বৃষসংহার – তৃতীয় পর্ব

তৃতীয় পর্ব

সূর্যের চারিদিকে পৃথিবীর বার্ষিক গতির জন্য আমাদের আকাশের তারাগুলির অবস্থান প্রতি রাতে বদলায়। কোনো স্থানীয় সময়ে রাত্রি নটায় কোনো বিশেষ নক্ষত্রকে অস্ত যেতে দেখা যায়। তবে পরেরদিন তাকে রাত ৮ টা ৫৬ মিনিটে অস্ত যেতে দেখা যাবে। পনেরদিন পর নক্ষত্রটি রাত্রি আটটা সময় এবং এক মাস পর সন্ধে সাতটার সময় অস্ত যাবে। এভাবে চব্বিশ ঘন্টা ঘুরে এক বৎসর পর আবার একই সময় তাকে অস্ত যেতে দেখা যাবে।


এবারে বৎসরের দিনটির কথা ভাবা যাক যেদিন বৃষ তারামন্ডলীকে অন্তিম বারের নিমিত্ত সূর্যাস্তের পরেপরেই আকাশের পশ্চিমে দিগন্তে দেখা যায়।  শেষবারের মতো , কারণ এর পরের দিন এই তারামন্ডলী আরো কিছু আগে অস্ত যাবে ।অর্থাৎ , তখনো আকাশে সূর্য থাকবে। তাই আর এই বৃষ মন্ডলী দেখা যাবে না। অর্থাৎ , বৃষ রাশি তারকামন্ডলীর সেই অর্থে মৃত্যু ঘটবে। 


বৃষ তারামন্ডলী সন্ধ্যাকাশে  অন্তিমবারের মতো অস্ত যাবার মুহূর্তে যদি কেউ মাথার উপরে তাকান তাহলে সেখানে দেখতে পাবেন সিংহ তারামন্ডলীকে। এমনও মনে হতে পারে যে , এই সিংহটি বৃষকে যুদ্ধে হারিয়ে দিয়েছে। সিংহ তারামন্ডলী মাথার উপরে , যেন সে তার শক্তি মত্ততার তুঙ্গে এবং সে দিগন্তে পলায়মান মহিষের পিছু নিয়েছে। অর্থাৎ, সিংহের বৃষ সংহার ঘটছে এই ব্রহ্মান্ডে।  


কিন্তু আকাশে তো মেষ, কর্কট, মীন ইত্যাদি অনেক তারামন্ডলী রয়েছে। তারাও প্রত্যেকে একটা সময়ের পর সূর্যের পথে অস্ত যাবে । তবে কেন কেবল বৃষ সংহার ? প্রায় ৪০০০ হতে ৩০০০ খ্রিস্টপূর্ব্বাব্দ বা তারও আগে এই বৃষ তারামন্ডলীর মৃত্যু  হতো বছরের একটি বিশেষ সময়ে। এই ঘটনা সম্পন্ন হতো শীতের অন্তিমে, বসন্তের আগমনে শস্য বপনের সময়। সিংহের বৃষ সংহার শীতের রুক্ষতাকে দূর করে ধরায় শস্য সম্পদ লক্ষ্মীর আগমন এবং এক নব কৃষি বর্ষের সূচক স্বরূপ ছিল। 


মহাকালের নিয়মে ক্রমে পরবর্তী সময়ে এই বৃষ মৃত্যুর সময় ধীরে ধীরে বদলে যায়। কারণ পৃথিবীর আহ্নিক ও বার্ষিক গতি ব্যতীত যে গতি আছে , তারজন্য….যা আমরা উপলব্ধি করতে পারি না। 
আহ্নিক আর বার্ষিক গতিতে পৃথিবীর চলন সীমাবদ্ধ নয়। তার আরও একটি গতি আছে। পৃথিবীর অক্ষ নিজের কক্ষতলের নিজের কক্ষতলের উপর লম্ব নয়।তাই ২৫৮০০ বছরে লম্বের চারিদিকে একবার আবর্তন করে পৃথিবীর অক্ষ। পরিণামে , সূর্যের তুলনায় ক্রান্তিবৃত্ত ও বিষুবরেখা ছেদ বিন্দুও ২৫৮০০ বছরে একবার ৩৬০ ডিগ্রি আবর্তিত হয়। একেই অয়ন বা মেরুগতি বলে। সুদীর্ঘ বছর ধরে এই যে চলন , এখানে পৃথিবীর লক্ষ্যও অস্থির হতে বাধ্য হয়। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায় , আজকের পৃথিবীর চলন ধারা ধ্রুবতারার অভিমুখে । কিন্তু একটা সময়ের পর আর তা থাকবে না। 


এ প্রসঙ্গে কামিনীকুমার দে বলেছেন :
ড্রেকো মন্ডলের আলফা অর্থাৎ সর্বজ্জ্বল তারাটি প্রসিদ্ধ। শিশুমারের শেষ তারা এবং সপ্তর্ষির বশিষ্ঠের মাঝামাঝি স্থানে অবস্থিত এই তারাটি পাঁচ হাজার বৎসর পূর্বে আমাদের ধ্রুবতারা ছিল। তখন খ গোলকের মেরুবিন্দু ইহার কাছাকাছি ছিল এবং উত্তর আকাশে ইহাকে স্থির নিশ্চল মনে হইত । আকাশের তারাগুলি প্রত্যেকে ইহাকে কেন্দ্র করিয়া আকাশ পরিক্রমা করিত।মেরুবিন্দু ক্রমে  অতি ধীর গতিতে সরিয়া বর্তমানে শিশুমার মন্ডলের সর্বজ্জ্বল তারার কাছে আসিয়াছে এবং ইহা আমাদের বর্তমান ধ্রুবতারা ।(এখন হইতে ৫০০০ বছর পরে মেরুবিন্দু সিফিউস মন্ডলের উজ্জ্বলতম তারার কাছে যাইবে ; ১২০০০ বছর পরে উত্তর আকাশের উজ্জ্বলতম তারা অভিজিতের কাছে যাইবে এবং ইহারা যথাক্রমে ধ্রুবতারা রূপে গণ্য হইবে। )


কামিনীবাবুর বক্তব্য পড়ার পর মহামান্য তিলকের অনুমান সত্যতা সম্পর্কে সন্দেহ থাকে না। কিন্তু এর একটা প্রভাব পৃথিবীর উপর অতি দ্রুত অনুভূত হয়। নিসর্গের পরিবর্তন ঘটে যাবে আগামী ৪ -৫ হাজার বছরের মধ্যে।  তার কারণ ঋতুর পরিবর্তন ঘটবে। যে সময় বর্ষা আসার কথা সে সময় বর্ষা আসবে না ।কৃষিকাজের সময় যাবে কৃষি কাজের সময় যাবে বদলে। তাই কখনো মার্গশীর্ষ কখনো বা ফাল্গুনী পূর্ণিমা তে বছরের সূচনা হত, আবার হয়তো সেই একই ভাবে আবার অন্য কোন সময় বছরের সূচনা হবে। 


 আমাদের অনুমান প্রাচীন পণ্ডিতগণ অয়ন নিয়ে কোন আলোচনা স্পষ্ট না করলেও বিষয়টিকে যথেষ্টভাবে উপলব্ধি করেছিলেন। অনেক পরের শতকের মাঝামাঝি সময়ে একমাত্র দ্বিতীয় আর্যভট্ট #আর্যসিদ্ধান্ত গ্রন্থটিতে অয়নগতি  সংক্রান্ত ভাবনা ব্যক্ত করেছেন। 
উক্ত কারণেই আকাশের তারাগুলির অবস্থানও একটু একটু করে বদলায়। তাদের অস্ত বা উদয়ের সময়ও বদলে যায়। এই ভাবেই প্রায় ১০০০ খ্রিস্টাপূর্ব্বাব্দে এসে বৃষ তারামন্ডলী মৃত্যুর সময় মাসখানেক পিছিয়ে যায়। মোটামুটি এখন কার মার্চ মাসের শেষের দিকে। অর্থাৎ, যখন দিন রাত্রির দৈর্ঘ্য এক সমান হয়। এটিও বৎসরের একটি বিশেষ সময়। 


ভারতবর্ষে রাশির উপর প্রথম গুরুত্ব দেন #কুসুমপুরনিবাসী এক পন্ডিত। তাঁর নাম আর্যভট্ট । তাঁকে বলা হত #কুসুমপুরের_মহাজ্যোতিষী।  তাঁর মৌলিক সিদ্ধান্তমূলক #আর্যভট্টীয় গ্রন্থটির চারটি অধ্যায় যথা –  দশগীতিকা , গণিতপাদ, কালক্রিয়া ও গোলোক। তিথি বা নক্ষত্র নয় ,  দশগীতিকার প্রারম্ভে যুগের সূচনা ঘোষণা করেছেন রাশির মাধ্যমে। সেখানে মেষ রাশিকে সূচক হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। 
Starting at the beginning of Mesa at sunrise on Wednesday at Lanka.
 কিন্তু কেন মেষ রাশিকে সূচক হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে ? তার কারণ ব্যাখ্যা করেছেন তিনি গোলক অধ্যায়ের  ২৫ সংখ্যক সিদ্ধান্তে। 
Multiply the day – radius of the circle of greatest declination ( 24 degrees) by the sine of the desired sign of the zodiac and divide by the radius of the day – circle of the desired sign of the zodiac . The result will be the equivalent in right ascension of the zodiac. The result will be the Equivalent in right ascension of the desired sign beginning with Mesa.


” আর্যভট্টীয় অব  আর্যভট্ট ” গ্রন্থে এই সিদ্ধান্ত শ্লোকের বিস্তৃত বিশ্লেষণ রেখেছেন কৃপাশঙ্কর শুক্লা।  অতিরিক্ত হবে ভেবেও, আযভট্ট গ্রহণ করেন দ্বিগুন কোণের অর্ধ জ্যা। সেখানে গ্রিসীয় পন্ডিতগণ সাইনের মান হিসেবে কেবল কোণের জ্যা বুঝতেন। আর্যভট্টের অর্ধ জ্যা ভারতীয় জ্যোতির্বিজ্ঞানে জ্যা রূপে গৃহীত হয় ।
এছাড়াও তিনি গোলক অধ্যায়ের ১  সংখ্যক সিদ্ধান্ত শ্লোকে  বৈশম্পায়ন পথ বা রবি মার্গকে অবলম্বন করে উল্লেখ করেন দ্বাদশ রাশির অবস্থান । মেষ থেকে শুরু করে কন্যা রাশি পর্যন্ত রবিমার্গের উত্তরদিক আর সপ্তম রাশি তুলা থেকে শুরু করে মীন পর্যন্ত রবিপথের দক্ষিণ দিক অর্থাৎ অপরার্ধ।

মেষ রাশিতে সূর্যের প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গেই যুগের সূচনা –  একথা পরবর্তীকালে বরাহমিহির স্বীকার করেছেন  তাঁর #পঞ্চসিদ্ধান্তিকা গ্রন্থে। কিন্তু  #চলাপৃথ্বীস্থিরাভিমি  অর্থাৎ সূর্যস্থির , পৃথিবী সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে চলেছে কিংবা চাঁদ পৃথিবীর চারিদিকে পরিভ্রমন করছে , সূর্যের আলোয় চন্দ্র আলোকিত ইত্যাদি মতবাদ সমসাময়িক ও পরবর্তীকালে নানা বিজ্ঞানী যেমন  লল্ল , ব্রহ্মগুপ্ত  , ভাস্করাচার্য কেউই সমর্থন করেনি। 
 সেই সময়ের  ট্র্যাজিক হিরো কুসুমপুরের আর্যভট্ট  গ্রীক  পণ্ডিতগণের অনুশীলনে আবার তিনি আবিষ্কৃত হলেন কয়েক শতক পেরিয়ে ।

আযভট্টের সামান্য পরেই বরাহমিহির। সেই সময় ভারতবর্ষের প্রচলিত জ্যোতিষ বিষয়ক মতবাদ হল পাঁচটি  – সূর্যসিদ্ধান্ত, রোমক সিদ্ধান্ত, পৌলিশ সিদ্ধান্ত ,  পৈতামহসিদ্ধান্ত , বশিষ্ঠ সিদ্ধান্ত নিয়ে আলোচনা করেন বরাহমিহির তাঁর পঞ্চসিদ্ধান্তিকা গ্রন্থে। এই গ্রন্থ সূর্যসিদ্ধান্ত কে শ্রেষ্ঠত্বের সম্মান প্রদান করেন । রাশি প্রসঙ্গে আলোচনা করতে পঞ্চসিদ্ধান্তিকা ত্রয়োদশ অধ্যায় নবম সিদ্ধান্ত শ্লোকে জানান –

For the gods the rising sun , when at the first point of Aries, revolvs to the right , moving in the horizon ; at Lanka he then revolvs right overhead; and in an opposite direction for the Asura.
ভারতীয় জ্যোতির্বিজ্ঞানী মেষ রাশির ” প্রথম সূচনা বিন্দু”  সম্পর্কে সুস্পষ্ট কোনো উল্লেখ নেই । অরূপরতন ভট্টাচার্য মনে করেন” মেষের আদি বিন্দু ”  বোঝাতে বাসন্ত বিষুববন কে গ্রহণ করা হয়েছিল। তবে একথা ঠিক যে,  বরাহমিহির আর্যভট্ট কে অনুসরণ করেই মেষ রাশি নক্ষত্র চক্রের প্রারম্ভ নির্দিষ্ট করেন। 


২৭ নক্ষত্র কে নিয়ে মাসগুলি গড়ে উঠেছে।  কিন্তু চান্দ্রবর্ষের সঙ্গে সৌরবর্ষের কোন মিল নেই । উভয়ের পার্থক্য প্রায় ১১ দিনের মতো । অথচ সূর্যই ঋতুগুলির  নিয়ন্ত্রক। তাই কৃষির কারণে জনসাধারণের অধিক প্রয়োজন ছিল সৌরকেন্দ্রিক মাস এবং  বর্ষগণনা ।
এক একটি রাশি পেরিয়ে যেতে সূর্যের যে সময় লাগে, সেই সময়ের মধ্যে গড়ে ওঠার সৌর মাস। এই সৌরমাসগুলির অন্যতম হল মধু মাস অর্থাৎ চৈত্র মাস। চৈত্রমাসেই বৎসরের প্রারম্ভ হত একসময়। তারও পূর্বে ছিল ভগবান শ্রীকৃষ্ণের উক্তি অনুযায়ী অগ্রহায়ণ মাস। তখন মৃগশিরা নক্ষত্র ছিল নক্ষত্রচক্রের প্রথম নক্ষত্র।


সম্ভবত অয়নের কারণে বেদাঙ্গ জ্যোতিষ রচনা কালে ধনিষ্ঠা নক্ষত্রের অমাবস্যা থেকে বর্ষ সূচিত হয়েছিল। সূর্যসিদ্ধান্তও এই মত সমর্থন করে। ঋতুগুলি সেখানে এভাবে আসে –  শিশির বসন্ত গ্রীষ্ম বর্ষা শরৎ হেমন্ত। ধনিষ্ঠা অমাবস্যায় বছরের প্রারম্ভ ঘটলে কৃত্তিকা নক্ষত্রে বাসন্ত বিষুবন ঘটবে। তৈত্তিরীয় সংহিতায় এইজন্যই কৃত্তিকা নক্ষত্রকে আদি নক্ষত্ররূপে চিহ্নিত করা হয়েছে।


এই বৈদিক নক্ষত্র চক্রের পরিবর্তন করেন বরাহমিহির। তিনি আদি নক্ষত্র রূপে চিহ্নিত করেন অশ্বিনী এবং শেষতম নক্ষত্র রেবতী । রাশিচক্রে মেষ এবং অশ্বিনী একই বিন্দুতে অবস্থানকারী । আর্যভট্ট এই মেষরাশি থেকে থেকে বর্ষ গণনা শুরু করেছিলেন । বরাহমিহির তাকে আরও বিস্তৃত করলেন। কেননা অয়ন চলন এর কারণে নৈসর্গিক পরিবর্তন পৃথিবীতে তখন দৃশ্যমান । বলাবাহুল্য , বরাহমিহিরের কথা বা ঘোষণা সবাই মেনে নিয়েছিলেন। কারণ , তিনি ভারতবর্ষের কোন গ্রাম কুসুমপুরের নয় রাজধানী অবন্তি অর্থাৎ উজ্জয়নী নগরের পণ্ডিত ছিলেন। তিনি রাজধানী থেকে বলেছিলেন । তিনি সম্রাটের একান্ত নিজস্ব লোক ছিলেন এবং অবশ্যই তিনি বলার পর নতুন করে গণনা শুরু হলো। যেহেতু অয়নের জন্য ঋতু পরিবর্তন ঘটে গেছে – তাই মধু বা চৈত্র নয় , মাধব অর্থাৎ মেষ রাশির বৈশাখ মাস থেকে বর্ষ গণনা শুরু হলো।  ভারতবর্ষে প্রামাণ্য হিসেবে বরাহমিহিরের কল্যাণে ঘটল প্রথম পঞ্জিকা সংশোধন ।
মধু ও মাধব অর্থাৎ চৈত্র ও বৈশাখ মাসে বৈদিক মানুষেরা অনুভব করেছিলেন না শীত না উষ্ণ আবহাওয়,  কুসুমাকর প্রকৃতি । কিন্তু বরাহমিহিরের কালে মাধব অর্থাৎ বৈশাখ মাসে ছিলনা বসন্ত সমীরণ ।ছিল চারিপাশের দারুন অগ্নি বাণ। তার অনেক পরে বর্ষা  আসত আষাঢ়ে। 


সেই যে কালীদাসের মেঘদূত কবিতায় বলা হয়েছে – আষাঢ়স্য প্রথম দিবসে মেঘমাশ্লিষ্ট সানুং ….
প্রাচীন নিয়ম অনুসারে জ্যৈষ্ঠ মাসের  ১২ তারিখ থেকে ধানের জমিতে বীজ বপন করা হয় । প্রবাদ আছে : ” জ্যৈষ্ঠের বার যত গুনতে পার।” বীজ বপনের পূর্বে দুবার কেদার বা জমি কর্ষণ করা ছিল বাধ্যতামূলক । তা ঘটত বৈশাখে।  চড়া রৌদ্র না পেলে জমির আগাছা নষ্ট হবেনা। জমির মাটি ঝুরঝুরে হবেনা।
 ঝুরঝুরে মাটিতে বীজ বোনা হবে।  মাটির ভিতরে গরমে থাকা বীজ গুলি  দু-এক সপ্তাহের মধ্যে অঙ্কুরিত হয়ে উঠে বিক্ষিপ্ত হালকা বৃষ্টিতে । হয়তো এই কৃষি সূচনার কথা চিন্তা করে পঞ্জিকা সংশোধন করেছিলেন বরাহমিহির ।  
বরাহমিহিরের বৃহৎসংহিতায় কৃষি এবং আবহাওয়া সম্পর্কে বিশদ বর্ণনা করা হয়েছে। চাষের জন্য দুটি ঋতুর নাম উল্লেখ করা হয়েছে তাহলো , গ্রীষ্ম ও শরৎ। বসন্তেও  ছোট খাটো চাষ কোথাও কোথাও হত।  তিনি নানা ধরনের ধান ও শস্যের কথা উল্লেখ করেছিলেন।ঘটনার কথা উল্লেখ করেছেন।  এক্ষেত্রে তাঁর পঞ্চসিদ্ধান্তিকা গ্রন্থের প্রভাব ছিল সুদূরপ্রসারী।


তাছাড়াও , মধ্য প্রাচ্যে সেই একই হিসাবে ১০০০ খ্রিস্টাপূর্ব্বাব্দে রাজনৈতিকভাবে পটপরিবর্তন ঘটে। ওই অঞ্চলে এই সময়কে নতুন বছর বলে মেনে নেন। তাই সুমারীয় বা সনাতনী বৃষ সংহার মূর্তি পারস্যেও বজায় রইল। তাই ৫০০ খ্রিস্টপূর্ব্বাব্দে বানানো পার্সিপোলিসের প্রাসাদে সিংহের বৃষ সংহারের চিত্র নানাভাবে চিত্রিত হয়েছে। পারস্যের অধীন টার্সুস শহরে এই ছবি আঁকা মুদ্রা প্রাপ্তি ঘটেছে। 
এই তো গেল সিংহ বৃষ যুদ্ধ। কিন্তু সিংহবাহিনী , যিনি তিন কল্পে মহিষাসুর বধ করেন তিনি ? হ্যাঁ তিনিও থাকেন সিংহের সঙ্গে। 

মা দুর্গা… তথা সমগ্র জগতের নিকট মাতৃস্বরূপা। আবার তিনি মায়ের নিকট কন্যা স্বরূপা।তিনি কখনো সিংহবাহিনী , কখনো তিনি ব্যাঘ্রবাহিনী জগদম্বা শেরাবালী, কখনো তিনি মহাবিদ্যা শারদা , কখনো তিনি শস্যশ্যামলা শাকম্ভরি মহালক্ষ্মী। আশ্বিনের চারিটি দিবস জুড়ে আনন্দময়ী তাই আসেন এই ধরাধামে। মানবকুল তাঁর প্রাণ প্রিয় কন্যা , স্নেহময়ী মা কে নিয়ে হৃদয়ের উচ্ছাসে ভেসে যায়। সব অশুভ , সব দুঃখ , সব ব্যাথা সেই দেবীপক্ষে থমকে দাঁড়ায়।


সনাতনের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব হচ্ছে মহিষমর্দিনী শ্রীশ্রী দুর্গাদেবীর পূজানুষ্ঠান। ধর্মীয়, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক তথা নানাবিধ ক্রিয়াকর্ম এই পূজানুষ্ঠানে যুক্ত হয়ে এ অনুষ্ঠানকে দিয়েছে নতুন মাত্রা। ভাব-ভক্তি, ইষ্ট-নিষ্ঠা, ভক্তপ্রাণের মুখরতা আর সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের  দুর্গা পূজা আজ অতুলনীয় ধর্মানুষ্ঠানে পরিণত হয়েছে।


আচারে-অনুষ্ঠানে, আয়োজনে, অংশগ্রহণে, আকারে-আঙ্গিকে, আনন্দ-উৎসবে এ পূজা আজ ব্যক্তি ও পরিবারের সংকীর্ণ গন্ডী পেরিয়ে পেয়েছে সার্বজনীনরূপ। দুর্গামায়ের আগমনী ছন্দে ছন্দায়িত হয় ভক্তজনের তনুমন। মঙ্গলালোকে উচ্ছ্বসিত, সমুদ্ভাসিত ও উদ্বেলিত হয় শরণাগতের অন্তরাকাশ।দুর্গাপূজা মূলতঃ শক্তিপূজা। শুভশক্তি আবাহনার্থেই মহিষমর্দিনী দুর্গাময়ের পূজানুষ্ঠান।


অনন্তকোটি-ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টিকারিণী ব্ৰহ্মশক্তি দেবী মানবীকে নীলাম্বরে সুখাসীনা দেখলেন এবং তাঁরই শ্ৰীমুখ হতে তাঁর মহিমাবাণী শ্রবণ করলেন –
“অহং রাষ্ট্ৰী সংগমনী বসূনাং চিকিতুষী প্রথমা যজ্ঞিয়ানাং 

 ময়া সোহান্নমত্তি যো বিপশ্যতি যঃ প্রাণিতি য ঈং শৃণোত্যুক্তম্‌ ৷
অমন্তবো মাং ত উপক্ষীয়ন্তি শ্রুধি শ্রুত শ্রদ্ধিবং তে বদামি ৷৷   

যং যং কাময়ে তং তমুগ্ৰং কৃণোমিতং ব্ৰহ্মাণং তমৃষিম্‌ তং সুমেধাম্‌ ৷” 


একজন দেবী ,সিংহ ও মহিষ, মানুষের সংস্কৃতির ইতিহাসে এই symbol টার বয়স কত জানেন? ৯৫০০ বছর… আজ্ঞে হ্যাঁ, একটাও শূন্য বেশী দেখেন নি… সাড়ে নহাজারই লেখা ওটা… সবচেয়ে পুরনো এমন সিম্বল পাওয়া গেছে চাতালহয়ুক এ …

সমগ্র বিশ্বে দেবী মাতৃ রূপে পূজিতা হতেন । তিনি মধ্যপ্রাচ্যে ইনানা , ইশতার নামে পূজিতা হতেন আজ থেকে চার হাজার বৎসর পূর্বে। তিনি সেখানেও সিংহবাহিনীই ছিলেন। তিনি ছিলেন – প্রেম, সৌন্দর্য, প্রজনন, যুদ্ধ, ন্যায়বিচার ও রাজনৈতিক ক্ষমতার দেবী।মিশরে সিংহ দেবী মেনহিট উপাসিত হতেন। তিনি ছিলেন যুদ্ধ এবং সূর্যের দেবী। মিশরীয় পুরাণ অনুসারে সেই দেবী ছিলেন রুদ্ররূপী। শত্রুনাশিনী হিসাবে তিনি উপাসিতা হতেন। তাঁর অপর নাম ছিল শেখমেট। রাজকুলে তিনি উপাসিতা হতেন কুলদেবী রূপে। বলা হয় ইনি সূর্য দেব রা এর কন্যা ও চক্ষু স্বরূপ ছিলেন। 

মেসোপটেমিয়া সভ্যতা থেকে মহেঞ্জদারো হরপ্পা সুপ্রাচীন ভারতবর্ষ , চীন থেকে  জাপান মহামাতৃকার আরাধনা করা হত সেই সুপ্রাচীন কাল হতে মহামাতৃকা দেবীর আরাধনা করা হত ইতিহাস পূর্ব কাল হতে। সেই সুপ্রাচীন কাল থেকেই তিনি বহুরূপে ব্যাপ্ত।  কখনো তিনি সিংহবাহিনী সিবিলি, কখনো তিনি যুদ্ধের দেবী সিংহ বাহিনী ইস্তার , কখনো তিনি ব্যাঘ্র বাহিনী সৈন্ধ্বব দেবী। কখনো তিনি গ্রিক শস্যের দেবী দিমিতার। কখনো তিনি জাপানে জুনতেই ক্যানন (Juntei Kannon)” ১৮ হাতের দুর্গা ।মহাযান পরিব্রাজকদের হাত ধরে দেবীর এই রূপ জাপানে পৌঁছায় ৭০০ শতাব্দীর কাছাকাছি।ভারতের দ্রাবিড় সভ্যতায় মাতৃ-তান্ত্রিক দ্রাবিড় জাতির মধ্যে মাতৃদেবীর পূজার প্রচলন ছিল। কুশান রাজা কনিস্কের মুদ্রাতেও খোঁজ পাওয়া যায় সিংহবাহিনী দেবী নানা-র। তুর্কমেনিস্তান ও আফগানিস্তানে প্রচলিত ছিল এই দেবীর মাহাত্ম্য। তিনি ত্রিশক্তি দেবী রূপে পূজিতা হতেন প্যাগান আরবে লাত, উজ্জা , মানাত।

অর্থাৎ , সেই সুপ্রাচীন হতে আরো প্রাচীন কালে পূজিতা দেবী বৃহত্তর ভারতেও পূজিতা হতেন নানা রূপে নানা নামে। আজি হতে প্রায় পাঁচ হাজার বৎসরেও পূর্বে বেদ যখন শ্রুতি ছিল কেবল তখন সেখানেই পরমা আদ্যাশক্তির উল্লেখ করা হয়েছে। বেদের শক্তিরূপা আদি পরাশক্তি, দিতি, অদিতি , ঊষা , সরস্বতী , ইলা , ভারতী, ইন্দ্রাণী, সীতা, সরমা, যমী প্রমুখের নাম উল্লেখ আছে। সুতরাং মাতৃ উপাসনা বাহির হতে জম্বুদ্বীপে আনতে হয় নি। বরং মাতা নিজেই সর্বব্যাপী। 

ক্রমশঃ

©দুর্গেশনন্দিনী
তথ্যঃ  ১. আকাশের তারায় মহিষাসুরমর্দিনী   

       ২. লোকায়ত রাঢ় বঙ্গ       

   ৩. বিজ্ঞান চর্চায় প্রাচীন ভারত ও সমকালীন অন্যান্য দেশ   

       ৪. ঋগ্বেদ সংহিতা       

   ৫. শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা       

    ৬. বঙ্গাব্দ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.