দোল মানে রঙের উৎসব। দল মানে বসন্তকে আবাহন, নতুন হাওয়া আর প্রেমের আনন্দে মেতে ওঠার সময়। আবিরে পলাশে রাঙিয়ে দিয়ে যাওয়ার সময়। কেবল বাংলা নয়, ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে বিভিন্ন ভাবে দোলপূর্ণিমায় মেতে ওঠেন মানুষেরা। বৃন্দাবন-মথুরার রাধাকৃষ্ণের আরাধনা, তাঁদের লীলাখেলাই হোক, বা শান্তিনিকেতনের পলাশ, আবির আর রবীন্দ্রনাথ – একেক জায়গায় দোল তার একেক রূপ নিয়ে হাজির হয়। আবিরের জায়গায় অজান্তেই চলে আসে বাঁদুরে রং। ভাংয়ের নেশায় মেতে ওঠে গোটা ভারত। দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে সেই আবিরের ঢেউ পৌঁছে যায় বিদেশেও। এই রঙিন ছবিটি সরিয়ে একটু বাইরে আসা যাক। একটা বিশেষ উৎসবের দিকে পা বাড়াই আমরা। আদতে সেটিও দোল উৎসবই। উল্লাস,, উত্তেজনা, আনন্দ, গান-বাজনা, সঙ্গীত – সবই রয়েছে। কিন্তু এটি ঠিক রাধাকৃষ্ণের হোলিখেলা নয়। এখানে বিরাজ করেন এক ও একমাত্র দেবাদিদেব মহাদেব। তাঁর ইচ্ছেতেই নাকি এখানে আনন্দে মেতে ওঠে বাচ্চা থেকে বুড়ো।
এটি ঠিক রাধাকৃষ্ণের হোলিখেলা নয়। এখানে বিরাজ করেন এক ও একমাত্র দেবাদিদেব মহাদেব। তাঁর ইচ্ছেতেই নাকি এখানে আনন্দে মেতে ওঠেন বাচ্চা থেকে বুড়ো কিন্তু দোলের সুন্দর ছবিটা এখানে নেই; বরং প্রথম দর্শনে মনে হতে পারে ভয়ংকর, কুৎসিত! এখানে আবির নয়, মানুষের হাতে হাতে ঘোরে চিতাভস্ম! মানুষের অস্থি! সেই চিতাভস্ম, ছাই ধুলোই হাওয়ায় ওড়ে। সেটাই এখানকার আবির! সাধু সন্ন্যাসীদের ভয়াল রূপ, মরার খুলি আর পুজোপাঠ – সব মিলিয়ে এক অন্য দোল উৎসবের সাক্ষী থাকে দেশ। আর সেই উৎসবেই আপনাকে স্বাগত জানাচ্ছে বেনারস, বাঙালির আপন কাশী । স্বাগত জানাবে মাসান হোলি (Masaan Holi), যে দোল উৎসব আজও ভারতের এক বিস্ময় ।
মাসান হোলি আসলে কী? সাধারণত আমরা যে দোল উৎসবের কথা জানি বা দেখি, তার থেকে বেশ খানিকটাই আলাদা এটি। প্রধানত হোলির পাঁচদিন আগে, একাদশী তিথিতে এই উৎসব শুরু হয়। এই বিশেষ তিথিকে কাশীর মানুষরা বলেন ‘রংভরি একাদশী’ (Rangbhari Ekadashi)। কথায় বলে, বেনারস শহরটা শিবের ত্রিশূলের ওপর টিকে রয়েছে। দেবাদিদেব মহাদেব শিবই এখানকার আত্মীয়, জামাই, প্রধান আরাধ্য ভগবান। কাশীর বাসিন্দাদের বিশ্বাস, রংভরি একাদশীতে শিব এবং পার্বতী একসঙ্গে মিলিত হন। নিজের ভক্তদের সঙ্গে শোভাযাত্রায় অংশ নেন। ভক্তদের মধ্যেই আনন্দে মেতে ওঠেন দুজনে। আর তার পরদিন শিব চলে আসেন মাসানে। সেখানে ভূত, প্রেত, আত্মা, মৃতদেহ, সাধু ও ভক্তদের সঙ্গে ফের একবার দোল খেলায় মেতে ওঠেন। এই গোটা উৎসবটার নামই তাই মাসান হোলি বা মাসান দোল উৎসব।
এই বিশেষ দিন, বেনারসের গলিতে গলিতে গেলে কেবল একটাই মন্ত্র, একটাই উৎসব। মাসান হোলি উপলক্ষে সমস্ত মানুষই পথে নেমে পড়েন। ঠিক কত বছরের পুরনো এই উৎসব? সঠিক হিসেব নেই; তবে ভক্তদের বিশ্বাস, বেনারস শহর যবে তৈরি হয়েছে, তবে থেকেই এটি চলছে। হাজার হাজার বছর ট্র্যাডিশনে মেতে ওঠেন মানুষ। তবে কেবল স্থানীয় মানুষরাই নন, দূরদূরান্ত থেকে ভয়ালদর্শন অঘোরী, নাগা সাধুরা এই দোল খেলায় এসে যোগ দেন। মূলত তাঁরাই এই উৎসবের কেন্দ্রবিন্দু।
রংভরি একাদশীর ওই বিশেষ শোভাযাত্রা শুরু হয় অঘোর পীঠ বাবা কেনারাম আশ্রম থেকে। হাজার হাজার মানুষ শিব আর পার্বতীর মূর্তি মাথায় নিয়ে বেরিয়ে পড়েন পথে। প্রায় প্রত্যেকেরই হাতে থাকে বিশাল বিশাল ডমরু। সেই সমবেত আওয়াজে গমগম করে ওঠে গোটা বেনারস। গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠবে আপনারও।
আর এনার্জি? একজনের থেকে আরেকজনের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ছে সেই শক্তি। আবির, সিঁদুর, ফুল – এসব তো আছেই। তবে আসল উপকরণ এগুলো নয় ।
মাসান হোলির মূল জিনিসই হল ছাই। কিলো কিলো ছাই নিয়ে আসা হয় সবার জন্য । তাও যে সে ছাই নয়, চিতাভস্ম! মানুষের অস্থিভস্ম! সেসবই গায়ে, মুখে মেখে রাস্তায় নেমে পড়েন অঘোরী সাধু থেকে সাধারণ মানুষ। সাধুদের টকটকে লাল চোখ, সিঁদুর আর লাল বস্ত্র- রুদ্রাক্ষের সঙ্গে থাকে নরমুণ্ড। মানুষের মাথার খুলি দিয়ে তৈরি মালা পরে থাকেন তাঁরা। সেটা নিয়েই নাচতে নাচতে পাই হাজির হন শ্মশানে।
হ্যাঁ, ঠিকই শুনলেন। শ্মশানই হল মাসান হোলির বৃন্দাবনক্ষেত্র।
মণিকর্ণিকা আর হরিশ্চন্দ্র – বেনারসের এই দুটি ঘাট ভারতবিখ্যাত। বলা হয়, এখানকার চিতা নাকি কখনও নেভে না। সেই দুটি শ্মশানঘাটেই হাজির হন অঘোরী সাধু থেকে সাধারণ মানুষ সে এক বিষম দৃশ্য! শ্মশানের মধ্যে মৃতদেহ আসছে, চিতা জ্বলছে, মানুষ পুড়ছে। তারইমধ্যে ছাই, চিতাভস্ম নিয়ে দোল খেলায় মেতে উঠেছে হাজার হাজার মানুষ। এই অসম্ভব দৃশ্য না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না! একেকজনের একেকরকম সজ্জা, একেকরকম আয়োজন । সারা গায়ে মৃত মানুষের অস্থিভস্ম মেখে নিজেরাই ‘ভূত’ হয়ে ওঠেন কাশীবাসীরা। সেইসঙ্গে থাকে ভাং। নেশায়, শিবের আরাধনা, ডমরুর আওয়াজে শেষ হয় মাসান হোলি ৷ বলা হয়, কাশীর এই মাসান হোলিই ভগবান শিবের সবচেয়ে আপন, প্রিয়তম উৎসব। তাই তো তিনি নিজে ভক্তদের মাঝে উপস্থিত হন! এমনই বিশ্বাস।
আজও গোটা ভারতের এক বিস্ময় এই বিশেষ দোল উৎসব । আজও দেশ-বিদেশ থেকে অগুনতি মানুষ আসেন স্রেফ এই উৎসব নিজের চোখে দেখার জন্য। এখন অবশ্য স্রেফ ছাই থাকে না; সঙ্গে আবির, গোলাপের পাপড়িও থাকে। তবে বেশিরভাগ অংশটাই থাকে সেই চিতাভস্ম। তরুণ প্রজন্মও মাসান হোলিতে ব্যাপকভাবে যোগ দেন। সেখানে একটাই আরাধনা, একটাই মন্ত্র – শিব। তিনিই তাঁদের – বন্ধু, আত্মীয়, আবার সহায়। আর সেই রীতিই অদ্ভুত করেছে বেনারসের এই মাসান হোলিকে।