মীরা মুখোপাধ্যায় (১৯২৩-১৯৯৮), এই নামটার সঙ্গে প্রথম পরিচয় খুব অদ্ভুতভাবে। সম্ভবত, ২০১৭-এর প্রথমদিকে নন্দিনী সুন্দরের একটি বই THE BURNING FOREST India’s War in Bastar বেশ হৈচৈ ফেলে দেয়। বস্তারে সাধারণ মানুষের উপর রাষ্ট্রশক্তির যড়যন্ত্র নিয়ে খুব ধারালো ভাষায় নিন্দা করেন প্রফেসর সুন্দর। বস্তার নিয়ে আরও জানার আগ্রহে যখন বেশকিছু বই আর পত্রিকার সন্ধান করছি, সেই সময় ভাস্কর মীরা মুখোপাধ্যায়ের নাম সামনে আসে। শিল্পীর কাজ তখন সেইভাবে উপলব্ধি করতে না পারলেও, শিল্পের জন্য, নতুন কিছু জানার আগ্রহে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন প্রান্তে তাঁর ছুটে যাওয়া অবাক হয়ে পড়তে শুরু করি। মীরার সমগ্র জীবন ফিরে দেখতে গেলে এখনও সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হিসাবে আবির্ভূত হয়, বস্তার।
১৯২৩ সালে কলকাতার বউবাজারে এক একান্নবর্তী পরিবারে মীরার জন্ম। মাত্র ১৪ বছর বয়সে তাঁকে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ইন্ডিয়ান সোসাইটি অফ ওরিয়েন্টাল আর্টে ভর্তি করে দেওয়া হয়। পরবর্তী চার বছর এখানেই চিত্রশিল্পী হিসাবে নিজেকে তৈরি করেন তিনি। এরপর, দিল্লির পলিটেকনিকে পেন্টিং, গ্রাফিক্স ও স্কাল্পচার নিয়ে ডিপ্লোমা করেন। ১৯৫২ সালে শিল্পী দিল্লি থেকে ফিরে শান্তিনিকেতনে কাজ শুরু করেন। এখানেই তাঁর পরিচয় হয় ইন্দোনেশিয়ার শিল্পী আফান্দি কোসোমার সঙ্গে। কোসোমার সঙ্গে পরিচয় মীরার শিল্পদর্শনকে বেশ প্রভাবিত করে। শুধু ছবি না এঁকে, নিজের তৈরি শিল্পকর্মকে বিশ্লেষণ করার মন্ত্র তিনি কোসোমার কাছে লাভ করেন। উচ্চতর শিক্ষার জন্য মীরা ১৯৫৩ সালে বার্লিনের একাডেমি ডের বিল্ডেন্ড কুন্সট (Akademie der Künste/Academy of Arts)-এ যোগ দেন। এখানে তিনি টোনি স্ট্যাডলার ও হাইনরিক কার্চনারের মতো শিল্পীদের সহচর্য লাভ করেন। বলা যেতে পারে তাঁদের হাত ধরেই ভাস্কর মীরা মুখোপাধ্যায়ের জন্ম। ভারতে ফিরে বিভিন্ন জায়গায় শিল্পকলার শিক্ষিকা হিসাবে নিযুক্ত থাকলেও নতুন কিছু করার নেশা সবসময় তাঁকে অস্থির করে রাখত। অবশেষে ১৯৬০ সালে নিজের বাঁধা মাইনের চাকরিকে বিদায় জানিয়ে ছত্তিশগড়ের বস্তারে কাজ শুরু করেন মীরা। সামনে এক নতুন জগত খুলে যায়।
বস্তারে উপজাতিদের সঙ্গে থেকে ডোকরা কাস্টিং-এর পদ্ধতি শিখতে শুরু করেন শিল্পী। এই কাজ হাতে কলমে শিখতে কম কষ্ট সহ্য করতে হয়নি তাঁকে। বস্তারের জঙ্গলে এক নতুন জীবনযাত্রা শুরু করতে হয়। কারিগরের খোঁজে তিনি গঙ্গামুন্ডা, দান্তেওয়াড়া, ভৈরমগড় অক্লান্তভাবে চষে বেড়িয়েছেন। এখানকার স্থানীয়দের সঙ্গে থেকে তাদের জীবনযাত্রা খুব গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন। আদিবাসীদের প্রতি অসম্ভব শ্রদ্ধাশীল ছিলেন মীরা। এখানকার মানুষদের শিল্পবোধ, খাদ্যাভ্যাস, বৈবাহিক জীবন, প্রেম, দুঃখ, লড়াই সবকিছুর বর্ণনা শিল্পীর বিভিন্ন সাক্ষাৎকার ও লেখায় বারবার ফুটে উঠেছে। একটি সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, ‘আমার জীবনে যতকিছু দুঃখ-আঘাত-কষ্ট এসেছে, এবার তা যেন সোনা হয়ে আমার মনকে চারিদিক থেকে ভরিয়ে দিল। তখন, ১৯৬০ সালে জগদলপুরে এত লোক ছিল না। প্রথমে তো এদের খুঁজে বার করি। তারপর এই প্রকৃতি ও প্রকৃতির টুকরো সহজ প্রাণবন্ত লোকগুলো, আর তাদের সহজ জীবন ও মর্ম দিয়ে করা কাজ – প্রতিদিন আমি একটু-একটু শিখি।’
Ashoka at Kalinga, ১৯৭২, নয়া দিল্লি’র মৌর্য শেরাটন হোটেল প্রাঙ্গনে রয়েছে ব্রোঞ্জের এই ভাস্কর্যটি
t
মীরা লক্ষ্য করেছিলেন, এখানকার মানুষদের ধর্মীয় বিশ্বাস, রীতিনীতি ভীষণভাবে তাদের শিল্পবোধকে প্রভাবিত করেছিল। বস্তারে এসে শিল্পী দন্তেশ্বরী নামের সঙ্গে পরিচিত হন। দন্তেশ্বরী বস্তার রাজপরিবারের কুলদেবী। আদিবাসীদের আরাধ্যা্। এখানে দন্তেশ্বরীর বিভিন্ন মাপের মূর্তি তৈরি হয়। পুজা-পার্বণের পাশাপাশি এই মূর্তি মাড়াই বা মেলাতে বিক্রি হয়। দশহরা, অর্থাৎ পুজো থেকে আরম্ভ করে ফাল্গুন মাস পর্যন্ত বিভিন্ন জায়গায় চলে এই মেলা। এই মূর্তি নিয়ে অদ্ভুত ঘটনার সাক্ষী হন মীরা। রায়পুর থেকে কিছু দূরে কেশকাল। সেখানে পাহাড়ের উপর একটি জায়গাকে আদিবাসীরা জেল হিসাবে ব্যবহার করে। নতুন মূর্তি কেনার পর যদি বাড়িতে কোনও দুর্ঘটনা ঘটত, তাহলে সেই মূর্তিকে তারা জেলে রেখে আসত। মানে মূর্তিকে বন্দি করা হত। এই ছোটো, ছোটো ঘটনাগুলি শিল্পী খুব গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেছিলেন। দান্তেওয়াড়া থেকে ৪০ মাইল দূরে ভৈরমগড়ের মহিষ শিং পরা মাড়োয়াদের নাচের সৌন্দর্য তাঁকে মুগ্ধ করে। এখানে তিনি একসঙ্গে অনেকগুলি ভৈরব দেখতে পেলেন-বন ভৈরব, চণ্ডাল ভৈরব, ঘাট ভৈরব, জটা ভৈরব, চিনা ভৈরব, নৌকা ভৈরব। বনের ভিতরে এমন অপূর্ব মূর্তিগুলি ভাঙা-ভাঙা মন্দিরগুলিতে ছড়িয়ে আছে। বন ভৈরবের মুখে একেবারে মাড়োয়া আদল। চিনা ভৈরব নৃত্যভঙ্গিমায়। এখানে কোনও মূর্তির সঙ্গে কোনও মূর্তির মিলে নেই। শিল্পীর কথায়, ভৈরবরা কোথাও নিস্তব্ধ, কোথাও তাদের মুখে অট্টহাসি, কোথাও নৃত্যের ছন্দে তারা সমস্ত বনকে জাগিয়ে দিচ্ছে। জগদলপুরের দশহরার সময় মীরা প্রথম দেখলেন এখানকার রাজা তথা দন্তেশ্বরী মন্দিরের প্রধান পুরোহিত প্রবীরচন্দ্র ভঞ্জ দেও-কে। রাজার সঙ্গে পরে কেন্দ্রীয় সরকারের বিরোধ চরমে ওঠে। শান্ত বস্তার হঠাৎ অশান্ত হয়ে উঠলো। ছেনি, হাতুড়ির পরিবর্তে হাতে তখন তীর-ধনুক। পুরো অঞ্চলে যুদ্ধের দামামা ধ্বনিত হচ্ছে। এই পরিবর্তনটা শিল্পী খুব কাছ থেকে দেখেছিলেন। আদিবাসীরাও প্রবীরচন্দ্র ভঞ্জ দেও-কে সমর্থন জানিয়ে সরকারের বিপক্ষে গেল। চূড়ান্ত অস্বস্তিকর পরিস্থিতি তৈরি হল সমগ্র অঞ্চলে। পুলিশ ও আধা সামরিক বাহিনীতে ছয়লাপ চারিদিক। ১৯৬১ সালের ২৭ মার্চ দণ্ডকারণ্য সমাচারে ‘Pravir Killed’-এর খবর প্রকাশিত হল। অনেক বছর পর আবার বস্তারে গিয়েছিলেন মীরা। কিন্তু প্রথমবারের সঙ্গে এই জায়গার কোথাও মিল নেই। আগে মাইলের পর মাইল বনে ঘেরা ছিল। সেখানে এখন চারিদিকে গাছ কেটে, কেটে চওড়া রাস্তা তৈরি হয়েছে। মানুষজনের জীবনযাত্রাও পাল্টে গেছে অনেক। আদিবাসীদের সেই সহজ, সরল জীবনযাত্রা যেন উধাও। এই পাল্টে যাওয়া সমাজ তাঁকে মানসিকভাবে খুব পীড়া দেয়।
Seated Woman, ব্রোঞ্জ
একসময় যে বস্তারে ডোকরা কাস্টিং শিখতে গিয়েছিলেন শিল্পী, সেই জায়গা কখন যেন মীরার মন ও মননে স্থায়ী জায়গা করে নেয়। তাঁর শিল্পকর্মেও এই সময়ের শিক্ষার ছাপ খুবই স্পষ্ট। ৭০-এর দশক থেকে মীরা দেশ ও বিদেশের মাটিতে নিজের শিল্পকর্মের প্রদর্শন শুরু করেন। Christie’s মতো বিখ্যাত অকশন হাউসে তাঁর কাজ প্রদর্শিত হয়।
মীরার শিল্পসাধনায় বন্ধু নির্মল সেনগুপ্তের এলাচি গ্রামের বাড়িটির বিশেষ ভূমিকা আছে। এখানেই নিজের কর্মক্ষেত্র গড়ে তোলেন শিল্পী। স্থানীয় মানুষদেরও নিজের মতো গড়েপিঠে নিয়ে শিল্পকর্মে যুক্ত করেন। এদের মধ্যে অনেকেই দক্ষ শিল্পীতে পরিণত হন। মহিলাদের নিয়ে কাঁথার কর্মশালা শুরু করেন। পাশাপাশি চলতে থাকে তাঁর ফাউন্ড্রি বা ঢালাইয়ের কাজ। সাধারণত মূর্তি বানানোর সময় প্লাস্টার অব প্যারিস দ্বারা মূল অংশটি তৈরি করা হয়। কিন্তু মীরা ব্যবহার করতেন এঁটেল মাটির সঙ্গে খড়ের টুকরো, ধানের কুড়ো, ছাঁকা গোবর আর বেলে মাটির সংমিশ্রণ। এই দিয়ে মূল অংশটি তৈরি হত। তারপর মৌচাক থেকে সংগৃহীত মোমের সুতো বানিয়ে সেটি খাঁজে, খাঁজে জড়িয়ে সমানভাবে মূল মূর্তিটা তৈরি করা হত। এরপর গোলা-মাটি তার উপর মোটা টেপা-মাটি। পরে বালি-মাটি, একদম উপরে তুষ-মাটির প্রলেপ। যখন ফার্নেসে দেওয়া হত, মোমটা গলে গিয়ে একটা নেগেটিভ স্পেস তৈরি হত। সেখানে গলা ধাতু ঢেলে দেওয়ার ফলে মূর্তির ভিতরটা ফাঁপা থেকে যায় ও তাতে মূর্তির ওজন কম থাকে। ইটের গোল উনুন বা ভাটায় তিনি কাজ করতেন। এর আঁচ ঠিকমতো বজায় রয়েছে কিনা, সে দিকে নজর রাখতেন নিজেই। এইভাবে দেশীয় ও পশ্চিমি ধাঁচের মিশ্র পদ্ধতিতে তিনি কাজ শুরু করেন। Ashoka at Kalinga, Earth Carriers, Smiths Working Under a Tree, Mother and Child, Srishti, The Rumour and portrait of Nirmal Sengupta- মতো কাজগুলি মীরাকে শিল্পী হিসাবে অমর করে রাখবে। কাজই তাঁর কাছে ধ্যান ছিল এবং সেই ধ্যানমগ্ন অবস্থাতেই তাঁর শেষ কাজ, গৌতম বুদ্ধের ১৪ ফুটের ধ্যানস্থ মূর্তি শেষ করে যেতে পারেননি।
Smiths Working Under a Tree
ভাস্করের পাশাপাশি লেখক হিসাবেও আত্মপ্রকাশ করেন মীরা। ১৯৭৮ সালে তাঁর Metal Craft in India নামে একটি মনোগ্রাফ প্রকাশিত হয়। পরবর্তীতে তিনি Metal Craftsmen in India (1979) আর In Search of Viswakarma (1994) নামে দুটি শিল্প বিষয়ক বইও লেখেন। ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে বিশ্বকর্মাদের খোঁজ করতে গিয়ে কোনো বাধা বিপত্তি শিল্পীকে দমাতে পারেনি। আমৃত্যু (১৯৯৮) শিল্পের সাধনায় তাঁর প্রাণ নিবেদিত ছিল।