” ‘মহেশ’ নামে আমার লেখা একটি ছোট গল্প আছে, সেটি সাহিত্যপ্রিয় বহু লোকেরই প্রশংসা পেয়েছিল।

একদিন শুনতে পেলাম গল্পটি Matric-এর পাঠ্য-পুস্তকে স্থান পেয়েছে। আবার একদিন কানে এল সেটি নাকি স্থানভ্রষ্ট হয়েছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে নিজের কোন যোগ নেই, ভাবলাম এমনিই হয়ত নিয়ম। কিছুদিন থাকে, আবার যায়। কিন্তু বহুদিন পরে এক সাহিত্যিক বন্ধুর মুখে কথায় কথায় তার আসল কারণ শুনতে পেলাম। আমার গল্পটিতে নাকি গো-হত্যা আছে।

আহা! হিন্দু বালকের বুকে যে শূল বিদ্ধ হবে! বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের বহু টাকা মাইনের কর্তা-মশায় এ অনাচার সইবেন কি করে? তাই ‘মহেশ’, এর স্থানে শুভাগমন করেছেন তাঁর স্বরচিত গল্প ‘প্রেমের ঠাকুর’। আমার ‘মহেশ’ গল্পটা হয়ত কেউ কেউ পড়ে থাকবেন, আবার অনেকেই হয়ত পড়েন নি। তাই শুধু বিষয়-বস্তুটা সংক্ষেপে বলি।

একটি হিন্দুপ্রধান হিন্দু জমিদার-পালিত ক্ষুদ্র গ্রামে গরীব চাষা গফুরের বাড়ি। বেচারার থাকার মধ্যে বহুজীর্ণ, বহুছিদ্রযুক্ত একখানি খড়ের ঘর, বছর-দশেকের মেয়ে আমিনা, আর একটি ষাঁড়। গফুর ভালবেসে তার নাম দিয়েছিল মহেশ। বাকি খাজনার দায়ে ছোট গাঁয়ের ততোধিক ছোট জমিদার যখন তার ক্ষেতের ধান-খড় আটক করলে, তখন সে কেঁদে বললে, হুজুর! আমার ধান তুমি নাও, বাপ-বেটীতে ভিক্ষে করে খাবো, কিন্তু খড় ক’টি দাও,—নইলে এ-দুর্দিনে মহেশকে আমার বাঁচাবো কি করে? কিন্তু রোদন তার অরণ্যে রোদন হল—কেউ দয়া করলে না। তার পরে শুরু হল তার কত রকমের দুঃখ, কত রকমের উৎপীড়ন। মেয়ে জলের জন্যে বাইরে গেলে সেই জীর্ণ কুটীরের খড় ছিঁড়ে নিয়ে লুকিয়ে মহেশকে খাওয়াতো, মিছে করে বলতো, মা আমিনা, আজ আমার জ্বর হয়েছে, আমার ভাত ক’টি তুই মহেশকে দে।

সারাদিন নিজে অভুক্ত থাকতো। ক্ষুধার জ্বালায় মহেশ অত্যাচার করলে এই দশ বছরের মেয়েটার কাছেও তার ভয় ও কুণ্ঠার অবধি থাকতো না। লোকে বলতো, গরুটাকে তুই খাওয়াতে পারিস নে গফুর, ওকে বেচে দে। গফুর চোখের জল ফেলে আস্তে আস্তে তার পিঠে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলতো, মহেশ, তুই আমার ব্যাটা,—আমাকে তুই সাত সন প্রতিপালন করেছিস। খেতে না পেয়ে তুই কত রোগা হয়ে গেছিস,—তোকে কি আজ আমি পরের হাতে দিতে পারি, বাবা! এমনি করে দিন যখন আর কাটতে চায় না তখন একদিন অকস্মাৎ এক বিষম কাণ্ড ঘটলো।

সে গ্রামে জলও সুলভ নয়। শুকনো পুকুরের নীচে গর্ত কেটে সামান্য একটুখানি পানীয় জল বহু দুঃখে মেলে। আমিনা দরিদ্র মুসলমানের মেয়ে, ছোঁয়া-ছুঁয়ির ভয়ে পুকুরের পাড়ে, দূরে দাঁড়িয়ে প্রতিবেশী মেয়েদের কাছে চেয়ে-চিন্তে অনেক দুঃখে বিলম্বে তার কলসীটি পূর্ণ করে বাড়ি ফিরে এল। এখন ক্ষুধার্ত তৃষ্ণার্ত মহেশ তাকে ফেলে দিয়ে কলসী ভেঙ্গে ফেলে এক নিশ্বাসে মাটি থেকে জল শুষে খেতে লাগল।

মেয়ে কেঁদে উঠলো। জ্বরগ্রস্ত, পিপাসায় শুষ্ককণ্ঠ গফুর ঘর থেকে বেরিয়ে এল—এ দৃশ্য তার সইল না। হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে যা সুমুখে পেলে—একখণ্ড কাঠ দিয়ে সবলে মহেশের মাথায় মেরে বসল। অনশনে মৃতকল্প গরুটা বার-দুই হাত-পা ছুঁড়ে প্রাণত্যাগ করলে।

প্রতিবাসীরা এসে বললে, হিন্দুর গাঁয়ে গোহত্যা! জমিদার পাঠিয়েছেন তর্করত্নের কাছে প্রায়শ্চিত্তের ব্যবস্থা নিতে। এবার তোর ঘরদোর না বেচতে হয়। গফুর দুই হাঁটুর ওপর মুখ রেখে নিঃশব্দে বসে রইল। মহেশের শোকে, অনুশোচনায় তার বুকের ভেতরটা পুড়ে যাচ্ছিল। অনেক রাতে গফুর মেয়েকে তুলে বললে, চল্‌ আমরা যাই।

মেয়ে দাওয়ায় ঘুমিয়ে পড়েছিল, চোখ মুছে বললে, কোথায় বাবা? গফুর বললে, ফুলবেড়ের চটকলে কাজ করতে।

আমিনা আশ্চর্য হয়ে চেয়ে রইল। ইতিপূর্বে অনেক দুঃখেও তার বাবা চটকলে কাজ করতে রাজী হয়নি। বাবা বলতো, ওখানে ধর্ম থাকে না, মেয়েদের আব্রু-ইজ্জত থাকে না—ওখানে কখন নয়। কিন্তু হঠাৎ এ কি কথা?

গফুর বললে, দেরি করিস নে মা, চল্‌। অনেক পথ হাঁটতে হবে। আমিনা জল খাবার পাত্র এবং বাবার ভাত খাবার পিতলের বাসনটি সঙ্গে নিতেছিল, কিন্তু বাবা বারণ করে বললে, ও-সব থাক্‌ মা, ওতে আমার মহেশের প্রাচিত্তির হবে।

তার পরে গল্পের উপসংহারে বইয়ে এইরূপ আছে

—“অন্ধকার গভীর নিশীথে সে মেয়ের হাত ধরিয়া বাহির হইল। এ গ্রামে আত্মীয় কেহ তাহার ছিল না, কাহাকেও বলিবার কিছু নাই। আঙ্গিনা পার হইয়া পথের ধারে সেই বাবলা-তলায় আসিয়া সে থমকিয়া দাঁড়াইয়া হুহু করিয়া কাঁদিয়া উঠিল। নক্ষত্রখচিত কালো আকাশে মুখ তুলিয়া বলিল, আল্লাহ! আমাকে যত খুশি সাজা দিয়ো, কিন্তু মহেশ আমার তেষ্টা নিয়ে মরেছে। তার চরে খাবার এতটুকু জমি কেউ রাখেনি। যে তোমার দেওয়া মাঠের ঘাস, তোমার দেওয়া তেষ্টার জল তাকে খেতে দেয়নি, তার কসুর তুমি কখনো যেন মাফ্‌ করো না।”

এই হল গোহত্যা! এই পড়ে হিন্দুর ছেলের বুকে শেল বিঁধবে। তার চেয়ে পড়ুক ‘প্রেমের ঠাকুর’!

তাতে ইহলোক না হোক তাদের পরলোকে সদ্গতি হবে! এই কান্তিমান সুপরিপুষ্ট প্রেমের ঠাকুরটিকে প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করে, মুসলমান-সম্পাদিত কাগজে এই গল্পটির যে কড়া আলোচনা বেরিয়েছিল তার কি কোন হেতু নেই? একেবারে মিথ্যা অমূলক?

তাই আমার চেয়েও বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তিটিকে সসম্মানে নিবেদন করে রাখি যে, খুব বড় হলেও মনের মধ্যে একটুখানি বিনয় থাকা ভাল। ভাবা উচিত, তাঁর রচিত গল্পের সঙ্গে বাঙলার ছাত্র-ছাত্রীদের পরিচয় না ঘটলেও বিশেষ কোন লোকসান ছিল না।

Text Book থেকে পয়সা পাইনে—ও ব্যবসা আমার নয়—সুতরাং ক্ষতিবৃদ্ধিও নেই—তবু ক্লেশবোধ হয়। নিজের জন্য নয়,—অন্য কারণে। শুধু সান্ত্বনা এই যে, অযোগ্যের হাতে ভার পড়লে এমনি দুর্দশাই ঘটে। যে ব্যক্তি কোনদিন সাহিত্য সাধনা করেনি সে কি করে বুঝবে কার মানে কি! শুনেছি নাকি আমার ‘রামের সুমতি’ গল্পের খানিকটা দিয়েছেন। অত্যন্ত দয়া,—বোধ করি আশা এর থেকে রামেদের সুমতি হবে। কিন্তু মুশকিল এই যে, দেশে রহিমরাও আছে।

আর শুধু বিদ্যালয়ই নয়, মহেশের ভাগ্যে অন্য দুর্ঘটনাও ঘটেছে। তার বিস্তারিত বিবরণ দিতে চাইনে, কিন্তু নিঃসংশয়ে জানি এক হিন্দু জমিদার রক্তচক্ষু হয়ে শাসিয়ে বলেছিলেন, ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের সাহায্যে ছাপা মাসিক বা সাপ্তাহিকে এ ধরনের গল্প যেন আর ছাপা না হয়। এতে জমিদারের বিরুদ্ধে প্রজা ক্ষেপিয়ে দেওয়া হয়। অর্থাৎ দেশের সর্বনাশ হয়।”

…………………………………………………………………

১৯৩৬ সালের ৩১ শে জুলাই ঢাকায় অনুষ্ঠিত ‘মুসলীম সাহিত‍্য সমাজ’ এর দশম বার্ষিক অভিভাষণে উপরোক্ত কথাগুলি বলেছিলেন প্রখ্যাত সাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ( ১৮৭৬ – ১৯৩৮ )।

(তথ‍্যসূত্র ; মুসলীম সাহিত্য সমাজের বার্ষিক অধিবেশন: সভাপতিদের অভিভাষণ ; সংকলন : হাবিব রহমান, বাংলা একাডেমি, ঢাকা,২০০২ )

শরৎচন্দ্রের ” মহেশ” গল্পে আমরা দেখতে পাই ,

১) এক অবলা পোষ‍্য জীবের সাথে দরিদ্র ভূমিহীন, কর্মহীন কৃষকের আত্মিক সম্পর্ক।

২) জমিদারি শাসনব্যবস্থার নির্মমতা তথা শোষণের ফলে কিভাবে কৃষিনির্ভর এক মানুষ নিজের জমি ও সর্বস্ব খুইয়ে হয়ে ওঠে চটকলের সাধারণ দিনমজুর – সেই চিরকালীন অর্থনৈতিক সমস‍্যা।

অবলা জীবকে কেন্দ্র করে যত গল্পই রচিত হোক না কেন , মহেশ সর্বাগ্রগণ্য।

এটি বাংলা ছোটগল্পের একটি মাইলস্টোন। গল্পটির প্রধান উপজীব‍্য করুনরস।

সপ্তম শ্রেণী থেকে দ্বাদশ শ্রেণী। গল্পটা ঘুরে ফিরে সিলেবাসে চলে আসত। কিন্তু একটা সময় একই প্রশ্নের উত্তর প্রত্যেক বছর লিখতে লিখতে কিছুটা বিরক্ত লাগত। মনে হত, একই চর্বিতচর্বণ, রুগ্ন ষাঁড়ের জাবর কাটার মত।

শরৎচন্দ্রের হৃদয়কে আমরা ছাত্রাবস্থায় ” মহেশ”, “অভাগীর স্বর্গ”, “লালু”, ” শ্রীকান্ত” র কিছু নির্বাচিত অংশ — বাংলা সিলেবাসের এইসব গল্পের মাধ‍্যমেই অনুভব করতাম।

” মহেশ” গল্পটি বাংলায় অসাম্প্রদায়িক চেতনার একটি দলিল, একটা ম‍্যানিফেস্টো, একটা রেফারেন্স পয়েন্ট। নজরুলের ” হিন্দু না ওরা মুসলীম” বা “একই বৃন্তে দুইটি কুসুম” এর মতই বিভিন্ন লেখায়, প্রবন্ধে, স্কুলের রচনায়, নেতাদের বক্তৃতায়, বিতর্কে গল্পটির স্বতঃস্ফূর্ত উল্লেখ চলে আসে।

শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় যথার্থই বলেছেন-“হিন্দুর গোজাতি-বাৎসল্য ও মুসলমানের গোখাদক-বৃত্তি সম্বন্ধে আমাদের যে বদ্ধমূল ধারণা আছে শরৎচন্দ্র তাহারই বিরুদ্ধে প্রচারের আতিশয্যহীন,কলাবোধসম্মত একটি অতি-সূক্ষ্ম প্রতিবাদ জানাইয়াছেন।তর্করত্নের শাস্ত্রবিধি সমর্থিত গোপ্রশস্তি যে নিছক ভণ্ডামি ও গফুরের অযত্ন যে নিরুপায়ের গভীর বেদনাময় অক্ষমতার ফল তাহা বুঝিতে আমাদের এক মুহূর্তও দেরি হয় না”।(বঙ্গ সাহিত্যে উপন্যাসের ধারা,পৃষ্ঠা-২২৭)

………………………………………………………………….

শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাঁর “স্বদেশ ও সাহিত‍্য” রচনা সংকলনে অকপটেই দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের কাছে স্বীকার করেছিলেন যে তিনি “হিন্দু মুসলীম ইউনিটি”তে বিশ্বাস করেন না।

উত্তরে দেশবন্ধু তাঁকে বলেন, ” আপনার মুসলমানপ্রীতি অতি প্রসিদ্ধ।”

শরৎচন্দ্র তাতে লিখেছিলেন, ” ভাবিলাম, মানুষের কোন সাধু ইচ্ছাই গোপন রাখিবার যো নাই, খ্যাতি এত বড় কানেও আসিয়া পৌঁছিয়াছে। কিন্তু নিজের প্রশংসা শুনিলে চিরকালই আমার লজ্জা করে, তাই সবিনয়ে বদন নত করিলাম।”

শরৎচন্দ্রের “শ্রীকান্ত” উপন‍্যাসে “বাঙালী ও মুসলমান ছেলেদের মধ্যে ফুটবলা খেলা” লাইনটি পড়ে ক্ষুব্ধ হয়ে শিক্ষিত মুসলীম সমাজের প্রতিনিধিরা শরৎচন্দ্রকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, আপনি কি। আমাদের বাঙালী ভাবেন না? শরৎ উত্তর করেছিলেন, বিহারের পটভূমিতে মুসলমান বলতে তিনি হিন্দুস্তানী অবাঙালী মুসলমানদের বুঝিয়েছিলেন।

১৯৩৬ সালে ঢাকায় এসে শরৎচন্দ্র প্রকাশ‍্য সমাবেশে ঘোষণা করেছিলেন তিনি মুসলমান সমাজ নিয়ে উপন্যাস লিখবেন। সেদিন হলভরা দর্শকদের আসন থেকে মিজানুর রহমান নামের একজন লেখক শরৎচন্দ্রকে (পরে প্রবন্ধ আকারে লিখে) আহ্বান জানিয়েছিলেন, আপনি হিন্দু সমাজকে চাবুক মেরে যেভাবে কশাঘাত করছেন প্রতিকারের আশায়, একইভাবে মুসলিম সমাজকে কশাঘাত করুন…।

শরৎচন্দ্র কথা দিয়েছিলেন তিনি মুসলিম সমাজের ভিতরে প্রচলিত অসংগতি ও শোষণের মত বিষয়কে উপজীব্য করবেন নিজের লেখায়। কাজী মোতাহার হোসেন চৌধুরীর সঙ্গে দাবা খেলার সময়ও একই মত দিয়েছিলেন। কিন্তু ‘মহেশ’ ছাড়া শরৎবাবুর কলমে মুসলিম সমাজ বিষয়ে আর তেমন কোন লেখা নেই কেন ?

মহেশে মুসলিম সমাজের কোন ত্রুটি নিয়ে কথা নেই। বরং বর্ণহিন্দু জমিদার ও ব্রাহ্মণ সমাজের হাতে নিপীড়িত হওয়ার করুণ কাহিনী বর্ণিত হয়েছে। শরৎবাবু জীবিত থাকাকালে এই গল্প পাঠ্য হয়েছিল স্কুলে। কিন্তু মহেশ গল্পে এক ভিন্নধর্মীর হাতে গোমাতাকে হত্যার মত কাহিনী থাকাতে হিন্দু সমাজের মানহানি হয়েছে — এই যুক্তিতে রক্ষণশীল সমাজপতিদের দাবীর মুখে গল্পটি পরবর্তীকালে পাঠ্য পুস্তক থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়।

প্রখ্যাত বুদ্ধিজীবী কাজি মোতাহার হোসেন চৌধুরী মুসলিম সমাজ নিয়ে লেখার জন্য শরৎবাবুকে বার বার তাগাদা দিচ্ছেলেন। তিনি আক্ষেপ করে বলছিলেন, ‘আপনারা কি আমাদের একঘরে করে রাখবেন?’

” গোজীবন’ লিখে মীর মোশাররফ হোসেনকে ধর্মানুভূতিতে আঘাত লাগার দরুণ মামলা মকদ্দমায় জড়িয়ে পড়তে হয়েছিল। মহামারিতে কৃষিকাজের অন্যতম মাধ্যম গরুর সংখ্যা হঠাৎ হ্রাস পাওয়ায় গরু জবাই না করতে আবেদন জানানই হয়েছিল বিপদের কারণ।

বাংলা সাহিত্যে সূর্যের মত দীপ্তিমান যিনি, সেই রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং তখন মুসলমানদের ধর্মানুভূতিতে আঘাত দিয়ে বসে আছেন! তার কবিতাকে সেন্সর করতে দাবী করেছে মুসলমান সমাজ।

‘কথা ও কাহিনী’ কাব্যগ্রন্থের ” মানী” কবিতায় ‘আরঙজেব ভারত যবে/ করিতেছিল খান খান’ লাইনটি এদেশের তাঁদের “পূর্বপুরুষদের” অপমানিত করা হয়েছে বলে দাবী করে রবীন্দ্রনাথকে ক্ষমা চাইতে বলেছিল ধর্মপ্রাণ মানুষের দল। বলেছিল, ঐ লাইন তুলে নিতে হবে…।

কয়েক বছর আগেই (১৯৩১) কলকাতায় বিখ্যাত বইয়ের দোকান ‘সেন ব্রাদার্স’-এর মালিক ভোলানাথ সেনকে তার দুইজন কর্মচারী সমেত ধর্মানুভূতিতে আঘাত দেয়ার অভিযোগে দুইজন মুসলিম যুবক নৃশংসভাবে খুন করে। ‘প্রাচীন কাহিনী’ নামে তৃতীয় ও চর্তুথ শ্রেণীর পাঠ্য হিসেবে একটি বই ভোলানাথ প্রকাশ করেছিলেন। বইটির লেখক স্বয়ং ভোলানাথ সেন। এটি সরকার পাঠ্য পুস্তক হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছিল। সেই বইতে ইসলাম ধর্মের প্রবর্তক হযরত মুহম্মদের নামে যে অধ‍্যায় ছিল সেখানে ভাল ভাল কথা বলে তাকে সম্মান করা হলেও সেখানে একটা ছবি ছাপা হয়েছিল যেখানে দেখানো হয়েছিল মসজিদে মুহম্মদ দাঁড়িয়ে আছেন আর তার সামনে ফেরেশতা জিব্রাইল উপস্থিত। এই ছবিটি বৃটিশ মিউজিয়াম থেকে অনুমতি নিয়েই বইতে প্রকাশ করা হয়েছিল। অর্থাৎ, এই ছবিটি বৃটিশ মিউজিয়ামে রক্ষিত আছে। কিন্তু ঢাকার একজন মুসলমান জমিদারের ধর্মানুভূতিতে প্রচন্ড আঘাত লাগে এই ছবি দেখে।তাঁরা কলকাতায় এসে দুজন পাঞ্জাবী মুসলমান যু্বককে উদ্বুদ্ধ করে এর প্রতিশোধ নেয়ার জন‍্য। একদিন কলেজ স্ট্রীটে ভোলানাথবাবুর দোকানে দুই যুবক এসে তাঁকে খুন করে যায় তাঁর দুই কর্মচারী সমেত। দিনেদুপুরে এই খুন নিয়ে ভীষণ তোলপাড় হয়েছিল।

শরৎবাবু রাজনীতি করা মানুষ, তাই সতর্ক হয়ে গিয়েছিলেন। হিন্দুসমাজে শরৎবাবুর জন্মকর্ম। যে চাবুক শরৎচন্দ্র হিন্দু সমাজের উপর প্রয়োগ করেছিলেন অকুন্ঠিত সাহসের সঙ্গে, নিজস্ব অধিকারবলে, তা কি অপরের ওপর প্রয়োগ করা যায় ? এতে তো অধিকার আর ভদ্রতার প্রশ্নটিও জড়িয়ে আছে।

১৯৩৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে দেয়া ডি লিট উপাধি প্রদান করে। কলকাতার কাগজ সজনীকান্ত দাস সম্পাদিত “শনিবারের চিঠি” এই নিয়ে কুৎসিত ভাবে আক্রমণ করে কথাশিল্পীকে।

শরৎচন্দ্রের এই সম্মানপ্রাপ্তির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছিল মুসলিম ছাত্ররা। তাঁদের অভিযোগ, শরৎবাবু তাঁর বিভিন্ন লেখায় মুসলমানদের হেয় করেছেন। তাঁকে সংবর্ধনা জানাতে অস্বীকৃতি জানায় মুসলিম ছাত্রদের পরিচালিত সংগঠনগুলো।

তাঁদের মূল আপত্তি অবশ‍্য শরৎচন্দ্রের ১৯২৬ সালে ” হিন্দু মুসলমান সমস‍্যা” নামে একটি ভাষণকে কেন্দ্র করে। ভাষণটি ১৯৩৩ সালে ” হিন্দু সংঘ ” নামে একটি পত্রিকায় প্রবন্ধ আকারে মুদ্রিতও হয়েছিল। এই প্রবন্ধে নাকি শরৎবাবু তাঁদের জাতির উদ্দেশ্যে বিচ্ছিরি বিচ্ছিরি সব কথা বলেছিলেন। যাঁরা পড়েছিলেন প্রবন্ধটি, তাঁরা সবিস্ময়ে জিজ্ঞাসা করলেন, ” কংগ্ৰেসের পদাধিকারী শরৎবাবু এ কোন হিন্দুসভার ইশতেহার লিখেছেন ?”

উক্ত প্রবন্ধটি একটি ডায়নামাইট। শরৎবাবুর ভক্তদের মধ‍্যে যাঁদের হৃদয় দুর্বল, তাঁরা দয়া করে পড়বেন না। বিস্তারিত আলোচনা নাই বা করলাম।

অনেকের মনেই প্রশ্ন জাগে, যিনি ” মহেশ” এর মত গল্প বললেন, তিনি অন‍্যান‍্য লেখায় এতটা আক্রমনাত্মক কঠিন কথা লিখলেন কি করে ?

আসলে সমস‍্যাটি অন‍্য জায়গায়। এটি অনেকেই ধরতেই পারেন না যে শিল্পীর মধ‍্যে দ্বৈত সত্ত্বা থাকে। মরমী গল্পকার তাঁর হৃদয় দিয়ে যে গল্প লেখেন তা রাজনৈতিক নিবন্ধকারের বিশ্বাস, তথ‍্য ও মতবাদ প্রভাবিত রচনার চেয়ে আলাদা।

ঘটনাচক্রে হয়ত গল্পকার ও নিবন্ধকার একই লোক।

পোস্ট ; ঋতুপর্ণ বসু

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.