যজ্ঞশিষ্টাশিনঃ সন্তো মুচ্যন্তে সর্বকিল্বিষৈঃ।
ভুঞ্জতে তে ত্বঘং পাপা যে পচন্ত্যাত্মকারণাৎ।।
যিনি যজ্ঞাবশেষ অন্নগ্রহণ করেন, তাঁরাই পুণ্যবান ব্যক্তি। কেবলমাত্র যিনি নিজের জন্য অন্নপাক করে ,ভোজন করেন তিনি মহাপাপী। সে অন্ন পাপন্ন হয়।
আবার
দুঃখেষ্বনুদ্বিগ্নমনাঃ সুখেষু বিগতস্পৃহঃ ।
বীতরাগভয়ক্রোধঃ স্থিতধীর্মুনিরুচ্যতে ॥
দুঃখে উদ্বেগহীন, সুখে নিঃস্পৃহ এবং আসক্তিশূন্য, ভয়মুক্ত ও ক্রোধরহিত ব্যক্তি মুনি এবং স্থিতপ্রজ্ঞ বলে উক্ত হয়।
যঃ সর্বত্রানভিস্নেহস্তত্তৎ প্রাপ্য শুভাশুভম্ ।
নাভিনন্দতি ন দ্বেষ্টি তস্য প্রজ্ঞা প্রতিষ্ঠিতা ॥
যিনি সকল বস্তু ও ব্যক্তিতে স্নেহবর্জিত এবং প্রিয় ও অপ্রিয় বিষয় উপস্থিত হলে যিনি যথাক্রমে আনন্দ এবং দুঃখিত হন না, তিনিই স্থিতিপ্রজ্ঞ।
ঋষিযজ্ঞ , ভূতযজ্ঞ , পিতৃযজ্ঞ, নৃযজ্ঞ এবং দেবযজ্ঞ – এই পঞ্চযজ্ঞ গৃহস্থের নিত্য অনুষ্ঠেয়। কিন্তু সব থেকে শ্রেষ্ঠ যজ্ঞ হল কর্মযজ্ঞ। যজ্ঞাদি কর্ম সকলই বেদ হতে উৎপন্ন এবং বেদ অক্ষর পরমাত্মা হতে সমূদ্ভুত। অতএব সর্বার্থ প্রকাশক বেদ সর্বদা যজ্ঞে প্রতিষ্ঠিত আছেন। যিনি কর্মচক্রে আবদ্ধ না হয়ে কেবল ইন্দ্রিয়দ্বারা পরিচালিত হয় , সে মহাপাপী হয়। অনাশক্ত হয়ে কর্মের অনুষ্ঠান করলে , কামনা শূন্য হয়ে কর্ম করলে ব্যক্তির সঙ্গের সমগ্র সংসার সেই একদিন না একদিন ভোগ করেন। সেই জন্যই স্বামী বিবেকানন্দ বলতেন – ” কর্মযোগ অন্যনিরপেক্ষ মুক্তিমার্গ নিষ্কামকর্ম দ্বারা চিত্তশুদ্ধি হলে মোক্ষ বা জ্ঞান লাভ হয়। ” শ্রেষ্ঠ ব্যক্তির কর্মকেই জগৎ সংসার অনুসরণ এবং অনুকরণ করেন। স্বধর্মে প্রবৃত্ত করাই লোকসংগ্রহ। এক দীর্ঘকালে ধরে বৈদেশিক শক্তির আগ্রাসন থেকে ভারতমাতার হৃত গৌরব পুনরুদ্ধার করার নিমিত্ত কিছু মহাপুরুষ সেই কর্মযজ্ঞে নিজেকে আহুতি দিয়েছিলেন। চারশত বৎসরের পরাধীনতার গ্লানি থেকে আপন মাতৃভুমিকে রক্ষার জন্য কত ব্যক্তি যে নিজেকে আহুতি দিয়েছিলেন , কত মা সন্তানহারা , কত শিশু যে পিতৃহারা এবং কত স্ত্রী যে তাঁর প্রাণপ্রিয় মানুষটিকে হারিয়ে হাহাকার করেছিলেন তার হিসাব হয়তো আজ আর বিগত ৭০ বছরের বানানো মেকি ইতিহাস দিতে পারবে না।
জাতির জীবনে হাজার হাজার বছরের ক্লীবত্ব অন্ধকার ব্যাপৃত হয়েছে তাকে দূর করাই হল প্রকৃত কর্মযোগ। নশ্বর দেহকে ধরে কি লাভ ? যা আদি , যা অন্তত , যা স্বধর্মের তাকে রক্ষা ব্যতীত কি কর্ম থাকতে পারে? সেই পথই অবলম্বন করে ছিলেন এক অগ্নিপুরুষ। তিনি আদিত্যের ন্যায় তাঁর সৌরজগৎ নির্মাণ করে মৌন জাতিকে মুক্তির আলোক দেখিয়েছিলেন। সেই ভগবান শ্রী কৃষ্ণের গীতার বাণী মেনে তাঁরা অখণ্ড ভারতবাসীকে ক্লীবত্ব নতুন করে লড়তে শিখিয়েছিলেন। সে যুদ্ধ কোনো কুরুক্ষেত্রের থেকে কম ছিল না।
হম , আমি অখন্ড ভারতবর্ষের সেই সূর্যের কথা বলছি যিনি চট্টগ্রামে এক ব্রহ্মান্ড নির্মাণ বিদেশি শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে ছিলেন। যে সৌরমন্ডলের ভয়ে তাঁকে ও তাঁর সহযোদ্ধাকে ফাঁসি হবার পূর্বেই প্রচন্ড অত্যাচার করে হত্যা করা হয়। চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠনের পর দুবছর নয় মাস আটাশ দিন মাস্টারদা ব্রিটিশ সরকারের চোখে ধুলো দিয়ে আন্ডারগ্রাউন্ডে থেকেও চরম প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যে লড়াই চালিয়ে যান। ১৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৩৩ গৈরলা গ্রামে পুলিশের হাতে তিনি ধরা পড়েন। তারপর ! তারপর অসহ্য অত্যাচার। কিন্তু সেই যে গীতায় লেখা আছে –
ক্লেশোহধিকতরস্তেষামব্যক্তাসক্তচেতসাম্।
অব্যক্তা হি গতির্দুঃখং দেহবদ্ভিরবাপ্যতে।।
দেহধারিগণের পক্ষে নির্গুণ ব্রহ্মবিষয়ক নিষ্ঠা লাভ করা অতি কষ্টকর। কারণ, দেহাত্মবোধ বিদূরিত না হইলে নির্গুণ ভাবে স্থিতিলাভ করা যায় না। মাস্টারদা তাঁর সম্পূর্ণ জীবন দেশমাতৃকার জন্য উৎসর্গ করেও মৃত্যুর সময়েও সেই অসম্ভব অত্যাচরকে হাসি মুখে মেনে নিয়েছিলেন। নশ্বর দেহ ত্যাগ করে আবার এই ভারতমাতার বুকে ফিরবেন অন্যকোন রূপে এবিশ্বাস তাঁর মধ্যে , শুধু তাঁর কেন , প্রতিটি দেশমাতৃকার সন্তানের মধ্যে বাস করত। তাই তাঁরা হাঁসি মুখে সব কিছু মেনে নিয়ে কর্মযোগ সম্পাদন করতেন। বিশ্বাস ছিল একদিন জয় তাঁদেরই হবে।
অথৈতদপ্যশক্তোহসি কর্ত্তুং মদ্ যোগমাশ্রিতঃ।
সর্ব্বকর্ম্মফলত্যাগং ততঃ কুরু যতাত্মবান্।।
বিচারে তারকেশ্বর দস্তিদার ও মাস্টারদার ফাঁসির সাজা হলেও সরকারি মদতে সেদিন তাঁদের ভীষণ অত্যাচার করে খুন করা হয় , তারপর সরকারি নিয়মে ফাঁসির দড়িতে ঝুলিয়ে দেওয়া হয় দেহ। সেই প্রাণহীন দেহগুলি আর কেউ দেখতে পাননি, হয় নি কোনো অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া। দেহগুলিকে বাক্সবন্দী করে সাগরের জলে ফেলে দেওয়া হয়েছিল। তবুও সেই সৌরমন্ডলের প্রত্যেকে মৃত্যুঞ্জয়ী হয়েছিলেন। কারণ তাঁরা প্রত্যেকেই অমৃতের সন্তান ছিলেন।
মৃত্যুর পূর্বে মাস্টারদা সূর্য সেন তাঁর সৌরমন্ডলের সহযোদ্ধাদের রুদ্ধ কারাগার থেকে একটি লিখিত বিবৃতি দেন। মাস্টারদা সূর্যসেন গৈরলা গ্রামের ধরা পড়ার পর থেকে ফাঁসির পূর্ব পর্যন্ত চট্টগ্রাম জেলে বন্দীজীবন কাটিয়ে ছিলেন। নিরাপত্তাজনিত কারণে চট্টগ্রাম জেলের ভিতরেই আদালত বসিয়ে বিচারকার্য সম্পন্ন হয়েছিল । এই এক বছর জেল থেকে মাস্টারদা তাঁর সৌরমন্ডলকে ১৬ চিঠি লিখেছিলেন। সৌরমণ্ডলের মধ্যে গ্রহ উপগ্রহ সকলেই থাকে। সেই গ্ৰহ উপগ্রহের মধ্যে প্রিয়জনরাও ছিলেন ।
সূর্য সেন সবচেয়ে বেশি চিঠি লিখেছিলেন বৌদি বিরাজমোহিনী দেবী। বিরাজমোহিনী দেবী খুড়তুতো দাদা চন্দ্রকুমারের স্ত্রী ছিলেন। তাঁকে লেখা চিঠির সংখ্যা ছিল সাতটি। এর পরে তিনি চিঠি লিখেছিলেন মেজদিদি বাল্যবিধবা সাবিত্রী দেবীকে। তাঁকে তিনটি চিঠি লিখেছিলেন। এছাড়াও খুড়তুতো দাদা চন্দ্রকুমার, খুড়তুতো ভাই অজিত কুমার এবং নিজের ভাই কমলকুমারকে দুটি করে চিঠি লিখেছিলেন । সেসব চিঠিতে কত সহজ কথায় কত সুন্দর করে যে জীবন দর্শনকে তুলে ধরেছিলেন , কত সুন্দর করে গীতার বাণীর মূল কথাটুকু বলেছিলন , তা না পড়লে জীবন যেন অসম্পূর্ণ থেকে যায়।
আমি এখানে একটি চিঠি তুলে ধরবো। রায়ঘোষনার পর মাস্টারদা চিঠিটি বৌদি বিরাজমোহিনী দেবীকে লিখেছিলেন।
স্নেহময়ী বৌদি, তারিখ :২১/ ১১/৩৩
আমার ভক্তিপূর্ণ প্রণাম গ্রহণ করুন। আপনাদের ২০ শে অক্টোবর ও ৩রা নভেম্বর এবং মণির ৭ই কার্ত্তিকের চিঠি একই সঙ্গে গত ১১ই নভেম্বর পেয়েছি। অষ্টদূর্ব্বা পাঠিয়েছিলেন বলে লিখেছিলেন । অষ্টদূর্ব্বা পাইনি। আমি গত ৮ই নভেম্বর আপনার নামে শহরে ঠিকানায় একখানা চিঠি দিয়েছি , আশা করি পেয়েছেন! দাদা এবং অন্যান্য গুরুজনকে আমার ভক্তিপূর্ণ প্রণাম জানাবেন। কমল, অজিত, গোপাল, রাখাল, মণি, রাণী, বাদল এবং ছোটদের সকলকে আমার স্নেহশীষ দেবেন।
বৌদি, হাইকোর্টের রায় শুনে আপনারা বোধহয় শোকে একেবারে মমুহ্যমান হয়ে পড়েছেন , হওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু আপনারা গত নয় মাসে এই আঘাতটুকু সহ্য করার জন্য হৃদয়কে তৈরি করেছেন বলে আমার ধারণা। আমি বেশ আনন্দ নিয়ে যাচ্ছি। আমার কোন দুঃখ নেই। আপনাদেরও দুঃখ করার কোনো কারণ নেই । আর আমার মোকদ্দমা চালানোর সম্পর্কে আপনাদের খুব সন্তুষ্ট হওয়াই উচিত। আপনারা এত অভাবের মধ্যেও কলকাতার সবচেয়ে বড় ব্যারিস্টার দিয়ে আমার মোকদ্দমা চালিয়েছেন। চাটগাঁয়েও খুব ভালো ব্যারিস্টারি নিযুক্ত করেছিলেন। এরচেয়ে বেশি আর কি করবেন? আপনাদের সাধ্যের অতিরিক্ত আপনারা করেছেন। আমি যখন শুনলাম ব্যারিষ্টার বি.সি. চ্যাটার্জী হাইকোর্টে আমার মোকদ্দমা করেছেন তখন আপনাদের প্রতি কৃতজ্ঞতায়, শ্রদ্ধায় আমার মন ভরপুর হয়ে উঠলো। আমাদের চেয়ে অনেক ভালো আর্থিক অবস্থার লোকেও যে এতোটুকু করতে পারেনা। সঙ্গে সঙ্গে আমার জন্য আপনাদের অগাধ স্নেহ-মমতার কথা ভেবে আমার মন করুন হয়ে উঠলো। যখন হাইকোর্টের রায় শুনলাম তখন নিজের কথা কিছুই মনে হলো না, আপনাদের কথাই প্রাণের মধ্যে ভেসে উঠলো। ভাবলাম এই নির্মম আঘাতটুকু আপনাদের কি ভীষণভাবে বাজবে। বৌদি, আপনারা চিরদিন আমার জন্য যা করলেন তার কণামাত্র প্রতিদানও আমি দিতে পারিনি । গুরুজনের স্নেহ-মমতার ঋণ কেউ পরিশোধ করতে পারেনা। আমি আপনাদের কাছে সম্পূর্ণ ঋণীই রয়ে গেলাম । আমার জন্য কোন দুঃখ করবেন না । ভগবান চিরদিনই মঙ্গলময়।
ইতি
আপনার স্নেহের
শ্রী সূর্য্যকুমার সেন
হ্যাঁ, এই তো হল আসল মহাপুরুষ। যিনি নিষ্কাম কর্ম সাধন করে আমাদের সুফল দান করে গিয়েছিলেন।
অদ্বেষ্টা সর্ব্বভূতানাং মৈত্রঃ করুণ এবচ।
নির্ম্মমো নিরহঙ্কারঃ সমদুঃখসুখঃ ক্ষমী।।
সন্তুষ্টঃ সততং যোগী যতাত্মা দৃঢ়নিশ্চয়ঃ।
ময্যর্পিতমনোবুদ্ধির্যো মদ্ভক্তঃ স মে প্রিয়ঃ।।
©দুর্গেশনন্দিনী