অরাজকতার রাজ্য হিসাবে পরিচিত উত্তরপ্রদেশ বর্তমানে অপরাধ ও অপরাধীদের প্রতি কঠোর থেকে কঠোরতর হয়ে উঠেছে। শুধু তাই নয়, শাসনব্যবস্থার পাশাপাশি রাজ্যের শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য পরিসেবা আরও উন্নত হয়েছে। এই নতুন রূপের উত্তরপ্রদেশ এখন গোরক্ষপুরের গোরক্ষনাথ মঠের মহন্ত মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথের সমর্থক বলা যেতে পারে।
২০২০ সালের ২০ আগস্ট ছিল হিন্দুদের জন্য এক ঐতিহাসিক দিন। ৪৯২ বছরের নিরলস লড়াইয়ের স্বীকৃতিও বলা যায়। ১৫২৮ সালে বাবর যে রামমন্দিরকে ধ্বংস করেছিল, সেই মন্দিরের পুনঃপ্রতিষ্ঠার ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন হয় এদিন। ৪৯২বছরের দীর্ঘ এই গণআন্দোলনের মধ্যে ছিল ব্রিটিশ শাসনকালের ৯০বছর এবং স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে ৭০ বছরের আইনী লড়াই। রাম মন্দির কোনও যুদ্ধক্ষেত্র ছিল না। ১৫২৮ সালে বাবরের বঞ্চনার হাত থেকে রক্ষা পেতে হিন্দুরা তাদের শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে মুসলিম আক্রমণকারীদের বর্বরতার বিরুদ্ধে বীরের মতো যুদ্ধ করেছিল। কিন্তু স্বাধীনতার পর ভারতের কোন শক্তি তার হারানো গৌরব ফিরে পাওয়ার ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে? ভারতে আদর্শের মানদণ্ড হল ধর্মনিরপেক্ষতা, যা হিন্দু সভ্যতাকে অসম্মান, অবজ্ঞা এবং উপেক্ষা করে।
*বজ্রকঠিন মহন্ত যোগী আদিত্যনাথ বিপ্লবী “মহন্ত দিগ্বিজয় নাথ” -এর কথা মনে করিয়ে দেন, যিনি শুধুমাত্র গোরক্ষপুরের গোরক্ষনাথ মঠকেই মজবুত এবং সক্রিয় করেননি, ১৯৪৯ সালের রাম জন্মভূমি আন্দোলনে প্রথম সারিতে থেকে লড়াই করেছেন।*
১৯৫০ এর দশকে যখন ভারতে কংগ্রেস আধিপত্য বিস্তার লাভ করছিল, তখন হিন্দু সংস্কৃতি ও সভ্যতাকে সমর্থন করা ছিল কল্পনাতীত। মুসলিম আক্রমণকারী বাবর যে রাম মন্দিরকে ধ্বংসস্তুপে পরিণত করেছিল সেই মন্দির সংস্কারের দাবি জানানো ছিল সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সমতুল্য। ৪৯২ বছরের এই দীর্ঘ নিরলস লড়াইয়ে ছিলেন পিঠাধীশ্বর মহান্ত, শ্রী দিগ্বিজয় নাথের মতো নেতারা, যাঁরা ১৯৪৯ সালের রাম জন্মভূমি আন্দোলনের জন্য নিজেদের জীবন সম্পূর্ণভাবে নিয়োজিত করেছিলেন।
মহন্ত দিগ্বিজয় নাথ ১৮৯৪ সালে রাজস্থানের মেওয়ার উদয়পুরে স্বরূপ নানহু সিংহ নামে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তাঁর মা মারা যাওয়ার পরে ৮ বছর বয়সে তিনি নাথ সম্প্রদায়ে দীক্ষিত হন। এই ৮ বছর বয়সী ছেলেকে তাঁর নাথপাথ যোগী, ফুল নাথ গোরক্ষনাথ মঠে নিয়ে আসেন। নাথ সম্প্রদায় ছিল ভক্তদের সংঘ, যারা ভগবান শিবকে তাদের প্রধান ঈশ্বর এবং প্রথম গুরু (শিক্ষক) হিসাবে উপাসনা করেন। দিগ্বিজয় নাথ গোরক্ষপুরের গোরক্ষনাথ মঠ মন্দিরে বেড়ে ওঠেন। তিনি উচ্চ শিক্ষার জন্য গোরখপুরের সেন্ট অ্যান্ড্রুজ কলেজে ভর্তি হন। কিন্তু এইসময় তিনি ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রতি আকৃষ্ট হন। এরপর তিনি ১৯২০ সালে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসে যোগ দেন। মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীর নেতৃত্বে অসহযোগ আন্দোলনেও সক্রিয় অংশগ্ৰহন করেন। ১৯২০ সালের ৪ঠা সেপ্টেম্বর স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে (পূর্ণ স্বরাজ) *মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীর নেতৃত্বে অসহযোগ আন্দোলন শুরু হওয়ার পরে দিগ্বিজয় নাথ ব্রিটিশ সরকারকে বয়কট করার জন্য সমস্ত ভারতবাসীকে সংঘবদ্ধ করার কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েন*।
এইভাবেই অসহযোগ আন্দোলন গতি পায়। এমনকি বেকার এবং ছাত্ররাও তাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যোগদান বন্ধ করে দিয়েছিল। কিন্তু গান্ধীজী ১৯২২ সালের ৪ঠা ফেব্রুয়ারি চৌরিচৌরার ঘটনার পর হঠাৎ করেই অসহযোগ আন্দোলন বন্ধ করে দিলেন।। এদিন ভারতের যুক্তপ্রদেশের (বর্তমান উত্তরপ্রদেশ এবং উত্তরাখন্ড) গোরক্ষপুর জেলায় একটি পুলিশ স্টেশন আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। গান্ধীজী তাঁর ব্যক্তিগত মতাদর্শকে বজায় রাখতে গিয়ে লক্ষ লক্ষ মানুষের ত্যাগ, লড়াইকে নিমেষেই ধুলিস্যাৎ করে দিয়েছিলেন। এই ঘটনা মহন্ত দিগ্বিজয় নাথের চোখ খুলে দেয় এবং তিনি কংগ্রেস পার্টি ত্যাগ করেন। গান্ধীজী গোরক্ষপুরের মানুষের ক্ষোভের নিন্দা করেছিলেন, কিন্তু তিনি কেন প্রতিবাদকারীদের উপর ব্রিটিশ পুলিশের বর্বরতার বিষয়টি উপেক্ষা করলেন? দিগ্বিজয় নাথ চৌরিচৌরার ঘটনায় অংশ নিয়েছিলেন বলে তাঁর সাহসিকতার জন্য তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল।
১৯৩৫সালের ১৫ই আগস্ট দিগ্বিজয় নাথ গোরক্ষপুরের গোরক্ষনাথ মঠ মন্দিরের মহন্ত হিসাবে অভিষিক্ত হন। *তিনি ১৯৩৭ সালে হিন্দু মহাসভায় যোগ দিয়েছিলেন, তখন সভাপতি ছিলেন বিনায়ক দামোদর সাভারকর। তিনি চেয়েছিলেন গোরক্ষনাথ মঠকে হিন্দু আদর্শের রাজনীতির সাথে যুক্ত করতে।* মহন্ত দিগ্বিজয় নাথের আকাশছোঁয়া খ্যাতি মানুষকে তাদের ধর্ম ও জাতীয় কর্তব্যের প্রতি অনুপ্রাণিত করেছিল এবং তিনি যুক্ত প্রদেশের হিন্দু মহাসভার প্রধান হন।
১৯৪৮ সালের ৩০শে জানুয়ারী নাথুরাম গডসে মহাত্মা গান্ধীকে হত্যার করার পর, বহু হিন্দু জাতীয়তাবাদীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। মহন্ত দিগ্বিজয় নাথকেও গ্রেপ্তার করা হয়েছিল, কিন্তু গান্ধী হত্যায় কোনও প্রমাণ ও তাঁর ভূমিকা না থাকায় ৯মাস পর তাঁকে মুক্তি দেওয়া হয়েছিল। হিন্দু মহাসভাও এই ক্ষেত্রে ছাড় পায়নি।
*১৯৪৯ সালের ডিসেম্বরে, মহন্ত দিগ্বিজয় নাথ অখিল ভারতীয় রামায়ণ মহাসভার সাথে টানা ৯দিন ব্যাপী “রামচরিত মানস” আবৃত্তি করেছিলেন*। এরপরে, ভগবান রাম এবং দেবী সীতার মূর্তি নিয়ে আসা হয়। তবে অভিযোগ আছে যে রামচরিত মানস পাঠের পর নাকি বাবরি মসজিদের ভিতরে সেই প্রতিমা স্থাপন করা হয়েছিল। মহন্ত দিগ্বিজয় নাথ তাঁর রাজনৈতিক প্রভাব এবং দূরদর্শীতার সাথে রামজন্মভূমি আন্দোলনে রাস্তার সমাবেশ থেকে শুরু করে সংসদ ভবন পর্যন্ত সক্রিয়ভাবে অংশগ্ৰহন এবং লড়াই করেছিলেন।
মহন্ত দিগ্বিজয় নাথ ১৯৬৭ সালে গোরক্ষপুর থেকে লোকসভায় নির্বাচিত হন, তবে দুর্ভাগ্যক্রমে ১৯৬৯ সালের মাঝামাঝি সময়ে তিনি মারা যান। আজ যখন রাম মন্দির নির্মাণের মধ্য দিয়ে সভ্যতার ক্ষত নিরাময়ের পাশাপাশি শতাব্দী ধরে চলে আসা হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর নিপীড়নে মলম লাগানো হচ্ছে তখন রাম জন্মভূমি আন্দোলনে মহন্ত দিগ্বিজয় নাথের অবিস্মরণীয় জ্বলন্ত অবদানের কথা কৃতজ্ঞতার সাথে স্মরণ করতেই হয়।
*মনীষা ইনামদার*