আদি অনন্তকাল ধরে গহন রহস্যের জমকালো অন্ধকারে আচ্ছন্ন সীমাহীন এই মহাবিশ্বের অজানাকে জানার অভিপ্রায় মানুষের দীর্ঘদিনের , আর সেই অনুসন্ধিৎসু মনের ক্লান্তিহীন ও নিরলস প্রচেষ্টা আজও তাই গতিশীল

                              আদি অনন্তকাল ধরে গহন রহস্যের জমকালো অন্ধকারে আচ্ছন্ন সীমাহীন এই মহাবিশ্বের অজানাকে জানার অভিপ্রায় মানুষের দীর্ঘদিনের , আর সেই অনুসন্ধিৎসু মনের ক্লান্তিহীন ও নিরলস প্রচেষ্টা আজও তাই গতিশীল। 
বিজ্ঞান-প্রযুক্তির আন্তরিক সহায়তায় তবুও বোধকরি এ অনন্ত মহাবিশ্বের অতি সামান্য রহস্যই আজ অবধি সম্ভবপর হয়েছে উন্মোচন করা।                         .
সালটা ছিল ১৯৭৭ , মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ‘ন্যাশনাল অ্যারোনেটিক্স এন্ড স্পেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন’ ( NASA)  .
সে বছরের ২০ আগষ্ট উৎক্ষেপণ করেছিল ‘ভয়েজার-২’ নামক একটা স্পেস ক্রাফট্ , ও ঠিক তার পরের মাসেই সেই মহাকাশ গবেষণা সংস্থা দ্বারা উৎক্ষেপিত হয়েছিল ‘ভয়েজার-১’ নামক আরো এক স্পেস ক্রাফট্।  .
আমাদের সৌরজগৎ ও এর বাইরের তথ্য সংগ্রাহকের ভূমিকায় , মানবজাতির উপকারের স্বার্থে অবশেষে মহাশূন্যের উদ্দ্যেশ্যে পাড়ি দিয়েছিল এই দুই মহাকাশগামী যান।  .
টেলিস্কোপকে অতিক্রম করে , সে সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে দাঁড়িয়ে উন্নত বিজ্ঞান-প্রযুক্তি সৃষ্ট মহাকাশযানদ্বয় সমগ্র বিশ্ববাসীর জানার অসীম কৌতুহলকে কিছুটা হলেও হ্রাস করবে , এটাও ছিল এক মুখ্য আশা!  .

বিজ্ঞানীরা কিন্তু জানতেন যে , ‘ভয়েজার-১’ ও ‘ভয়েজার-২’ যাত্রা করতে করতে একদিন আমাদের এই সৌরমন্ডল ছাড়িয়েও পৌঁছে যাবে বহু দূরে , আর যে কারণেই ২০ শতাব্দীর এক প্রখ্যাত বিজ্ঞানী কার্ল সেগান-এর ধারণানুযায়ী দুটো স্পেসক্রাফটেই মানব সভ্যতার অস্তিত্বের নিদর্শনস্বরূপ প্রস্তুত ও স্থাপন করা হয়েছিল দুই গোল্ডেন রেকর্ড , যেগুলোকে বলা হয় ‘ভয়েজার গোল্ডেন রেকর্ডও।’ .
চালাবার নির্দেশিকাসহ রেকর্ড দুটোতে .
ছিল পৃথিবীর ৫৫ টা ভাষা , ১১৫ টা ছবি ও ভারতীয় রাগ , ভৈরবী সমেত বিভিন্ন দেশের সঙ্গীতের সংযোজন।  .
আর গোল্ডেন রেকর্ড তৈরির মাধ্যমে স্থাপন  করে , অনন্ত মহাশূন্যে সেগুলোকে ভাসিয়ে দেওয়ার উদ্দ্যেশ্য ছিল এটাই যে , দিনের পর দিন ধরে সুদীর্ঘ ও বিরামহীন পথ পাড়ি দিতে দিতে কখনও , কিংবা কোনো একদিন যদি অসীম মহাবিশ্বের কোনো এক গ্রহে এলিয়েন অথবা আমাদের মতই উন্নত প্রাণীর কাছে গিয়ে এই স্পেসক্রাফট্ গিয়ে পৌঁছায় , তবে তাঁরা ডিস্কগুলোকে অনুধাবন করে জানতে পারবে যে আমরাও প্রায় তাঁদেরই মতন এক প্রজাতির অত্যাধুনিক প্রাণী , যাঁরা এখনও নিজেদের অস্তিত্ব নিয়ে টিকে আছি কিংবা ছিলাম এই ইউনিভার্সেই।  .
মানব প্রজাতির , সর্বোপরি আমাদের এই সুন্দর পৃথিবীর অস্তিত্ব একদিন শেষ হয়ে যাবে হয়তো ঠিকই , কিন্তু বিলিয়ন বিলিয়ন বছর ধরে ওই গোল্ডেন রেকর্ড আমাদের সেইসব বিশেষ স্মৃতিকে আঁকড়ে ধরে রাখতে পরিচয় বহন করে যাবে যথেষ্ট সক্ষমতার।
জানুয়ারি ১৯৭৯ , 
ভয়েজার-১ কিন্তু কথা মতন চলে আসে
বৃহস্পতির কাছে , ও পৃথিবীতে পাঠাতে থাকে এর স্বচ্ছ এবং সাদা-কালো বিভিন্ন ছবি , কারণ সেই সময়ের বুকে দাঁড়িয়ে স্পেস ক্রাফটে কালার ডিটেক্টর বর্তমান ছিল না।  
পরে অবশ্য কালার ফিল্টারের সাহায্যপ্রার্থী হয়ে সেই সমস্ত ছবিই পরিবেশিত হয় জনসমক্ষে।
এদিকে বৃহস্পতির রেড স্পট বা লাল দাগগুলোর পরীক্ষা-নিরীক্ষায় জানা সম্ভব হয় যে ,  
‘গ্রেট রেড স্পট’-নামক অনেক বড় বড় ঘূর্ণিঝড় মজুদ আছে এই জুপিটার গ্রহের মধ্যেই , এবং তা পরিমানেও প্রচুর।
আর এভাবেই সর্বমোট এক ডজনের বেশি বিধ্বংসী ঝড়কে সনাক্ত করতে সক্ষম হয় এই ভয়েজার। 
এদিকে জুপিটারের অত্যাধিক শক্তিশালী  ম্যাগনেটিক ফিল্ড-এর সামান্যতম আঘাতেই যে কোনো মুহূর্তে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে নাড়ি-ভুঁড়ি বেরিয়ে যেতে পারে ভয়েজারের।
সাথে মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় অকালে প্রাণ  যেতে পারে হাজার হাজার মানুষের সেই সাজানো-গোছানো স্বপ্নের!
অবশেষে কিন্তু তা হওয়ার সম্ভাবনাকে কোনো প্রকারে কাটিয়ে ভয়েজার-১ সশরীরে অধ্যয়ন করে ফেলে বৃহস্পতির প্রধান চারটে চাঁদকে , যাদের মধ্যে ‘ক্যালিস্টো’ ও ‘গ্যানিমিড’ (গ্যালিলিও আবিষ্কৃত) ছিল সম্পূর্ণরূপে নিষ্ক্রিয় , 
এবং জীবনের কোনো অস্তিত্বের আশাই ছিল এগুলোর মধ্যে বৃথা।

 পরবর্তী প্রধান চাঁদযুগ্ম যথাক্রমে ‘ইউরোপা’ ও ‘আই ও’-এর মধ্যে ইউরোপার উপরিভাগটা ঢাকা বরফের পুরু চাদরে ,  
ও এর নিচে প্রমাণিত হয়
তরল রূপে জল হওয়ার পূর্ণ সম্ভাবনা।  
আর জুপিটারের শেষ প্রধান চাঁদ ‘আই ও’ , যেটা আবার পরিপূর্ন ভলকানিক সব অ্যাক্টিভিটিতে , অর্থাৎ ভাবলে রীতিমতন ঘুম ভেঙে তড়াক করে জেগে ওঠে শিহরণ যে , ‘আই ও’-তে সক্রিয় আগ্নেয়গিরি রয়েছে পৃথিবীর থেকেও বেশি।  
শুধু কি তাই?
এই আগ্নেয়গিরির মহা-বিস্ফোরণ ,  মহাশূন্যে ২০০ কিমি পর্যন্ত লাভাকে দিতে পারে একেবারে ছুঁড়ে। 

 
এই সমস্ত মূল্যবান তথ্যসমূহ সংগ্রহের মধ্যে দিয়ে প্রায় একবছর সময় অতিক্রান্ত করার পর ‘ভয়েজার-১’-এর পরবর্তী লক্ষ্য পড়ল সেই ‘শনি’ নামক গ্যাস দৈত্যের উপরে 
গিয়ে। 
হিন্দু ধর্ম মতে এক উগ্র দেবতাকে দেবরাজ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে আবার এই শনি গ্রহেরই নামানুসারে , যাঁর বক্রদৃষ্টির ফলে ভালো কাজ করা মানুষের হয় 
ভালো , আর যিনি করে বসেন মন্দ কাজ , তাঁদের উপরে প্রকোপের ফলে শাস্তিও হয় সেইরূপ।
বলাবাহুল্য এতদিন যাবৎ শনিকে কিন্তু দেখা যেত অত্যন্ত বেশি অস্পষ্টভাবে।
অবশেষে দীর্ঘদিনের সেই অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে এবারে ভয়েজার-১ পাঠাতে থাকে শনিগ্রহের রিং বা বলয়ের কিছু স্বচ্ছ ছবি এবং পরবর্তীতে আমাদের পরিচয় সম্পন্ন হয় শনির চাঁদ ‘টাইটান’-এর সাথেও। ‘টাইটান’-এর চিত্র থেকে গবেষণালব্ধ ফল এমন যে , যেখানে গোটা উপগ্রহটাই পরিপূর্ণ নাইট্রোজেনের জঙ্গলে , সেখানে এর ভূমি ভরা মিথেনের নদীতে , আর এই টাইটানের ব্যাস চাঁদের দেড় গুণ ও ভরও চাঁদের ১.৮ থেকে ৯ গুণ। 

বৃহস্পতির গ্যানিমেড বা গ্যানিমিড-এর পরেই এই টাইটানই আবার সৌরজগতের দ্বিতীয় বৃহত্তম উপগ্রহ। 
‘ভয়েজার-১’ -এর কাজ আপাতত এখানেই শেষ , এবারে শুরু ‘ভয়েজার-২’ এর গুরুত্বপূর্ণ সব কার্যকলাপ। 
শনির অনেক কাছ থেকে একে যেতে হবে ইউরেনাসের দিকে , এবং শেষমেষ  জানুয়ারী ১৯৮৬ তে ‘ভয়েজার-২’ সেই ইউরেনাসে গিয়ে পৌঁছায় এর সবথেকে  ছোটো ও কাছের চাঁদ ‘ম্যারেন্ডা’-র কাছে , এবং সাথে পরিচয় ঘটিয়ে দেয় ইউরেনাসের রেডিয়েশন বেল্ট ও ১০ খানা
ছোট চাঁদের সাথে। 

ইউরেনাস ছেড়ে ‘ভয়েজার-২’ নেপচুনের সন্ধানে পথ চলা শুরু করেছিল ১৯৮৯-এ , 
ও পৌঁছেও কিন্তু গেছিল আমাদের সোলার সিস্টেমের সবথেকে শেষে অবস্থিত নেপচুনের কাছে গিয়ে। 
এতদিন পর্যন্ত সবচেয়ে অস্পষ্ট ছবির নেপচুনকে অত্যন্ত কাছ থেকে অধ্যয়নের পর সামনে চলে আসে রীতিমতন এক অবাক করে দেওয়া তথ্য , 
যা ছিল এই গ্রহের মধ্যে উপস্থিত এক বড় দাগ। 
এরপর ‘ভয়েজার-২’ আরও কাছে পৌঁছালে পরিলক্ষিত হয় যে , দাগটা হচ্ছে সেই ইউরেনাসেরই চাঁদ ‘টাইটান’-এর , যার অর্ধাংশই ঢাকা নাইট্রোজেনের মোটা বরফে। 
নানা প্রতিবন্ধকতাকে উপেক্ষা করেই অতঃপর ভয়েজার আমাদের সোলার সিস্টেমের সব প্ল্যানেটকে চিরবিদায় জানিয়ে চলে যায় আরও অনেক দূরে।  
বলাবাহুল্য বিজ্ঞানীরা গবেষণা করে স্থির সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে , বৃহস্পতি ও শনির মাধ্যাকর্ষণ শক্তিকে ব্যবহার করে ইউরেনাস ও নেপচুনের কাছাকাছি পৌঁছানো সম্ভব , ও পরে প্লুটোকেও এর সাথে করা হয় যুক্ত।  
আমাদের সৌরমণ্ডলের সীমা অতিক্রম করে সর্বশেষ ‘ভয়েজার-১’ নামক মহাকাশ যানটি পৌঁছায় পৃথিবী থেকে ১২০০ কোটি মাইল দূরে সৌরজগতের শেষ প্রান্তে। 
পৃথিবী ছেড়ে সাড়ে আঠেরো বিলিয়ন কিলোমিটার দূরে যখন সে অবস্থান 
করছে , তখন কোনো রেডিও সিগন্যালকে পৃথিবী পর্যন্ত পাঠাতে সময় লেগে যাচ্ছে ১৭ ঘন্টা। 
এরপর আমাদের সৌরজগতের বাইরে এখন ‘ভয়েজার-১’ যে জায়গায় অবস্থান করছে তাকে বলা হয় ‘ইন্টারস্টেলার স্পেস!’
হাড় হিম করা ও রক্ত জমাট বাঁধা ঠান্ডা ও গহীন অন্ধকারে সমৃদ্ধ এই জগৎ , যেখানে আজও পর্যন্ত গিয়ে পৌঁছতে পারেনি মানব অভিজ্ঞতার লেশমাত্র।  
যেখানে সূর্যের প্রভাবের চেয়ে মহাকাশযানে বেশি কাজ করে মহাজাগতিক অন্যান্য বস্তুর! 
মহাবিশ্ব বিজ্ঞানীদের ধারণানুযায়ী মহাবিশ্বের মাত্র ৫ থেকে ১০ শতাংশ আলোকিত ও বাকি ৯০ থেকে ৯৫ ভাগই 
আবৃত নিকষ কালো গহীন অন্ধকারে! 
সীমাহীন সেই অন্ধকারে সম্পূর্ণ একা একা পথচলা ‘ভয়েজার-১’ সৌরজগতের বাইরের ছবি ও বার্তা কিংবা তথ্য প্রেরণ হয়তো ক্রমশঃ প্রকাশ্য। 
এখানে জানিয়ে রাখা ভালো যে , ভয়েজারের পাঠানো তথ্য ততদিন পৃথিবীতে পাঠানো সম্ভব , যতদিন পর্যন্ত ঠিক থাকবে এর মধ্যে বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থা। 
বিজ্ঞানীদের ধারণানুযায়ী আর ৯ থেকে ১০ বছরের মধ্যে তাও হয়তো উন্নীত হবে শেষ পর্যায়ে , তবুও সৎভাবে ভয়েজারের পথ চলা আজও বিরামহীন। 
ক্রমাগত ৪০-৪৪ বছরের টানা এই যাত্রায় ভয়েজারদ্বয় সমগ্র মানবজাতিকে মূল্যবান তথ্য প্রেরণ করেই চলেছে , কিন্তু দুর্ভাগ্যবশতঃ বর্তমানের উন্নত বিজ্ঞান-প্রযুক্তির মত আধুনিকতার কোনো ছোঁয়া তো নেইই এই স্পেস ক্রাফটে , বরং 
মহাকাশযান চলছে মাত্র ৬৮ কিলোবাইট (K.B)-এর কম্পিউটারের সাহায্যে।  
ভাবা যায়?
যেখানে বর্তমানে মোবাইলের
সবথেকে স্বল্প দামি একটা মেমোরিও ৮ থেকে ১৬ গিগাবাইট (G.B). 
প্রথমদিকে ভয়েজারের দায়িত্বে ৩০০ জন বিজ্ঞানী রাখা হলেও ২০০৪ সালের আগে এর গতিবিধি পর্যবেক্ষণের দায়িত্বে রাখা হয় ১০ জন বিজ্ঞানীকে। 
বিজ্ঞানীদের ধারণা অনুযায়ী ২০২০ সাল নাগাদ আমরা এর থেকে তথ্য পেতে পারি , এরপর সমস্যা দেখা দিতে পারে এদের বিদ্যুৎ শক্তিতে , 
ও এই সমস্যাকে উপেক্ষা করেই মহাকাশযানগুলো আমাদের পৃথিবী থেকে চলে যাবে আরো অনেক দূরত্বে , 
আর সেখান থেকে পাঠানো সংকেত দুর্বল হয়ে যাবে অনেকাংশেই।
শেষ পর্যন্ত এদের পাঠানো তথ্যকে সংগ্রহ করা আদৌ আর সম্ভব হবে কি না? 
তা যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশ রাখে বলে মনে করছেন বিজ্ঞানীমহল। 
২০৩০ সাল পর্যন্ত এই যানযুগ্ম কোথায় গিয়ে পৌঁছতে পারে , তা বলা সম্ভব নয় বলেও মনে করছেন বিজ্ঞানীরা। 
ভয়েজার লঞ্চ করার পরে পরেই ছোটো খাটো কিছু সমস্যা দেখা যাচ্ছিল , যার কারণে ভয়েজারকে বেশ কয়েকবার মাঝপথে করা হয় রি-প্রোগ্রামিংও।
সাথে সাথে দুর্বল হতে থাকা সিগন্যালকে ধরার জন্যে পৃথিবীতে ভয়েজারের জন্যে বসানো হয় আরো বড় ও অত্যাধুনিক অ্যান্টেনা , কারণ এর দূরত্ব ক্রমবর্ধমান। 
আজ ভয়েজার আমাদের ছেড়ে চলে গেছে 
এতটাই অবিশ্বাস্য দূরে যে , সেখান থেকে আমাদের সূর্যকে একটা ছোট্ট তারা কিংবা বিন্দুর মতই দেখা যাবে। 
আজও ক্রমশই ভয়েজার এগিয়ে চলেছে
এক অচেনা-অজানা পথের দিকে , যার শেষ আদৌ আছে কি না , তা অবকাশ রাখে যথেষ্ট সন্দেহের!
আমাদের সোলার সিস্টেমকে অনেক পিছনে ফেলে সে পৌঁছে গেছে ‘ডিপ স্পেসে!’ 
পৃথিবী ছেড়ে এখন সে ২১ বিলিয়ন (১বিলিয়ন =১০০০ মিলিয়ন , ১মিলিয়ন = ১০লাখ।) কিমি দূরে। 
বর্তমানে সূর্যের আলো যদি ভয়েজার পর্যন্ত পৌঁছতে চায় , তো এতে সময় লাগবে ১৭ ঘন্টা।  
সত্যিই রীতিমতন রোমাঞ্চকর কিংবা শিহরণ জাগানো এক মানব সৃষ্ট , ইতিহাসের উল্লেখযোগ্য অধ্যায় সৃষ্টিকারী ঘটনা! 
আলোর গতিবেগ যেখানে সেকেন্ডে ৩ লক্ষ কিমি , সেখানে নাকি ১৭ ঘন্টা সময় লাগবে ভয়েজারের বর্তমান অবস্থান অবধি আলো পৌঁছতে। 
পৃথিবী থেকে ভয়েজারের আজকের দূরত্ব তো নয় দিলাম ছেড়েই। 
১৯৯০ সালে সৌরমণ্ডলের কাজ শেষ করে ভয়েজার-১ যখন সৌরমণ্ডলের বাইরে যাওয়ার প্রস্তুতি পর্বে , এমন সময়ে 
বিখ্যাত মার্কিন জ্যোতির্বিজ্ঞানী ,  জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানী , বিজ্ঞান লেখক এবং মার্কিন মহাকাশ প্রকল্পসমূহের এক পুরোধা ব্যক্তিত্ব কার্ল এডওয়ার্ড সেগান-এর অনুরোধে ভয়েজারের ক্যামেরাকে পৃথিবীর দিকে করা হলে ৬ বিলিয়ন কিমি দূর থেকে সে সময়েই পৃথিবীকে দেখতে লাগছিল একটা উজ্বল ছোট্ট নীল বিন্দুর মতন! 
আর ৬ বিলিয়ন দূরত্ব থেকে ভয়েজার-১ এর নেওয়া এটাই ছিল পৃথিবীর প্রথম ও শেষ ছবি।  
ছবিটা দেখে আধ্যাত্মিকতায় ভরপুর হয়ে ওঠা মনের এই মানুষটার মূল্যবান বক্তব্যের প্রধান অংশ ছিল এরূপ ,   
“অনন্ত মহাবিশ্বে আমাদের পৃথিবী একটা ধুলোর কণাও নয়! 
এমন কোনো জায়গা নেই যেখান থেকে আমরা বিপদে পড়লে আমাদের কেউ উদ্ধার করতে আসবে বলে মনে হয়। 
এখন পর্যন্ত পৃথিবীই এমন স্থান যেখানে আমরা বসবাস করতে পারি , আর এমন কোনো জায়গা নেই যেখানে মানবজাতি থাকার জন্যে যেতে পারে , হ্যাঁ আমরা পৃথিবী থেকে অনেক জায়গাতেই গেছি কিন্তু এখনও পর্যন্ত কোথাও স্থায়ীভাবে বসবাস করতে পারিনি। 

এখন আপনি এই পৃথিবীকে পছন্দ করুন আর নাই করুন , আমাদেরকে এখানেই থাকতে হবে। 
আমার মতে এই ছবি (ছোট্ট নীল বিন্দু) আমাদেরকে কর্তব্যের কথা বলে। 
আমাদেরকে একে অপরের প্রতি আরো অধিক নরম ও সহনশীল আচরণ করতে হবে , যেন আমরা এই ছোট্ট বিন্দুকে আমাদের বসবাস উপযুক্ত করে একেও বাঁচিয়ে রাখতে পারি!” 
ভয়েজার-১ এখন পৌঁছে গেছে পৃথিবী থেকে ২১.৬ থেকে ২২ বিলিয়ন কিমি দূরে। আনুমানিক ৪০ হাজার বছর পর এটা 
১.৬ লাইট ইয়ার্স (আলোকবর্ষ) দূরে থাকা ৭৯৩৮৮৮(793888) নামক তারার খুব কাছ থেকে যাবে , এবং এই তারাটাই আবার ৪০ লক্ষ ৩০ হাজার কিমি প্রতি ঘন্টার গতিতে ছুটে আসছে আমাদের সৌরমণ্ডলের দিকে। 
এদিকে ভয়েজার-১ এর গতি এই সময়ে পৌঁছে গিয়েছে ৬১ হাজার ৪০০ কিমি / ঘন্টা পর্যন্ত।
‘ডিপস্পেস’-এ থাকা ভয়েজার-১ এর সাথে বিজ্ঞানীদের সম্পর্ক স্থাপনের কাজ করে রেডিও সিগন্যাল , এবং ভয়েজার-১ এখন পৃথিবী থেকে প্রতিদিন ১৪ লক্ষ ৭৩ হাজার ৬০০ কিমি দূরে চলে যাচ্ছে। 
এদিকে ব্যাটারি ক্রমশ দুর্বল হতে থাকার কারণে অনুমান করা হচ্ছে যে , ২০২৫ সাল নাগাদ কাজ করা বন্ধ করে দিতে পারে 
এটা , এরপর ভয়েজার-১ জমকালো অন্ধকারে অনন্ত মহাবিশ্বে ততক্ষণ ভ্রমণ করতে পারবে , যতক্ষণ পর্যন্ত এটা ধাক্কা না লাগছে কোনো অবজেক্টের সাথে , অথবা না পড়ছে মহাজাগতিক কোনো আক্রমণের কবলে , আর এভাবেই বিষয়টা ভয়েজার-২-এর ক্ষেত্রেও প্রায় একই। 
আজ পর্যন্ত মনুষ্যসৃষ্ট কোনো মহাকাশ যানই সক্ষমতার পরিচয় বহন করতে পারেনি এত দূর পর্যন্ত গিয়ে।
তবে ১৯৭৭-এ ‘ভয়েজার-১’ ও ‘ভয়েজার-২’ এর মতই ‘পায়োনিয়ার-১০’ ও ‘পায়োনিয়ার-১১’ নামক দুটি
 স্পেসক্রাফটকে যথাক্রমে ১৯৭২ , ২ মার্চ ও ১৯৭৩ , ৬ এপ্রিল মহাবিশ্বের অজানাকে অধ্যয়ণের জন্যে উৎক্ষেপণ করা হয়েছিল 
মহাকাশে , কিন্তু দুর্ভাগ্যবশতঃ একটার সাথে ১২ ও অপরটার সাথে ২০ বছর যাবৎ যোগাযোগের সর্বরকম আন্তরিক প্রচেষ্টা প্রমাণিত হয় একেবারে ব্যর্থ! 
আনুমানিক , ভয়েজারের সাথে এমনটাই ঘটবে। 
‘যার সৃষ্টি আছে , তার ধ্বংসও আছে।’
অতএব সমগ্র মানবজাতিসমেত আমাদের এ পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে একদিন হয়তো ঠিকই , কিন্তু অসীম ও অনন্ত মহাবিশ্বের সেই দুর্ভেদ্য অন্ধকারে তখনও হয়তো খড়কুটোর মতন ভেসে বেড়াবে ভয়েজার অথবা ত্যাগ করবে শেষ নিঃশ্বাস! 
চিরকালের মতন হারিয়ে যাবে আমাদের থেকে , আর আমরাও এদের থেকে।  

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.