বন জঙ্গল কাটি কাটি –
ভিঁড়ি বাঁধিলি-চমকি উঠিল
নোনা জল
থরহর কাঁপে বাধাবন।
মাটি কাটার গান, জল জঙ্গলের গান….সেই রবীন্দ্রনাথের চন্ডালিকায় সবাই গাইছিল-
মাটি তোদের ডাক দিয়েছে– আয় রে চলে আয় আয় আয়॥ ডালা যে তার ভরেছে আজ পাকা ফসলে– মরি হায় হায় হায়। হাওয়ার নেশায় উঠল মেতে দিগ্বধূরা ফসল-ক্ষেতে, রোদের সোনা ছড়িয়ে পড়ে ধরার আঁচলে– মরি হায় হায় হায়। মাঠের বাঁশি শুনে শুনে আকাশ খুশি হল। ঘরেতে আজ কে রবে গো, খোলো, খোলো দুয়ার খোলো।
উপনিষদ্ বলছেন – এষাং ভূতানাং পৃথিবী রসঃ পৃথিব্যা আপো রসঃ । অপামোষধয়ো রস ওষধীনাং পুরুষো রসঃ পুরুষস্য বাগ্ রসো বাচ ঋগ্ রস ঋচঃ সাম রসঃ সাম্ন উদ্গীথো রসঃ।।
পৃথিবী হল এই চরাচর ভূত সমূহের সার। জল পৃথিবীর সার , উদ্ভিদ জলের সার, মানব উদ্ভিদের সার, বাক্ মানুষের সার, ঋগ্বেদ বাকের সার, সমবেদ ঋগ্বেদের সার এবং উদ্গীথ বা ওম্ হল সামবেদের সার।
ঋগ্বেদ বলছেন –
অর্বাচী সুভগে ভব সীতে বন্দামহে ত্বা।
যথা নঃ সুভগাসসি যথা নঃ সুফলাসসি।।
ইন্দ্রঃ সীতাং নি গৃহ্নাতু তাং পূষানু যচ্ছতু।
সা নঃ পয়স্বতী দুহামুত্তারামুত্তরাং সমাম্।।
শুনং নঃ ফালা বি কৃষন্তু ভূমিং শুনং
কীনাশা অভি যন্তু বাহৈঃ।
শুনং পর্জন্যো মধুনা পয়োভিঃ
শুনাসীরা শুনমস্মাসু ধত্তম্।।
হে সুভগা সীতা ! আমরা তোমার বন্দনা করছি তুমি আমাদের সৌভাগ্যশালী করো, সুফল প্রদান করো। ইন্দ্র সীতাকে গ্রহণ করুন, পৃষা তাকে পরিচালিত করুন, তিনি জলবতী হয়ে বৎসরের পর বৎসর শস্য দোহন করুন। লাঙ্গলের ফাল সুখে ভূমি কর্ষণ করুক। রক্ষকগণ বলীবর্দদের সঙ্গে সুখে গমন করুন। পর্জন্য মধুর জলধারায় পৃথিবীকে সিক্ত করুন। হে শুন সীর , আমাদের সুখ প্রদান করুন।
শৌনকের মতে শুন হলেন দ্যু দেবতা, অতএব তিনি ইন্দ্র। সীর হলেন বায়ু। যাস্ক বলেন, শুন বায়ু ও সীর আদিত্য। আবার সীর শব্দের আদি অর্থ লাঙ্গল বা মাটি কোপানোর যন্ত্র বিশেষ। শুক্ল যজুর্বেদে আছে সীরানি হলানি মহীধর। সুনাসীর হল কৃষিকার্যের উপকরণদ্বয় – লাঙ্গল ও লাঙ্গলের ফলা।
সীতা অর্থাৎ লাঙ্গলের ফলা দ্বারা ভূমিতে চিহ্নিত রেখা। এই সূক্তের উদ্গাতা বামদেব ঋষি স্তুতি করছেন, লাঙ্গল দ্বারা কর্ষিত রেখা বৎসর বৎসর শস্যদোহন করুন। রামায়ণের কালে সীতার জন্মকথায় তাঁর নামের আদি অর্থই নিহিত ছিল। মিথিলার রাজা জনক হল দ্বারা যজ্ঞভূমি কর্ষিত করার সময় দেবীকে সীতায় অর্থাৎ লাঙ্গলের রেখায় প্রাপ্ত হন।
যুনক্ত সীরা বি যুগা তনুধ্বং কৃতে যোনৌ বপতেহ বীজম্।
গিরা চ শ্রুষ্টিঃ সভরা অসন্নো নেদীয় ইৎ সৃণ্যঃ পক্বমেয়াৎ।।
লাঙ্গলগুলি যুক্ত করো , যুগগুলি অর্থাৎ জোয়ালগুলি বিস্তারিত করো। এ স্থানে যে ক্ষেত্র প্রস্তুত করা হয়েছে, তাতে বীজ বপন করো। আমাদের স্তবের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের অন্ন পরিপূর্ণ হোক। সৃণিগুলি নিকটবর্তী পক্বশস্যে পতিত হোক, অর্থাৎ ফসল কাটা হোক।
ভূমি কর্ষণ , মাটি কাটা এক আদিম স্বভাব, প্রাচীন পদ্ধতি অন্ন উৎপাদনের নিমিত্ত। মাটি কাটার পরিশ্রমের জন্য বেদ , বেদান্ত কত মন্ত্র উচ্চারণ করেছেন। মন্ত্র উচ্চারণ করেছেন ভূমি মাতা , মায়াময় প্রকৃতিকে তুষ্ট রাখার জন্য।
তো যুগে যুগে খাদ্য সংগ্রহের জন্য ক্ষেত নির্মাণ, পুকুর কাটা, ভেড়ি বাঁধার জন্য মাটি কাটা আবশ্যক। ভূমি কর্ষণ বা মাটি কাটা, ভেড়ি বাঁধা খুবই কঠিন কাজ। এ কাজ করতে গেলে যৌথ প্রচেষ্টার প্রয়োজন, একক চেষ্টায় মাটি কাটা, ভেড়ি বাঁধা চলে না।
সাধারণ মানুষের জীবনে কষ্টকালীন গানই ছিল কষ্ট লাঘবের মূল অস্ত্র। সে গান একক ব্যক্তির গীত নয় , যৌথ জনসংগীত। ক্ষেত, ভেড়ি করতে গেলে মাটি কাটতে হবে, তারজন্য তাই লাঙ্গল কোদাল। ঝপ্ , ঝপ্ কোদালের কোপ পড়ে নরম অথবা শক্ত মাটির বুকে। সারি বদ্ধ ভাবে লোক দাঁড়িয়ে থাকে।এক একটি মাটির চাপড়া কেটে কোদালিয়া তুলে দেয় নিকটবর্তী লোকদের হাতে। মাটির চাপড়া ভর্তি ঝুড়ি হস্তান্তরিত হতে থাকে এক হাত থেকে অন্য হাতে। তারপর গিয়ে পড়ে ভেড়ির গায়ে। কোদালিয়া মাটি কাটে কোদালে, প্রতি কোপের তালে তালে গাইছে গান, আর অন্যরা দলবদ্ধভাবে ধুয়া ধরে চলেছে। কর্মের ক্লান্তি অপনোদন হচ্ছে গানে। মন ভরে ওঠে আনন্দে। কর্ম এগিয়ে চলে গানের প্রেরণায়।
যৌথ কর্মে ক্লান্তি কম। যৌথ কর্মচেতনাই কর্মের মূল প্রেরণা। তবুও মনুষ্য কাজের মধ্যে গান গাইতে চায়। এই গান গাইতে কোনো বাদ্যযন্ত্র লাগে না। দরকার হয় না কোনো আসর , জলসার। কর্মের জন্য যন্ত্রই হয়ে ওঠে কর্মমুখর বাদ্যযন্ত্র। সুর উৎসারিত হয় কর্মের তালে তালে। যৌথ কর্মের ক্লান্তি দূর হয় গানের সুরে আর হাতিয়ারের কর্মমুখর ছন্দে মধুর হয়ে ওঠে যৌথ কর্ম।
মানুষের গানের সঙ্গে কর্মমুখর হাত ও যন্ত্র বা অস্ত্রের সম্পর্ক খুব নিবিড়।
” Human rhythm originated from the use of tolls” – George Thompson ( Rhythm and Labour)
মনে হয়, মানব সভ্যতার আদি পর্বে মানুষের কন্ঠের সহযোগী সংরাগ তুলতে সাহায্য করত নানা অস্ত্র, নানা যন্ত্র। অস্ত্র, যন্ত্র যেমন দৈহিক শ্রমের ও দৈনন্দিন কর্মের সহায়ক ছিল, তেমন সহায়ক ছিল কন্ঠ সংগীতের তাল বা লয় বিন্যাসে। কালক্রমে সেই অস্ত্র, যন্ত্র রূপান্তরিত হয়েছে নানা প্রকার বাদ্যযন্ত্র রূপে। সবই নাদব্রহ্মের খেলা….
যত্র নাদো বিলীয়তে।
তদ্বিষ্ণোঃ পরমং পদং সদা পশ্যন্তি সূরয়ঃ।
শব্দ ব্রহ্ম, ঋষি মুনিরা ওই শব্দ লাভের জন্য তপস্যা করতেন। সিদ্ধ হলে শুনতে পায়, নাভি থেকে ওই শব্দ আপনি উঠছে — অনাহত শব্দ।
একমতে, শুধু শব্দ শুনলে কি হবে? দূর থেকে শব্দ-কল্লোল শোনা যায়। সেই শব্দ-কল্লোল ধরে গেলে সমুদ্রে পৌঁছানো যায়। যে কালে কল্লোল আছে সে কালে সমুদ্রও আছে। অনাহত ধ্বনি ধরে ধরে গেলে তার প্রতিপাদ্য ব্রহ্ম তাঁর কাছে পোঁছানো যায়। তাঁকেই পরমপদ বলেছে। ‘আমি’ থাকতে ওরূপ দর্শন হয় না। যেখানে ‘আমি’ও নাই, ‘তুমিও নাই, একও নাই, অনেকও নাই; সেইখানেই এই দর্শন……
দেবী আদ্যাশক্তি , তিনি নাদব্রহ্ম বা শব্দব্রহ্ম। তিনিই বাগ বৈ ব্রহ্মা। তিনিই ত্রিধা , গুপ্তরূপিদেবী। তিনি সত্ত্বগুণাত্মিকা সরস্বতী, তিনি রজসগুনাত্মিকা লক্ষ্মী , তিনিই তামসগুনাত্মিকা মহাকালী। তিনিই ধী , ঈশ্বরী, বেদগর্ভা , আর্যা, ব্রাহ্মী । বীণার জীবন ছন্দময়। বীণার ঝংকারে উঠে আসে ধ্বনি বা নাদ। বিদ্যার দেবী সরস্বতীর ভক্তরা সাধনার দ্বারা সিদ্ধিলাভ করলে বীণার ধ্বনি শুনতে পায়। বীণার সুর অত্যন্ত মধুর। তাই বিদ্যার্থীদেরও মুখ নিঃসৃত বাক্যও যেন মধুর ও সঙ্গীতময় হয়। সেই কারণেই মায়ের হাতে বীণা। তাই দেবী সরস্বতীর আরেক নাম ‘বীণাপাণি’। প্রয়োজনে এই নাদ এই বীণা ই অস্ত্র…
“জেনে বিন্দু নাদ কলা
সত্য নিয়ে কর খেলা”।
নাদ, বিন্দু, কলাই শব্দ, জ্যোতি, গতি। শব্দ ও জ্যোতি গতিসহচর। বিন্দু জীব। জীব গতিমান, জীবই কলা, ব্রহ্মের অংশ ব্রহ্ম। জীব বিন্দুর গতি হয় পরম ব্রহ্ম বিন্দুর আশ্রয়ে। যাহারা জানেনা তাহারা মায়াবৃত-অজ্ঞ, যাহারা জানেন তাহারা তত্ত্বদর্শী, মায়ামুক্ত প্রাজ্ঞ। কথিত আছেঃ- জীবঃ শিব এব। দ্যুলোকের যত গুপ্ত-কাহিনী ইহাদের মুখে। তাঁহারা বলেনঃ- “আ যে ধামানি দিব্যানি তস্তু”। ভূলোকের পরেও ঐ দিব্যলোক, আনন্দ খেলার স্থান জীবের জন্য সুনির্দিষ্ট।
কর্মের একটি নিজস্ব ছন্দ আছে। সেই ছন্দ আরও স্বতঃস্ফূর্ত ও প্রানবন্ত হয়ে ওঠে গানের সুরে। হৃদয়ের হয়ে ওঠে গানের সুরে। মনের আনন্দে তখন স্বাচ্ছন্দ্য কাজের আনন্দ হয়ে গানের মাধ্যমে আত্মপ্রকাশ পায়। গীতায় তাই বলা হয়েছে –
তস্মদাসক্তঃ সততম্ কার্যম্ কর্ম সমাচর।
অসক্তো হ্যাচরণকর্ম পরমাপ্নোতি পুরুষঃ।।
কর্মের ফলাফলের প্রতি আসক্ত না হয়ে, একজন কর্ত্তব্য হিসেবে কর্ম সম্পাদন করবেন, যেহেতু আসক্তি বিনা কর্মেই একজন পরম বা ঈশ্বরকে লাভ করেন।
মাটি কাটার গানের মতো যৌথ কর্মের গান পূর্ববঙ্গের #সারিগান অর্থাৎ নৌকা বাইচের গান। আবার কলকাতা বা শহরাঞ্চলে প্রচলিত আছে ছাদ পেটানোর গান। পালকিওলা , ভিস্তিওলাদের গান …
সারিগান নৌকার মাঝি-মাল্লাদের সঙ্গেই বেশি যায়। নৌকার মাঝি, কর্মজীবী ও শ্রমিকরা দলবদ্ধভাবে বা সারিবদ্ধভাবে কাজের তালে তালে শ্রম লাঘব করার জন্য এ গান থেকে থাকে। এ জন্যই এ গানের নাম হয়েছে ‘#সারিগান’। খেটে খাওয়া মানুষদের কাছে এ গানের এক বিশেষ মহত্ত্ব রয়েছে। কারণ এ গানের মাঝে শ্রমিকরা কাজের উদ্যম ও শক্তি ফিরে পায়।
‘সারি’ শব্দের আভিধানিক অর্থ ‘শ্রেণি’। শ্রেণি বা সারিবদ্ধ মানুষের গানই হচ্ছে সারিগান। অর্থাৎ সারি বা দলবদ্ধভাইে এ গান পরিবেশন করা হয়। ধারণা করা হয় পনের শতকেরও আগে সারি গানের উদ্ভব হয়েছিল। বাংলা সাহিত্যের প্রাচীন নিদর্শন চর্যাপদে ‘সারি’ শব্দের ব্যবহার রয়েছে। নদী – নৌকা মাঝি – সাঁকো— চর্যাপদে বারে বারে এই বিষয়গুলি উল্লিখিত হয়েছে । নদীমাতৃক বাংলা চর্যাগানের একটি বৃহৎ পটভূমি । তার উপর নদী মাঝি ও নৌকা আবহমান কাল ধরে রূপক হিসাবে বহুল প্রচলিত , যার শুরু সংস্কৃত কাব্যে । চর্যাগান থেকে বৈষ্ণবপদাবলী হয়ে বাউল গানের পথ ধরে ‘ সোনার তরী ‘ ছুঁয়ে তা আধুনিকতম কবিতা পর্যন্ত বিস্তৃত । চর্যার এই সংক্রান্ত পদগুলি থেকে আমরা নানা ধরনের নৌকা , ভেলা , নৌকার প্রত্যঙ্গের নাম , বৈঠা , গোলুই , কাছি , হাল , খুঁটি , সেঁউতি ইত্যাদির উল্লেখ পাই । সর্বোপরি নদী পার কারি / কারিণীদের সঙ্গে পরিচিত হই ।
গঙ্গা যমুনা মাঝোঁ রে বহই নাঈ ।
তহি বুড়িলী মাতঙ্গী জোইআ লীলে পার করেই ।।
বাহ তু ডোম্বী বাহ লো ডোম্বী বাটত ভইল উছারা ।
সদ্গুরু পাঅপসাএ জাইব পুনু জিনউরা
পাঞ্চ কেডুয়াল পড়ন্তে মাঙ্গে পিঠত কাচ্ছী
বান্ধী গঅণ দুখোঁলে সিঞ্চহু পাণী ন পইসই সান্ধি ।।
চন্দ সূজ্জ দুই চকা সিঠি সংহার পুলিন্দা ।
বাম দাহিণ দুই মাগ ন চেবই বাহ তু ছন্দা ।।
কবড়ী ন লেই বোড়ী ন লেই সুচ্ছরে পার করই ।
জো রথে চড়িলা বাহবা ণ জনই কুলে কুল বুড়ই ।।
এছাড়াও পনের শতকের কবি বিজয় গুপ্ত পদ্মপুরাণে একাধিকবার ‘সারি’ গানের কথা উল্লেখ করেছেন। এর একটি উদাহরণঃ
‘সকল ডিঙ্গায়ে চড়িয়া গাবরে (ভৃত্য) গাহে সারি দেখিতে দেখিতে ডিঙ্গা এড়াইল গাঙ্গুরি/ধবল নদী এড়াইয়া মানিক্যপুর যায়ে হাতা তালি দিয়া গাবরে গীত গায়ে”
দাঁড় অথবা বৈঠার ঝপ্ ঝপ্ শব্দের সঙ্গে গান তালে তালে ছন্দিত হয়ে ওঠে। যৌথকর্মের আনন্দ প্রকাশ পায় দ্রুত লয়ের সংগীতের মধ্যে। পল্লী অথবা নগর অঞ্চলে শ্রমিকদের মধ্যে এমনি কর্মপ্রেরণামূলক যৌথ কন্ঠের গানের অনেক নিদর্শন মেলে। শুধু কি তাই? সেই কোন প্রাচীনকাল থেকে ভারী জিনিস ওঠানো নামানোর জন্য কুলির কাজের তালে তালে গান গায়।
কাজের সঙ্গে সঙ্গীতের এই সমন্বিত রূপ দেখে একটি কথা সহজে মনে ওঠে যে, মানুষের মুখের ভাষায় সঙ্গে দৈহিক শ্রমের সংযোগ রয়েছে প্রচুর। কারণ ভাষাই হচ্ছে ছন্দোবদ্ধ কাব্যের প্রাণ। সঙ্গীতে কবিতা হচ্ছে গানের সুরের আশ্রয় এবং গানই হচ্ছে কাব্যের রূপ। বহুপঠিত ছান্দোগ্য ও কেন উপনিষদ্ সামবেদের অন্তর্গত। এই দুই উপনিষদ্ প্রধান (মুখ্য) উপনিষদ্গুলির অন্যতম এবং দর্শনের (প্রধানত বেদান্ত দর্শন) ছয়টি শাখার উপর এই দুই উপনিষদের প্রভাব অপরিসীম। সামবেদকে সংগীত ও নৃত্যকলার মূল বলে মনে করা হয়।
সামবেদ পৃথিবীর সর্বপ্রাচীন সংগীত গ্রন্থ। গাই বেকের মতে, ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীত ও নৃত্যের মূল সামবেদ, উপনিষদ্ ও আগম শাস্ত্রের ধ্বনি ও সংগীত-সংক্রান্ত দিক্নির্দেশিকার মতে নিহিত।গান ও মন্ত্রপাঠ ছাড়াও সামবেদে বাদ্যযন্ত্রের উল্লেখ রয়েছে। বাদ্যযন্ত্রগুলি বাজানোর নিয়ম ও নির্দেশিকা গন্ধর্ববেদ নামে পৃথক একটি সংকলনে পাওয়া যায়। এটি সামবেদের সঙ্গে যুক্ত একটি উপবেদ।সামবেদে বর্ণিত মন্ত্রপাঠের গড়ন ও তত্ত্ব ভারতীয় শাস্ত্রীয় শিল্পকলার গঠনগত আদর্শগুলিকে প্রভাবিত করেছে। ভারতীয় সংগীতের ইতিহাসে সামবেদের অবদান সংগীতজ্ঞরা বহুলভাবে স্বীকার করে থাকেন।
দেহের ভিন্ন ভিন্ন অঙ্গ প্রত্যঙ্গের ছন্দোময় কর্মের সংহতি নৃত্য, গীত। সব কিছুর মূলে রয়েছে আনন্দ।
ভরত মুনি দশ রকম লাস্যাঙ্গের কথা উল্লেখ করেছেন যথা – গেয়পদ, স্থিতপাঠ্য, আসীন, পুষ্পগন্ডিকা, প্রচ্ছেদক, ত্রিমূঢ় , সৈন্ধব, দ্বিমূঢ়ক, উত্তমোত্তম , উক্তপ্ৰত্যুক্ত। উপবিষ্ট হয়ে গীত পরিবেশনকে গেয়পদ বলা হয়। স্থিতপাঠ্য হল প্রাকৃত ভাষায় আবৃত্তিমূলক গান হতে হবে। চারিটি পদ তালে তালে গীত হলে তা আসীন। পুষ্পগন্ডিকাতে কন্ঠ ও যন্ত্রসংগীতের সহযোগিতা থাকবে। সুন্দর অঙ্গহারে তা নিষ্পন্ন করতে হবে। প্রচ্ছেদকে নৃত্যই প্রধান। ত্রিমূঢ়কে সুন্দর ললিত শব্দযুক্ত গীত থাকবে। এতে অঙ্গহার থাকবে না। সৈন্ধবে কোনো সুচারু অঙ্গহার বা রেচক থাকবে না । তবে বাদ্যযন্ত্র থাকবে। দ্বিমূঢ়কে চঞ্চপুট তালে মুখ প্রতিমুখ থাকবে। উত্তমোত্তমে হেলার প্রয়োগ হবে। উক্তপ্ৰত্যুক্তে সুন্দর বাক্যালাপ থাকবে এবং ক্রোধ ও ক্রোধের প্রশমিত রূপ থাকবে।
The three arts of dancing, music and poetry began as one. Their source was rhythmical movement of human bodies engaged in collective labour. – George Thompson ( Rhythm and Labour)
কর্মসঙ্গীতের নামই প্রমাণ করে যে, এগুলি শ্রম ও কর্মের সঙ্গে জড়িত লোকসঙ্গীত। কর্মে উৎসাহ দান, শ্রমভার লাঘব এবং চিত্তবিনোদনের উদ্দেশ্যে এ সঙ্গীতের আয়োজন করা হয়। ক্ষেত নিড়ানো, ধান-পাট কাটা, ধান ভানা ইত্যাদি কৃষিকাজ ছাড়াও দাঁড় টানা, ছাদ পেটানো, জাল বোনা, তাঁত বোনা, মাটি কাটা, ভারি বস্ত্ত টানা ইত্যাদি কাজেও কর্মসঙ্গীতের প্রচলন আছে। কর্মের সঙ্গে সঙ্গীতের কথা ও সুরের সরাসরি সম্পর্ক আছে। যেমন ‘আয় রে তরা ভুঁই নিড়াইতে যাই’, ‘আমরা ধান ভানিরে ঢেকিতে পার দিয়া’, ‘রঙের নাও রঙের বৈঠা রঙে রঙে বাও’ যথাক্রমে ক্ষেত নিড়ানো, ধান ভানা ও নৌকা বাইচের গান। এসব গানের কথা, ছন্দ ও সুরে ছড়িয়ে আছে জীবনের সাধ-আহ্লাদ, রস-রসিকতা, আনন্দ-উল্লাস ইত্যাদি।
সুন্দরবনের মাটি কাটার গানের পিছনেও রয়েছে এমন ই দৈহিক শ্রম সংহতি এবং কর্ম প্রেরণার আনন্দ।
ক্রমশঃ
©দুর্গেশনন্দিনী
তথ্যঃ সুন্দরবনের লোকসংস্কৃতি