মদনলাল ধিংড়াকে অপমান করেছিলেন গান্ধীজী

১৯০৯ সালের পয়লা জুলাই, সন্ধ্যাবেলা। লন্ডনের রাজসিক ইম্পিরিয়াল ইন্সটিটিউটের আলোকমালায় সুসজ্জিত প্রাঙ্গণে ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশনের আহ্বানে সাহেবি স্যুট-মেট, গাউন পরিহিত সাহেব-মেম এবং তাঁদের বশংবদ ভারতীয় আধিকারিকেরা জমায়েত হতে শুরু করেছেন। অনুষ্ঠানের মধ্যমণি নিঃসন্দেহে ভারত সচিবের প্রধান রাজনৈতিক সহকারী (Aide-de-Camp) রাজপুতানা রেজিমেন্টের পূর্বতন আধিকারিক তথা ব্রিটিশ সিক্রেট পুলিশের এক অন্যতম হর্তাকর্তা— স্যার উইলিয়ম হাট কার্জন। ওয়াইলি।
অতিথি অভ্যাগতদের মধ্যে দামি বাদামি কালারের স্যুট-টাই পরিহিত অবস্থায় দেখতে পাওয়া গেল একজন দীর্ঘকায়, সুদর্শন ভারতীয় তরুণকে। লন্ডনের ইউনিভার্সিটি কলেজে মেক্যানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের কৃতী ছাত্র ওই তরুণটি। সপ্রতিভ, নিখুঁত উচ্চারণে । ইংরেজিতে কথাবার্তা বলা, রোম্যান্টিক চোখের তরুণটির দিকে মোহময়ী দৃষ্টি দিচ্ছিলেন সুন্দরী ইংরেজ তরুণীরাও। অসীম ধৈর্য নিয়ে অনুষ্ঠানটিতে প্রতিটি বক্তার বক্তৃতা শুনছিলেন ওই ভারতীয় যুবকটি। তার দৃঢ় এবং ভাবলেশহীন মুখে কিন্তু কোনও অভিব্যক্তির ওঠানামা । দেখতে পাওয়া যাচ্ছিল না। যেন কোনও দুরূহ লক্ষ্যে পৌঁছোনোর সংকল্পে অটুট। রয়েছে ওই যুবকটির মানসিকতা। অনুষ্ঠান শেষ হলো। অতিথিরা একে একে চলে যাচ্ছেন সভাকক্ষ ছেড়ে।
কার্জন ওয়াইলি ও তার স্ত্রীও তাদের সঙ্গী হয়েছেন। হঠাৎই যেন শিয়রে শমনের মতো, ভারতীয়দের ওপর অনেক অত্যাচার চালানো ব্রিটিশ পুঙ্গব— কার্জন ওয়াইলি এবং তার পত্নীর সামনে এসে। দাঁড়ালেন সেই সুবেশ, ভারতীয় ছাত্রটি। হাতে তাঁর উদ্যত একটি ওয়েবলি অ্যান্ড স্কট রিভলবার। কার্জন ওয়াইলি ও তার স্ত্রীকে সরাসরি চারটি গুলি করলেন। যুবকটি। গুলি করলেন কার্জন ওয়ালিকে বাঁচাতে আসা পারসি চিকিৎসক কাওয়াস লালকাকাকেও। রক্তাক্ত অবস্থায়, সকলের ভয়বিহ্বল চোখের সামনে লুটিয়ে পড়ল কার্জন ওয়াইলি, তার স্ত্রী এবং কাওয়াস লালকাকার নিপ্রাণ তিনটি শরীর। দেশমাতৃকার অপমানের প্রতিশোধ নিতে পেরে উল্লসিত হলেন যুবকটি। আত্মাহুতি দেওয়ার জন্য নিজের মাথায় রিভলবারের নল ঠেকালেন তিনি। তবে, সাতটা বুলেট খরচ হওয়ার পর যুবকটির আগ্নেয়াস্ত্রে আর গুলি ছিল না। তাই, প্রফুল্ল চাকীর মতো আত্মহত্যা করতে পারলেন না তিনি। গোরা পুলিশ তৎক্ষণাৎ ধরে ফেলল মদনলাল ধিংড়া নামক সেই বীর যুবকটিকে।
স্বভাবতই, রাজদ্রোহের অপরাধে হত্যাকারী, ২৬ বছরের তরতাজা যুবক মদনলাল ধিংড়াকে ১৯০৯ সালের ২৩ জুলাই লন্ডনের ওল্ড বেহলি আদালতের কাঠগড়াতে তোলা হলো। মদনলালের বাবা গিট্টা মল ছিলেন অমৃতসরের প্রধান স্বাস্থ্য আধিকারিক। ছেলে স্বাধীনতা সংগ্রামের চরমপন্থা এবং ব্রিটিশ বিরোধিতার দিকে ঝুঁকছে দেখে । আগেভাগেই কার্জন ওয়াইলির বশংবদ ভৃত্য গিট্টা মল, খবরের কাগজে ঘটা করে বিজ্ঞাপন দিয়ে ঘোষণা করে। দিয়েছিলেন বিশ্বাসঘাতক’ মদনলাল। ধিংড়াকে তিনি ত্যাজ্যপুত্র’ করলেন। তবে, ‘মুক্তির মন্দির সোপানতলে’ প্রাণদান করার জন্য যে চির-নবীন প্রাণটি উন্মুখ হয়ে আছে, তার কাছে পরিবারের। বিমুখতা কোনও বড়ো ব্যাপারই ছিল না। বিচারের নামে প্রহসনের সময় মোটেই আত্মপক্ষ সমর্থন করেননি মদললাল ধিংড়া। তেজস্বী এই যুবকটি কোনও আইনজীবীরও সাহায্য নেননি। কাওয়াস লালকাকার অনিচ্ছাকৃত হত্যার জন্য। অনুতাপ স্বীকার করে মদললাল ধিংড়া দৃপ্তকণ্ঠে জানান— সাগরপাড়ের ইংরেজরা ভারতকে অত্যাচারের বধ্যভূমিতে পরিণত করেছে। তিনি যদি আত্মদান করেন তাহলে ভারতীয় যুবসমাজ অবশ্যই ইংরেজ-নিধনে সর্বশক্তি দিয়ে ঝাপিয়ে পড়বে। কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে মদনলাল ধিংড়া যুক্তি দেখিয়েছিলেন—ইংরেজরা যদি জার্মান হানাদারদের বিরুদ্ধে। নিজেদের জন্মভূমিকে রক্ষা করতে পারে, তাহলে আপামর ভারতবাসীরও অধিকার আছে ঘৃণ্য ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদ এবং ঔপনিবেশিকতাবাদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র ও আমরণ প্রতিরোধ গড়ে তোলার।
পলাশি যুদ্ধে অন্যায্য বিজয়ের সময় থেকেই নবাব মিরজাফরকে ‘ক্লাইভের গর্দভ’ বানিয়ে ব্রিটিশরা যেভাবে ভারতকে নিঃস্ব করে দিতে শুরু করেছিল তার প্রমাণ, মদললাল ধিংড়া তুলে ধরেছিলেন তাঁর বলিষ্ঠ বক্তব্যে—“I hold the English people responsible for the murder of eighty millions of Indian people in the last fifty years, and the Britishers are also responsible for taking away 10 crores British pounds every year from India…it is perfectly justifiable to kill the Englishmen who are polluting our sacred land”— “গত পঞ্চাশ বছরে আট কোটি ভারতবাসীকে হত্যা করার জন্য ইংরেজদের আমি দায়ী করছি। প্রতি বছর ভারতবর্ষ থেকে ১০ কোটি পাউন্ডের মতো অর্থ নিয়ে যাওয়ার জন্যও ব্রিটিশরা দায়ী…যে ব্রিটিশরা আমাদের পবিত্র জন্মভূমিকে কলুষিত করছে তাদেরকে হত্যা করা যুক্তিযুক্ত।” ১৯০৯ সালের ১৭ আগস্ট, লন্ডনের পেন্টনভিল সংশোধনাগারে ফাসি হয় প্রবাসী এই বিপ্লবীর। এই দেশপ্রেমিক যুবকের প্রতি প্রবল সহমর্মিতা দেখান ভারতীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের সমর্থক এবং লন্ডনের অন্যতম সাম্যবাদী সংবাদপত্র—‘দ্য। ইন্ডিয়ান সোশিওলজিস্ট’-এর মুদ্রক গাই অ্যালড্রেড। মদনলাল ধিংড়ার ওপর তাঁর এই কাগজে একটি বিস্তৃত প্রতিবেদন ছাপা হয়।
বলাই বাহুল্য, ইংরেজ সরকারের ক্রোধ গিয়ে পড়ে গাই অ্যালড্রেড-এর ওপর। তাকে এক বছরের সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়। মদনলাল ধিংড়ার লড়াকু মানসিকতার দ্বারা অনুপ্রাণিত হন ব্রিটিশ একাধিপত্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণাকারী আইরিশ বিপ্লবীরাও। দ্য টাইমস পত্রিকাতে ফাঁসির মঞ্চে দৃঢ়, আত্মপ্রত্যয়ী বিপ্লবী মদনলাল ধিংড়ার ভূয়সী প্রশংসা করে লেখা হয়েছিল—“He asked no questions. He maintained defiance of studied indifference. He walked smiling from the dock”—“COATS প্রশ্ন করেননি ধিংড়া। এক প্রস্তর কঠিন ঔদাসীন্য ছিল তাঁর মুখে। হাসিমুখে ফাঁসির মঞ্চে উঠেছিলেন তিনি। দুঃখের বিষয়, সর্দার ভগৎ সিংহ, শুকদেব ও রাজগুরুর মতো ভারতের মুক্তিযুদ্ধে। আত্মবলিদানকারী মদনলাল ধিংড়ার প্রতিও চরম ঔদাসীন্য এবং বিরোধিতা দেখিয়েছিলেন মহাত্মা গান্ধী। তিনি, মদনলাল ধিংড়াকে আক্রমণ করেছিলেন তীব্র, নিন্দামূলক ভাষায়—”–“India can gain nothing from the rule of murderers-no matter whether they are black or white. Under such a rule, India will be utterly ruined and laid waste”– “হত্যাকারীদের শাসন থেকে ভারতের কোনও লাভই হবে না— তা সে হত্যাকারীর গায়ের রং সাদা বা কালো যাই হোক না কেন। এই ধরনের শাসনে ভারতের চূড়ান্ত ধ্বংস এবং অবক্ষয় ঘটবে।” গান্ধীজীর এই বিরূপ মন্তব্যের প্রতিবাদ কিন্তু গোপনে করেছিলেন ইংল্যান্ডের দুই পূর্বতন প্রধানমন্ত্রী ডেভিড লয়েড জর্জ এবং স্যার উইনস্টন চার্চিল। তাঁরা পঞ্জাবের অমৃতসরে জন্মানো এই যুবকের সাহসিকতা এবং মৃত্যুর সময় তার চারিত্রিক দৃঢ়তার প্রশংসা করেছিলেন। আসলে, যে পঞ্জাবের মাটি সর্দার ভগৎ সিংহ, জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের কুখ্যাত নায়ক জেনারেল মাইকেলও-ডায়ারের হত্যাকারী উধম সিংহ, চন্দ্রশেখর আজাদ, কর্তার সিংহ, গদর। পার্টির স্থাপয়িতা লালা হরদয়ালের মতো বীর, স্বাধীনতাকামী সন্তানদের জন্ম দিয়েছে, সেই সপ্তসিন্ধুর দেশের বিপ্লববাদ তো প্রসারিত হয়েছিল মদনলাল ধিংড়ার বুকেও।
সন্ত্রান্ত, ধনী পরিবারেই জন্ম হয়েছিল মদনলাল ধিংড়ার। তাঁর ছয় ভাইও বিদেশে পড়াশোনা করেছিলেন। অমৃতসরের এম.বি. ইন্টারমিডিয়েট কলেজ থেকে যোগ্যতার সঙ্গে উত্তীর্ণ হওয়ার পর মদনলাল ধিংড়াও উচ্চশিক্ষার জন্য ‘কালাপানি’ পেরোলেন। বিপ্লবী শ্যামজী কৃষ্ণবর্মার ইন্ডিয়া হাউস’-এর সদস্য হলেন মদন। এই সংস্থাতেই যুক্ত থেকে ভারতের বিপ্লববাদের জননী নামে খ্যাতা মাদাম ভিকাজী রুস্তমা কামা জার্মানির স্টুটগার্ট শহরে ভারতের জাতীয় পতাকার প্রথম রূপটি প্রকাশ করেছিলেন। মদনলাল ধিংড়া ইংল্যান্ডে থাকাকালীন বুঝতে পেরেছিলেন— যদি স্বদেশি এবং ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের আরও গভীরে প্রবেশ করতে হয়— তাহলে পারিবারিক বড়লোকি চাল আর সাহেবি ধরাচুড়া পরা তাঁকে ছাড়তে হবে। সেজন্য ইংল্যান্ডে মালবাহকের কাজ করেছিলেন তিনি। বিলেতে আসার আগে মুম্বাইতে কারখানার শ্রমিক হিসেবেও কাজ করেছিলেন মদনলাল ধিংড়া। দাদা ডাঃ বিহারীলাল ও স্বামী বিবেকানন্দের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে মদনলাল সবসময়েই মনে করতেন— “মূখ ভারতবাসী, দরিদ্র ভারতবাসী আমার ভাই… ভারতের কল্যাণ, আমার কল্যাণ।” সাধারণ ভারতবাসীদের হৃদয়ে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে যে কী প্রবল ক্রোধ জমে আছে। সেটা জানতে পেরেছিলেন মদনলাল। ধিংড়া। তখন থেকেই ব্রিটিশ নিধনকে জীবনের ব্রত হিসেবে গ্রহণ করেন তিনি। বঙ্গভঙ্গের প্রধান হোতা কার্জন এবং বাঙ্গলার ছোটলাট লেফটেন্যান্ট গভর্নর ব্যামফিল্ড ফুলারকেও হত্যা করার পরিকল্পনা করেছিলেন মদনলাল ধিংড়া। ভারতের চরমপন্থী স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে নেতাজী ও তার আজাদ হিন্দ ফৌজ, মাস্টারদা সূর্য সেনের চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন, মহারাষ্ট্রের বালকৃষ্ণ ও দামোদর হরি চাপেকার এবং রামপ্রসাদ বিসমিল আসফাক উল্লাহ ও ঠাকুর রোওশন সিংহের নেতৃত্বে কাকোরী ট্রেন ডাকাতির রোমাঞ্চকর কাহিনি গুরুত্ব পেয়েছে। কিন্তু প্রাপ্য মর্যাদা পাননি অগ্নিদিনের সৈনিক মদনলাল ধিংড়া।
কৌশিক রায়

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.