মোদী ম্যাজিকে মিরাকেল ঘটাচ্ছে শেয়ার বাজার

একটা সময় ভারতীয় অর্থবাজারে থরহরিকম্প জাগাতো শেয়ার ধস নামক শব্দটি। প্রায়শই শোনা যেতো বাজারে নাকি মহাপতন ঘটেছে। নিফটি আর সেনসেক্স নামক দুইমানিকজোড় তাতে কুপোকাত হয়ে পড়তেও সময় নিত না। এই প্রবণতাটা ২০১৪ পর্যন্ত চলেছে নিয়ম করে। তারপরেই ভারতবর্ষে এল সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। সারা দেশজুড়ে উঠল নমো ঝড়। দিল্লির গদিতে বসলেন নরেন্দ্র ভাই দামোদরদাস মোদী। ব্যস, সারা দেশটাই আমূল যেন পালটে যেতে লাগল কোনো এক জাদুস্পর্শে। জিডিপি জানান দিতে থাকল ভারত সত্যি বাড়ছে। বৃদ্ধির অন্যতম সূচক শেয়ারবাজার হয়ে উঠল সাবালক। মোদী আসার আগে পর্যন্ত যে নিফটি সূচক সাড়ে ৫ হাজার আর সেনসেক্স ১৬-১৭ হাজারের ঘরে ঘুরছিল। তাই গত ৫ বছরে অতিক্রম করল বিশাল একটা পথ। ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনের ফলে বেরনোর আগে থেকেই শেয়ার ইনডেক্স বুঝিয়ে দিচ্ছিল প্রত্যাবর্তন। ঘটছে নমো-২ সরকারের। সে সময় ১১,৮৫০ পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছিল নিফটি। সেনসেক্সও তখন ৪০ হাজার ছাপিয়ে গেছে। তাপরের ঘটনা তো ফের ইতিহাস ঘটাল এ ভারতবর্ষে।বিরোধীদের মুখে ছাই দিয়ে, যাবতীয় সমালোচনাকে ফুঙ্কারে উড়িয়ে নরেন্দ্র মোদী দ্বিতীয়বারের জন্য ক্ষমতায় ফিরলেন গত ২৩ মে। নোটবন্দি, জিএসটি, আর্থিক সংস্কার ও পিছিয়ে পড়া মানুষের জন্য মোদীজীর একের পর এক পদক্ষেপ এই জয়কে ত্বরান্বিত করল। তার ওপর সারাবিশ্বে কূটনৈতিকভাবে কৌলিন্য পেল মোদীর নেতৃত্বাধীন ভারত। আর হ্যা, এই অবসরে নিফটি মহারাজও পেরিয়ে যায় ১২ হাজারের মাইলস্টোন। সেনসেক্সও ৪১ হাজারের গণ্ডিকে অতিক্রম করল অবলীলাক্রমে। গত পাঁচ বছরের নিরিখে নিফটি দ্বিগুণের বেশি ও সেনসেক্স ৩ গুণের কাছাকাছি বেড়েছে। যা শুধুমাত্র মোদী সরকারের স্বচ্ছ অর্থনীতির জন্যই সম্ভব হয়েছে বলে মনে করছেন অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞরা। আগামী ৫ বছরে এই প্রবণতা অব্যাহত থাকার সম্ভাবনা প্রবল করে তুলেছে। সেদিক থেকে দেখলে আগামী ৫ বছরে অর্থাৎ ২০২৪ এ গিয়ে ভারতীয় নিফটি ২০ হাজার ও সেনসেক্স ৬০-৭০ হাজারের কাছে গেলে মোটেই অবাক হওয়ার মতো কিছু থাকবে না।
চীনের একচ্ছত্র আধিপত্যেও ভাগ বসিয়েছে নরেন্দ্র মোদীর শাসনাধীন ভারতভূমি। বস্তুত, ভারতীয় শেয়ার বাজারেও সেই চৈনিক লগ্নি পুরোপুরি ভাগ জমাতে শুরু করেছে। এফ আই আইদের হাত ধরে। এর সঙ্গে রাশিয়া, আমেরিকা, ফ্রান্স, জার্মানি, ইজরায়েল প্রভৃতি দেশের পাশে দাঁড়ানোও বিশাল ফ্যাক্টর হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিদেশিদের পাশাপাশি যোগ করতে হবে ভারতীয় ফান্ড বা ডিআইআইদের লগ্নিকে। এখন বিদেশিরা বেচলেও ভারতীয় শেয়ার বাজারকে কিছুতেই পড়তে দেন না ভারতীয় মিউচুয়াল ফান্ড। ভারতের অর্থবাজারে বেশ কিছু কোম্পানি রয়েছে যারা ধারাবাহিকভাবে ভালো ফল করে চলেছে। যথারীতি বাজারে মাথা উঁচু করে টিকেও আছে তারা। এমন কোম্পানি সত্যি বলতে হাতে গোনা যারা বছরের পর বছর ধরে লাগাতার শেয়ার গ্রহীতাকে লাভবান করে চলেছে। এদের আরও একটা দিক থেকে বিচার করতে হয়। সেটা হলো এদের ডিভিডেন্ড দেবার প্রবণতা থেকে। অনেক সময়েই দেখা যায় এসব উন্নতমানের শেয়ার শুধুমাত্র বোনাস ও ডিভিডেন্ড দিয়ে দিয়ে তাদের ক্রেতাদের ভরপুর করে তোলেন। যে সুযোগটা মোটেই মেলে না “কালকের যোগী’ শেয়ারগুলির ক্ষেত্রে। এজন্যই বিশেষজ্ঞরা পই পই করে বলে থাকেন উন্নত মানের শেয়ার কেনার কথা। আর দুদিনের চাঁদনি ছড়ানো শেয়ার থেকে নির্দিষ্ট পরিমাণ লাভ নিয়ে (বলা ভালো ফাটকা করে) বেরিয়ে যাওয়া সবচেয়ে নিরাপদ।
গত এক-দু বছরে নতুন উচ্চতায় চড়ার যে অভ্যেস রপ্ত করেছে ভারতীয় শেয়ার বাজার, তার কাছাকাছি জায়গাটা হলো ১২ হাজার। সেনসেক্সও পেল পুরনো উচ্চতা। ছুঁয়ে দেখার ঝাঁঝ। এখন ১২ হাজারের ওপরে থাকা প্র্যাক্টিস করতে হবে নিফটি মহারাজকে। এরপরের জংশন যে ১৩ হাজার সেটা বোঝার জন্য হয়তো খুব একটা বোদ্ধা হতে হবে না। কিন্তু তার আগে পার্টি যাতে ভেস্তে না যায় সেদিকটাতেও চোখ রাখতে হবে খুব স্বাভাবিকভাবেই। আবার। সূচকের এই লম্ফঝম্প কেন ও কতদিন তার স্থায়িত্ব, সেটাও একটা বড়ো ব্যাপার। এই মুহূর্তে বিশ্ব বাজারের নিয়ম করে ওপরে থাকা, ক্রুড অয়েলের দাম নীচে নামা ও বিদেশিদের পুনরায় ক্রেতার ভূমিকা নেওয়া এই ত্র্যহস্পর্শ বাজার বাড়তে সাহায্য করছে। তার ওপর মোদী ম্যাজিক তো আছেই।
এত কিছুর মধ্যেও মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে বহু ভারতীয় কোম্পানি, কিন্তু কোয়ার্টার অনুযায়ী লাভের মাত্রা বাড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে। যার প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়ছে। তাদের শেয়ারের দামে। গাড়ি প্রস্তুতকারী সংস্থা ও গাড়ির অনুসারী শিল্প সম্পর্কিত বহু শেয়ার এই দু-এক বছরে বেলাগামভাবে বেড়ে চলেছে। বিশিষ্ট শেয়ার বিশেজ্ঞরা ইঙ্গিত দিচ্ছিলেন এই সেক্টরের ইতিবাচকতা নিয়ে। যাঁরা তাঁদের কথা শুনে বাধ্য ছাত্রের মতো এসব শেয়ার কিনে তাদের ডিম্যাট ভরেছেন তারা আজ লাভের মুখ দেখছেন।
এই মুহূর্তে ভারতের অর্থবাজার যেমন লড়াই করছে নিফটির ওপরে থাকা নিয়ে। আগের উচ্চতার খুব কাছে ঘোরাঘুরি করছে। ঠিকই, কিন্তু এমন কোনও ইতিবাচক ব্রেক আউটও হয়নি যার জোরে বুক ঠুকে বলা যায় নিফটি নতুন রেকর্ড তৈরি করতে যাচ্ছে। পাশাপাশি এটাও সত্যি যে এমন কিছু অঘটন ঘটে যায়নি, যার ওপর নির্ভর করে বলা যায় বাজার খারাপ জায়গায় চলে গেল। খুব ছোটো একটা জোনের মধ্যে নিফটি প্রায় মাসখানেক ধরে আটকে রয়েছে। তার ওপরের দিকটা যদি ১২ হাজার হয়, তবে নিশ্চিতভাবে নীচের জায়গাটা হলো ১১, ৬০০। ৪০০-৫০০ পয়েন্টে সীমাবদ্ধ নিফটির এই ঘোরাফেরা। যথারীতি সেনসেক্সও এই ঘূর্ণি চক্করের মধ্যেই আছে। এখানে একটা বিষয় পরিষ্কার, নিফটি যদি ১১,৯০০ পার হয়ে চলতে পারে ও দুটো ক্লোজিং এই জায়গায় দিতে পারে তাহলে আরও অনেক বিস্তৃতি ঘটবে এই গুরুত্বপূর্ণ সূচকের। আর ১১,৬০০ ভেঙে ট্রেড করতে থাকলে নিফটি কিছুটা নিচে চলে যাবে। যদিও বিশেষজ্ঞদের বড়ো অংশের বক্তব্য বাজার এখন বিরাট কিছু নিচে আসবে না। বরং আরও ওপরে যাওয়ার ম্যারাপ বাঁধার প্রক্রিয়া চলবে বেশ কিছুদিন।
বাজার যখন বাড়তে থাকে তখন একটা চালু কথা মানুষের মুখে মুখে ফেরে— স্কাই ইজ দ্য লিমিট। এমনিতে একটা কথা আবার ভারতের বাজারের সম্পর্কে শোনা যায়, সেটা হলো এখানকার লগ্নিকারীরা যতই লাভে থাকুন আর তাদের হাতের শেয়ার যতই বেড়ে যাক না কেন কিছুতেই বেচতে চান না তারা। অথচ সেই একই মানুষ যদি দেখেন কোনও শেয়ার তার সর্বোচ্চ অবস্থানকে ছাপিয়ে ক্রমে বেড়েই চলেছে। তখন তারা লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে সেখানে। কিনতে যান। এটাকে যদি দোষ বলা হয় তবে তাই। তবু এই ‘টিপিক্যাল’ প্রথা কিছুতেই ছাড়তে চান না ভারতের লগ্নিকারীরা। সূচক একেবারে টঙে বসে আছে, এই অজুহাত দেখিয়ে অনেকেই হাত লাগাতে চাইছেন এই বাজারে। ফলে ওপর-নীচের এই টানাপোড়েনের মাঝে পড়ে বাজার বড় পরিশ্রান্ত হয়ে উঠছে। বুল-যোদ্ধাদের এই রণক্লান্ত অবস্থানের সুযোগ নিতে চাইছেন। বেয়ারারা। এই পর্যন্ত সব ঠিক আছে। কিন্তু তাদের আবার নড়াচড়া করতে দিচ্ছে না বুলরা।
দেশের বর্তমান রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অবস্থানের প্রেক্ষিতে ২০১৭-র শুরু আর শেষে বেশ কিছু তফাত গড়ে দিয়েছে। যা ২০১৮-য় শেয়ার বাজারকে মসৃণ থাকতে দেয়নি। সূচক ওপরে ওঠা সত্ত্বেও মুখ ফিরিয়ে থেকেছে সকলের ভারী পছন্দের মিডক্যাপ। সেদিক থেকে ফের ২০১৯ নতুন করে উজ্জীবিত করতে শুরু করেছে সূচকজোড়কে। সেক্ষেত্রে নিফটির। জন্য ওপরের দিকে সাড়ে ১২ হাজার শক্ত চ্যালেঞ্জ। আবার নীচে খুব ভালো সাপোর্টের জায়গা আপাতত ১১,৫০০-১১,৭০০ বলেই মনে হচ্ছে। এই মুহূর্তেমুনাফা লাভের তাগিদে বাজার পড়লেও, বারবার তা ঠেলেঠুলে ওপরে চলে আসবে। যারা নিয়ম করে ট্রেড করেন, তারা একটু সাপোর্টরেজিস্ট্যান্স মেনে কাজ করলে লাভবান। হওয়ার সুযোগ থাকছে ভরপুর।
পার্থসারথি গুহ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.