চতুর্থ পর্ব
বৃষ তারামন্ডলী সিংহ তারামন্ডলীর সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে চলে আসে ঠিক মাথার উপর , তখন যদি আকাশের দিকে তাকাই , তাহলে তবে দেখব সিংহের পাশে রয়েছেন এক নারী । হ্যাঁ , কন্যা রাশি বা তারামন্ডলী। যাকে পশ্চিমে বলে Virgo। এই নারীর নিকট থাকে আরো কিছু চমক প্রদ তারকামন্ডলী। যেমন – বুটিস – আকৃতি গদার ন্যায়, করোনা বোরিয়ালিস – আকৃতি চক্রের ন্যায়। অন্যদিকে রয়েছে সর্পাকৃতি হাইড্রা। আরও ভালো করে দেখলে দেখতে পাবেন বৃষের নিকট অবস্থান করে কালপুরুষ।
মহর্ষি লগধ প্রণোদিত বেদান্ত জ্যোতিষ , শতপথ ব্রাহ্মণ, সূর্যসিদ্ধান্ত রচনার বহু পূর্বে গড়ে উঠেছিল বেদ। সেই বৈদিক ঋষিগনও সকল কিছু গণনা করে ছয়টি ঋতু র সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিলেন।
#কৃষ্ণযজুর্বেদসংহিতার চতুর্থ কান্ড , চতুর্থ প্রপাঠকের একটি মন্ত্রে যজমানের উৎকর্ষের জন্য ঋতু ও মাসগুলিকে আহ্বান জানান যাজক :মধুশ্চ মাধবশ্চ বাসন্তিকাবৃতু শুক্রশ্চ শুচিশ্চ গ্ৰৈষ্মাবৃতুনভশ্চ নভস্যশ্চ বার্ষিকাবৃতু ইষশ্চজ্জর্শ্চ শারদাবৃতু সহশ্চ সহস্যশ্চ হৈমন্তিকাবৃতু তপশ্চ তপস্যশ্চ শৈশিরাবৃতু….
বিজনবিহারী গোস্বামী এর ব্যাখ্যায় বলেছেন :
মধু মাধব চৈত্র ও বৈশাখ বসন্ত ঋতু । শুক্র শুচি জ্যেষ্ঠ আষাঢ় গ্রীষ্ম ঋতু , নভঃ নভশ্চ শ্রাবণ ও ভাদ্র বর্ষা ঋতু , ইষঃ ঊর্য আশ্বিন এবং কার্তিক শারদ ঋতু , সহঃ সহস্য অগ্রহায়ণ ও পৌষ হেমন্ত ঋতু, তপঃ তপস্য মাঘ ফাল্গুন শিশির ঋতু।
কেবল মাত্র কৃষ্ণযজুর্বেদ নয়, গোটা বৈদিক সাহিত্য মধু ও মাধব অর্থাৎ চৈত্র বৈশাখ মাসের জয়গানে মুখরিত।
বেদে এমন মন্ত্রও পাওয়া যায় যেখানে ছয় ঋতুকে একটি পক্ষীর সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে।
প্রজাপতিরগ্নিমচিনুতর্ত্তুভিঃ সমবৎসরং বসন্তনৈবোস্য পূর্ব্বা চিনুতগ্রীষ্মেণ দক্ষিণং পক্ষং বর্ষাভিঃ পুচ্ছং শরদোত্তরং পক্ষং হেমন্তন মধ্যং
অর্থাৎ, ঋতুর দ্বারা যেমন বৎসর হয় , সেরূপ প্রজাপতি ঋতুর দ্বারা অগ্নি চয়ন করেছিলেন । ঋতুময় এ যজ্ঞ এ সংকল্প হচ্ছে চয়ন। বসন্ত ঋতু এর শিরোভাগ, গ্রীষ্ম দক্ষিণ পক্ষ , বর্ষা পুচ্ছ ও হেমন্ত মধ্যদেশ।
এখানে পাঁচটি ঋতুর কথা বলা হলেও বসন্ত ঋতুকে স্থাপন করা হয়েছে শিরোদেশ হিসাবে।যেমন – শতপথ ব্রাহ্মনে শিশির ঋতুকে কল্পনা করা হয়েছে প্রজাপতির মস্তক হিসাবে।
শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার গীতার একটি শ্লোক :
বৃহৎ সাম তথা সাম্নাং গায়ত্রীছন্দসামহম। মাসানাং মার্গশীর্ষোহহম্তুনাংকুসুমাকরঃ ।।
অর্থঃআমি সামবেদের মধ্যে বৃহৎ সাম,সমস্ত ছন্দের মধ্যে গায়ত্রী,মাস সমুহের মধ্যে অগ্রাহায়ন,এবং ঋতুদের মধ্যে পুষ্প সমরোহময় বসন্ত।
রাজশেখর বসু মহাশয়ের মতে এই মার্গশীর্ষ হল মাঘ মাস। কিন্তু ম্যাকসমুলার সম্পাদিত ‘স্যাক্রেড বুক অফ ইস্ট ” নামক গ্রন্থমালায় গীতা অনুবাদক কাশীনাথ ত্র্যম্বক তেলঙ্গ একটি টীকায় মার্গশীর্ষ বলতে বোঝাতে চেয়েছেন :
Margasirsha is November – December . Madhusudana says this is best month , as being neither too hot nor too cold.
আমরা বুঝতে পারি নভেম্বর ডিসেম্বর অর্থাৎ অগ্রহায়ণ মাস। এক্ষেত্রে তেলঙ্গ ছান্দোগ্য উপনিষদের প্রসঙ্গকে উল্লেখ করেছেন।
যাই হোক , বৈষ্ণব সম্প্রদায় মার্গশীর্ষ অর্থাৎ অঘ্রহায়ন মাস থেকে বর্ষ গণনা করে আসছেন আজও। আসলে মৃগশিরা একটি নক্ষত্র । সেই নক্ষত্রের নামানুসারে মার্গশীর্ষ অর্থাৎ অগ্রহায়ন।মার্গ অর্থাৎ পথ । সেই পথের সবোর্চ্চ শীর্ষে অবস্থান করে মার্গশীর্ষ। অগ্রহায়ণ অর্থাৎ অগ্রে বা আগে। তার সঙ্গে হায়ন অর্থাৎ বৎসর। বৎসরের আগে অবস্থিত প্রথম মাস।
ঐতরেয় ব্রাহ্মণে উল্লেখ্য একটি কাহিনী বলি :
রোহিনীর রূপে প্রজাপতি আসক্ত হয়ে তাঁকে অনুসরণ করলেন। রোহিনী তখন হরিণীর ছদ্মবেশ ধারন করে বনের মধ্যে অন্তর্ধান করলেন। এই অনাচার ও পদস্খলন দেখে দেব্যাগন এক ভূতবান পুরুষ সৃষ্টি করে প্রজাপতিকে হত্যার আদেশ দিলেন। সেই ভূতবান প্রজাপতিকে তীর বিদ্ধ করলে প্রজাপতি আকাশের বুকে মৃগশিরা নক্ষত্র হয়ে রইলেন। সেই হরিণী রূপী রোহিনী তাঁর পাশে স্থান পেলেন। এত সেই ভূতবান হলেন #কালপুরুষ।
উক্ত কাহিনী থেকে মহামান্য তিলক মনে করেন , যীশুর জন্মের প্রায় পাঁচ হাজার বছর আগে বিষুবন মৃগশিরা নক্ষত্রে ছিল। পরবর্তী সময়ে সেটি সরে যায় রোহিনী নক্ষত্রের দিকে । সেই কারণেই হয়ত মার্গশীর্ষ থেকে পরে বা ভারতের অধিকাংশ স্থানে বৎসর গণনা হয় নি।
এই প্রসঙ্গে অতিরিক্ত কিছু কৌতূহল আমাদের মনে দানা বাঁধে । ঋক্ এবং যজুর্বেদ একই ভাষার স্তরও কালের অন্তর্ভুক্ত । প্রাচ্যবিদ্যা – বিশারদ পন্ডিত সমাজ ব্যাকরণগত প্রয়োগ ও পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করে প্রমাণ করেন , খ্রিস্টের জন্মের বহু বহু আগেই – প্রায় বারোশো থেকে হাজার বছর আগে এগুলি রচিত হয়েছিল।
এই সব গণনা রীতির একটি অন্যতম কারণ ছিল আবহাওয়া। উত্তর পশ্চিম ভারতে শীতের আধিক্য । তাঁরা শীত ঋতুকে প্রায় চার মাস ধরে ভোগ করতেন। অগ্রহায়ণ – পৌষ এবং মাঘ – ফাল্গুন দুটি শীতের মধ্যে কিছু পার্থক্য বর্তমান। তাই শিশির ঋতু হিসাবে চিহ্নিত হয় শেষ দুইটি মাস। আর কুসুমাকর বসন্ত ঋতু থেকে সূচিত হয় নতুন বৎসর। জরা গ্রস্থ ধূসর শীত থেকে মুক্তি মেলে।
গ্রিক পুরাণে এই কালপুরুষ ওরিয়ন নামে অভিহিত হয়। সেই গ্রিক পুরাণে এই ওরিয়নের জন্ম হয় একটি মৃত বৃষের চর্ম হতে। যদিও এর সঙ্গে মহিষাসুরের কোনো সম্পর্ক নেই। সুতরাং জোড়াতালি দিয়ে এসব মেলাতে চাইলে হবে না। মহামান্য তিলক ১৮৯৩ সালে তাঁর দ্য ওরিয়ন গ্রন্থে সে ব্যাখ্যা করেছেন।
মাইকেল স্পিডেল ১৯৮১ সালে মিথ্রজ ওরিয়ন গ্রন্থে এই তারামন্ডলীকে মিথ্র বলেছেন। সে সব তর্কে যাবার কোনো মানে হয় না। কারণ , উপরে এবং পূর্বে আমি তার ব্যাখ্যা করেছি।
উপরিক্ত তারকা মানচিত্রই দেবী দুর্গার এক নিদারুণ সত্যের মতো মহাজাগতিক প্রকাশ। আজ হতে বহু বহু হাজার বছর আছে বৃষ তারামন্ডলীর অবসান ঘটত বসন্ত কালে। তাই , আমরা কিন্তু বসন্তেও মায়ের আরাধনা করি।
এমন অতিজাগতিক ঘটনা বছরের আরো একটি সময় ঘটে। তবে সেটি সন্ধ্যাকাশে নয় । শেষরাত্রির আকাশে, প্রভাত হবার পূর্বে। হয় অকাল বোধন। আগে আমরা বৃষ তারকামন্ডলীকে শেষ বারের জন্য সূর্যাস্তের পূর্বে পশ্চিম আকাশে দেখতে পেয়েছি। বছরে আরও একটি দিন আসে ভোরের সূচনায় , রাত্রির আঁধার ঘোচার মুহূর্তে। বছরে ওই দিন সূর্যদোয়ের আগের মুহূর্তে হয় বৃষ সংহার। অর্থাৎ , একে শেষ বারের জন্য দেখা যাবে পশ্চিম দিগন্তে । এটি Acronychal setting নামে পরিচিত।
খ্রিস্টের জন্মের বহু বহু বহু শত কি হাজার বৎসর পূর্বেও এই দ্বিতীয় ঘটনা সূচিত হয় শরৎকালে। সুবিশাল ভারতে সেই সময় গুরুত্বপূর্ণ শস্য বপনের পালার সূচনা হতো, এখনো হয়। নানান ধরনের ধরনের ধানের মধ্যে শরতে বপন করা ধানের কদর অধিক গুরুত্বপূর্ণ ভাবা হতো। বসন্ত হতে শরতের মনোরম পরিবেশ উৎসব পালনে উপযুক্ত অনুমান করা হয়েছিল। যেহেতু সূর্য উদয়ের পূর্বে আকাশে সেই মহাজাগতিক ভাবে তারকামন্ডলীর সমাবেশে ব্রহ্মময়ী অশুভ নাশ করতেন তাই শরতেও দেবীর বোধন সম্ভব সেই ব্যাখায় উপনীত হয়েছিলেন প্রাচীন ঋষিগণ।
তবে, বর্তমানে পৃথিবীর অক্ষরেখার গতির পরিবর্তনের জন্য উক্ত মহাজাগতিক ঘটনা শরতে আর দেখা যায় না। দেখার জন শরতের শেষে হেমন্ত ঋতু পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়।
কালিকাপুরাণ মতে শ্রীহরি দেবীকে বহন করছেন। এই হরি শব্দের এক অর্থ সিংহ।
আবার শ্রীশ্রীচণ্ডীতে উল্লেখ আছে গিরিরাজ হিমালয় দেবীকে সিংহ দান করেন।
শিবপুরাণ বলে, ব্রহ্মা দুর্গাকে বাহনরূপে সিংহ দান করেছেন। উদ্দেশ্য ছিল শুম্ভ ও নিশুম্ভ বধের সুবিধা।
মায়ের সিংহের নাম সোমনন্দী । চন্ডীতে তিনি ধূটসট এবং মহাকেশরী নামে উল্লিখিত হয়েছেন।
এই সব গেল পুরাণকথা। এ ছাড়াও যুক্তিবাদী বাস্তব ধারণা থেকে যদি বাহনদের দেবদেবীর প্রতীক হিসাবে মনে করা যায়, তা হলেও দেখা যাবে দেবী দুর্গার সঙ্গে সিংহের স্বভাব প্রকৃতিগত অনেক মিল রয়েছে। সে ক্ষেত্রে সিংহকে দেবীর বাহ্য লক্ষণের সঙ্গে মিলিয়ে দেখলে বোঝা যাবে দেবীর বাহন রূপে সিংহ কেন?
দেবী নিখিল বিশ্বে সম্রাজ্ঞী। সিংহ পশু রাজ্যের সম্রাট। দেবী অস্ত্রধারিণী, সিংহও দন্ত-নখরধারী। দেবী জটাজুটযুক্ত, সিংহ কেশরযুক্ত। দেবী মহিষাসুরমর্দিনী, সিংহ মহিষের সঙ্গে যুদ্ধ বিজয়ী। সিংহের থাবায় এমন শক্তি যে এক থাবায় মহিষের খুলি মস্তক থেকে ছিন্ন হয়ে যেতে পারে। সিংহ একটি মহাবীর্যবান পশু। দেবী সর্বশক্তিধারিণী।
আবার আধ্যাত্বিকতার দিক থেকেও বিচার করা যেতে পারে। অসীম শক্তিশালী সিংহের কাছে আমাদের শিক্ষা নিতে হবে আত্মসর্মপণের। কারণ সে দেবীর পদতলে নিত্য শরনাগত। জীব মাত্রই পশু। পশু চায় পশুত্ব থেকে মুক্তি, চায় দেবত্বে উন্নীত হতে। তাই মাতৃচরণে আত্মসমর্পিত। সিংহ পশুশ্রেষ্ঠ হয়েও দেবশক্তির আধার হয়েছে শুধু দেবীর শরণাগতির প্রভাবেই।
অপর দিকে দেবীর লক্ষ্য লোককল্যাণ। সত্ত্বগুণময়ী মা রজোগুণোময়ী সিংহকে বাহন হিসাবে নিয়ন্ত্রণ করে লোকস্থিতি রক্ষা করছেন। রজোগুণের সঙ্গে তমোগুণের সমন্বয় ঘটলে লোককল্যাণ হয় না, হয় লোকসংহার। তাতে আসুরিকতা ও পাশবিকতার জয় হয়। এই পাশবিকতা ও আসুরিকতার সংহার করে, সমাজ কল্যাণকর কাজ করতে চাই রজোগুণাত্বক শক্তির সাধনা। তাই দেবী সত্ত্বগুণময়ী হয়ে রজোগুণাত্মক সিংহকে করেছেন বাহন, অর্থাৎ অনুগত আজ্ঞাবহ ভৃত্য।
মহামায়া ব্রহ্মময়ী মা দুর্গার মূর্তি, পূজা , নাম ইত্যাদির বহু ব্যাখা। নানা রূপে, নানাভাবে তিনি সদাই আমাদের জগৎকে তারণ করছেন। জগৎ বলতে কেবল তো মানুষ নয়, জগৎ বলতে এই পৃথিবীর বুকে জন্মানো প্রতিটি প্রাণ তাঁর সন্তান। তিনি এই ব্রহ্মান্ডের প্রতি কণায় বিরাজিতা। তিনি শক্তি। তিনি ব্রহ্মান্ডের যাবতীয় শক্তির উৎস এবং যাবতীয় শক্তিই তাঁর মধ্যে সমাহিত হয়েছে। শক্তি অর্থাৎ কর্ম। কর্ম ব্যতীত মহাকালের কালচক্র ঘুরবে কি করে ?
ত্বয়ৈব ধার্য্যতে সর্ব্বং ত্বয়ৈতৎ সৃজ্যতে জগৎ।
ত্বয়ৈতৎ পাল্যতে দেবি ! ত্বমৎস্যন্তে চ সর্বদা।।
বিসৃষ্টৌ সৃষ্টিরূপা ত্বং স্থিতিরূপা চ পালনে।
তথা সংহৃতিরূপান্তে জগতেহস্য জগন্ময়ে
মহাবিদ্যা মহামায়া মহামেধা মহাস্মৃতি
মহামােহা চ ভবতী মহাদেবী মহাসুরী।।
হে দেবি ! তােমাদ্বারা এই সমস্ত জগৎ সৃষ্ট হইতেছে, এবং পরিপুষ্ট হইতেছে, আবার তােমাদ্বারাই অনন্ত জগৎ রক্ষিত হইয়া প্রলয়কালে বিধ্বস্ত হইতেছে। অতএব হে জগন্ময়ে ! তুমিই সৃষ্টিকালে সৃজ্যবস্তুস্বরূপ, এবং সৃষ্টিক্রিয়া-রূপা, পালন এবং সংহার বিষয়েও তুমিই যথাক্রমে পাল্য,পালন, সংহাৰ্য্য ও সংহারস্বরূপা। তুমিই মহাদেবশক্তি,আবার অসুরগণ যে শক্তিপ্রভাবে বলীয়ান, সে শক্তিও তোমা হইতেই বিকাশিত হইয়াছে।
ত্রিধা চকার চাত্মানং স্বেচ্ছয়া প্রকৃতি স্বয়ং।
মায়া বিদ্যা চ পরমেত্যেবং সা ত্রিবিধাঽভবৎ॥
মায়া বিমোহিনী পুংসাং যা সংসার-প্রবর্তিকা।
পরিস্পন্দানিশক্তি র্যা পুংসাং যা পরমা মতা।
তত্ত্বজ্ঞানাত্মিকা চৈব সা সংসার-নিবর্তিকা॥
অর্থাৎ, মূলপ্রকৃতি পরব্রহ্ম ভগবতী স্বয়ং স্বেচ্ছায় নিজ শক্তিকে মায়া, বিদ্যা এবং পরমা এই ত্রিবিধরূপে বিভক্ত করেন।
ঈশ্বরঃ সর্বভূতানাং হৃদ্দেশেহর্জুন তিষ্ঠতি।ভ্রাময়ন্ সর্বভূতাদি যন্ত্রারূঢ়ানি মায়য়া ॥
হে অর্জুন ! পরমাত্মারূপে আমি সকলেরই হৃদয়ে বিরাজ করি এবং মায়ার দ্বারা যন্ত্রারূঢ় পুত্তলিকার মতো জীবকে ভ্রমণ করাই।
ব্রহ্মসংহিতায় বলা হয়েছে –
মায়য়া রমমাণস্য ন বিয়োগস্তয়া সহ।
আত্মনা রময়া রেমে ত্যক্তকালং সিসৃক্ষয়া।।
মায়ার সংসারে তাঁর বিয়োগ নাই। তাঁর ইচ্ছায় বারবার প্রলয় ও সৃষ্টি। শূন্য ও মায়া একত্রে তা সম্পাদন করছেন প্রতি নিয়ত। শূন্যের সঙ্গে রমা নিয়ত বিহারশীল তাই রমার অপর নাম নিয়তি।
নিয়তিঃ স রমা দেবী তং প্রিয়া তদ্বশং সদা।
ব্রহ্মসংহিতায় বলা হয়েছে –
এবং জ্যোতির্মময়ো দেবঃ সদানন্দঃ পরাৎপরঃ।
আত্মারামস্য তস্যাস্তি প্রকৃত্যা ন সমাগমঃ।।
তিনিই প্রকৃতি , আবার তিনি প্রকৃতি হতে নির্লিপ্ত । তিনি ও প্রকৃতি একই আবার এক হয়েও এক নয়। শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায় প্রকৃতির বেশ পরিষ্কার বিশ্লেষণ আছে। শ্ৰীদুর্গাই রূপভেদে প্রকৃতি বা মহামায়া ও যোগমায়া নামে অভিহিতা হন। যোগমায়া রূপই শ্ৰীদুর্গার প্রকৃত স্বরূপ।
প্রথমে পূজিতা সা চ কৃষ্ণেন পরমাত্মনা।
বৃন্দাবনে চ সৃষ্ট্যাদ্যৌ গোলকে রাগমণ্ডলে।
মধুকৈটভভীতেন ব্রহ্মণা সা দ্বিতীয়তঃ।
ত্রিপুরপ্রেষিতেনৈব তৃতীয়ে ত্রিপুরারিণা।।
ভ্রষ্টশ্রিয়া মহেন্দ্রেন শাপাদ্দুর্বাসসঃ পুরা
চতুর্থে পূজিতা দেবী ভক্ত্যা ভগবতী সতী।।
তদা মুনীন্দ্রৈঃ সিদ্ধেন্দ্রৈর্দেবৈশ্চ মুনিমানবৈঃ।
পূজিতা সর্ববিশ্বেষু বভূব সর্ব্বতঃ সদা।।
এই বিশ্বব্রহ্মান্ড যাঁর প্রকাশ আমরা তাঁর পূজা করব কি দিয়ে ?
শক্তিপূজা মুখের কথা নয়।
শক্তি শারীরিক-মানসিক ও আধ্যাত্মিক । ভক্তি তাঁর পূজা। তাঁর প্রিয় কর্ম করাও তাঁর পূজা । আমরা তাঁকে মাতৃরূপে দেখতে ভালবাসি । তাঁর পূজাই সার্থক, যিনি বিশ্বজননী কে সত্যসত্য মা মনে করেন মায়ের প্রিয় কার্য করেন। তাঁর আজ্ঞা পালন করে সুখী হন।
তিনি ধন্য , তিনি শত ধন্য, যিনি মাকে আনন্দময়ী রূপে দেখতে পান। তিনি এক গান শুনতে পান। গানের ভাষা ও ভাব বুঝতে পারেন না। কিন্তু দিবারাত্রি সেগানের মধুর সুর শুনতে পান।
এসো দেবী, এসো এ আলোকে, একবার তোরে হেরি চোখে–
গোপনে থেকো না মনোলোকে ছায়াময় মায়াময় সাজে॥
#সমাপ্ত
©দুর্গেশনন্দিনী
তথ্যঃ ১. আকাশের তারায় মহিষাসুরমর্দিনী
২. লোকায়ত রাঢ় বঙ্গ
৩. বিজ্ঞান চর্চায় প্রাচীন ভারত ও সমকালীন অন্যান্য দেশ
৪. ঋগ্বেদ সংহিতা
৫. শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা
৬. বঙ্গাব্দ