আজ থেকে একশো ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ বছর আগের ঘটনা, ঋণগ্রস্ত এক ব্যক্তি দিশেহারা হয়ে চতুর্দিক ঘুরে বেড়াচ্ছেন।যদি কোন সহৃদয় ব্যক্তির কাছ থেকে কিছু অর্থ সাহায্য পাওয়া যায়।বহু প্রচেষ্টার পর কিছু উপায় হল।এর তার কাছ থেকে কোনও ভাবে ৪০০ টাকা সংগ্রহ করে যখন নিজের গ্রাম মাথরুনে(বর্ধমান) ফিরলেন,দেখলেন এক অতিদরিদ্র বৃদ্ধ ব্রাহ্মণ তাঁর আশায় অপেক্ষা করছেন। ব্রাহ্মণের বাড়ি বন্ধক রাখা ছিল, ধার শোধ করতে অপারগ হওয়ায় নিজগৃহ থেকে উৎখাত হয়েছেন।ব্রাহ্মণের দৃঢ়বিশ্বাস ছিল,যিনি যেকোন আপদ বিপদে সকলের পাশে থাকেন,ধারদেনা করেও অপরের সংকটে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন, তিনি নিশ্চয়ই কিছু একটা উপায় বার করবেন।উপায় অতি সহজেই হয়ে গেল।ধারে সংগ্রহ করা.৪০০ টাকা থেকে ব্রাহ্মণের ঋণ,৩৯৯ টাকা.১৫ আনা, ৩ পাই পরিশোধ করে,হাতে মাত্র একটি পয়সা নিয়ে মহানন্দে গৃহে প্রবেশ করলেন।গৃহলক্ষী কাশীশ্বরী স্বামী-মুখে ব্রাহ্মণ বৃত্তান্ত শুনে স্বামী গর্বে আত্মপ্রসাদ লাভ করলেন।
হ্যাঁ এই ব্যক্তিই পরবর্তী কালের মহারাজা মনীন্দ্র চন্দ্র নন্দী।নিতান্তই দীনহীন অবস্থা থেকে শুরু করে পরবর্তীকালে প্রভূত সম্পত্তির অধিকারী হয়ে,পুনরায়“দানে দানে নিঃস্ব”হয়েছিলেন।আক্ষরিক অর্থেই তিনি ছিলেন কলির দাতাকর্ণ।যার সম্বন্ধে গান্ধীজী বলেছিলেন-“এতদিন আমি ভাবিতাম এই জগতের মধ্যে বুঝি আমার পার্শি বন্ধুদের দানের তুলনা নেই।এখন দেখিতেছি যে সে ধারণা শুধুমাত্র সম্প্রদায় হিসেবে তাঁদের প্রতি প্রযোজ্য।কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে এমন একজন প্রার্থীর কথাও আমার মনে পড়ে না,যাহার দান কাশিমবাজারের দান কে অতিক্রম করতে পারে”।রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন“এতদিন পরে একজন ধনী দেখিতে পাইলাম যিনি ধনের মর্যাদা করিতে রক্ষা করিতে শিখিয়াছেন।ইনি যেমন অন্তরের সহিত বিনয়ী তেমনি দেশের সদনুষ্ঠানে ইহার উৎসাহ একান্ত অকৃত্রিম”।কাজী নজরুল “মণীন্দ্র প্রয়াণ” কবিতায় লিখেছিলেন-
দানবীর…
ইন্দ্র কুবের লক্ষ্মী আশিস ঢেলেছিল যত শিরে
দুহাত ভরিয়া ক্ষুধিত মানবে দিলে তাহা ফিরে ফিরে।
যে ঐশ্বর্য লয়ে এসেছিলে তাহারই গর্ব লয়ে।
করেছ প্রয়াণ পুরুষ শ্রেষ্ঠ উঁচু শিরে নির্ভয়ে ।
অথচ কি আশ্চর্য! এই ব্যক্তিই শৈশব অবস্থা থেকে দুঃখ ও অর্থাভাবের মধ্য দিয়ে বেড়ে উঠেছিলেন।জন্ম ১৮৬০ খ্রিষ্টাব্দের ২৯শে মে, শ্যামবাজার কোলকাতায়। পিতা নবীনচন্দ্র,মাতা গোবিন্দ সুন্দরী।জন্মের দু’বছরের মধ্যেই মাতৃহারা।শিক্ষা প্রথম শ্যামবাজার অ্যাংলো ভার্নাকুলার( এভি )স্কুল, পরবর্তীকালে হিন্দু স্কুল।মাত্র ১২ বছর বয়সে পিতৃহারা হন।এরপর শারীরিক কারণে স্কুলে যাওয়া বন্ধ হলেও বাড়িতে গৃহ শিক্ষকের মাধ্যমে গণিত সাহিত্য ভূগোল শিক্ষা লাভ করেন।স্কুলজীবনে বিদ্যার্থী হিসেবে ততটা উজ্জ্বল না হলেও বিভিন্ন বিষয়ের ওপর অপরিসীম কৌতূহল ছিল- যা পরবর্তীকালে মণীন্দ্রচন্দ্র কে এক বিদ্যোৎসাহী ব্যক্তিত্বে পরিণত করেছিল। কাশিমবাজার এস্টেটের মহারাজা, রাজা কৃষ্ণনাথ এর বিধবা পত্নী মহারানী স্বর্ণময়ীর মৃত্যুর পর ১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দে তিনি কাশিমবাজার রাজ এস্টেটের উত্তরাধিকার লাভ করলেন। এরপর ১৮৯৮ এর ৩০ শে মে তিনি “মহারাজ” উপাধি প্রাপ্ত হন। প্রথমেই বলা হয়েছে যে মণীন্দ্রচন্দ্র প্রথাগতভাবে স্কুল-কলেজ না করলেও প্রবল বিদ্যোৎসাহী ছিলেন।জনকল্যাণমূলক যেকোনও কাজের জন্য তার সাহায্যের হাত সদাসর্বদা প্রসারিত ছিল।যে দেশ বিশ্বের প্রথম গ্রন্থ ঋকবেদ, প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় তক্ষশীলা্ বিশ্ববাসী্কে দিয়েছে, যে দেশ অপালা ,লোপামুদ্রা গার্গী, লীলাবতী দের মত বিদুষী দের জন্ম দিয়েছে,সে দেশে বিশেষ করে নারী শিক্ষার করুণ অবস্থা তাঁকে ব্যথিত করত। মণীন্দ্রচন্দ্রের সময়ে এমন কোন সারস্বত প্রতিষ্ঠান ছিল না,যা তার সাহায্য প্রার্থনা করে বঞ্চিত হয়েছে।কাশী হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়, কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, আইন কলেজ, বসু বিজ্ঞান মন্দির, আর জি কর মেডিকেল কলেজ, বহরমপুর কৃষ্ণনাথ কলেজ, বহরমপুর কে এন কলিজিয়েট স্কুল, কলকাতা অ্যালবার্ট ভিক্টর কুষ্ঠ হসপিটাল,বহরমপুর হাসপাতাল,বেঙ্গলি পত্রিকা ,কলকাতা মূক ও বধির বিদ্যালয়,কলকাতা মেডিকেল কলেজ,শম্ভুনাথ পন্ডিত হসপিটাল ,তালিকা সম্পুর্ন করতে গেলে আস্ত একটি বই হয়ে যাবে।মুর্শিদাবাদ জেলার বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তাঁর অর্থানুকূল্যে প্রতিপালিত হত I সৈদাবাদ অঞ্চলে তাঁর নামাঙ্কিত মণীন্দ্র চন্দ্র বিদ্যাপীঠ, মুর্শিদাবাদ জেলার একটি বিশিষ্ট উচ্চ বিদ্যালয় I
কেবলমাত্র বহরমপুর অথবা কাশিমবাজার নয় কলকাতাসহ অন্যত্রও বহু দুঃস্থ বিদ্যার্থীর আশ্রয়,জামা-জুতো,টিফিন্,শিক্ষাবৃত্তির সম্পূর্ণ খরচ জোগাতেন তিনি।তাঁর অর্থ সাহায্যে বহু ছাত্রাবাস পরিচালিত হত, এর জন্য কর্জ নিতেও তিনি কুন্ঠিত হতেন না।
বাংলা সাহিত্য সেবায় মণীন্দ্রচন্দ্রের উল্লেখযোগ্য অবদান হল,তাঁরই জমিতে বাঙালির সাহিত্য সাধনার অন্যতম প্রতিষ্ঠান “বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের” ভবন নির্মাণ।মুলত তাঁরই পৃষ্ঠপোষকতায় কাশিমবাজার রাজবাড়ি প্রাঙ্গণে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সভাপতিত্বে ঐতিহাসিক প্রথম সাহিত্য সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল।এছাড়াও সঙ্গীত একাডেমী, নাট্য একাডেমী প্রতিষ্ঠায় তাঁর অবদান অতি উল্লেখযোগ্য।
আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্রের আদর্শে অনুপ্রাণিত মণীন্দ্রচন্দ্র স্বদেশী শিল্প স্থাপনের অন্যতম পথিকৃৎ।১৯০৫ খৃষ্টাব্দের ৭ই আগস্ট বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদে কলকাতার টাউন হলে যে ঐতিহাসিক সভা হয়েছিল,তার সভাপতিও ছিলেন তিনি।এই সভাতেই বিলাতি বস্তু বর্জনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।ব্রিটিশ দমননীতির তীব্র বিরোধী মনীন্দ্রচন্দ্র গোপনে বিপ্লবীদেরকেও সহায়তা করতেন।ব্রিটিশ বিরোধিতার কারণে ইংরেজ সরকার তাঁর “মহারাজা” উপাধি কেড়ে নিতে চাইলে তিনি স্পষ্ট ভাষায় জানিয়েছিলেন-“মহারাজা মনীন্দ্রের চেয়ে মনীন্দ্রবাবু হয়ে থাকাই তাঁর কাছে বেশী ভাল”।এরপর তারই উৎসাহে একের পর এক স্বদেশী কারখানা স্থাপিত হয়।বেঙ্গল পটারি,হাতিবাগানের টিন প্রিন্টিং,সিংভূম চীনামাটির খনি,নলহাটিতে পাথরের খাদান কারখানা,বহরমপুর উইভিং ফ্যাক্টরি,জাহাজ,কয়লা,রেলপথ,মোটর,ট্যানারি,ছাপাখানা,তেলকল,ব্যাংক,সমবায়,অভ্র,সর্বক্ষেত্রে মণীন্দ্রচন্দ্র দান অথবা বিনিয়োগের মাধ্যমে স্বদেশী শিল্পকে সমৃদ্ধ করেছিলেন।এছাড়াও প্রতিষ্ঠানগুলি যাতে সুচারু ভাবে চলতে পারে তার জন্য কয়েকটি কারিগরি বিদ্যালয়েও প্রভূত অর্থ সাহায্য করেছিলেন।স্বদেশী শিল্পের পাশাপাশি জনগন যাতে নাগরিক জীবনের অত্যাবশকীয় পরিষেবা গুলি পেতে পারে, সেই উদ্দেশ্যে তিনি বহুবার নাগরিক প্রতিনিধি নির্বাচিত হয়েছেন।বহরমপুর পুরসভা,জেলাবোর্ডের চেয়ারম্যান পদ থেকে শুরু করে রাজ্য ও তৎকালীন কেন্দ্রের বিভিন্ন পরিষদের সদস্য হিসাবে অসংখ্য জন কল্যাণকারী পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। ধর্ম সংস্কৃতির প্রসারের ক্ষেত্রেও তাঁর ভূমিকা অনস্বীকার্য।তিনি ছিলেন পরম বৈষ্ণব ।গৌড়ীয় বৈষ্ণব সন্মেলন তারই মস্তিষ্কপ্রসুত।১৯১৫ সালে হরিদ্বারে“নিখিল ভারত হিন্দু মহাসভা” সম্মেলনে তিনিই সভাপতিত্ব করেছিলেন।বহু দুস্থঃ গ্রন্থকার তাঁর অর্থানুকূল্যে পুস্তক প্রকাশ করেছেন।ধর্ম সাহিত্যে তাঁর অবদানের জন্য তিনি “শ্রী গৌড় রাজর্ষি”,“ধর্মরাজ”,“ভক্তি সাগর”,“বিদ্যা রঞ্জন”,“ভারত ধর্ম ভূষণ”,“দান কল্পতরু” উপাধিতে ভূষিত হয়েছিলেন।তিনি দৃপ্ত কণ্ঠে বলেছিলেন –“আমার যাহা কিছু আছে সমস্তই পরের জন্য এবং ইহার জন্য আমি ভগবানের নিযুক্ত একজন কর্মচারী মাত্র”। শুধু তিনি নন, পরবর্তীকালে তাঁর স্ত্রী পূত্র, পরবর্তী প্রজন্মও দানশীলতার পরিচয় দিয়েছেন I বিড়ম্বনা এই যে আজ তথাকথিত ঐতিহাসিক গন মুর্শিদাবাদকে নবাবের জেলা বলে প্রতিনিয়ত ঢক্কানিনাদ করেন, অথচ শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ক্ষেত্রে নবাবদের অবদান নাই বললেই চলে I সেক্ষেত্রে মুর্শিদাবাদ জেলার দানবীর মহারাজ শ্রী মণীন্দ্র চন্দ্র নন্দীর অবদান রাজ্য ত দূর, জেলারই বা কতজন জানেন?কিন্তু চতুর্দিকে ক্রমাগত অর্থ সাহায্যের কারণে একসময় মহারাজ সত্যই নিঃস্ব হয়ে পড়লেন।তাঁকে ধার নেওয়া শুরু করতে হল।যদিও দান খয়রাতি আগের মতই চলতে থাকল।একটা সময় নিরুপায় হয়ে তাঁকে এক সাহেব কোম্পানি থেকে কোটি টাকা ধার নিতে হয়।উদ্বেগ, দুশ্চিন্তার করালগ্রাসে মহারাজের শরীর স্বাস্থ্য ক্রমশঃ ভগ্ন হতে শুরু করে।“দানে দানে নিঃস্ব” মনীন্দ্রের সমস্ত সম্পত্তি এক সময় “কোর্ট অফ ওয়ার্ডসের” অধীনস্থ হয়ে যায়। এরপর মহারাজা ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হলে, স্বাস্থ্যের আরও অবনতি ঘটে।বাধ্য হয়ে মহারাজা কে উন্নততর চিকিৎসার জন্যে কোলকাতায় আনা হয়।সেখানে খ্যাতনামা চিকিৎসক,ডাঃ নীলরতন সরকার সুচিকিৎসার যথাসম্ভব ব্যবস্থা করলেও, ১২ ই নভেম্বর,১৯২৯,মধ্যরাত্রে আপামর জনসাধারণ কে পরমাত্মীয় বিয়োগযন্ত্রণাবিদ্ধ করে মহারাজা মনীন্দ্রচন্দ্র অমৃত লোকে প্রস্থান করলেন।
মন্দার গোস্বামী