মব লিনচিং সরকারকে বদনাম করার এক অপচেষ্টা

কিছুদিন আগে বিখ্যাত কার্টুনিস্ট সতীশ আচার্যের একটি কার্টুন সোশ্যাল মিডিয়ায় খুব চর্চা হয়েছিল। কার্টুনটি ছিল ভক্তদের উদ্দেশে ভগবান রামের অনুরোধ— Not in my Name’। এই কার্টুনে স্পষ্ট চিত্রিত আছে একদল উন্মুক্ত ভিড় গাছে বেঁধে অসহায় এক ব্যক্তিকে খুব মারধর করছে। মারতে মারতে ওই ব্যক্তিকে ‘জয় শ্রীরাম’ বলার জন্য বাধ্য করা হচ্ছে। পাশেই কাঁধে তির-ধনুক নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন রাম। তিনি সেই উন্মুক্ত জনতাকে হাত জোড় করে কাতর অনুরোধ করছেন দয়া করে আমার নামে নয়। কার্টুনটি আমাদের দেশে ঘটে যাওয়া সম্প্রতি কয়েকটি উগ্র সাম্প্রদায়িক ঘটনার ছবি চিত্রায়িত করেছে। প্রকৃতপক্ষে সমাজের কিছু দুষ্কৃতী ‘জয় শ্রীরাম’ ধ্বনিকে পুঁজি করে ভগবান রামের নামকে কুলষিত করছে।রাম তো স্বয়ং ন্যায় ও দয়াশীলতার প্রতীক। আর রামরাজ্য হচ্ছে শৌর্য, সমৃদ্ধি এবং আদর্শের দ্যোতক। যদিও ১৯৯২ সালে রাম মন্দিরের দাবিতে রামভক্তরা পুরো দেশ জুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল, কিন্তু উত্তর ভারতের গ্রামাঞ্চলে ধার্মিক হিন্দুদের মধ্যে ‘রাম রাম’, ‘জয় সিয়া রাম’, এবং‘জয় শ্রীরাম কি’ বলে সংবর্ধনা জানানোর রেওয়াজ অনেক পুরোনো। জয় শ্রীরাম ধ্বনিতে কোনো প্রকার হিংসা বা ভীতির সামান্য শ্লেষ থাকতে পারে না। কোনো ধর্মগ্রন্থে কিংবা ধর্মীয় নেতার সুরেও থাকা উচিত নয়। এখন ধর্মের চেয়ে রাজনীতিতে ‘জয় শ্রীরাম’ স্লোগান উচ্চারিত হওয়ায় একদল মানুষ রামের নামে উগ্র সাম্প্রদায়িকতার পথ বেছে নিয়ে ভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে ভীতির সৃষ্টি করে ভোটব্যাঙ্ক তৈরির চেষ্টা করছেন।
পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে ‘জয় শ্রীরাম’ ধ্বনি অনেক দূর পর্যন্ত গড়িয়েছে। মমতা ব্যানার্জি যখন সংখ্যালঘু তোষণে বেপরোয়া তখন বিজেপি রামনামে পশ্চিমবঙ্গের গদি দখল প্রায় স্থির করে নিয়েছে। তৃণমূল কংগ্রেস এতই কোণঠাসা হয়ে পড়েছে যে বিজেপির রাম নবমীর পাল্টায় তারাও রামনবমী উদ্যাপন করতে বাধ্য হয়েছে। কিন্তু বিপত্তি ঘটল যখন মমতার উদ্দেশে জয় শ্রীরামের জয়ধ্বনি ছুঁড়ে দেওয়া হলো। মমতা পারতেন নিজেকে স্থির রেখে জয় শ্রীরামের ধ্বনিতে শামিল হতে। তা না করে তিনি ‘জয় শ্রীরাম শুনেই গ্রামের পাগলি বুড়ির মতো খেপে যাচ্ছেন। তার এই অপরিপক্কতার ফল ২০১৯-এর লোকসভায় অবশ্যই পেয়েছেন। কোনো ধ্বনি খুব স্পর্শকাতর হয় যখন সেটা জোর করে কাউকে মানানো হয় বা যারা বিশ্বাস রাখে তাদের ধমক দেওয়ায়। এটা অনস্বীকার্য সত্য যে জয় শ্রীরাম ধ্বনিকে কেন্দ্র করে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে মব লিনচিংয়ের ঘটনা ঘটেই চলছে। ২০১৯-এর মে মাসে হরিয়ানার জামে মসজিদ থেকে নামাজ পড়ে আসার সময় এক মুসলমানকে পিটিয়ে জবরদস্তি জয় শ্রীরাম বলানোর অভিযোগ আসে। ২৮ মে ২০১৯-এ মথুরায় এক রাশিয়ান ঈশ্বরভক্তকে দু’বার রাম রাম’ বলার চাপে গলায় ছুরি গেঁথে দেওয়া হয়। কলকাতার পার্ক সার্কাসে ‘জয় শ্রীরাম’ না বলায় মোহাম্মদ শাহরুখ নামের এক ব্যক্তিকে চলন্ত ট্রেন থেকে ফেলে দেওয়ার অভিযোগ ওঠে। উত্তরপ্রদেশে কয়েকজন বাইক আরোহী তাজ নামের এক ব্যক্তির মাথার টুপি খুলে দেওয়ার অভিযোগ ওঠে। ঝাড়খণ্ডের জামতারা এলাকায় লুঙ্গি পরিহিত এক ফল বিক্রেতাকে বলপূর্বক ‘জয় শ্রীরাম’ বলতে বললে উনি রামায়ণ পাঠ শুরু করে দেন, আসলে উনি হিন্দু ছিলেন যেটা তার পোশাকে দুষ্কৃতীরা সঠিক অনুমান করতে পারেনি। পশ্চিমবঙ্গের পুরুলিয়ায় ‘জয় শ্রীরাম’ না বলায় ১১ বছরের এক মাদ্রাসা ছাত্রকে মারধর করার অভিযোগ ওঠে। ওড়িশার বছর চব্বিশের এক যুবককে মব লিনচিঙের ঘটনায় প্রাণ দিতে হয়। ২২ জুন ২০১৯ তরবেজ আনসারিকে বাইক চুরির অভিযোগে একটি ভিড় টানা কয়েকঘণ্টা মারধর করে এবং পুলিশি হেফাজতে তরবেজ আনসারির মৃত্যু ঘটে। আসলে এগুলি সবই চক্রান্ত। উদ্দেশ্যে হলো মোদী সরকারকে হেয় প্রতিপন্ন করা।
মব লিনচিঙের এই ঘটনায় দেশ জুড়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়। অল ইন্ডিয়া জমিয়ত উলেমা-এ-হিন্দু বিশেষ চিন্তা প্রকট করতে গিয়ে মব লিনচিঙ আটকাতে বিশেষ আইন প্রণয়ন করতে সরকারকে আহ্বান জানান। হায়দরাবাদের সাংসদ তথা AIMIM প্রধান আসাদুদ্দিন ওয়েসি বিজেপি-আরএসএসকে কাঠগড়ায় তুলে বলেন ‘পিঠিয়ে হত্যা করা পিএম মোদীর সংস্কার।মব লিনচিংয়ের জন্য ভারতের ইতিহাস মোদীজীকে স্মরণ রাখবে।” কোনো প্রমাণ, তথ্য ছাড়া দেশের এই বিচ্ছিন্ন ঘটনাগুলোর জন্য ওয়েসি অ্যান্ড গ্যাং বিজেপি-আর এস এসকে দায়ী করছে, অথচ এরাই দেশের জঙ্গি আক্রমণ ও ধর্ষণকাণ্ডে সাফাই দেন অপরাধীর কোনো জাত ধর্ম থাকতে পারে না। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী পাকিস্তান, বাংলাদেশ সরকারের মতো বোবা কিংবা অন্ধ নন। উনি মহান সংসদে দাঁড়িয়ে ঝাড়খণ্ডের মব লিনচিঙের কড়া প্রতিক্রিয়া জানিয়ে দুষ্কৃতীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে আদেশ দিয়েছেন। এর আগেও ভুয়ো গো-রক্ষকদের হুঁশিয়ারি দিয়ে আইন হাতে তুলে না নিতে সতর্ক করে দিয়েছিলেন। মোদীজী ২০১৯-এর বিশাল জয়ের পরে প্রথম ভাষণে ‘সবকা সাথ, সবকা বিকাশ এবং সবকা বিশ্বাস’ ধ্বনি দেশের সকল ধর্মীয় জাতিগোষ্ঠীর সমানাধিকারের আওয়াজ তুলেছেন। মোদী সরকারের ধর্মীয় সংখ্যালঘু মন্ত্রক স্কুলছুট সংখ্যালঘু ছাত্রীদের দেশের মুখ্যধারার শিক্ষায় উদ্যোগী করতে মাদ্রাসার শিক্ষকদের বিশেষ প্রশিক্ষণের মাধ্যমে মাদ্রাসায় হিন্দি, ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞান, কম্পিউটার শিক্ষার প্রসার ঘটানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। মোদী সরকারের 3E পলিসি অর্থাৎ Education, Employment, Empowerment-এর কার্যক্রমের মাধ্যমে আগামী ৫ বছরে প্রি মেট্রিক, পোস্ট মেট্রিক, প্রফেশনাল এবং টেকনিক্যাল কোর্সের সহায়তায় ৫ কোটি সংখ্যালঘু শিক্ষার্থীদের বৃত্তি প্রদান করা হবে, তার ৫০ শতাংশ ছাত্রী হবে। এই বৃত্তিতে আর্থিকভাবে দুর্বল ছাত্রীদের জন্য ১০ লাখেরও অধিক ‘বেগম হজরত মহল বালিকা ছাত্রী বৃত্তি’যুক্ত আছে। সংখ্যালঘু মন্ত্রক ‘পড়ো এবং বাড়ো জাগরতা অভিযান দেশের প্রথম ৬০ ধর্মীয় সংখ্যালঘু এলাকা থেকে শুভারম্ভ হবে। এ ছাড়াও কেন্দ্র এই সরকার তাদের প্রাথমিক সিদ্ধান্তে আর্থিক দিক দিয়ে পিছিয়ে পড়া অল্পসংখ্যক তথা মুসলমান, খ্রিস্টান, শিখ, জৈন, বৌদ্ধ, পারসি যুবাদের জন্য কেন্দ্র ও রাজ্যে সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার ফ্রি কোচিং ব্যবস্থাপনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। মোদী সরকারের ধর্মীয় অল্প সংখ্যকদের প্রতি এরূপ সিদ্ধান্ত সবকা সাথ বিকাশ এবং সবকা। বিশ্বাসের প্রতিফলন।
‘জয় শ্রীরাম’ ধবনি কাউকে দিয়ে জবরদস্তি বলানো নিশ্চিত অপরাধ, তেমনি কাউকে ‘জয় শ্রী রাম’ ধ্বনিতে বাধাদান করাটাও সংবিধানের অনুচ্ছেদ ২৫-এর ‘ধর্মীয় স্বাধীনতার অধিকার’ খর্বের আওতায় পড়ে। পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ ২৪ পরগনার বিষ্ণুপুরের বাখারহাট উচ্চ বিদ্যালয়ে কয়েকজন পড়ুয়া জয় শ্রীরাম ধ্বনি দেওয়ায় বহিরাগত কিছু যুবক বিদ্যালয়ে ঢুকে বেধড়ক মারধর করে। ঠিক তেমনি হাওড়ার শ্রীরামকৃষ্ণ শিক্ষালয়ে প্রথম শ্রেণীর এক ছাত্র আরিয়ান সিংহ জয় শ্রীরাম বলায় ওই স্কুলের শিক্ষকের হাতে নিগৃহ হয়। নবদ্বীপে শঙ্কর দেবনাথ নামে বছর একত্রিশের যুবককে ‘জয়। শ্রীরাম’ এবং নরেন্দ্র মোদী’ জিন্দাবাদ স্লোগান তৃণমূল গুন্ডারা সেই বাড়িতে ঢুকে ভাঙচুর চালায়। এই ঘটনাগুলো দেশের মিডিয়া হাউস এবং বুদ্ধিজীবীদের ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা বা মব লিনচিংয়ের সংজ্ঞায় আসবে কিনা জানা নেই! দেশের একটি বিশেষ মহল মিথ্যে ধর্মীয় অসহিষ্ণুতার জিগির তুলে আন্তর্জাতিক মহলে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করতে চায়। উদারণস্বরূপ উত্তরপ্রদেশের উন্নাওয়ে এক মাদ্রাসা ছাত্রকে মারধর করে ‘জয় শ্রীরাম’ বলানোর অভিযোগ আসে। কিন্তু প্রদেশের এডিজি তদন্ত করে জানতে পারেন ঘটনাটি খেলার ময়দানে বাচ্চাদের মধ্যে ক্রিকেট খেলা নিয়ে সামান্য ঝগড়াকে অহেতুক সাম্প্রদায়িকতার রং ঢালার চেষ্টা করা হয়।
সম্প্রতি সোশ্যাল মিডিয়ায় একটি ভাইরাল হওয়া ভিডিয়োতে দেখা যায় পশ্চিমবঙ্গের কোচবিহারে আসগর আলিকে কান ধরিয়ে জবরদস্তি ‘জয় শ্রীরাম’ বলিয়ে উঠবস করানো হচ্ছে। পরে প্রাথমিক তদন্তে উঠে আসে তৃণমূল আশ্রিত আফসি মিঞা বিজেপিকে কালিমালিপ্ত করার জন্য নিজে ঘটনাটি ঘটায়। উত্তরপ্রদেশের কানপুরে এক অটোচালককে মধ্যে রাতে কিছু দুষ্কৃতী ‘জয় শ্রীরাম’ বলানোর জন্য মারধর করার অভিযোগ আসে। তদন্তে শহরের এসপি রবীনা ত্যাগী জানান, সেটি মদের টেবিলে বন্ধুদের মধ্য ঝগড়া এবং মারধরের ঘটনা, কোনো সাম্প্রদায়িক হিংসার ঘটনা নয়। তাই এটা স্পষ্ট যে এরকম অনেক মিথ্যে সাজানো ঘটনায় শ্রীরামের নামে কুৎসা রটানো হচ্ছে। কয়েকবছর আগে এরকম জুবায়ের নামক এক যুবককে সাম্প্রদায়িক হিংসায় ট্রেন থেকে ফেলে মারার গুজব উঠেছিলো, পরে তদন্তে প্রমাণ হয় ঘটনাটি ছিল নিছক ট্রেনের আসন নিয়ে ঝগড়া।
এরকম ভুয়ো ও কয়েকটি বিচ্ছিন্ন ঘটনাকে কেন্দ্র করে আমেরিকার বিদেশ মন্ত্রণালয়ের ধর্মীয় স্বতন্ত্রতা রিপোর্ট ২০১৮-তে ভারতে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উ পর হিন্দুত্ববাদী সংগঠনের হামলার অভিযোগ আনে। ঝাড়খণ্ডের গণপিটুনির ঘটনা রাষ্ট্র সঙ্ঘের মানবাধিকার পরিষদে আলোচনা হয়। কিন্তু ভারতে ধর্মীয় সংখ্যাগুর এবং তাদের উপসনাস্থলে হামলার ঘটনা ধর্মনিরপেক্ষতার ভারী পাথরে চাপা পড়ে যায়। রাজস্থানে এক দলিত যুবক মুসলমান মেয়েকে ভালোবাসায় মব লিনচিংয়ের শিকার হয়ে মৃত্যু ঘটে। বিহারে ভগবানপুরের কাউন্সিলর মহম্মদ খুরশিদ তার বন্ধু দের সঙ্গে মিলে এক হিন্দু মা-মেয়েকে ধর্ষণ করে এবং মাথার চুল কেটে দেয়। সিউড়ির বারইপুর গ্রামে মাহফিজুর, খায়রুল, বাবু শেখরা হিন্দুদের মেরে গ্রামছাড়ার ফরমান দিয়েছে। রাজধানী
দিল্লির ১০০ বছরের দুর্গামন্দির মুসলমান। গুন্ডারা গুড়িয়ে দিয়েছে, এরকম হাজারো ঘটনা কয়েক পৃষ্ঠায় লিখে শেষ করার মতো নয়। কিন্তু হায়, নির্দিষ্ট কয়েকটি বিচ্ছিন্ন ঘটনাকে কেন্দ্র করে দেশকে কিছুদিন পরপর অস্থির করে তোলার ষড়যন্ত্র চলছে। ২৮ সেপ্টেম্বর ২০১৫ থেকে ৭ জুন ২০১৯ পর্যন্ত মব লিনচিংয়ের ঘটনায় ভারতে মোট ১৪১ জনের প্রাণহানি ঘটে, যেখানে ৭০ জন মুসলমান এবং ৭১ জন হিন্দু। এটা অত্যন্ত সুখকর খবর যে মব লিনচিংয়ের ঘটনা আটকাতে উত্তরপ্রদেশ সরকার দোষীদের জন্য আজীবন কারাবাসের আইনপ্রণয়ন করতে চলেছে।
রঞ্জন কুমার দে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.