আমাকে টান মারে রাত্রি জাগানো দিন

আমাকে টানে গূঢ় অন্ধকার

আমার ঘুম ভেঙ্গে হঠাৎ খুলে যায়

মধ্য রাত্রির বন্ধ দ্বার।

 বাংলাদেশের নদী বেষ্টিত জেলা বরিশাল। বরিশালের নদী বন্দর মুলাদিতে ৬দিন ধরে চলে হিন্দুদের উপর নির্মম গণহত্যা।

১৯৫০ সালের ফেব্রুয়ারি। মুসলিমরা গুজব ছড়ায় যে, “একে ফজলুল হককে কোলকাতায় হত্যা করা হয়েছে!” সাথে সাথে ঢাকায় গণহত্যা শুরু হয়। মুলাদি বসবাসরত হিন্দু ও খৃস্টানদের মাঝে তীব্র উত্কন্ঠা শুরু হয়। ১৪ ফেব্রুয়ারি ‘জিন্নাহ ক্লাবে’ এক সভায় মুসলিম নেতৃবৃন্দ হিন্দু ও খৃস্টানদের সুরক্ষার ব্যাপারে আশ্বস্ত করে। কিন্তু পরদিন কাজিরচর ও খাসের হাটে হানা দেয় মুসলিমরা।

১৬ ফেব্রুয়ারিঃ রাতে সাতানি গ্রামে হানা দিয়ে পুরো গ্রাম জ্বালিয়ে দেয় মুসলিম দাঙ্গাবাজ। ৪হিন্দুকে হত্যা করা হয়। নিরীহ হিন্দুরা মুলাদি পুলিশ স্টেশনে অভিযোগ দেয়। ওসি তাদের শবদাহ করতে বলে। ওসি নিহতদের পরিবারকে জানায় তারা রোগের কারণে মরেছে। পুলিশের নির্বিকার ও অবিবেচক মনোভাবের কারণে হিন্দুদের মনে ভীতির সঞ্চার ঘটে।

১৭ ফেব্রুয়ারিঃ রাতে ‘আল্লাহু আকবর ও কাফিরদের হত্যা কর’ এরকম শ্লোগান অনেক দূর থেকে শোনা যাচ্ছিল। ভোরে হিন্দু ও খৃস্টানরা মুলাদি পুলিশ স্টেশনে পালিয়ে যান। কিন্তু ওসি তাদের কোন প্রকার আশ্রয় দেয় নি।

বিকাল ৩টায় ৩-৪হাজার মুসলিম দাঙ্গাবাজ মুলাদি বন্দরের গুদামে হানা দিয়ে ব্যাপক লুন্ঠন চালায়। মুসলিমরা প্রকাশ্যে নির্বিচারে হিন্দু পুরুষদের হত্যা ও নারী নির্যাতন করছিল। তাদের পৈশাচিক হত্যা, নারী নির্যাতন ও অপহরণ, লুন্ঠন ও অগ্নিসংযোগ সন্ধ্যা পর্যন্ত চলতে থাকে। খৃস্টান চার্চ ভাঙচুর ও লুট করা হয়। রাস্তা, নদী ও নদীর ঘাট সর্বত্র মৃতদেহে পূর্ণ হয়ে গেছিল। শুধুমাত্র এক হিন্দুর সুপারি বাগানেই ৩০০ মৃতদেহ পাওয়া যায়।

১৮ ফেব্রুয়ারিঃ শনিবার। ভোরে বেঁচে যাওয়া হিন্দু খৃস্টান নিজ গৃহে ফিরে যায়। গৃহ আর নেই। লুটপাট করে ধ্বংস করে দিয়েছে দাঙ্গাবাজ মুসলিম। বিকালে হিন্দু ও খৃস্টানরা মুলাদি পুলিশ স্টেশনে যায়। এইবার, অর্থ ও স্বর্ণালঙ্কারের বিনিময়ে তাদের আশ্রয় দেয় পুলিশ। ইতোমধ্যে আধাসামরিক আনসার বাহিনী লাউড স্পিকারের মাধ্যমে হিন্দুদের থানায় জড়ো হতে বলে। এরপর মুসলিম গুন্ডারা পুলিশের সামনে শতাধিক হতভাগ্য অমুসলিম পুরুষদের হত্যা করে।

ওসি নিজেই হিন্দু নারীদের সিঁদুর মুছে দেয়। এবং শাঁখা চুড়ি ভেঙে দিয়ে জোরপূর্বক কলেমা পড়তে বাধ্য করে। পরে নারীদের গুন্ডা নেতাদের কাছে ভাগ করে দেয়া হয়।

২০ ফেব্রুয়ারিঃ মুলাদি ও আশপাশের গ্রামের বেঁচে যাওয়া হিন্দুরা খোলা আকাশে, বনে ও পোড়া বাড়িতে রাত কাটায়। ২০তারিখ ভোরে ওসি ঘোষণা করে যে বন্দরের কাছে রিলিফ ক্যাম্প খোলা হয়েছে। হিন্দুরা পুলিশ থানায় জড়ো হয়। পুলিশ তাদের কাছ থেকে অর্থ ও স্বর্ণালঙ্কার কেড়ে নিয়ে বন্দরের দিকে পাঠিয়ে দেয়। হিন্দুদের তিন ভাগে ভাগ করে গুদামে পাঠানো হয়। দুপুর ১২টায় ওসির সঙ্কেত পেয়ে ৩হাজার দাঙ্গাবাজ হিন্দুদের উপর হানা দেয়। ৭০০ পুরুষ ও বয়স্ক নারী হত্যা করে নদীতে লাশ নিক্ষেপ করে মুসলিমরা। অবশিষ্ট মেয়েদের কলেমা পড়িয়ে মুসলিম বানানো হয়। প্রায় ৫০ জন মেয়েকে মুসলিম নেতাদের মাঝে ভাগ করা হয়।

বিকালে লঞ্চে করে রিজিওনাল কন্ট্রোলার সিরাজুল হক সশস্ত্র পুলিশ নিয়ে মুলাদি আসেন। বেঁচে যাওয়া হিন্দুদের নিয়ে বরিশাল চলে যান সিরাজুল হক।

বিশ্লেষণঃ মুসলিম দাঙ্গাবাজ সহ আনসার, পুলিশ পর্যন্ত সরাসরি গণহত্যায় অংশ নিয়েছে। তলোয়ার ও চাপাতি দিয়ে কমপক্ষে ৩হাজার হিন্দুকে হত্যা করা হয়। কত নারী নির্যাতিত ও ধর্মান্তরিত হয়েছে তার কোন হিসেব নেই।

ইসলাম নির্বিচার অমুসলিম হত্যা সমর্থন করে। কারণ ৬দিন গণ হত্যা চলেছে। কিন্তু কোন মসজিদের ইমাম বাধা দেয় নি।

নিহতদের সংক্ষিপ্ত তালিকাঃ

  1. Pranballabh Ghosh
  2. Ganga Charan Sarkar (62)
  3. Nityananda Pal (65)
  4. Makhanlal Kundu
  5. Sukhamay Kundu
  6. Radhashyam Kundu
  7. Bipin Kundu
  8. Nagen Kundu
  9. Haren Kundu
  10. Mahendranath Gayen
  11. Dr. Prafulla Gayen
  12. Parambrata Gayen
  13. Barada Kanta Pal
  14. Gopal Pal
  15. Sukhada Sundari Pal
  16. Dhiren Pal
  17. Kabiraj D. N. Ray
  18. Madan Pal
  19. Gopal Kundu
  20. Kayek Kundu
  21. Mahesh Chandra Pal (117)
  22. Madan Nandi
  23. Lalu Nandi
  24. Narayan Bhaduri
  25. Jashoda Lal Kundu
  26. Dr. Kumud Bihari Banerjee

 বখতিয়ার খিলজির গৌড় আক্রমণ দিয়ে বাংলায় ইসলামের আগমন। তার পরের ৫৫০ বছরের অভিজ্ঞতায় বাঙালি হিন্দুর মনে ইসলাম সম্পর্কে কোন ভাল মনোভাব তৈরির অবস্থা হয় নি। ইসলামের ধাক্কায় বাংলায় কোন প্রাচীন হিন্দু মন্দির নেই। মন্দিরগুলি যে ছিল তার প্রমাণ রয়ে গেছে বিভিন্ন প্রাচীন, মসজিদগুলির গায়ে। এ প্রসঙ্গে গোলাম মুরশিদ লিখছেন – ‘মুসলমানরা অসংখ্য মন্দির ধ্বংস  করেছিলেন বলে দাবী করা হয়, তার পক্ষে একটা যুক্তি হল, কোনো কোনো মসজিদ পুরোনো মন্দিরের জায়গাতেই নির্মাণ করা হয়েছিল। কিন্তু এর থেকেও বড়ো যুক্তি হল মসজিদ নির্মাণে মন্দিরের পাথর ব্যবহার করা হয়েছে। অন্তত প্রথম তিন শতকের মসজিদে যে ব্যাপক পরিমাণে মন্দিরের মূর্তিসংবলিত পাথর দেখা যায়, তা থেকে এ ধারণা হতেই পারে। ত্রিবেণীদে সবচেয়ে পুরানো যে মসজিদ রক্ষা পেয়েছে জাফর খানের, তাতে এরকম মূর্তিখোদিত পাথর আছে। আদিনা মসজিদেও। এমনকি, দীক্ষিত বাঙালি সুলতান জালালউদ্দীন একলাখী নামে তাঁর নিজের যে-সমাধি তৈরী করিয়েছিলেন, তাতেও হিন্দু মন্দিরের পাথর লক্ষ্য করা যায়। বরেন্দ্র রিসার্চ মিউজিয়ামে আরও পরের মহিসন্তোষ মসজিদ-সহ একাধিক মসজিদের যে-মিহরাব আছে, তারও উল্টোদিকে হিন্দু দেবদেবীর মূর্তি রয়েছে’। (হাজার বছরের বাংলা সংস্কৃতি, পৃ. ৬১-৬২, অবসর, ২০০৮, ঢাকা) ঢাকা বিমানবন্দরের বর্তমান নাম হজরত শাহজালাল যিনি স্থানীয় হিন্দু রাজাকে হত্যা করে উত্তরবঙ্গে তরবারির জোরে ইসলাম প্রবর্তন করেছিলেন। সুফি বলে পরিচিত হজরত শাহজালালের সমাধিস্থলটি শ্রীহট্ট ও বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ মসজিদ। পূর্ববঙ্গে ও আসামে ইসলামে ধর্মান্তকরণের জন্য সবচেয়ে বিখ্যাত এই সুফি শাহজালাল। এসবের পরেও হিন্দুর মুসলমান সম্প্রীতির গল্প ছড়িয়ে গেছেন বামপন্থী ঐতিহাসিকেরা। পশ্চিমবঙ্গের গত কয়েক দশকের শিক্ষিত প্রজন্ম এইসব গল্প শুনেই বড় হয়েছে।

আরেকটি গল্প এই সেকুলার ঐতিহাসিকেরা হিন্দু বাঙালির মনে গুজে দিতে পেরেছেন-তা হল হিন্দু উচ্চবর্ণের অত্যাচার থেকে রক্ষা পেতে বৌদ্ধ ও নিম্নবর্ণের হিন্দুদের ইসলাম গ্রহণ। আফগানিস্থানসহ মধ্য এশিয়ার বৌদ্ধ অঞ্চলগুলিতে কোন হিন্দু উচ্চবর্ণের অত্যাচার ছিল না তাহলে সেগুলি কেন সম্পুর্ণ মুসলমান হয়ে গেল। কারণ ইসলামের তরবারির সামনে বৌদ্ধরা টিকে থাকতে পারেনি। বাংলাতেও একই ঘটনা। বখতিয়ার খিলজি গৌড়ে আসার আগে ১১৯৩ সালে নালন্দার মতন বিশ্ববন্দিত বৌদ্ধ শিক্ষা কেন্দ্রকে একেবারে ধ্বংস করে এসেছেন। নালান্দার গ্রন্থাগার নাকি তিন মাস ধরে জ্বলেছিল। বখতিয়ার খিলজি গোবিন্দপালের রাজধানীর বৌদ্ধবিহার ধ্বংস করে সব ভিক্ষুদের হত্যা করেছিলেন যার ফলে বৌদ্ধবিহারের বইগুলো পড়বার মত কোন লোক জীবিত ছিল না (গোলাম মুরশেদ-প্রাগুক্ত)। সেন আমলে বাংলার বৌদ্ধরা অবহেলিত ও সামাজিক অত্যাচারিত হচ্ছিলেন, কিন্তু বৌদ্ধবিহার ধ্বংসকারী ইসলামকে তাঁরা কেন স্বাগত জানাতে যাবেন? উত্তর ভারতের আরো বেশী সামাজিক অত্যাচারিত নিম্নবর্ণের হিন্দুরা দলে দলে মুসলমান হল না তাহলে বাংলায় তারা কেন ধর্ম পরিবর্তন করতে যাবে? নিম্নবর্ণের হিন্দুদের সঙ্গে মুসলমানদের যে কোন সখ্যতা নেই তার আধুনিক প্রমান পাকিস্তান থেকে ১৯৫০ সালে পাকিস্তানের আইন মন্ত্রী নিম্নবর্ণের হিন্দুদের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নেতা যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডলের পলায়ন এবং আজ পর্যন্ত বাংলাদেশে থেকে যাওয়া নিম্নবর্ণের হিন্দুদের ক্রমাগত দেশত্যাগ। পশ্চিমবঙ্গে তফশিলি আন্দোলনের অন্যতম শক্তি মতুয়ারা সবাই পূর্ব পাকিস্তান থেকে ইসলামি অত্যাচারে পালিয়ে এসেছেন।

বামপন্থী প্রভাবিত উদ্বাস্তু আন্দোলন শুধু পূর্ব পাকিস্তানে হিন্দুদের উপর অত্যাচারের খবর চেপেই গেল না, এক পা এগিয়ে পাকিস্তানকে সমর্থন করতে লাগলো। ১৯৫২ সালের ১৮ই অক্টোবর ওয়েলিংটন স্কয়ারে UCRC মিটিং- এ পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জীকে ধিক্কার জানানো হয়। ১৯৫৩ সালের ৭ এপ্রিল এক বিরাট সমাবেশ করে UCRC পশ্চিমবঙ্গ আইনসভায় তাদের একগুচ্ছ দাবী-দাওয়া পেশ করে। তাদের দাবীর মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটি হল ‘বাস্তুহারা মুসলমানদের পুর্নবাসন ও তাদের জন্য অর্ন্তবর্তী ত্রাণভাতা’। কি আশ্চর্য! যারা বাস্তুচ্যুত মুসলমানদের ফিরিয়ে আনতে গলা ফাটাচ্ছেন, ভুলেও তাঁরা নেহেরু-লিয়াকত চুক্তি অনুযায়ী নিজেদের নিরাপদে পূর্ব পাকিস্তানে ফিরে যাওয়ার কথা বলেছেন না! নিজেদের লোকেদের প্রতি উচ্চবর্ণের বিশ্বাসঘাতকতা পূর্ব পাকিস্তান থেকে পাকাপাকি ভাবে বেআইনি দেশত্যাগের ধারাকে নিশ্চিত করলো। উদ্বাস্তুদের অবিরাম দেশত্যাগ আজও চলেছে। ১৯৭৫- পরবর্তী এই উদ্বাস্তুদের বেশীর ভাগই ভারতীয় সংবিধান অনুযায়ী তপশিলী হিন্দু।

কেন লক্ষ লক্ষ হিন্দু উদ্বাস্তু দিনের পর দিন বছরের পর বছর চলে আসতে থাকল তা নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের হিন্দু বাঙালি ঐতিহাসিক, সাহিত্যিক, চলচিত্রকার, সংখ্যাতাত্বিক – সবাই নীরব থেকেছেন। এর একটা বড় কারণ বামপন্থী প্রভাবে ধর্মনিরপেক্ষতায় হিন্দু বাঙালির দীক্ষা যার অন্যতম শর্ত যে মুসলমান বা ইসলাম নিয়ে কোন সমালোচনা করা যাবে না। সাহিত্যসমালোচক অশ্রকুমার শিকদার লিখেছেন – ‘দেশভাগ-দেশত্যাগ নিয়ে লিখলে পাছে সাম্প্রদায়িকতা প্রশ্রয় পেয়ে যায়, সেই ভয়ে বাংলা সাহিত্য যেন শিটিয়ে ছিল। অথবা সব কথা বলা যায় না বলেই সংকুচিত ছিল। ….. ‘দেশভাগ-দেশত্যাগ নিয়ে এপারের বাংলা সাহিত্যের নীরবতার কারণ বুঝতে গেলে অখণ্ড কম্যুনিস্ট পার্টির ভূমিকা খানিকটা জানা দরকার’। দেশভাগের গল্পসংকলন ‘রক্তমণির হারে’র ভূমিকায় দেবেশ রায় প্রশ্ন তুলেছেন, ‘বাংলা গল্প-উপন্যাস এমন স্তব্ধ হয়ে গেল কেন দেশভাগ-স্বাধীনতার ঘটনায়?’ তিনি মনে করেন এই নীরবতা ঘটেছিল সচেতন শিল্পগত কারণে। ‘কোনো-কোনোসময়  এমনও আসে শিল্প-সাহিত্যের এক-একটি ফর্মে, যখন সেই ফর্ম তার দুটিমাত্র হাতকেও গুটিয়ে ফেলে তার সময়কে প্রত্যাখ্যান করতে।

একটু সাহস করে যারা কিন্তু লিখেছেন, যেমন সুনীল-শক্তি দলের কবি হয়েও ভুক্তভোগী তারাপদ রায় তাঁর আত্মজীবনীমূলক লেখাপত্রে কিন্তু সত্য কথা বলে ফেলে মার্জনাও চেয়ে নিয়েছেন- ‘এসব কথা এভাবে বলা উচিত নয়। মনের দুঃখে লিখে ফেললাম। যদি এর মধ্যে ক্ষীণতম সাম্প্রদায়িকতা থাকে, এক ভিটে ছাড়া অনন্ত উদ্বাস্তু  মানুষের মনের দুঃখের কথা ভেবে ক্ষমা করে দেবেন’। উদ্বাস্তুদের দুঃখ-দারিদ্র নিয়ে অনেক নভেল গল্পো লেখা হয়েছে যাদের একেবারে আদর্শ শক্তিপদ রাজগুরুর লেখা আবেগে জবজবে গপ্পো নিয়ে ঋত্বিক ঘটকের সিনেমা মেঘে ঢাকা তারা। এখানে কোথাও কেন উদ্বাস্তু হল, কি ঘটনা ঘটলো যাতে একদল মানুষ এরকম মানবেতর জীবনযাত্রা মেনে নিয়ে উদ্বাস্তু হলেন তা ঋত্বিক ঘটকের চলচ্চিত্র বা অন্যান্য আলাপচারিতায় কখনোই নেই। না তা থাকতে নেই। পূর্ব-পাকিস্তানের ব্যাপক অমানবিক হিন্দু বিতাড়নের কোন কথা থাকলে তা প্রতিক্রিয়াশীল ছাপ্পা লেগে যাবে। তাই ঋত্বিক চুপ। মেঘে ঢাকা তারা-র নায়িকা যাত্রাপালার মত দাদা আমি বাঁচতে চাই বলে হাহাকার করে একেবারে চূড়ান্ত মেলড্রামা করে, ক্যামেরা আকাশ মেঘ ঝর্ণা পাহাড়ে সেই আর্তনাদকে প্রতিধ্বনিত করে- কিন্তু তাঁকে তো এই মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়েছে পূর্ব পাকিস্তানের ইসলামি দাঙ্গাবাজেরা, সে কথা চেপে রাখলে শেষ পর্যন্ত মৃত্যুই তাঁর উপযুক্ত প্রাপ্তি, যে প্রাপ্তির দিকে যাত্রা শুরু করেছে পুরো পশ্চিমবঙ্গটাই।

ধর্মকে সামাজিক জীবনে গুরুত্ব না দিয়ে একটি ধর্মনিরপেক্ষ বহুত্ববাদী সমাজ গড়ার প্রচেষ্টা নিল হিন্দু বাঙালি। যদিও এই প্রচেষ্টায় জাতপাতের বিরুদ্ধে লড়াইটি যথেষ্ট গুরুত্ব পায় নি। এই শুভ প্রচেষ্টার পাশাপাশি চলতে থাকলো মুসলিম মৌলবাদকে তোষণের পালা। ঠিক একইভাবে ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক পশ্চিম ইউরোপ সাংস্কৃতিক বহুত্ববাদের (multi-culturalism) নামে ইসলামি মৌলবাদের তোষণ চালিয়ে আসছে গত কয়েক দশক। তার ফল এখন ইউরোপ ভুগতে শুরু করেছে। পশ্চিমবঙ্গে ১৯৭৭ সালে ক্ষমতায় এসে মৌলবাদী মাদ্রাসা শিক্ষা প্রসারে মন দিলো বামপন্থীরা, সারা ভারতে প্রথম মাদ্রাসা শিক্ষার জন্য আলাদা মন্ত্রী হলেন একজন। এই আবহে শুরু হল বাংলাদেশ থেকে ব্যাপক মুসলমান অনুপ্রবেশ। এত বিপুল হিন্দু উদ্বাস্তু আগমনের পরও ১৯৫১ সাল থেকেই ধীরে পশ্চিমবঙ্গের মুসলমান জনসংখ্যার অনুপাত বেড়েই চলেছিল। এবার তা অ্যারো দ্রুত বাড়লো। যখন পূর্ব পাকিস্তান / বাংলাদেশের হিন্দু জনসংখ্যার অনুপাত ১৯৫১তে ২২শতাংশ থেকে কমে ২০০১-এ ৯শতাংশ পৌছল, পশ্চিমবঙ্গের মুসলমান জনসংখ্যার অনুপাত ১৯শতাংশ থেকে ২৫ শতাংশ হলো যা ২০১১ তে ৩০শতাংশে পৌঁছবে বলে অনুমান। শ্যামাপ্রসাদের ভবিষ্যৎবাণী মিলে গেল।

 জনমানচিত্রের এই বিপর্যয়ে হিন্দু বাঙালি বিন্দুমাত্র বিচলিত হলো না, এই বিষয় নিয়ে ইতিহাস, সমাজবিদ্যা বা অর্থনীতিতে কোন আলোচনা প্রায় অশ্লীলতা বলে বিবেচিত হলো। হিন্দু বাঙালি দুর্গা পূজাকে ধর্মের কলুষমুক্ত করতে তাকে শারদোৎসব বানালো আর পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মুসলিম ধর্মানুষ্ঠানে গিয়ে হিজাব পড়ে নিলেন। আম্বেদকরের কথা স্মরণ করুন- সংখ্যায় বৃদ্ধি পেলে ইসলামি মৌলবাদ আরো শক্তিশালী হবে। পশ্চিমবঙ্গ তৈরীর মূল ভিত্তি যে অমুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠতা, হিন্দু বাঙালির আত্মবিস্মৃতি এই সত্যটাকে প্রায় বিলুপ্ত করে দিতে পেরেছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.