সনাতন হিন্দু ধর্মের অন্যতম পবিত্র উৎসব মকর সংক্রান্তি উৎসব I সমগ্র ভারত যখন উত্তুরে হাওয়ার তীব্র প্রভাবে জবুথবু হয়ে অলস দিন কাটায় , তখন শীত বিদায়ের বার্তা নিয়ে, প্রকৃতিতে নুতন প্রাণ স্পন্দন সঞ্চার করে আমাদের জীবনে আসে মকর সংক্রান্তি I ভারতবর্ষ শুধুমাত্র আধ্যাত্মিকতার দেশ নয়, ভারতবর্ষ বিজ্ঞানের দেশও বটে I টাইকোব্রাহে, গ্যালিলিও, কেপলার, নিউটনেরও বহু বহু পূর্বে হাজার হাজার বছর আগেও বিজ্ঞান চেতনা সম্পন্ন ভারতীয় ঋষিমুনিগন গ্রহ, নক্ষত্রের সঞ্চারপথ সম্পর্কে বিশদভাবে জানতেন I তাঁরা জানতেন যে সূর্য আপাত স্থির, আর তাকে কেন্দ্র করে পৃথিবী নিরন্তর ভ্রমন করে চলেছে I তাঁরা এই ভ্রমনকাল কে 12 টি রাশিতে ভাগ করে প্রতিটি রাশির একটি করে নামকরণ করেন I আজকের দিনে সূর্যের মকর সংক্রমন ঘটে, অর্থাৎ সূর্য ধনু থেকে মকর রাশিতে প্রবেশ করে I যে সূর্য এতদিন মকর ক্রান্তি রেখার ওপর লম্ব ভাবে কিরণ দিচ্ছিল,দক্ষিনায়ণ শেষ হয়ে এবার তার উত্তরায়ণ শুরু হয় I উত্তর গোলার্ধ হেলে ক্রমশ: সূর্যের কাছে আসতে থাকে, আলোক , উষ্ণতা বৃদ্ধি পায়, অন্ধকার,শৈথিল্য,জড়তা মুক্ত হয়ে জীবকূল নব আনন্দে জেগে ওঠে I সনাতন হিন্দু সমাজ চিরকালই আলোক রুপী সত্য, জ্ঞান,
অমৃতের উপাসক,I সেই কোন কালে ভারতীয় ঋষিগন উদাত্ত কন্ঠে বলে গিয়েছেন.. “অসতো মা সদগময়, তমশ: মা জ্যোতি:র্গময় “, অর্থাৎ আমাকে অসত্য থেকে সত্যের পথে, অন্ধকার থেকে আলোর পথে নিয়ে চল I তাই সৌর বৎসর নিয়ন্ত্রিত মকর সংক্রান্তি দিনটি, শুধু মাত্র বিজ্ঞান নয় আধ্যাত্মিকতার দিক থেকেও অতি গুরুত্বপূর্ণ I মকর সংক্রান্তির দিন সূর্যের উপাসনা করা হয় Iকথিত, এই দিনে সূর্যদেব তার পূত্র শনির সাথে সাক্ষাৎ করতে আসেন I তাই এই দিনটি মিলনৎসবের দিনও বটে I পৌরাণিক মতে আজকের দিনেই ভগীরথের তপস্যায় তুষ্ট মা গঙ্গা স্বর্গ থেকে মর্ত্যে পতিত হয়ে সগররাজের , ভশ্মীভূত ষাট হাজার পুত্রকে পবিত্র গঙ্গাস্পর্শে অভিশাপ মুক্ত করেন এবং গঙ্গাসাগরে মিলিত হন I তাই স্নান মাহাত্যের দিক থেকেও দিনটি অতি পবিত্র I সারা বিশ্ব থেকে কোটি কোটি নরনারী তীব্র শীত উপেক্ষা করে পুণ্যস্নানের আশার গঙ্গাসাগরে আসেন I আসেন পুণ্য কুম্ভ স্নানে I বহু ভাষাভাষী, খাদ্য, বস্ত্র বিবিধতায় ভরপুর সনাতন হিন্দু সমাজে বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্য গড়ে ওঠে I এই উৎসবের মধ্যে দিয়েই সমগ্র বিশ্ব সনাতন ভারতবর্ষ কে প্রত্যক্ষ করে থাকে I শুধুমাত্র পুণ্য কুম্ভ অথবা গঙ্গাসাগরে নয় এই দিনে ভারতবর্ষের প্রায় সমগ্র অংশেই ভিন্ন ভিন্ন নামে এই উৎসব পালিত হয় I
পৌষ মাসের শেষ দিন বলে বাংলায় পৌষ সংক্রান্তি,আসামে ভোগালি বিহু, বিহার উত্তর প্রদেশে খিচড়ি,পাঞ্জাব, হরিয়ানায় লোরী,কাশ্মীরে শায়েন ক্রাত, গুজরাটে উত্তরায়ণ,কর্নাটকে মকর সংক্রমণ, ওড়িশা , মহারাষ্ট্র, অন্ধ্রপ্রদেশ এবং কেরলে মকর সংক্রান্তি ,তামিলনাড়ু তে পোঙ্গল সহ বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন নামে একই উৎসব পালিত হয় I শুধু মাত্র এদেশেই নয়,বিদেশেও এই উৎসব পরম শ্রদ্ধা উৎসাহের সাথে পালিত হয় I নেপালে মাঘী , থাইল্যান্ডে সংক্রান, লাওসে পি-মা-লাও, মিয়ানমারে থিং-ইয়ান এবং কম্বোডিয়ায় মহাসংক্রান নামে পরিচিত I
পুরাণ মতে এই দিনেই দেবাসুরের যুদ্ধ সমাপ্ত হয়ে শুভ শক্তির প্রতিষ্ঠা হয়ে ছিল I শাস্ত্র মতে দক্ষিনায়ণের ছয় মাস দেবতাদের ক্ষেত্রে এক রাত মাত্র I তাঁরা এই সময় নিদ্রামগ্ন থাকেন I আবার উত্তরায়নের ছয় মাস তাঁরা জাগ্রত থাকেন I সুতরাং উত্তরায়ণের শুভ সূচনায় নিদ্রোত্থিত দেবতাদের বন্দনায় মুখরিত হয় মানব সমাজ I চতুর্দিকে বেজে ওঠে শঙ্খ , ঘন্টা, শুরু হয় হোম,যজ্ঞ,পূজা,গীতা পাঠ,কীর্তন, তর্পন, দান I শাস্ত্র অনুযায়ী মকর সংক্রান্তির দিনে যজ্ঞের আহুতি গ্রহণের জন্য দেবতারা মর্ত্যে নেমে আসেন। আবার এই পথেই পু্ণ্যাত্মারা শরীর ত্যাগ করে স্বর্গলোকে প্রবেশ করেন।তাই মহাভারতে আমরা দেখি দক্ষিনায়ণ কালে আটান্ন দিন শর সজ্জায় শায়িত পিতামহ ভীষ্ম এই বিশেষ দিনটিতেই স্বেচ্ছামৃত্যু বরণ করেন I
মকর সংক্রান্তির অপর একটি নাম তিল সংক্রান্তিI এই দিনে তিল দিয়ে তৈরী করা নাড়–, মিষ্টি, ফল ইত্যাদি পূজার নৈবেদ্য হিসাবে নিবেদন করা হয়I এছাড়াও নুতন ফসল ওঠার আনন্দে নানা জাতের পিঠা, পায়েস ইত্যাদির আয়োজন করে দিনটি আরও আনন্দদায়ক করে তোলা হয় I
রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ দিনটিকে একাত্ম জাতীয়তাবাদের প্রতীক রূপে পালন করে I বিশ্বের প্রাচীনতম শ্রেষ্ঠ সভ্যতা সনাতন হিন্দু সভ্যতা I সাহিত্য, কলা,জ্ঞান, বিজ্ঞান,সহ বিশ্বকল্যাণকারী চেতনা সমৃদ্ধ হওয়া সত্বেও আমরা কিন্ত বিদেশী শাসকদের কাছে বার বার পরাজিত হয়েছি, লুন্ঠিত হয়েছি, শোষিত হয়েছি I আমাদের শ্রদ্ধাকেন্দ্র গুলি ধংস করে দেওয়া হয়েছেI এরমুলে ছিল হিন্দু সমাজের অভ্যন্তরে পারস্পরিক অনৈক্য, বিভেদ, শিথিলতা, উদাসীনতা I স্বামী বিবেকানন্দের ভাবধারায় উদ্বুদ্ধ সঙ্ঘ উদাসীন, আত্মবিস্মৃত হিন্দুসমাজের সমস্ত বিভেদ,দুর্বলতা, কাপুরুষতা, অজ্ঞানতা দূর করে পারস্পরিক আত্মীয়বন্ধনের মাধ্যমে শক্তিশালী হিন্দু সমাজ নির্মাণ করতে চায় I সঙ্ঘের শাখায় আজ তিল নাড়ু বিতরণ করা হয় I তিল খুবই হালকা, সামান্য ফুঁ দিলে উড়ে যায়, কিন্ত সেই তিলকে গুড়ের মাধ্যমে সঙ্ঘবদ্ধ করলে,তা কঠোর বস্তুতে পরিণত হয় I স্বাধীনতার 75 বৎসরের দ্বারপ্রান্তে এসে আজও আমরা সম্পূর্ণ ঐক্যবদ্ধ হতে পারিনি I “নাগিনীরা চারি দিকে ফেলিতেছে বিষাক্ত নিশ্বাস,”I বিচ্ছিন্নতাবাদী ব্রেকিং ইন্ডিয়া গ্ৰুপ, টুকড়ে টুকড়ে গ্যাং আজও সমান তালে সক্রিয় I দেশ, ধর্ম, সংস্কৃতি রক্ষায় আজ তাই চাই অখন্ড, ঐক্যবদ্ধ, শক্তিশালী হিন্দু সমাজ I গুড়ের ন্যায় ভালোবাসার বন্ধনের মাধ্যমেই তা সম্ভব I মকর সংক্রান্তির পুণ্য তিথিতে তাই এই হোক আমাদের একমাত্র প্রার্থণা I তবেই নির্মাণ হবে পরম বৈভবশালী ভারতবর্ষের I
মন্দার গোস্বামী