।।প্রথম অংশ।।

সে মালা নিলে না গলে, পরম হেলায়
সেই সূক্ষ্ম সূত্রখানি দুই ভাগ করে
ছিঁড়ে দিয়ে গেলে। লুটাইল ধূলি-’পরে
এ প্রাণের সমস্ত মহিমা। তোমা-’পরে
এই মোর অভিশাপ— যে বিদ্যার তরে
মোরে কর অবহেলা, সে বিদ্যা তোমার
সম্পূর্ণ হবে না বশ— তুমি শুধু তার
ভারবাহী হয়ে রবে, করিবে না ভোগ;
শিখাইবে, পারিবে না করিতে প্রয়োগ।

আমি ঋষি পুত্র। আমি আজ অভিশাপ গ্রস্ত। আমি কচ। দেবগুরু বৃহস্পতির পুত্র।আমি  নিঃস্ব। আমি জয়ী কিন্তু পরাজয়ের গ্লানি আমাকে কুড়ে খাচ্ছে। আমি  আমি হয়তো ইতিহাসে অথবা পৃথিবীর অথবা সুরলোকের প্রথম গুপ্তচর। হ্যাঁ , আমি গুপ্তচর হয়ে গিয়েছিলাম মৃতসঞ্জীবনীর সন্ধানে সেই মৃত লোকে । আমি জানতাম না সে সঞ্জীবনী কি? তা কোন মন্ত্র? তা কোন গাছ? তা কোন জল? নাকি অন্য কোন কিছু? আমি গিয়েছিলাম স্বর্গ থেকে মর্তে….. রাক্ষস মাঝে ছিল আমার বাস। গুরু শুক্রাচার্য ছিলেন আমার জ্ঞানবিদ্যা গুরু।

জানিনা আমি কোনদিন ভালোবেসে ছিলাম কিনা ?তবুও আমি তাকে কোনদিন ভুলতে পারিনি …আজ আমি অভিশপ্ত …কেন অভিশপ্ত হলাম ?

 সে অনেক আগের ঘটনা । অমৃত লক্ষী এবং স্বর্গরাজ্যের অধিকার নিয়ে  নিত্য সুর অসুরে লড়াই লেগেছিল । দেব, দৈত্য দানব প্রত্যেকেই ছিলেন বৈমাত্রেয় ভাই। সেই লড়াইয়ে দেবগুরু বৃহস্পতি দেবতাদের স্বার্থ রক্ষায় সদা সর্বদা নিযুক্ত ছিলেন। তেমনি শুক্রাচার্য ছিলেন অসুর দৈত্য দের পক্ষে ছিলেন।  বৃহস্পতি ও শুক্রাচার্য উভয়েই ছিলেন অত্যন্ত তেজস্বী ।  শুক্রাচার্য ছিলেন আমার গুরু।  কি করে তিনি আমার গুরু হলেন? 



শুক্রাচার্য  ভৃগু পুলমার সপ্ত ছেলের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী ছিলেন। যদিও অনেকেই বলেন আমার গুরু ভৃগু পুত্র কবির পৌত্র তবুও ভৃগু মুনির অন্য নাম ছিল কবি ।

 ভৃগো পুত্রঃ কবি র্বিদ্বান শুক্র কবি সুতো গ্রহঃ।

সেই প্রথম সংঘাতের সময় থেকে বৃহস্পতি দেবতা দের পক্ষে , শুক্রাচার্য দৈত্য দানবের পক্ষে যুক্ত হন।  শুক্রাচার্যের বাসস্থানটি ছিল চমৎকার ।তা তোপবনে না হলেও তোপবন সম সুন্দর ছিল।  শুক্রাচার্যের চার ছেলে। তারাও অসুর রাক্ষসদের যাজন করতেন। শুক্রাচার্য যখন থেকে অসুরদের গুরু হয়েছিলেন তখন থেকে আরম্ভ করে এ পর্যন্ত দেবতা এবং অসুরদের বিরাট বিরাট যুদ্ধ হয়ে গিয়েছে। সে যুদ্ধে সংখ্যা অনেক । অসুরদের মধ্যে হিরণ্যকশিপু, প্রহ্লাদ, বলি এই তিনজনই অত্যন্ত বিখ্যাত রাজা ছিলেন । ইন্দ্রের ন্যায় তারা সম্মানীয় ব্যক্তি ছিলেন।এমনকি তারা স্বর্গের সিংহাসনে বসে ছিলেন ।

 মহারাজ বলি ভগবান বিষ্ণুর নির্দেশে পাতাল রাজ্য প্রতিষ্ঠা করলেন।  পুনশ্চ দেবাসুরের যুদ্ধ শুরু হলো। সেই যুদ্ধে দেবতা ও অসুর উভয় প্রাণ হারাতে লাগল। সে অবস্থায় শুক্রাচার্য নির্ণয় নিয়েছিলেন মহাদেবের উপাসনা করার দরকার।

গুরুর কথা শুনি দৈত্যকুলের তদানীন্তন বৃদ্ধ দৈত্য প্রহ্লাদ দেবতাদের ডেকে বললেন , “আজ থেকে তোমাদের সঙ্গে আমাদের কোনো বিবাদ-বিসম্বাদ রইল না।  তোমরা এই ত্রিভুবনের অধিকার নাও।

শুক্রাচার্য অসুরদের পরিকল্পনা অনুমোদন করে বললেন, ” আমি যতদিন মহাদেবের তপস্যা সম্পূর্ণ না করে ফিরে আসি ,ততদিন তোমরা সংযত থেকো। ফিরে এসে যদি আমি উপলব্ধি করি পুনশ্চ যুদ্ধ শুরু হবে। সেখানে তোমাদের জয় হবে সুনিশ্চিত।” শুক্রাচার্য চলে গেলেন। যুদ্ধ ফেলে অসুরগণ ধর্মকর্মে মন দিলেন।

যুয়ং তপশচরধ্বং বৈ সংবৃতা ব্ল্কলৈর্বনে।

  শুক্রাচার্য মহাদেবের পরম ভক্ত ছিলেন। শুক্রাচার্য সেই মহাদেবের নিকট গিয়ে বললেন, ” প্রভু আমি এমন বিদ্যা চাই যা দেবগুরু বৃহস্পতি ও জানেন না । যা অসুর কুলের প্রাণ ও বংশ রক্ষা করবেন।” মহাদেব বললেন , ” বেশ, তোমার ইচ্ছা আমি সম্পূর্ণ করবো । তুমি আমার পরম এবং অন্যতম ভক্ত। তবে তোমাকে একটি কঠিন পরীক্ষার নির্দেশ আমি দেবো। তা যদি তুমি করতে পারো তা হলে আমি তোমায় এমন বরদান করব যা ব্রহ্মাণ্ডের কোন দিন কেউ পায়নি।”

 ”   বেশ , আমি রাজি মহাদেব। ”

দেবাদিদেব বললেন, ” তুমি যদি হাজার বছর ধরে অবাঙ অবস্থায় শুধু কুন্ডু ধূমপান করে তপস্যা করতে পারো, তবেই তুমি বৃহস্পতির অগম্য সেই  মহামন্ত্র লাভ করবে । ”

শুক্রাচার্য মহাদেবের নির্দেশ মেনে তাঁরই নির্দিষ্ট একটি ধুমোদগারী কুণ্ডের তীরে তপস্যায় মগ্ন হলেন। – ততো নিযুক্ত দেবেন কুন্ডাধারস্য ধূমকৃৎ। মহাশিব মন্ত্র তাঁর দেহ হতে বাহির হয়ে ত্রিলোককে আচ্ছাদিত করল। কঠিন সে তপস্যা যা কারুরই পক্ষে সম্ভব নহে , তা করতে দেখে সকলে বিস্মিত হল…..

এই সমস্ত কিছু দেখে, স্বর্গ ও মানবকুল চিন্তায় পড়লেন । এর ফল ভালো হবে না। ইন্দ্র তাঁর কন্যা জয়ন্তীকে দেখে বললেন , একটি কাজ তোমায় করে দিতে হবে। অসুর গুরু শুক্রাচার্য ব্রত গ্রহণ করেছেন মহাদেব কে তুষ্ট করার উদ্দেশ্যে। এই কারণে আমি বড় ব্যাকুল হয়ে পড়েছি ।শুক্রাচার্য যদি এই বলে তপস্যায় ফল লাভ করেন তাহলে অসুর কুল পুনরায় শক্তিশালী হয়ে উঠবে  । সকল অসুর হিরণ্যকশিপুর, প্রহ্লাদ বা বলির মত জ্ঞানী পন্ডিত এবং প্রজাবৎসল রাজা হন না । সে কারণে তারা যদি ত্রিভুবনের অধিকারী হন তাহলে তা অত্যন্ত ক্ষতিকারক হবে । তুমি অতি শীঘ্র শুক্রাচার্যের কাছে যাও। তাঁর যেমন ভাল লাগে , তেমন ব্যবহার , নানা উপাচার দিয়ে তুমি তাঁর সেবা করে তাঁকে সমাধি ভঙ্গ করো । “

অপ্সরাদের শুক্রাচার্যের কাছে পাঠালে হিতে বিপরীত হতে পারে। তাতে মুনির অভিশাপ প্রাপ্তি যেটা মোটেই অসম্ভব নয়। পিতার চিন্তাকুল অনুরোধ শুনে শুভাচারিণী জয়ন্তীর সোৎকন্ঠে উপস্থিত হলেন শুক্রাচার্যের তপভূমি, যেখানে তিনি শুধু কুন্ডু ধূমপান করে শিবের তপস্যা মগ্ন ছিলেন।  শুক্রাচার্য্যকে দেখার পর তাঁর সঙ্গে সেই ব্যবহার করতে লাগলেন যেমনটি পিতা তাঁকে বলে দিয়েছিলেন।

 কিন্তু ব্যবহারের মাঝে কিছু তফাৎ ছিল ।স্বার্থের জন্য নিজেকে বিকিয়ে দিয়ে শতেক প্রলোভন সৃষ্টি করতে পারতেন জয়ন্তী। কিন্তু দেবকন্যা হওয়ার জন্যই হোক বা অন্য যেকোনো কারণে জয়ন্তীর মধ্যে সে গভীরতা আগে থেকেই ছিল।  তার জন্য তিনি শুক্রাচার্যের সঙ্গে কোন প্রকার অসংযত আচরণ করলেন না ।শুক্রাচার্য একজন বেদজ্ঞ ঋষি হওয়ার পরেও কেবলমাত্র তার হতশ্রী শিষ্যদের জন্য কষ্ট করে যাচ্ছেন । এই উদ্যমের প্রয়াস জয়ন্তীকে মুগ্ধ করল । শুক্রাচার্যের মায়ায় পড়ে গেলেন।

 ধুমকুণ্ডের পাশে বসে শুক্রাচার্য তপস্যা করেন । আর জয়ন্তী ?  জয়ন্তী তাঁর শরীরের উষ্ণতা হ্রাস করার জন্য কলা পাতা কেটে এনে তাকে হাওয়া করেন। রুক্ষ শুষ্ক মুনির সামনে এনে রাখেন সুবাসিত নির্মল জল। গ্রীষ্মের দাবদাহে মাথার ওপর আঁচল বিছিয়ে মুনিকে ছায়া প্রদান করেন । দিনেশেষে খাবার জন্য ফল আহরণ করেন । সকালবেলায় মনে নিত্যকর্ম অগ্নিস্টমের জন্য কুশ কুসুম এর ব্যবস্থা  করেন। রাতের পত্র শয্যা রচনা করে আচার্যকে পাখার হাওয়া করার জন্য জয়ন্তী বসে থাকেন। মুনি কোন কথা বলেন না । জয়ন্তীও কোন কথা বলেন না।  জয়ন্তী এমন কোন ব্যবহার করেন না যাতে মুনির মনে তপ কার্য ছেড়ে বিকৃতি আসে অথবা ক্রোধের সৃষ্টি হয়।

এক অর্থে শুক্রাচার্য যদি মহাদেবের জন্য তপস্বী হয়ে থাকে,ন তবে জয়ন্তী শুক্রাচার্যের জন্য তপস্বিনী । আসলে তিনি গুরু শুক্রাচার্য কে ভালবেসে ফেলেছিলেন।

বহু বছর পর শুক্রাচার্য তপস্যা শেষ করলেন।  সন্তুষ্টহয়ে’ মহাদেব তাকে বললেন , “তুমি যে তপস্যা করেছ ,তা আর  অন্য কেউ পারবেনা । আমি আশীর্বাদ করছি আমি যে নিগূঢ় মন্ত্র জানি, তার সমস্ত রহস্য তুমি ছাড়া আর কোন দিন কারো কাছে প্রতিভাত হবে না। এ মন্ত্র শক্তি এবং তোমার প্রতিভার তেজে  তুমি জয়ী হবে।”

মহাদেব শুক্রাচার্য্যকে মন্ত্র যে দান করেছিলেন তাই ছিল সঞ্জীবনী মন্ত্র।  অসুরদের বাঁচিয়ে তুলতে পারবেন শুক্রাচার্য সেই মন্ত্র দ্বারা। আর এই মন্ত্রেরর জন্যই আমি বৃহস্পতি পুত্র শুক্রাচার্যের আশ্রমে এসেছি। বাস করেছি অসুরদের মাঝে বিপদ সংকুল হয়ে…..

আচ্ছা সেই জয়ন্তীর কি হল ?

ক্রমশঃ

 দুর্গেশনন্দিনী 

পরবর্তী অংশ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.