহ সম্পন্ন করলেন। সেই সময়ের সমাজের শাস্ত্রজ্ঞ রবি ঠাকুর বা গগন ঠাকুরকে উপেক্ষা করার বিন্দুমাত্র ক্ষমতা ছিল না। জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির অচলায়তন ভেঙ্গে প্রথম বিধবা বিবাহ সুসম্পন্ন হল। তবে এইটি জোড়াসাঁকোর প্রথম বিধবা বিবাহ হলেও ঠাকুরবাড়ির ক্ষেত্রে প্রথম নয়। এর কিছুদিন পূর্বেই পাথুরিয়াঘাটার ঠাকুরবাড়িতে ছায়ার পুনর্বিবাহ হয়। সেখানেও পাত্র খোঁজায় রবীন্দ্রনাথের হাত ছিল।

কঠিন লোহা কঠিন ঘুমে ছিল অচেতন
ও তার ঘুম ভাঙাইনু রে!
লক্ষযুগের অন্ধকারে ছিল সংগোপন
ওগো, তায় জাগাইনু রে।
পোষ মেনেছে হাতের তলে,
যা বলাই সে তেমনি বলে,
দীর্ঘ দিনের মৌন তাহার আজ ভাগাইনু রে।
অচল ছিল, সচল হয়ে
ছুটেছে ঐ জগৎ জয়ে,
নির্ভয়ে আজ দুই হাতে তার রাশ বাগাইনু রে।

ছায়া বা ছায়াময়ী ছিলেন দর্পনারায়ণ ঠাকুরের পুত্র হরিমোহনের উত্তরপুরুষ সতীন্দ্রমোহনের কন্যা। পারিবারিক সম্পর্কসূত্রে কবি পরিবারের সঙ্গে এঁদের যোগ না থাকলেও দূরত্ব ছিল না। রেণুকার অকাল মৃত্যুর পাঁচ বছর পর রবীন্দ্রনাথ তাঁর মধ্যম জামাতা সত্যেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যের সঙ্গে ছায়ার বিবাহ দেন। কারণ রেণুকার মৃত্যুর পরেও সত্যেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য শান্তিনিকেতন বা রবি পরিবার থেকে দূরে সরে যাননি। ১৯০৮ সালের ৮ ই জুন বিবাহ হয়। এ ব্যাপারে কবি কয়েকবার কন্যাপক্ষের বাড়িও যান। তিনি স্বয়ং বিবাহের অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। তিনি রথীন্দ্রনাথকে চিঠিতে লিখেছেন , ” বিয়ের অনুষ্ঠানের চুকে গেছে আজ সত্য তার নববধূকে সঙ্গে করে আমাদের এখানে এসেছে।” তিনি মৃত কন্যার শাড়ি, গহনা সব ছায়াকে যৌতুক দেন।

কিন্তু দুর্ভাগ্য ! সত্যেন্দ্রনাথ ২৬ শে অক্টোবর ইহলোক ত্যাগ করলেন। কবি বড় দুঃখ করে মনোরঞ্জন ভট্টাচার্যকে লিখেছিলেন , ” ….অদ্য মাস পাঁচ ছয় হইল আমিই চেষ্টা করিয়া তাহার বিবাহ দিয়েছিলাম। …. সত্যেন্দ্র তিন চার – দিন জ্বরে ভুগিয়া নববধূকে অনাথা করিয়া সংসার পরিত্যাগ করিয়া বিদায় লইয়াছেন। মৃত্যু লীলা অনেক দেখিলাম।”

সত্যেন্দ্রর কাকা নরেন্দ্র ভট্টাচার্যকে তাঁর ভাইপো মৃত্যুসংবাদ দিয়ে লিখেছেন , ” ছায়ার দুঃখের কথা।আমরা ভাবিয়া কিনারা পাইব না।ছায়ার বৈধব্য কবির মনে গভীর চাপ সৃষ্টি করে। এটিই ছায়াময়ীর প্রথম বিবাহ ছিল। তিনি যেন কিছুতেই দায় এড়াতে পারছিলেন না। মাত্র কয়েক মাসের বিবাহ কিরূপে ভবিতব্য হয়? কবি সতীন্দ্রমোহনকে কন্যার পুনরায় বিবাহ দেওয়ার জন্য উৎসাহিত করলেন।

১৯০৯ সালে ছায়ার পুনরায় বিবাহ হল। পাত্র ছিলেন নলিনীকান্ত চট্টোপাধ্যায়। তিনি ঢাকার প্রখ্যাত ব্রাহ্ম নবকান্ত চট্টোপাধ্যায়ের সুপুত্র। নবকান্তর কন্যা চারুবালার সঙ্গে বিবাহ হয় সুধীন্দ্রনাথ ঠাকুরের। নবকান্ত নিজেও প্রগতিশীল ছিলেন। তবে পুত্রের বিবাহের বহু পূর্বে ১৯০৪ সালে তিনি মারা যান। পিতার শিক্ষা পুত্রের মধ্যে সঞ্চারিত হয়েছিল বলাই বাহুল্য।

এই বিবাহে কবিগুরু অত্যন্ত খুশি হন এবং নিজে আচার্যের কাজ করেন। সে সময় সমাজ ও পরিবারে অবশ্যই এ নিয়ে আলোড়ন উঠেছিল। কিন্তু সতীন্দ্রমোহন অত্যন্ত সাহসী এবং স্বাধীনচেতা ব্যক্তি ছিলেন। তিনি যেমন মেয়েদের বাল্য বিবাহ দেন নি , তেমনি বিধবা বিবাহ দিতেও ভয় পাননি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সক্রিয় ভূমিকায় সামাজিক অবমাননার ভয় অনেকটাই কেটে গেছিল। ছায়াময়ীর দ্বিতীয় বিবাহের ফল বড় সুখের হয়েছিল। স্বামী সন্তান নিয়ে তাঁর সংসার ভরে উঠেছিল।

প্রতিমার সঙ্গেও পাথুরিয়াঘাটার ঠাকুরদের যোগ ছিল। তাঁর পিতা শেষেন্দ্রভূষণ প্রসন্নকুমার ঠাকুরের দৌহিত্র ছিলেন। সমস্ত সামাজিক বাধা অগ্রাহ্য করে প্রতিমা রবীন্দ্র – পরিবারের গৃহলক্ষ্মী হয়ে প্রবেশ করলেন। সত্যই তিনি ছিলেন মূর্তিমতী লক্ষ্মীশ্ৰী। শোনা যায় প্রত্যক্ষদর্শীদের নিকট নাকি তাঁর রূপের কাছে মাধুরীলতার রূপও নিষ্প্রভ হয়ে গিয়েছিল। তাঁর শান্ত, ধীর, স্থির ,সুপ্রসন্নভাব কবির হৃদয়ে মাতৃচিত্র রচনা করেছিল।

কবি চিঠিতে লিখলেন, ” …তোমাদের মধ্যে ও আমার সংসারের মধ্যেও সেই পবিত্র পরম পুরুষের আবির্ভাব বাধামুক্ত হয়ে প্রকাশ পাক এই আমার অন্তরের একান্ত কামনা। তোমার মনের মধ্যে সেই অমল সৌন্দর্যটি আছে – যখন তাঁর জ্যোতি সেখানে জ্বলে উঠবে – তখন তোমার প্রকৃতির স্বচ্ছতা ও সৌন্দর্যর মধ্য থেকে সেই আলো খুব উজ্জ্বল ও মধুর হয়ে প্রকাশ পাবে তাতে আমার সন্দেহ নেই। তুমিই আমার ঘরে তোমার নির্মল হস্তে পুণ্য প্রদীপটি জ্বালাবার জন্যে এসেছ – আমার সংসারকে তুমি পবিত্র জীবনের দ্বারা দেবমন্দির করে তুলবে এই আশা প্রতিদিনই মনের মধ্যে প্রবল হয়ে উঠছে।”

প্রতিমাই রবীন্দ্রনাথের শেষ বয়সের ” মা- মণি ” , তাঁর পরম আদরের ব্রাইড- মাদার বা বউমা। দীর্ঘ বত্রিশ বৎসর ধরে নিষ্ঠার সঙ্গে তাঁর সেবা করেছিলেন প্ৰতিমা। সেই সেবার ভার তিনি নিয়েছিলেন স্বেচ্ছায় ও সানন্দে। তারপর শান্তিনিকেতনে তাঁর প্রবেশ এবং বাকিটা ইতিহাস। সে ইতিহাস না হয় বলব আরেক দিন….. আজ মুক্তির আনন্দে গান গাই…

আমি কারে ডাকি গো
আমার বাঁধন দাও গো টুটে।
আমি হাত বাড়িয়ে আছি
আমায় লও কেড়ে লও লুটে।
তুমি ডাকো এমনি ডাকে
যেন লজ্জা ভয় না থাকে,
যেন সব ফেলে যাই, সব ঠেলে যাই,
যাই ধেয়ে যাই ছুটে।

তথ্যঃ ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহল

©দুর্গেশনন্দিনী

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.