স্বাধীনতার সূচনা সময়ে ভারতে ছিল নির্মম দারিদ্র, অত্যন্ত হতাশাব্যঞ্জক নানান সামাজিক সূচক ও প্রাথমিক পরিকাঠামোহীন একটি দেশ। স্বাধীনোত্তর কর্মকাণ্ডের শুরুতে দেশ সমাজবাদী অর্থনীতিকেই দেশ চালনার মডেল হিসেবে বেছে নেয়। এরই অঙ্গাঙ্গী ছিল লাইসেন্স পারমিট রাজ, সরকারি নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের বিতরণ ও মূল্য নির্ধারণ এবং অতি প্রাচীনপন্থী এক বাণিজ্যনীতি। অবশ্যম্ভাবী ফলশ্রুতিতে চারটি দশক ধরে অর্থনৈতিক প্রগতি ছিল নিতান্তই ঢিমেতালে। পরিবর্তনের প্রথম ঘণ্টাটি বেজেছিল যখন প্রথম উদারনৈতিক সংস্কারের মাধ্যমে কাঠামোগত পরিবর্তনের প্রয়াস নেওয়া হয়। এই প্রক্রিয়া ১৯৮০ সালে প্রথম দায়সারা ভাবে শুরু হলেও ১৯৯১ থেকে উৎসাহব্যঞ্জক গতিতে এগোতে থাকে। কিন্তু যেহেতু প্রারম্ভিক চারটি দশক অতি নগণ্য উন্নয়নের কানাগলিতে হারিয়ে গিয়েছিল তাই সাম্প্রতিক উন্নয়ন দ্রুত অগ্রসরমান হলেও দেশের সমস্যাগুলির পরিমাণ এখনও বিপুল। এই পরিস্থিতিতে যদি কেউ সমালোচক হিসেবে ভারতের এ যাবৎ ক্ষমতায় থাকা সরকারগুলির এখনও না মেটা সমস্যা সমূহের নিরিখে বিচার করতে যান তিনি মনের আনন্দে তালিকা তৈরি করতে পারবেন। যেহেতু শেষ যে সরকার ক্ষমতাসীন সেটি নরেন্দ্র মোদীর, তার ফলে ‘সব বেটাকে ছেড়ে বেড়ে ব্যাটাকে ধর’ প্রচলিত বাক্যটি মেনে তারা মোদীকে সহজ টার্গেট হিসেবে বেছে নিয়েছেন।
তাদের এই অসার সমালোচনা অবশ্য কিছুই প্রমাণ করতে পারবে না। উল্টে ব্যুমেরাং হয়ে তার পূর্ববর্তী দীর্ঘস্থায়ী সরকারগুলির ওপরই বর্তাবে। বলা দরকার যথার্থ মূল্যায়ন যদি করতে হয় সেক্ষেত্রে উন্নয়নকে পরিমাপ করতে হবে পূর্ববর্তী সরকারগুলির সঙ্গে তুলনামূলক ভিত্তিতে। হ্যাঁ, এই মানদণ্ড ও অর্থনীতি গ্রাহ্য রীতি যদি অনুসরণ করা হয়, তাহলে এই উপসংহারকে এড়িয়ে কিছুতেই পালানো যাবে না যে এই সরকার চমৎকার কাজ করেছে। আর এই সরকারের পরিবর্তে যদি পূর্ববর্তী ইউপিএ সরকার ঘরানার কোনো বাধ্যতামূলক ভাবে বেছে নেওয়ার বিকল্প সরকার আসে (কেননা বাজারে বিকল্প অতি দুর্লভ), তবে যা আসবে তা হবে ইউপিএ সরকারের উনিশ-বিশ যা দেশকে অর্থনৈতিক পঙ্গুত্বের পথে দ্রুত ফিরিয়ে নিয়ে যাবে।
এই নিবন্ধের স্থান অকুলান হেতু এই সরকারের উন্নয়নমুখী গৃহীত নীতিগুলির সামগ্রিক তালিকা তুলে ধরার অসুবিধে রয়েইছে। তবে এই ধরনের বিস্তারিত বিবরণী তুলে ধরার তেমন কোনো প্রয়োজনও নেই। কেবলমাত্র তিনটি বড়ো ধরনের সংস্কারের কথা তুলে ধরলেই যথেষ্ট নমুনা পেশ হবে বলে মনে করি। এগুলি ইতিমধ্যেই কার্যক্ষেত্রে পরীক্ষিত হয়েছে। (১) ইনসলভেন্সি ও ব্যাঙ্করাপ্সি কোড, (২) গুডস ও সার্ভিসেস ট্যাক্স (জিএসটি), (৩) ডাইরেক্ট বেনিফিট ট্রান্সফার (সরকারি যে কোনো ভাতা ভরতুকি সবই উপভোক্তার ব্যাঙ্ক খাতায় সরাসরি জমা হবে, ডিবিটি)। এই ধরনের সংস্কারের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারে এমন কোনো সংস্কার বিগত ১০ বছরের দুটি ইউপিএ সরকারের জমানায় হয়েছে কিনা খুঁজতে গিয়ে তোলপাড় করেও আমার নজরে কিছু আসেনি। ইউপিএ সরকারের নেওয়া যে বড়ো ধরনের প্রকল্পগুলি নিয়ে ডঙ্কা বাজানো হয় যেমন মনরেগা, জাতীয় খাদ্য নিশ্চয়তা প্রকল্প বা শিক্ষার অধিকার এই সমস্ত প্রকল্পগুলি সবই মূলত সামাজিক ন্যায় যা কখনই কোনো স্থায়ী সম্পদ সৃষ্টি করে না, ফলে অর্থনীতিরও কোনো শ্রীবৃদ্ধি ঘটায় না।
বছর পাঁচেক আগের একটি গণ-বিতর্ক সভায় বিগত সরকারের এক মন্ত্রী তৎকালীন সরকারের তরফে সাফাই দিতে গিয়ে অতি উচ্চ হারে বৃদ্ধির পরিসংখ্যান দাখিল করছিলেন। কিন্তু এর বিপরীতে যখন তাকে প্রশ্ন করা হয় যে কী ধরনের সংস্কার প্রক্রিয়া ওই সরকার হাতে নিয়েছিল তার যদি দু’ একটা উদাহরণ তিনি দেন তাহলে বৃদ্ধির কারণ বুঝতে সুবিধে হবে। এক্ষেত্রে তাঁর কাছে কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি। আমি কিন্তু এই সূত্রে একটা কথা বার বার বলে এসেছি যে, আগের দুই প্রধানমন্ত্রী নরসিংহ রাও ও অটলবিহারী বাজপেয়ী যে সংস্কার প্রক্রিয়াগুলি অত্যন্ত ধৈর্য সহকারে বাস্তবায়িত করেছিলেন পরবর্তী ইউপিএ সরকার দুটি তারই প্রলম্বিত লাভ ভোগ করেছে।
টেলি যোগাযোগ ব্যবস্থা, অটোমোবাইল, দু’চাকার গাড়ি, নাগরিক উন্নয়ন ও সফটওয়ার শিল্পের ক্ষেত্রে যে অসামান্য উন্নতি পরিলক্ষিত হয়েছে তার মূলে রয়েছে ওই সমস্ত সংস্কারগুলির দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব। ইউপিএ সরকার, না বর্তমান মোদী সরকার কে অর্থনীতিতে বেশি বৃদ্ধি ঘটাতে পেরেছে তাই নিয়ে শুরু হওয়া নিরন্তর বিতর্কগুলিতে এই বিষয়টা সম্পূর্ণ এড়িয়ে যাওয়া হচ্ছে।
প্রথম ইউপিএ সরকার এতটাই ভাগ্যবান ছিল যে অটলবিহারীর রোপিত বীজ যখন সোনালি শস্যের রপ নিয়েছে তারা অকাতরে তার লাভ তুলেছে। অথচ দুর্ভাগ্যজনক ভাবে তাদের ইনিংসে তারা কোনো কাজ না করে শস্যক্ষেত্রটিকে তো চষেইনি, বরং তার ওপর সুফলভোগ করার উচ্ছিষ্টগুলি ছড়িয়ে দিয়ে গেছে।
এই পরিস্থিতিতে পরবর্তী সরকারের প্রথম বছরটি জঞ্জাল সাফ করতেই কেটে যায়। দেশে শস্যক্ষেত্র সম উৎপাদন ক্ষেত্রকে সচল করতে শিল্পদ্যোগীদের পুরনো Retrosprective Tax (ONICS|P|7 72675 ওপর পুনর্বার কর দেওয়া)-এর মতো উৎপাদন ক্ষেত্রের পক্ষে চরম ক্ষতিকর করপ্রথা বিলোপ, মুদ্রাস্ফীতিকে বাগে আনার সঙ্গে সঙ্গে দীর্ঘদিন ঝুলে থাকা পরিকাঠামো ক্ষেত্রের প্রকল্পগুলিকে ছাড়পত্র ও আমলাতন্ত্রের পঙ্গুত্বকেও সামাল দিতে হয়।
এই ব্যাপক প্রশাসনিক অবহেলা পর্যালোচনা করার পর কেউ কি বুক বাজিয়ে বলতে পারবেন যে বিরোধী দলগুলির পাঁচ মিশেলি সরকার যদি হয় তারা যে আবার এমনই নেতিবাচক পরিস্থিতিকে টেনে আনবে না? বিরোধীপক্ষের মধ্যে আমার মনে হয় একমাত্র অন্ধ্রপ্রদেশের চন্দ্রবাবু নাইডু ছাড়া কেউই মনে করেন না যে বড়ো ধরনের অর্থনৈতিক সংস্কার ছাড়া দ্রুত অর্থনৈতিক বৃদ্ধি কোনোদিনই সম্ভব নয়। এই কাণ্ডজ্ঞানহীনরা মনে করে অর্থনৈতিক বৃদ্ধি ভারত বরাত জোরেই পেয়ে যেতে বাধ্য। আর বৃদ্ধির ভাণ্ডার দু’হাতে খরচ করে ‘কামধেনু’র মতো চালিয়ে যাওয়া যেতে পারে। হ্যাঁ, নীতিগতভাবে এ পর্যন্ত একটিই ভবিষ্যৎ সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা দৃঢ়ভাবে শোনা গেছে, তা হলো দেশব্যাপী সকলের জন্য ন্যূনতম আয়ের নিশ্চয়তা প্রকল্প। এটি রাহুল গান্ধীর প্রতিশ্রুতি। দুর্ভাগ্যজনকভাবে বিগত ইউপিএ সরকারের ঘরানার মতো এটিও সঞ্চিত সম্পদ বাঁটোয়ারা করে দেওয়ার নতুন বোতলে পুরনো মদ। এটি জন্মসূত্রেই মারাত্মকভাবে ভ্রান্ত।
প্রাথমিক ভাবে এই পরিকল্পনাটি সকলের জন্য একটি প্রাথমিক আয় বলে ঘোষণা হয়েছিল। কিন্তু অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞ প্রবীণ চক্রবর্তী যিনি কংগ্রেস দলের পরিসংখ্যান বিশ্লেষক গোষ্ঠীর প্রধান তিনি বললেন যে, সকল নাগরিককে একটি পূর্ব নির্ধারিত ন্যূনতম আয়ের নিশ্চয়তা দেওয়া হবে। এর নির্যাস দাঁড়াল এই যদি কারুর আয় পূর্ব নির্ধারিত ন্যূনতম আয়ের চেয়ে কম থাকে তাহলে সরকার তাকে সেই ঘাটতিটুকু পূরণ করে দেবে। উদাহরণটা এরকম যদি নির্ধারিত ন্যূনতম আয় ১০ হাজার টাকা ধার্য হয় আর লোকটি ইতিমধ্যে ৬ হাজার টাকার রোজগেরে হয় সেক্ষেত্রে তাকে কেবল ৪ হাজার টাকাই দেওয়া হবে।
এই প্রকল্পের মারাত্মক ভুল এটাই যে যদি কেউ বুঝে নেয় তার পক্ষে ১০ হাজার টাকার কাজ জোটানো কোনোভাবে সম্ভব নয়। তাহলে সে নিষ্কর্মা হয়ে বসে থাকবে। কেননা সে তো নিষ্কর্মা হয়েই ১০ হাজার পেয়ে যেতে পারে। সত্যিই তো দুনিয়ায় কে আর এমন বোকা আছে যে খেটে মরে ৬ হাজার টাকা রোজগার করবে যা সরকারি দানের (১০ হাজার) দেওয়ার আগে কেটে নেবে।
কংগ্রেসকে সামাজিক প্রকল্পে খরচ করতে হলে কোনো ভালো বিকল্প খুঁজতে হবে বিশেষ করে উন্নয়নমুখী কোনো সংস্কার যা দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। তাদের বোঝা উচিত ‘কামধেনু’ একটি মিথ বা অতিকথন, বাস্তবে তা কোনোদিনই ঘটে না।
অরবিন্দ পানাগোড়িয়া
(লেখক কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক)