লজ্জা পায় জালিয়ানওয়ালা বাগও

১৯৭৮ সালে বামফ্রন্ট ক্ষমতায় আসার পরে শরণার্থীরা বিপুল সংখ্যক বাংলায় ফিরে আসতে শুরু করে। তবে এর মধ্যে বামফ্রন্ট শরণার্থীদের বসতি স্থাপনের বিষয়ে তাদের নীতি পরিবর্তন করেছে এবং শরণার্থীদেরকে রাষ্ট্রের বোঝা হিসাবে বিবেচনা করেছে, কারণ উদ্বাস্তুরা পশ্চিমবঙ্গ নয় বরং ভারতের নাগরিক ছিল। প্রায় দেড় লক্ষ লোক, দন্ডকারণ্য শরণার্থীদের প্রায় সবাই এসেছিল (যেখানে তাদের বেশিরভাগকে ফেরত পাঠানো হয়েছিল)। ইতিমধ্যে প্রায় ৪০,০০০ শরণার্থী দক্ষিণে গিয়েছিল এবং কয়েক মাস ধরে হাসনাবাদে শিবির স্থাপন করেছিল মেরিখাপ্পিতে (তাদের নামকরণ করা হয়েছিল “নেতাজি নগর”), এটি রিজার্ভ ফরেস্ট আইনের আওতায় একটি সুরক্ষিত জায়গা। একজন জীবিত ব্যক্তি দাবি করেছেন যে দ্বীপটিতে কেবল ঝোপঝাড় ছিল এবং তারা মাছ ধরার সাথে জড়িত ছিল। তারা স্কুল এবং হাসপাতালও তৈরি করেছিল।


“ভাববেন না স্যার! তিন দিনে ওদের পাঠিয়ে দেব দণ্ডকারণ্যে৷ তবে, অমিয়কে (২৪ পরগনা জেলার তৎকালীন এস পি অমিয় সামন্ত) একটু খোলা হাত দিতে হবে৷” স্বয়ং এসপি-র এই আবেদনে সায় দিলেন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু, যারা নিজেদের উদ্বাস্তু আন্দোলনের ‘চ্যাম্পিয়়ন’ বলে দাবি করেন৷ জ্যোতি বসু ও তৎকালীন ত্রাণমন্ত্রী রাধিকা বন্দ্যোপাধ্যায় মহাকরণে বলেন, মরিচঝাঁপি থেকে উদ্বাস্তুদের ফিরতেই হবে৷ বিধানসভায় জ্যোতিবাবুর ঘোষণা, “৩১শে মার্চের মধ্যে সুন্দরবনের মরিচঝাঁপি থেকে সব উদ্বাস্তু পরিবারকে চলে যেতে হবে৷ স্বেচছায় না গেলে পুলিশ তাদের জোর করেই দণ্ডকারণ্যে পাঠাবে৷”

সেই মতো, ১৯৭৮-এর ২৪ জানুয়ারি শুরু হল অপারেশন মরিচঝাঁপি, ১৪৪ ধারা জারি করে নিয়ন্ত্রিত হল বাইরের মানুষের যাতায়াত৷ মরিচঝাঁপির চারদিক ঘিরে জলপথে ১৬ দিন ধরে টানা অবরোধ তৈরি করা হল৷ বন্ধ করা হল খাদ্য ও পানীয় জল সরবরাহ৷ এতেও দমানো গেল না উদ্বাস্তুদের৷ তাই এবার শুরু হল সরাসরি সশস্ত্র হামলার পথ৷ সু৲ন্দরবনের দ্বীপবাসী  নিঃস্ব, অসহায় উদ্বাস্তুদের উপর পুলিশি নির্তন৷ ঘটানো হল নৌকাডুবিও৷ ১ জানুয়ারি পুলিশ নির্বিচারে কাঁদানে গ্যাস ছুড়লো৷ সরকারি হিসেবে সেদিন নিহত দু-জন, উদ্বাস্তদের মতে, সেদিন গুলিতে নিহত ৩০ জন৷ লাঠি পিটিয়ে মারা হয় আরও কয়েক শো উদ্বাস্তুকে৷ পুলিশ বাড়ি বাড়ি ঢুকে তল্লাশির নাম করে মহিলাদের বিবস্ত্র করে খুন করে৷ এমনই একজন মেনি মুণ্ডা ও তার কোলের ছেলে, যাদের সেই অপারেশনেই মৃত্যু হয়৷

জ্যোতিবাবুর নির্দেশে বাধ্য হয়ে দ্বীপ ছেড়ে পালান পূর্ববঙ্গের হাজার হাজার উদ্বাস্তু, যাদের দণ্ডকারণ্য থেকে ডেকে এনেছিলেন জ্যোতি বসু, রাম চ্যাটার্জি এবং ক্ষমতাসীন দলের শাখা ইউসিআরসি’র নেতারা৷ দণ্ডকারণ্য থেকে আসা পূর্ববঙ্গের মানুষদের ফের শুরু হল উদ্বাস্তুজীবন৷ অথচ, ক্ষমতাসীন বাম নেতাদের আশ্বাসেই তাঁরা দণ্ডকারণ্যের রুক্ষ্ম ভূমি ছেড়ে এসেছিলেন গাঙ্গেয়ভূমিতে৷ আর, ডেকে এনে তাদেরই উপর পৈশাচিক রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস নামালো সরকার৷ আজও তার বিচার হয়নি৷

সুন্দরবনের নদী, খাঁড়ি বয়ে রক্তের স্রোত বঙ্গোপসাগরে মিশলেও আজও মুছে যায়নি মরিচঝাঁপির স্মৃতি৷ মরিচঝাঁপির হাজার হাজার উদ্বাস্তুকে দণ্ডকারণ্যে ফেরত পাঠালেও বারাসতের কাছে মরিচঝাঁপি কলোনিতে, শিয়ালদহ রেলপথের দু-পাশে মরিচঝাঁপির শত শত পরিবার কোনওমতে পুলিশের নির্তন এড়িয়ে থেকে গেছে৷ এখন পরিবর্তিত পরিস্হিতিতে তারাও আশায় বুক বাঁধছেন–এবার বুঝি সুবিচার হবে, শাস্তি পাবে খুনিরা৷

৪৩ বছর আগের ঘটা সুন্দরবনের প্রত্যন্ত দ্বীপের ওই গণহত্যার তদন্তের বহু তথ্য ধরা রয়েছে বেশ কিছু গ্রন্হে,তথ্যচিত্রে, বিধানসভার কার্যবিবরণীতে৷ অমানবিক এই গণহত্যা প্রসঙ্গে বিবেকানন্দ মুখোপাধ্যায় বামফ্রন্ট সরকারকে কটাক্ষ করে লিখেছিলেন,
“সমাজতন্ত্রের বিজ্ঞাপনটা শুধু বত্তুৃতামঞ্চের সাইন বোর্ডে টাঙানো আছে৷”

এই ঘটনাটি সর্বাধিক হিংস্র ও নৃশংস মানবাধিকার লঙ্ঘন যা স্বাধীনতা-উত্তর ভারতে ১৯৪৮-এর শিখবিরোধী দাঙ্গা এবং ১৯৯০-এর দশকের কাশ্মীর উপত্যকা সংঘর্ষের আগ পর্যন্ত ঘটেছিল।

***ময়ূখ দেবনাথ*

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.