নাকে নল, গলায় জোশ, কাজে হুঁশ! শেষ লড়াইটুকু মনে রাখবে এ দেশের রাজনীতি

দীর্ঘ লড়াই শেষে আজ রবিবার, নিজের বাসভবনে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন গোয়ার মুখ্যমন্ত্রী মনোহর পর্রিকর। তাঁর প্রয়াণের খবর আসার পরেই শোকস্তব্ধ হয়ে পড়ে গোটা দেশ। ঘোষিত হয় রাষ্ট্রীয় শোকও। লোকসভা নির্বাচনের আগে গুরুত্বপূর্ণ এই মানুষটির মৃত্যু, দলের বড়সড় ক্ষতি বলেই মনে করছে বিজেপি।

শীর্ষ নেতৃত্ব, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী যেমন জানিয়েছেন, আধুনিক গোয়ার রূপকার ছিলেন মনোহর পর্রিকর। নিজের মন্ত্রিসভার সদস্যের প্রয়াণে এই ভাষাতেই তাঁকে সম্মান জানিয়েছেন মোদী।

শনিবার সকাল থেকেই গোয়ার মুখ্যমন্ত্রীর শারীরিক অবস্থার অবনতি হতে শুরু করে। সন্ধেয় তাঁর অবস্থা অত্যন্ত আশঙ্কাজনক বলে গোয়ার মুখ্যমন্ত্রীর টুইটার হ্যান্ডেল থেকে ট্যুইট করা হয়। এর পরে থেকেই তাঁর বাড়ির সামনে ভিড় জমতে শুরু করে। রাত আটটায় তাঁর মৃত্যুর খবর জানা যায়। গোয়ার পানাজিতে নিজের বাড়িতেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন তিনি।

এ দিন পর্রিকরের মৃত্যুর পরে দীর্ঘ তিনটি টুইট করেছেন প্রধানমন্ত্রী। প্রথম টুইটে নিজের সঙ্গে মনোহর পর্রিকরের ছবিও পোস্ট করেন মোদী। প্রয়াত মুখ্যমন্ত্রীকে অতুলনীয় নেতা বলে উল্লেখ করে মোদী লেখেন, “এক জন প্রকৃত দেশপ্রেমিক এবং ব্যতিক্রমী প্রশাসক ছিলেন তিনি।” একই সঙ্গে তিনি আরও লিখেছেন, “দেশের প্রতি তাঁর অনবদ্য অবদানের কারণে তিনি স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। তাঁর প্রয়াণে আমি গভীর মর্মাহত। তাঁর পরিবার এবং অনুগামীদের সমবেদনা। ওম শান্তি।”

মোদী সরকারের জমানায় প্রতিরক্ষা মন্ত্রী ছিলেন মনোহর পর্রিকর। পরে গোয়ার মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পরে, সেই পদ থেকে ইস্তফা দেন। তবে প্রতিরক্ষা মন্ত্রী হিসেবে দেশের একগুচ্ছ গুরত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিয়েছিলেন তিনি। যে কথা উঠে এসেছে মোদীর তৃতীয় টুইটে। প্রধানমন্ত্রী লিখেছেন, “মনোহর পার্রিকর প্রতিরক্ষা মন্ত্রী হওয়ার পরে ভারত এক নয়া উচ্চতায় পৌঁছেছিল। তিনি একাধিক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন দেশকে প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে উন্নত করার জন্য।”

উরিতে জঙ্গি হামলার পর সেনাবাহিনীকে স্বাধীনতা দিয়েছিলেন তৎকালীন প্রতিরক্ষা মন্ত্রী মনোহর পর্রিকর। সালটা ২০১৬। ২৮-২৯ সেপ্টেম্বরের রাতে পাক অধিকৃত কাশ্মীরের ভিতরে ঢুকে গিয়ে পাক জঙ্গি ঘাঁটি গুঁড়িয়ে দিয়ে আসে ভারতীয় সেনার স্পেশ্যাল ফোর্স। সেই সফল অভিযানের পরে শুধু সেনাবাহিনীকে নয়, ১২৭ কোটি ভারতবাসীকে ক্রেডিট দিয়েছিলেন পর্রিকর।

সেই সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের সিদ্ধান্ত প্রতিরক্ষামন্ত্রী হিসেবে তাঁর কৃতিত্ব বাড়িয়ে দিয়েছিল অনেকটাই। একটি অভিযানেই বদলে গিয়েছিল পাকিস্তানের কাছে ভারতের ভাবমূর্তি। পর্রিকরই প্রথম দেখিয়ে দিয়েছিলেন, চাইলে ভারতও পারে পাকিস্তানের মাটিতে গিয়ে জঙ্গিঘাঁটি গুঁড়িয়ে দিয়ে আসতে।

তবে সেটাই প্রথম নয়। তারও আগে, ২০১৫ সালের জুন মাসে উত্তর-পূর্বের জঙ্গি সংগঠন এনএসসিএন(কে) মণিপুরের চন্দেল জেলায় ভারতীয় সেনা জওয়ানদের ওপর হামলা করলে ১৮ জন সেনা শহিদ হন৷ এর দিন কয়েক পরেই ভারত-মায়ানমার সীমান্তে এই হামলার প্রত্যাঘাতে, মাত্র ৪০ মিনিটের অভিযানে প্রায় শ’খানেক জঙ্গিকে খতম করে আসে বায়ুসেনা ও প্যারা কম্যান্ডো বাহিনী।

এমন দৃঢ় মানসিকতার ও বিচক্ষণতার সঙ্গে পরিস্থিতি বিচার করে সিদ্ধান্ত নেওয়ার নেতাকে হারিয়ে বিজেপির বহু নেতাই শোকস্তব্ধ। কেন্দ্রীয় মন্ত্রী স্মৃতি ইরানি জানিয়েছেন, বিজেপি পরিবারের প্রত্যেকের কাছে এটা খুব বড় ক্ষতি।

পর্রিকরের মৃত্যুর খবর পৌঁছতে কার্যত ভেঙে পড়েন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী নিতিন গড়করিও। তিনি জানিয়েছেন, পার্টি সদস্যের বাইরেও এক জন ভাল বন্ধু ছিলেন মনোহর। তাঁর মৃত্যু বিজেপিকে মারাত্মক ক্ষতির মুখে দাঁড় করাবে বলেই মনে করেন নিতিন।

তবে মন্ত্রিত্বের দাপট যতই থাকুক, পর্রিকরের শেষের কয়েক মাসের লড়াই কোনও দিন ভুলবে না ভারতীয় রাজনীতি। শেষ কয়েক মাস তিনি চিকিৎসার জন্য ছুটে বেড়িয়েছেন দেশ-বিদেশে। তার পরেও সারা দেশের মানুষ দেখেছে ভেঙে পড়া চেহারায়, নাকে নল লাগানো অবস্থায় বাজেট পেশ করেছেন এই লড়াকু মানুষটা।

জানুয়ারি মাসে গোয়ার বাজেট পেশ করার সময় তিনি বলেছিলেন, “বর্তমান পরিস্থিতির জন্য আমি বিস্তারিত বাজেট বক্তৃতা পেশ করতে পারছি না। কিন্তু আমার একটা জোশ রয়েছেই। খুব উঁচু তারে বাঁধা জোশ রয়েছে। আর, আমি রয়েছি হুঁশেই।” শেষ দিন পর্যন্ত ধরে রাখা এই জোশ আর হুঁশ বহু দিন মনে রাখবে ভারতীয় রাজনীতি।

মারণরোগে আক্রান্ত হওয়া সত্বেও, অসুস্থতাকে কোনও দিনই আমল দেননি তিনি। শেষ প্রাণশক্তিটুকু দিয়েও মুখ্যমন্ত্রিত্ব চালিয়ে গিয়েছেন দৃঢ়চেতা মনোভাবের সঙ্গে। উড়ালপুল উদ্বোধন করতে গিয়ে মাস দুয়েক আগেও চেঁচিয়ে উঠেছিলেন, ‘হাউ ইজ় দ্য জোশ’ বাক্যটি ব্যবহার করে। উচ্ছ্বাসে ভাসিয়ে দিয়েছিলেন উপস্থিত ভিড়কে।

যদিও বিরোধীরা বারবার বলেছিলেন, অসুস্থ পর্রিকরকে দিয়ে জোর করে প্রশাসনিক কাজ চালাতে চাইছে বিজেপি কিন্তু পার্রিকর সব সময়েই বলেছেন, তিনি নিজের ইচ্ছেতেই কাজ করে যাচ্ছেন। তিনিই ভারতের প্রথম বিধায়ক, যিনি আইআইটি-র প্রাক্তনী ছিলেন। বম্বে আইআইটি থেকে প্রাক্তন ছাত্র হিসেবে বিশেষ পুরস্কারও পান তিনি।

তার পরে খুব কম বয়সেই আরএসএসের সদস্য হন পর্রিকর। পরে সঙ্ঘচালক হিসেবেও কাজ শুরু করেন তিনি। এর পরে ১৯৯৪ সালে ভারতীয় জনতা পার্টির বিধায়ক হিসেবে নির্বাচিত হন গোয়া থেকে। পরে ২০০০ সালে গোয়ার মুখ্যমন্ত্রী হন তিনি। সেই দফায় তাঁর সরকার মাত্র দু’বছর টিকলেও, কয়েক মাস পরে ২০০২ সালের ৪ জুন ফের তিনিই গোয়ার মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে নির্বাচিত হন।

নিজেকে সব সময়েই সাধারণ মানুষের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে দাবি করতেন পর্রিকর। মানুষের জন্য কাজও করতেন মাটিতে পা রেখে। সম্ভবত সেই কারণেই তাঁকে দ্বিতীয় বার বিশ্বাস করেছিল গোয়াবাসী।

ইতিমধ্যেই সোমবার এক দিনের জাতীয় শোক ঘোষণা করেছে কেন্দ্রীয় সরকার। অন্য দিকে তাঁর রাজ্যে সোমবার থেকে টানা ৭ দিন শোক পালন করা হবে বলে জানা গিয়েছে।

তার আগে, সোমবার সকাল সাড়ে ১০টা পর্যন্ত পানাজিতে বিজেপি রাজ্য দফতরে প্রয়াত মুখ্যমন্ত্রীর দেহ রাখা হবে। সেখান থেকে কলা অ্যাকাডেমিতে নিয়ে যাওয়া হবে তাঁকে। সকাল ১১টা থেকে বিকেল ৪টে পর্যন্ত সাধারণ মানুষ তাঁদের প্রিয় নেতাকে সেখানে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে পারবেন। তার পরে, পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় গোয়াতেই সম্পন্ন হবে তাঁর শেষকৃত্য।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.