দ্বিতীয় পর্ব


নিরাকার ব্রহ্মের উপাসনা আর দুর্গা ও শক্তি পূজার মধ্যে নেই কোন প্রভেদ। কারণ ‘এক ও অদ্বিতীয় নিরতিশয় চৈতন্যস্বরূপ ব্রহ্ম অনাদিসিদ্ধ মায়ার আবরণে ধর্ম ও ধর্মীরূপে প্রতিভাসিত হন।’অগ্নি ও তার উত্তাপকে যেমন পৃথক করা যায় না, ধর্ম ও ধর্মীকে যেমন স্বতন্ত্র ভাবা যায় না, তেমনি ব্রহ্ম আর শক্তিও অভিন্ন।


দেবী ভগবতে আছে-“সদৈকত্বং ন ভেদোহস্তি সর্বদৈব মমাস্য চ।

যোহসৌ সাহম্ অহং যাসৌ ভেদোহস্তি মতিবিভ্রমাৎ”

অর্থাৎ “আমি ও ব্রহ্ম এক। উভয়ের মধ্যে ভেদ নেই। যিনি ব্রহ্ম তিনিই আমি। আমি যাহা, তিনিও তাহাই। এই ভেদ ভ্রমকল্পিত, বাস্তব নহে।” ‘আমি’-ই দুর্গা বা শক্তি। সচ্চিদানন্দরূপিণী মহামায়া পরাশক্তি অরূপা হয়েও ভক্তপ্রাণের পরিত্রাণ রূপে ধরা দেন। যিনি সর্বশক্তিমান সব কিছুই তাঁর ইচ্ছাধীন, সব কিছুই তাঁর আয়ত্তাধীন। তাই তিনি নিরাকার পরব্রহ্ম হয়েও স্বেচ্ছায় সাকারে আত্মপ্রকাশ করতে পারেন। 
তো যা বলছিলাম, দুর্গা ঠাকুর আর মিথ্র দেবতার মধ্যে একটাই বই অন্য কোনো সাদৃশ্য নেই । সেটি হল , মহাদেবের বর লাভ করে রম্ভাসুরের ঔরসে মহিষাসুর তিনবার জন্ম গ্রহণ করেছিলেন। এবং ব্রহ্মার বরে কেবলমাত্র নারী শক্তির হাতে মহিষাসুর মৃত্যু কামনা করেন।  এই যে মহিষাসুর তিন কল্পে জন্মগ্রহণ করেন , বহুরূপঙ্গিনী মহামায়া আদ্যাশক্তি শ্ৰী শ্ৰী মহাদেবী দুর্গাও তিন কল্পে তিন ভিন্ন রূপে অশুভশক্তি রূপী মহিষাসুরকে বধ করেন। 

কালিকা পুরাণের ষাটতম অধ্যায় উল্লিখিত হয়েছে যে, দেবী প্রথম কল্পে অষ্টাদশভূজা উগ্রচন্ডা রূপে আবির্ভূতা হয়ে মহিষাসুরকে বধ করেন এবং তৃতীয় কল্পে দশভূজা দুর্গা রূপে মহিষাসুরকে নাশ করেছিলেন। 


রোমান পুরাণে মিথ্র দেবতাকে একটি বৃষ সংহার করতে দেখা যায়। এই মূর্তির উৎস খুঁজতে স্টার্ক নামে এক জার্মান পন্ডিত বলেন যে , হয়তো এই মূর্তির সঙ্গে আকাশের তারকামন্ডলীর কোনো যোগ আছে। কিন্তু তাঁকেও লোকে পাগল ইত্যাদি উপমা দিয়ে পাত্তা দেয় নি। বছরের  পর সবাই মিলে সুমের এবং পারস্যের উপকথাগুলির মধ্যে এই মহিষ বধের উল্লেখ খুঁজে বেড়িয়েছেন। এবং যখন কোনো গল্প খুঁজে পাওয়া গেল না তখন তাঁরা আঙ্গুর ফল টকের মতো মিথ্র কাল্ট ব্যাপারটাকে রহস্য বলে উল্লেখ করে দিয়েছেন । 

হার্টনারের লেখা প্রবন্ধটি পড়ে অনেকেরই স্টার্ক মহাশয়ের কথা মনে পড়ে গিয়েছিল । এরপর অনেকেই পৌরাণিক কথা, বিশেষ করে মূর্তি বা চিত্র তত্ত্ব অন্বেষণ করতে রাতভরে আকাশ দেখেছেন। অনেকের আবার এরম ব্যাখ্যা প্রমাণে ব্যস্ত থাকতেন যে ,নানা পৌরাণিক কথা নাকি প্রাচীন কালে জ্যোতির্বিজ্ঞানের আবিষ্কারের প্রচেষ্টা। এসবের মধ্যে যে বই দুটি ছিল সবথেকে বিতর্কিত সেই হল জিয়োর্জিও দ্য সান্তিয়ানা এবং হার্থা ফন ডেখেন্ডের ১৯৬৯ সালের লেখা ” হ্যামলেট’স মিল – অ্যন এসে অন নলেজ এন্ড ইটস থ্রু মিথস।” এই বইয়ের বক্তব্যতে গবেষকদের মধ্যে প্রায় হাতাহাতি লেগে যায়। এরপর ১৯৮৯ সালে ডেভিড উলনসের লেখা দ্য অরিজিনস অফ দ্য মিথ্রাইক মিস্ট্রিজ বইটির উপপাদ্যও একই ছিল।

 

এবার আমি বলি, হ্যাঁ প্রাচীন সনাতনী সভ্যতা ছিল অনেক উন্নত। সেখানে রীতিমতো গাণিতিক ব্যাখ্যায় জ্যোতিষ চর্চা হতো। বেদের ‘নাসাদীয় সূক্ত’ ও ‘হিরণ্যগর্ভ সূক্ত’ এই দুটি সূক্তে মহাবিশ্ব সৃষ্টির অপূর্ব রহস্য বৈজ্ঞানিকভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। এই সূক্ত দুটি বিজ্ঞানী মহলে ব্যাপক আলোচিত কেননা সূক্ত দুটিতে মহাবিশ্ব সৃষ্টি সম্পর্কে যা বলা হয়েছে তা বর্তমান বিজ্ঞানের ধারণার সাথে প্রায় পূর্ণাঙ্গ মিলে যায়। 

নাসদাসীন্নো সদাসীত্তদানীং নাসীদ্রজো নো ব্যোমা পরো যৎ।

 কিমাবরীবঃ কুহ কস্য শর্মন্নম্ভঃ কিমাসীদ্গহনং গভীরম্।।

ন মৃত্যুরাসীদমৃতং ন তর্হি ন রাত্র্যা অহ্ন আসীৎ প্রকেতঃ।

 আনীদবাতং স্বধয়া তদেকং তস্মাদ্ধান্যন্নঃ পরঃ কিং চনাস।।

সেখানে এও বলা হয়েছে – 
“অহস্তা যদপদী বর্ধত ক্ষাঃ শচীভির্বেদ্যানাম্। 

শুষ্ণং পরি প্রদক্ষিণিদ্ বিশ্বায়বে নি শিশ্নথঃ।।”


 বেদ থেকে শুরু করে  বিবিধ ক্ষেত্রে জ্যোতিষের গভীর মূল প্রতিপাদ্য বিষয় সমূহ রূপক ও ছন্দ আকরে বিবিধ বিষয় প্ৰক্ষিপ্ত ভাবে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে । সেগুলির মাঝে সংবৎসর বিভাগ থেকে সময়ের হিসাব , দিন , ইত্যাদি থেকে শুরু করে তিথি নির্ণয়ের পদ্বতি ও আলোচিত আছে। সে বেদাঙ্গ জ্যোতিষ কে প্রধানত চারটি ভাগে ভাগ করা যায়।  তুলনামূলক ভাবে অথর্ব বেদে এর পূর্ণাঙ্গতা লক্ষণীয় । সেখানে  শুভ সময়ের বিবরন,  দিন , গ্রহের নাম ইত্যাদি সবিশেষ বর্ণিত রয়েছে। কল্প অংশে আশ্বল সূত্র , পারাক্ষর সূত্র ও বেদাঙ্গ জ্যোতিষ সমৃদ্ধ । 


       বেদের আরেক প্রধান শাখা নিরুক্ত । সেখানে নিরুক্তকার য়াস্ক নীহারিকা বলছেন – 
    ” অন্তরীক্ষাস্যুপরি স্যানদনশিলা আপা: “
আবার বাল্মীকি রামায়নে নীহারিকার বর্ণনা দিতে গিয়ে  লিখেছেন – 
সাগরঙ চাম্বরঙ  প্রখ্যাম্বরম সাগরপমম ।
                 সাগরম চাম্বরম চেতি নির্বিশেষম দৃশ্যতে।।
এর সাধারণ অর্থ হল সাগর অম্বর তুল্য আর অম্ভর সাগর তুল্য । এই দুয়ের মধ্যে ভেদ নেই । 
  মহর্ষি ব্যাস গঙ্গাকে উপলক্ষ করে রূপকার্থে লিখেছেন – 
       ‘ দিবি ছায়াপথো যস্তু অনু নক্ষত্র মন্ডলম      

   দৃশ্যতে ভাস্বর রাত্রও দেবী ত্রিপমগা তু গা ।।


 ছায়াপথ সম্পর্কে ব্যাস দেবের সে জ্যোতিষ শাস্ত্রে গ্রহ নক্ষত্রদির সম্পর্কিত উপলব্দি যে কত গভীর ছিল তা বলাই বাহুল্য।  এখানে ত্রিপথমগা মানে ত্রি পথ স্বর্গ , মর্ত্য ও পাতাল এই তিনপথে গঙ্গা প্রবাহিত হয়েছেন । তাই ত্রিপথমগা বলা হয়েছে । গঙ্গা শব্দের মূল আভিধানিক অর্থ গমন কারিণী । তিনি জ্যোতি সমূহে অনুগমন করেন সে নদী কোটি কোটি তারা সমাযুক্ত। । তাই সেখানে ছায়াপথ কে গঙ্গার সাথে তুলনা করা হয়েছে । 


      আবার জ্যোতিষ শাস্ত্রের মর্ম বাণী ক্ষেত্রে স্মরণাপন্ন হয়ে সেটাই বলি –    

  হিরন্ময়েন পাত্রেশ সত্যসপিহিতন্ম মুখম । 

     তৎ ত্বম পুষন্ন।প বৃণু সত্যধর্মায় দৃষ্টয়ে ।।
অর্থাৎ , হিরন্ময় পাত্রের দ্বারা সত্যের মুখ আচ্ছাদিত আছে । হে আদিত্য পুষন তুমি সত্য ধর্ম জানার জন্য সে আবরণ উন্মোচন কর ।জ্যোতিষ মানে জ্যোতি:  যিনি সে আবরণ উন্মোচন করতে সমর্থ হবে তার কাছে জ্যোতিষের জ্যোতি তার কাছেই প্রতিভাত হবে । 


 সৌর মন্ডলের প্রধান গ্রহ সূর্য । বেদে সূর্যকে নিন্ম রূপে বর্ণনা করেছে এই ভাবে – 

তরনির্বিশ্বদর্শতো জ্যোতিষ্কদসী সূর্য বিশ্বমাভাসি রোচনম । 


অর্থাৎ যিনি ত্রান করেন বিশ্বাদর্শন করান ।জ্যোতিষ্কের স্রষ্টা সূর্য বিশ্ব কে আভাষিত করে। 
এই ভাবে সুর্যের শ্রেষ্ঠত্ব কে প্রতিপন্ন করা হয়েছে ।

 
   পরবর্তী কালে , আর্যভট্ট তার সূর্য সিদ্ধান্ত গ্রন্থে  গ্রহের গতিপথ বর্ণনা সম্পর্কে লিখেছেন যে –   ” সূর্যামুক্তা উদিয়ন্ত্রে শীঘ্রশচরকে দ্বিতীয়গা ।   

  সমাসতৃতীয়গে  জ্ঞেয়া মন্দা ভানো চতুর্থগে।।     

বকরা:স্যু পঞ্চ ষষ্টহরকে অতি বক্র নগাস্টকে।       

       নবমে দশমে ভানো জায়তে কুটিল গতি ।।     

দ্বাদশ একাদশে সূর্যে ভজনতে শীগ্রতা পুনঃ ।”


 সে শ্লোক টির সরালার্থ নিন্মরূপে –  সূর্য যে রাশির যত অংশে থাকে সেই রাশির তত অংশে হতে নিস্ক্রান্ত হলে দুই রাশি পর্যন্ত সূর্য মুক্তা গ্রহাশীঘ্রগামী হয় । সূর্য হতে তৃতীয় রাশিতে চলার সময় গ্রহ সমগামী হয় । চতুর্থ রাশিতে মন্দ্গামী । পঞ্চম ও ষষ্ঠম রাশিতে চলার সময় বক্রগামী হয় । সপ্তম অষ্টম রাশিতে অতিবক্র গামী হয় নবম দশম রাশিতে সঞ্চার কালে সরল গতি প্রাপ্ত হয় । একাদশ ও দ্বাদশ রাশিতে পুনঃ শীঘ্র গতি প্রাপ্ত হয়।।                                              

প্রাচীন ভারতে অরণ্যবাসী , গুহাবাসী মুনি ঋষি এবং রাজ্য শাসনকারী রাজা ছাড়াও  আরণ্যক , পাহাড়ি , মরুবাসী ,সুদূর দ্বীপবাসী নানা উপজাতি গোষ্ঠীর বাস ছিল। তাঁরাও কিন্তু তাঁদের মতো করে জ্যোতিষ চর্চা করতেন। তাঁদের নিজ চর্চিত জ্যোতির্বিদ্যা অনুশীলনে দিন , মাস , বৎসর গণনা হত। । হয়ত তার সঙ্গে শিল্প , কল্প, ব্যাকরণের কোনো ছন্দ ছিল না। আকাশের তারাদের নিয়ে তাঁদেরই মুখে ছড়িয়ে পড়ত কত শত গল্প গাঁথা। 

সেই সুপ্রাচীন জম্বুদ্বীপ বা আর্যাবর্ত বা ভারতবর্ষে সূর্য এবং চন্দ্র কে কেন্দ্র করে কেবল দিন, রাত, তিথি, ক্ষনের বিচারই হত না। বরং তাঁদের কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল নানা আচার। পরে সেইসব আচার ব্যবস্থাই লোকাচার নামে খ্যাত হয়েছে। 

মহাভারতের ইচ্ছামৃত্যুর অধিকারী গঙ্গা পুত্র দেবব্রত ভীষ্ম শর শয্যায় শায়িত বলেছিলেন – 
 ” উত্তরায়ণের আরম্ভ পর্যন্ত আমি এই শয্যায় শুয়ে থাকবো।

সূর্য যখন উত্তর দিকে গিয়ে সর্বলোক প্ৰতপ্ত করবেন তখন আমার প্রিয় সুহৃৎ তুল্য প্রাণ ত্যাগ করব।

“প্রসঙ্গত জানিয়ে রাখি কুরুক্ষেত্রের মহাযুদ্ধ শেষ হলে-যুধিষ্ঠির রাজ্যলাভ করে অভিষিক্তহলেন। এই সময় কৃষ্ণেরপরামর্শে যুধিষ্ঠির শরশয্যায় শায়িতভীষ্মের কাছে আসেন।সেখানে কৃষ্ণের অনুরোধে ভীষ্মযুধিষ্ঠিরকে বিবিধ পরামর্শ দেন।শরশয্যায় মোট আটান্ন দিন থাকার পরভীষ্ম মাঘ মাসের শুক্ল পক্ষেরঅষ্টমী তিথিতে যোগযুক্তহয়ে ইচ্ছামৃত্যু গ্রহণ করেন। এই দিনেরস্মরণে আমরা ভীষ্ম-তর্পণকরে থাকি ।


পিতামহ ভীষ্ম যে অয়ন চলনের কথা বলেন ” বেদাঙ্গ জ্যোতিষ ” গ্রন্থেও সেই অয়নের কথা বলা আছে । “বেদাঙ্গ জ্যোতিষ ” রচনার কালেও মাঘ মাস থেকে যুগের গণনা শুরু হতো।

 মহর্ষি লগধ প্রণীত যে জ্যোতিষ গ্রন্থটি পাওয়া যায়, সেখানে ঋগ্বেদীয় পাঠে ছত্তিরিশটি এবং যজুর্বেদীয় পাঠে তেতাল্লিশটি সিদ্ধান্ত শ্লোক বর্তমান। কিন্তু টি এস কুপান্না শাস্ত্রী (১৯৮৪ ) মহাশয়ের অনুবাদ এবং মূল রচনায় আমরা দেখি যজুর্বেদাঙ্গ জ্যোতিষের তেতাল্লিশটি শ্লোকের মধ্যে তিরিশটি ঋগ্বেদীয় জ্যোতিষের সিদ্ধান্ত শ্লোকের অবিকল অনুলিপি মাত্র। 


তবুও  আকর  হিসাবে যে সকল শ্লোক পাওয়া যায় তার মধ্যে  ঋগ্বেদীয় জ্যোতিষের পঞ্চম এবং যজুর্বেদীয় জ্যোতিষের ষষ্ঠ শ্লোকের অর্থ :ধনিষ্ঠানক্ষত্রে চন্দ্রসূর্য অবস্থান করলে মাঘমাস, তপঃঋতু, শুক্লপক্ষে উত্তরায়ণ সূচনা এবং যুগের শুরু হয় ।
ঋগ্বেদীয় জ্যোতিষী ষষ্ঠ এবং যজুর্বেদ জ্যোতিষে  সপ্তম শ্লোকে বলা হয়েছেঃ ধনিষ্ঠা থেকে উত্তর দিকে এগিয়ে চন্দ্র সূর্য যখন অশ্লেষা নক্ষত্রে এক হবে তখন ঘটবে দক্ষিণায়ন এবং সেই মাসটি বলা বাহুল্য-  শ্রাবণ । সুতরাং, মহাভারতে পিতামহ ভীষ্ম যে কথাগুলি বলেন, বেদাঙ্গ জ্যোতিষ অয়ন সম্পর্কিত  তথ্য দিয়ে তার প্রমাণ রাখে।


 মাঘ মাসের যুগের সূচনা বা শুরু । এই কথাও ঋগ্বেদীয় জ্যোতিষ গ্রন্থে ঘোষিত হয়েছে পৃথকভাবে –
মাঘাশুক্লাপ্রাপান্নাসায়া পৌয়াকৃষ্ণাসমাপিনাঃ।যুগস্যা পঞ্চাবর্ষায়া কালজনানাম প্রকাশতে।।
অর্থাৎ পাঁচ বছরের একটি যুগের সূচনা হতো মাঘ মাসের শুক্লপক্ষে এবং এবং সমাপ্তি হতো পৌষ মাসের কৃষ্ণপক্ষে।  জৈন সাধু ভদ্রবাহু অনেক কাল পরে #সূর্যপ্রজ্ঞপ্তি রচনা করেছিলেন।সেই গ্রন্থেও পাঁচ বৎসরকে যুগের পরিবর্তে উল্লেখ করতে দেখা যায়।আসলে পাঁচ বৎসর যুগগণনার এক মাত্র কারণ, প্রতি পাঁচ বৎসর অন্তর কুম্ভরাশির অন্তর্গত ধনিষ্ঠা নক্ষত্রে চন্দ্র ও সূর্যের মিলন ঘটে। এই টুকুই পাঁচ বছরের যুগ গণনার ভিত্তি। 

 অপ্রাসঙ্গিক হলেও একটি কথা এ প্রসঙ্গে আসে : প্রাচীন ঋষিগণ আকাশে চন্দ্র ও সূর্যের অবস্থান পর্যবেক্ষণ করে খুঁজে পেয়েছিলেন , প্রতি পাঁচ বছর অন্তর , কুম্ভরাশির অন্তর্গত ধনিষ্ঠা নক্ষত্রে উভয়ের মিলন হয়। চন্দ্র সূর্যের এই মিলন বলা বাহুল্য যুগ গণনার মূল কারণ। প্রতি পাঁচ বছরে ফাল্গুন মাসের অমাবস্যার দিন এই মিলন ঘটে।
অবশ্য  ১২ বছরের যুগও আছে বা ছিল। এই যুগ বৃহস্পতির নামে চিহ্নিত। সূর্য যে রাশি চক্রকে এক বছরে অতিক্রম করে সেখানে বৃহস্পতি একেকটি রাশিকে অতিক্রম করতে এক বছর সময় নেয় । ১২ টি রাশি অতিক্রম করতে ১২ বছর লাগে। ১২ বছর পরে কুম্ভ রাশিতে বৃহস্পতি উপস্থিত হলে তখন হয়  #বার্হস্পত্য যুগ । সম্পূর্ণ হয় তখনই আমাদের দেশে কুম্ভ মেলা অনুষ্ঠিত হয় ।প্রতি ১২ বছর অন্তর এই মেলার অনুষ্ঠান ।


আবার রাশি গুলিকে পাঁচবার অতিক্রম করতে বৃহস্পতির সময় লাগে ৬০ বছর।  এজন্য ৬০ বছরে  বার্হস্পত্য  যুগের বিচার হয়ে থাকে। 
 আলবেরুনী সহজ ভাবে লিখেছিলেন :
 বৃহস্পতির সৌর দল থেকে আরম্ভ করে সূর্য এবং বৃহস্পতির আবর্তনের ভিত্তিতে বর্ষের  যে যুগাবর্ তাকেই বলা হয় #সংবৎসর । এক পূর্ণ আবর্তনের সময়কাল  ষাট বর্ষ বলে সংবৎসরকে বলা হয় #ষষ্টাব্দ । এই যুগাবর্তের সূচনা হয় মাঘ মাসের প্রথম দিকে বহিষ্ঠা কক্ষে বৃহস্পতির সূর্য থেকে। 
 পাঁচ বছরের সমন্বয়ে একটি যুগ। পাঁচটি বছরের কথা বলা হলেও#শুক্লযজুর্বেদ আমাদের জানায় চারিটি বৎসরের নাম। পরবর্তী কালে রচিত শতপথ ব্রাহ্মণ গ্রন্থে পাঁচটি বৎসরের নাম এরকম : সংবৎসর, পরিবৎসর, ইদাবৎসর, ইৎবৎসর, অনুবৎসর। 
যুগের সূচনা হত মাঘ মাস  থেকে সেই কথা মহর্ষি লগধ জানিয়েছেন। অনুরূপ শতপথ ব্রাহ্মণ গ্রন্থে আছে :
 This Agni is Pragapati , and Pragapati is the year : the fifth layer is his head and dewy season is it’s head.

Dewy season অর্থাৎ শিশির ঋতু। এই ঋতু যথাক্রমে  মাঘ ও ফাল্গুন মাস। বৈদিক নাম হল তপঃ ও তপস্য। এই মাস দুটি প্রজাপতি অর্থাৎ প্রভুর মস্তক । আমাদের উপলব্ধি করতে অসুবিধা হয় না , শিশির ঋতুর মাঘ মাস থেকে যেমন যুগের শুরু তেমনি বৎসরেরও সূচনা। 
বৈশ্বানর_পথ বা #রবিমার্গ বা বর্তমান জ্যোতির্বিজ্ঞানে  #ক্রান্তিবৃত্ত এবং তাকে প্রাচীনকাল থেকে ১২ ভাগে ভাগ করে রাশিচক্র সৃষ্টি একথা পূর্বেই বলেছি। তারজন্য  পাশ্চাত্য স্মারক পত্ৰ নেবার একেবারেই প্রয়োজন নেই। 


এবার বলি হার্টনার আকাশে যে সিংহ মহিষের যুদ্ধের কথা বলেছেন , সেখানে তিনি সিংহ ও বৃষ রাশির কথা বলেছেন। এখন কথা হল সিংহ রাশি কেন বৃষ রাশিকে আক্রমণ করছে ? 
ত্য়ৈব ধার্য্যতে সর্ব্বং ত্বয়ৈতৎ সৃজ্যতে জগৎ।

ত্বয়ৈতৎ পাল্যতে দেবি ! ত্বমৎস্যন্তে চ সর্বদা।।

 বিসৃষ্টৌ সৃষ্টিরূপা ত্বং স্থিতিরূপা চ পালনে।

তথা সংহৃতিরূপান্তে জগতেহস্য জগন্ময়।।

মহাবিদ্যা মহামায়া মহামেধা মহাস্মৃতি ।

মহামােহা চ ভবতী মহাদেবী মহাসুরী।। 
হে দেবি ! তােমাদ্বারা এই সমস্ত জগৎ সৃষ্ট হইতেছে, এবং পরিপুষ্ট হইতেছে, আবার তােমাদ্বারাই অনন্ত জগৎ রক্ষিত হইয়া প্রলয়কালে বিধ্বস্ত হইতেছে। অতএব হে জগন্ময়ে ! তুমিই সৃষ্টিকালে সৃজ্যবস্তুস্বরূপ, এবং সৃষ্টিক্রিয়া-রূপা, পালন এবং সংহার বিষয়েও তুমিই যথাক্রমে পাল্য,পালন, সংহাৰ্য্য ও সংহারস্বরূপা। তুমিই মহাদেবশক্তি,আবার অসুরগণ যে শক্তিপ্রভাবে বলীয়ান, সে শক্তিও তোমা হইতেই বিকাশিত হইয়াছে।

#ক্রমশঃ
©দুর্গেশনন্দিনী
তথ্যঃ  ১. আকাশের তারায় মহিষাসুরমর্দিনী     

২. লোকায়ত রাঢ় বঙ্গ     

     ৩. বিজ্ঞান চর্চায় প্রাচীন ভারত ও সমকালীন অন্যান্য দেশ       

   ৪. ঋগ্বেদ সংহিতা       

   ৫. শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা       

    ৬. বঙ্গাব্দ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.