কথায় বলা হয় যে,সময় ও স্রোত কারুর জন্য অপেক্ষা করেনা।কিন্তু জাতীয় জীবনে কোনো কোনো তারিখের গুরুত্ব ইতিহাসে অপরিসীম।১০-ই মে এমনই একটি তারিখ যার সাথে আধুনিক ভারতের ইতিহাসের গভীর সম্পর্ক জড়িয়ে রয়েছে।
এই দিনটি ভারতবাসীকে উদ্বুদ্ধ করে অত্যাচারি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির (East India Company) বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিদ্রোহ করার।সেদিন সশস্ত্র বিপ্লবের অগ্নিশিখা ছড়িয়ে পড়েছিল ব্যারাকপুর (Barrackpore) থেকে মিরাট (Meerut)।দিল্লি (Delhi) থেকে চেন্নাই(Chennai)।হিন্দুর স্থান ভারতের হাজার হাজার “হিন্দুস্তানি”,ভারতজননীর বীর সন্তানরা আত্ম বলিদান দেন বিদেশী শাসকের বিরুদ্ধে স্বাধীনতার সংগ্রামে!মাতৃভূমির জন্য তাঁদের এই আত্মোৎসর্গ বৃথা যায়নি।
এই বিদ্রোহকেই স্বতন্ত্রী বীর সাভারকার(Swatantryveer Savakar) স্বাধীনতার জন্য ” প্রথম সশস্ত্র সংগ্রাম” বলে অভিহিত করেছেন।এরই ফলে ১৯৪৭-এর ১৫ই আগষ্ট স্বাধীনতা প্রাপ্তীর পথ মসৃণ হয়েছিল।এই বিদ্রোহই ভারতে প্রথম বিদেশী-বিধর্মী সাম্রাজ্যবাদী শাসকের সিংহাসন নাড়িয়ে দিয়েছিল।অবিস্মরণীয় এই সংগ্রামকে বিভিন্ন নামে অভিহিত করা হয়েছে।”সিপাহী বিদ্রোহ” বা “SEPOY MUTINY” , “THE UPRISING OF 1857″ বা ” সূর্যোদয়ের ১৮৫৭” , কিম্বা ” THE 1857 REBELLION” বা ” ১৮৫৭-র বিদ্রোহ” !
ঘটনাক্রমে এটা ছিল সর্ব ভারতীয় ক্ষেত্রেই মাতৃভূমির জন্য মুক্তির সংগ্রাম।যার সুসংহত নেতৃত্ব দিয়েছিলেন বাহাদুরশাহ জাফর (BAHADURSHAH ZAFAR),নানাসাহেব পেশওয়া (NANASAHEB PESHWA),তাঁতিয়া টোপি (TANTYA TOPE), ঝাঁসির রাণী লক্ষ্মীবাই (JHANSI RANI LAXMIBAI), বেগম হজরত মহল (BEGUM HAZRAT MAHAL) এবং অন্যান্য ভারত মায়ের বীর সন্তানগণ।এই মহাসংগ্রামে হিন্দু-মুসলিম সকল হিন্দুস্তানবাসী “হিন্দুস্তানী” যোগ দিয়েছিলেন।হিন্দু-মুসলিম ভেদাভেদের কোনো সীমানারেখা ছিল না।হিন্দু-মুসলমানের এই ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম বিষয়ে আলোকপাত করেছেন ব্রিটিশ ইতিহাসবিদ জর্জ উইলিয়ম ফরেস্ট (GEORGE WILLIAM FORREST) তাঁর গ্রন্থ “THE INTRODUCTION OF THE STATE PAPERS“-এ।তিনি লিখেছেন “স্বাধীনতার যুদ্ধ অল্প দিনেই শেষ হইল“।
তিনি আরও উল্লেখ করেছেন যে,”ভারতীয়দের বিদ্রোহ আমাদের অনেক কিছুই শিক্ষা দিয়েছে।যা ইতিহাসবিদের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।কিন্তু সবচেয়ে বড়ো সতর্কতা হল এই যে,বিপ্লবের সময় কি ব্রাহ্মণ কি শুদ্র কি হিন্দু কি মহমেডান সকলেই আমাদের বিরুদ্ধে একতাবদ্ধ হতে পারেন”!
স্বাধীন জাতি হিসেবে আমরা প্রতি বছর আড়ম্বর সহকারে ১৫-ই আগষ্ট স্বাধীনতা দিবস উদযাপন করি।এতে কেউ দ্বিমত জানান না।কিন্তু আমরা কি সত্যি সত্যি-ই সচেতন স্বাধীনতা সংগ্রামীদের আত্ম বলিদান বিষয়ে!অনামা-প্রচারের পাদপ্রদীপের আড়ালে যে হাজার হাজার ভারত মায়ের বীর সন্তানরা জন্মভূমির মুক্তি কামনায় জীবন বিসর্জন দিয়েছেন।তাঁদের কি আমরা মনে রেখেছি ! তাঁদের উদ্দেশ্যে কি শ্রদ্ধা জানাই!আমাদের মধ্যে কয়জন জানি--যাঁরা আন্দামানের সেলুলার জেলের অন্ধকুঠুরিতে কী তীব্র অত্যাচার সহ্য করে প্রাণ দিয়েছেন!আজকালকার শিশু পিজা হাটস বা ম্যাকডোনাল্টের আউটলেটের খবর বিষয়ে পারদর্শী।যথেষ্ট সচেতন এ-সকল বিষয়ে!কিন্তু তাঁরা ঘুণাক্ষরেও জানে না ১৮৫৭ সালের ১০-ই মে কী ঘটেছিল!
স্বাধীনতা সংগ্রামের পথচলা শুরু হয় ১৮৫৭-র মহা বিদ্রোহের মধ্য দিয়ে।তার ১৬১ বছর পরে এসে ১৯৪৭ সালের ১৫-ই আগষ্ট সেই চলার সফল পরিসমাপ্তি ঘটে।লক্ষ লক্ষ স্বাধীনতা-যোদ্ধা,সৈনিক,মৌলভী,সাধুসন্ত এবং আমাপর সাধারণ ভারতীয় তাঁদের বিসর্জন দেন দেশমায়ের চরণ কমলে।
ভারত এক হাজার বছর ব্যাপী রাষ্ট্রীয় দাসত্বের সাক্ষি হয়েছে।বার বার বহিঃশত্রুর আক্রমণ প্রতিহত করেছে।বিদেশী লুঠেরা এসেছে যুগে যুগে।কালের নিয়মে ভারত তাদের পিছু ফিরতে বাধ্য করেছে।রানা প্রতাপ,শিবাজী মহারাজ,ছত্রশাল বুন্দেলা,গুরু গোবিন্দ সিং এবং আরও অনেক বীর আমৃত্যু যুদ্ধ করে গিয়েছেন বিদেশী শত্রুর সঙ্গে।তবুও দেশ বাববারই পরাধীন হয়েছে।কখনও মুঘলদের অধীন কভু-ব্রিটিশ শাসনাধীনে শৃংখলিত হয়েছে ভারত মা!১৮৫৭-র মহাবিদ্রোহ পর্যন্ত ভারতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি-ই ভারত শাসন করত।সিপাহী বিদ্রোহ ব্রিটিশের বুকে কম্পন ধরিয়ে দিয়েছিল।সে-বছরই যুদ্ধ শেষে ব্রিটিশ রাজশক্তি পুরোপুরি ভাবে ভারতে সাম্রাজ্যবাদী শাসন শুরু করে।
১০-ই মে আধুনিক ভারতের ইতিহাসে এক "সন্ধিক্ষণ"!সিপাহী বিদ্রোহের অব্যবহিত পরই ব্রিটিশরা ভারতে ব্যবহারিক বিজ্ঞানের প্রচলন শুরু করে।ইংরাজি শিক্ষা চালু,রেলপথ বসানো,ডাক ও তার ব্যবস্থা স্থাপন ও অন্যান্য বৈজ্ঞানিক সুযোগ সুবিধা চালু করে।এই উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থায় ভারতের কল্যাণের চেয়ে ইংরেজদেরই লাভবান করেছিল বেশি।যে-কোনো অপ্রীতিকর পরিস্থিতি দমনে,বিপ্লবীশক্তিকে বিনাশ,বিপ্লবীদের হত্যা করা নয়ত তাঁদের বন্দি করে রাখতে,নতুবা তাঁদের "কালা পানি" পার করে আন্দামানের সেলুলার জেলে নির্বাসন দিতে নতুন যোগাযোগ ব্যবস্থা প্রভূত সাহায্য করে বিদেশী শাসককে।যুদ্ধক্ষেত্রে বা অন্যান্য ক্ষেত্র থেকে ধৃত স্বাধীনতা যোদ্ধাদের প্রকাশ্যে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা ব্রিটিশরা নিয়মিত করতে থাকে।ভারতের স্বাধীনতা অর্জনের সংগ্রামকে ইংরেজ দেখত সন্ত্রাসী কার্যকলাপের দৃষ্টিতে।তারা ভারতীয় জনমানসে এই ভয় ঢোকাতে চেয়েছিল যে,ভবিষ্যতে কোনো ভারতীয় যেন ব্রিটিশের দিকে আঙুল উঁচিয়ে কথা বলার সাহস না-পায়।
১৮৫৭-র মহাসংগ্রাম ছিল পূর্ব পরিকল্পনামাফিক একটি কৌশল।সংগ্রামের পরিচালকগণ পরিকল্পনা মতো প্রচার করে দেন যে,আক্রমণ শুরু করা হবে ১৮৫৭ সালের ৩১ মার্চ।কিন্তু,গোপনে ১০-ই মে তারিখই ঠিক করা ছিল।ওইদিন মিরাটে মঙ্গল পান্ডে এক ব্রিটিশ আধিকারিককে আক্রমণ করেন।এই আক্রমণের মধ্য দিয়েই মহাবিদ্রোহের সূচনা হয়।এবং তা দাবানলের মতো দেশের অন্যান্য অংশেও দ্রূত ছড়িয়ে পড়ে।
মিরাট ছিল ব্রিটিশদের কাছে খুবই নিরাপদ জায়গা।হিন্দু সৈনিকদের এক ধরণের টোটা বা কার্তুজ দেওয়া হয়েছিল।যা একটি আবরণে মোড়া থাকত।ওই আবরণ তৈরি হত চর্বি দিয়ে।হিন্দু সৈনিকরা ওই টোটা ব্যবহার করতে অস্বীকার করেন।এবং ব্রিটিশ সেনা-আধিকারিককে আক্রমণ করেন।এই ঘটনার জন্য ৮৫ জন সেনাকে কোর্ট মার্শাল করা হয় এবং ৯ জনকে জেলে ঢোকানো হয় ৯-ই মে তারিখে।
ঐতিহাসিক তথ্য মতে,১০-ই মে কিছু সেনা আধিকারিক ব্যারাকে ছিলেন।বাকিরা রবিবারের প্রার্থনার জন্য গির্জায় গিয়েছিলেন।তাঁরাও শব্দ শুনে বেরিয়ে আসেন।সেদিন বেশির ভাগ সেনা আধিকারিকই প্রাণ হারান সিপাহীদের গণ-অভ্যুত্থানে।নিহতদের মিরাটের খ্রিস্টান সমাধিক্ষেত্রে সমাহিত করা হয়।তাঁদের উত্তর পুরুষরা আজও আসেন সমাধিক্ষেত্রে নিহতদের শ্রদ্ধা জানাতে।এই সমাধিক্ষেত্রই উত্তর ভারতের বৃহত্তম এবং ২৩ একক জমি নিয়ে।
কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় হল এই যে,আমরা স্বাধীন ভারতের নাগরিকরা আমাদের পূর্ব পুরুষের আত্ম বলিদানের কথা ভুলে গিয়েছি!তাঁরা যে মাতৃভূমির দাসত্ব মোচনের জন্য নিজেদের জীবন উৎসর্গ করেছেন,সে-কথা আমরা মনে রাখিনি।আমরা আমাদের ব্যক্তি স্বার্থ ও লোভে এতটাই আচ্ছন্ন যে,তাঁদের কথা আমাদের জানতেই দেওয়া হয় না!তাঁরা যে তাঁদের বর্তমান দিয়ে আমাদের সুখের ভবিষ্যৎ গড়ে দিয়েছেন তা আর স্মরণে আসে না।
মিরাট ক্যান্টনমেন্টে ভারতীয় সৈনিকদের বিদ্রোহ ঐতিহাসিক ভাবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।এটা ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামের অভিমুখ রচনা করে দিয়েছিল।কিছু ইউরোপিয়ান পড়ুয়ারা এই মহাবিদ্রোহকে “SEPOR MUNITY” বা “GADAR” বলে ছোট করে দেখায়।কিন্তু ভারতীয় জনমানসে এই অভ্যুত্থান সুদূর প্রসারি প্রভাব ফেলে।অর্থনৈতিক-সামাজিক-ধর্মীয় সবক্ষেত্রের ভিতই নড়ে গিয়েছিল।এটাই ছিল প্রথম লোকপ্রিয় স্বতঃস্ফূর্ত জন-অভ্যুত্থান যার কোনো একক পরিচালক ছিল না।এটা ছিল সুসংহত লড়াই।যার প্রথম সারিতে ছিলেন বাহাদুরশাহ জাফর-নানাসাহেব পেশওয়া-ঝাঁসির রাণি লক্ষ্মীবাই এবং তাঁতিয়া টোপি।
স্বতন্ত্রী বীর বিনায়ক দামোদর সাভারকার সঙ্গত কারণেই এই জন-অভ্যুত্থানকে “প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম” বলে উল্লেখ করেছেন।ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির নথিপত্র,ব্রিটেনের মহাফেজখানার সরকারি তথ্যাটি বিশ্লেষণ করে শ্রী সাভারকার মহাবিদ্রোহের উপর একটি গবেষণা গ্রন্থ রচনা করেন।স্বাধীনতা সংগ্রামের সুবর্ণবর্ষে লন্ডনে একটি স্মারক অনুষ্ঠান আয়োজিত হয়েছিল।ভারত মায়ের বীর সন্তানদের সেখানে শ্রদ্ধা জানানো হয়।পরবর্তীকালে সাভারকারের গ্রন্থ বিপ্লবীদের প্রেরণা যুগিয়েছে বহুকাল।
যাইহোক।মাতৃভূমির প্রথম মুক্তি সংগ্রাম নানাবিধ কারণে ব্যর্থ হয়।তার বিস্তারিত আলোচনার অবকাশ এখানে নেই।দুঃখের বিষয় স্বাধীন ভারতে মহাবিদ্রোহের সেনানিরা অবহেলিতই রয়ে গেলেন!
আমরা স্মরণ করি নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসুকে।তাঁর রণধ্বনি “দিল্লি চলো“!এই রণ হুংকার প্রথম গর্জে উঠেছিল ১৮৫৭ সালের ১০-ই মে তারিখে।এবং লালকেল্লার রামপার্ট ব্যারাকে জাতীয় উত্তোলন করেন ভারতের বীররা।আমরা তাঁদের আত্মত্যাগ ভুলব না।পরবর্তীকালে সুভাষ চন্দ্র নির্বাসিত বিপ্লবীদের স্মরণে আন্দামান দ্বীপের নাম দেন “শহীদ দ্বীপ” ও নিকোবরের নাম রাখেন “স্বরাজ দ্বীপ”।অগণিত স্বাধীনতা যোদ্ধা এই দুই দ্বীপের শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছিলেন।
স্বাধীনতার প্রথম মুক্তি সংগ্রাম,সেপাহীদের জীবনপণ মহাবিদ্রোহ পরবর্তী সময়ে লক্ষ লক্ষ মানুষ মুক্তিযুদ্ধে আত্মাহুতি দিতে উদ্বুদ্ধ করেছে।বীরের রক্তে রঞ্জিত পথেই এসেছে দেশের স্বাধীনতা।তাই স্বাধীন ভারত,আধুনিক ভারতের ইতিহাসে ১০-ই মে একটি স্বর্ণমন্ডিত দিবস।তাকে ভোলা যায় না।তাকে ভোলা মানে আত্মাহুতি দেওয়া বিপ্লবীদের প্রতি অসম্মান প্রদর্শন করা।
ভাষান্তর : সুজিত চক্রবর্তী