যে খেলা লুপ্ত – পঞ্চম পর্ব

পঞ্চম পর্ব

প্রাচীন ভারতের গ্রামে গ্রামে একটি খেলা সুপ্রচলিত ছিল। খেলাটির নাম #বাচিক। কিন্তু অতি আশ্চর্যের বিষয় সেই খেলায় বচনের কোনো আড়ম্বর নেই।  এমন কি সে ই খেলা প্রায় নিঃশব্দেই চলত। খেলার কায়িক সম্বন্ধটাই ষোলআনা। 


এই খেলাতেও পূর্ব পর্বোক্ত লবন বীথিকা বা নুনঘর খেলার মতো একটি ঘর আঁকতে হতো । ঘরটি সমচতুষ্কোণ হতো এবং দুইটি কুঠুরিতে বিভক্ত থাকত। সমান সংখ্যক খেলোয়াড় দুই দলেই থাকত। এক দল খেলার ঘরের একদিকে হতে ক্রমান্বয়ে ঘর দুইটি পার হয়ে অন্যদিকে পৌঁছনোর চেষ্টা করত। অন্যদল তাদের বাঁধা দেবার চেষ্টা করত। 


একদল এক চিহ্নিত স্থানে দাঁড়িয়ে থাকত।  অন্যদল “ক” থেকে “খ” চিহ্নিত পথে , “গ” হতে “ঘ” চিহ্নিত পথে এবং “ঙ” হতে “চ” চিহ্নিত পথে দাঁড়িয়ে তাদের আগলাত। ” এক” চিহ্নিত স্থানে  খেলোয়াড়রা ক খ সরল রেখা পার হয়ে “দুই” চিহ্নিত কুঠুরিতে পৌঁছনোর চেষ্টা করত। ক খ সরলরেখা গুলি যারা আগলে থাকত তারা বাঁধা দিত।  দুই পক্ষ একজন অন্যজনের হাতে হাত দিয়ে উভয় উভয়কে টেনে সরাবার চেষ্টা করত। সেই সময়ে কেউ কারো পায়ে পা লাগিয়ে ফেলে দিতে পারত , তবে যে পড়ে যেত সেই হারত। অনেক ক্ষেত্রে পায়ে পা ঠেকিয়ে দিতে পারলেই কাজ হাসিল হতো। এই সময় খুব ধীরে সুস্থে করবার কিছু থাকত না। ফলে , পা ঠেকাবার নামে সজোরে লাথি চলত। প্রায় হাতে পায়ে সমানে দ্বন্দ্ব যুদ্ধ শুরু হতো।


এক চিহ্নিত ঘর হতে কেউ যদি দুই চিহ্নিত ঘরে এসে পৌঁছাত তাকে তাহলে পুনরায় তিন চিহ্নিত ঘরে পৌঁছতে হতো এবং সে গ ও ঘ সরলরেখায় পূর্বের ন্যায় বাঁধা পেত। এইরূপ তিন চিহ্নিত ঘর হতে বাইরে না এসে দাঁড়াতে পারলে জিৎ হতো না। কিন্তু তখনও ঙ ও চ সরলরেখা পার করতে হতো।
যদি কেউ দুই চিহ্নিত বা তিন চিহ্নিত ঘর হতে বাইরে ডাইনে বামে বাইরে চায় তবে তখন ক খ সরল রেখায় বালক ক গ পথে বা খ ঘ পথে  এবং গ খ সরল রেখার গ ঙ পথে বা ঘ চ পথে এসে তাকে বাঁধা দিতে পারত।  এই রূপ খেলাকে #হাতাহাতি লড়াই বললেও চলে। কারন হাতে হাতে প্যাঁচ করবার সময় বা পায়ে পায়ে জড়াজড়ি করবার সময় অনেক ক্ষেত্রে একজন আরেকজনকে জাপটে ধরে মাটিতে ফেলে গড়াগড়ি খেত। এই খেলায় প্রচুর পরিশ্রম হতো।  অনেক রকম কৌশল অভ্যাস করতে হতো। ফলে শরীর চর্চা বা ব্যায়ামের দিক থেকে এই খেলা খুব উপযোগী ছিল।


আরো একটি খেলা আমরা ছোট বেলায় খেলতাম, সেটি হল #জলডিঙ্গাডিঙ্গি খেলা। জল ডিঙ্গানো অর্থাৎ পার হওয়া। সাধারণত গ্রামের কুলীতে খেলার স্থান নির্দিষ্ট থাকত। কিংবা কোনো সমতল ক্ষেত্রে , যেখানে দুই পাশে ঘাস , মাঝখানটি পরিষ্কার সেখানে খেলা চলত। পরিষ্কার স্থানটি জল  আর ঘাস ঢাকা স্থানটি পাড় এই রূপ কল্পনা করা হতো।  একজন ফাঁকা জায়গায় দাঁড়াত। বাকি বালক বালিকারা সেই জায়গা পার হয়ে ঘাসের উপর দাঁড়াত। পার হবার সময় ছুঁয়ে দিলে যাকে ছুঁয়ে দেবে সে অস্পৃশ্য হত। ঘাসে পা দিলে আর ছোঁয়া চলত না। এক পাড়ে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা চলবে না। এপার হতে ওপার, ওপার হতে এপার আনাগোনা করতে হবে।


 কতকগুলি ধূলা জমা করে তার নিচে  একগাছি দূর্বাঘাসের খানিকটা অংশ লুকিয়ে রাখতে হতো । তারপর যতজন খেলত তাদের প্রত্যেকে সেই ধূলার উপর একবার করে ফুঁ দিত। এইরূপে যার ফুঁ তে ধূলা উড়ে গিয়ে দূর্বা ঘাস দেখা দিত ,সে হেরে যেত এবং সে অস্পৃশ্য হতো। তবে প্রত্যেককে সমান ভাবে ফুঁ পারতে হতো। কেউ কম কেউ জোরে ফুঁ দিলে গন্ডগোল বাঁধত। আগে ফুঁ দেওয়ার পালা নিয়ে ঝগড়াও হতো খুব। শেষের দিকে অনেকেই ফুঁ দিতে রাজি হতো না । এই খেলায় বেশ খানিকটা দৌড়ঝাঁপ হত।

এছাড়াও লক্ষ্য ও ধৈর্য্যের খেলা হল #গুলিখেলা , যা সারা ভারতে প্রচলিত। এটি মার্বেল খেলা নামেও পরিচিত। মাত্র ব্রিটিশ আমলে এদেশে কাঁচের গুলি বা মার্বেলের আমদানি হয়। তার আগে মাটির গুলি আগুনে পুড়িয়ে তার সাহায্যে খেলা হতো। গ্রামাঞ্চলে এখনও মাটির গুলির প্রচলন আছে।


খোলা উঠান বা মাঠে ছোট একটা গর্ত করে সাত-আট হাত দূরে দাগ কেটে সীমানা নির্ধারণ করা হয়। পরে দুই বা ততোধিক বালক মিলে গুলি খেলে। যে দান পায় সে সকলের গুলি নিয়ে দাগ থেকে ছুঁড়ে গর্তে ফেলার চেষ্টা করে। যেগুলি গর্তে পড়ে সে সরাসরি সেগুলির দখল পায়; আর যেগুলি ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে সেগুলির যেকোনো একটি প্রতিপক্ষের নির্দেশমতো নিজের অপর একটি গুলি দিয়ে আঘাত করে। সফল হলে সে গুলিটিও তার দখলে আসে। আর মারার সময় যদি নিজের গুলিটি অন্য কোনো গুলিকে স্পর্শ করে তাহলে শাস্তিস্বরূপ তাকে একটি গুলি দিয়ে দিতে হয়। দ্বিতীয়জন অবশিষ্ট গুলি নিয়ে একই পদ্ধতিতে খেলতে থাকে। গুলি ছোঁড়ায় ও আঘাত করায় যে যত দক্ষ, এ খেলায় সে তত ভালো করে।


#গোল্লাছুট সাধারণত খোলা মাঠ বা বাগানে খেলা হতো। প্রথমে একটি ছোট গর্ত করে সেখানে একটি কাঠি পুতে রাখা হতো। একে বলে গোল্লা এবং এটি হচ্ছে কেন্দ্রীয় সীমানা। পঁচিশ-ত্রিশ হাত দূরের কোনো গাছ বা ইট-পাথরকে বাইরের সীমানারূপে চিহ্নিত করা হতো। গোল্লা থেকে ছুটে গিয়ে বাইরের সীমানার গাছ-পাথরকে স্পর্শ করাই এ খেলার মূল লক্ষ্য। আর এ থেকেই খেলার নাম হয়েছে গোল্লাছুট । পাঁচ-সাতজনের দুই দলের সমান সংখ্যক খেলোয়াড় নিয়ে প্রতিযোগিতামূলক এ খেলা অনুষ্ঠিত হতো।

গোল্লাছুট খেলায় একজন প্রধান থাকত, তাকে বলা হয় ‘গোদা’। সে গোল্ল ছুঁয়ে দাঁড়াত, অন্যরা তার ও নিজেদের হাত পরস্পর ধরে ঘুরতে থাকত। বিপক্ষ খেলোয়াড়রা সুবিধামতো স্থানে দাঁড়িয়ে ওঁৎ পেতে থাকত। ঘুরতে ঘুরতে কারো হাত ছুটে গেলে সে দৌড়ে গিয়ে গাছ ছোঁয়ার চেষ্টা করত। ছোঁয়ার আগে বিপক্ষের কেউ তাকে ছুঁয়ে দিলে সে ‘মারা’ যেত, অর্থাৎ এবারের খেলা থেকে সে বাদ পড়ত। গোল্লা ছেড়ে শেষ পর্যায়ে গোদাকেও দৌড়াতে হত। যে কয়জন সফল হতো তারা গর্ত থেকে জোড় পায়ে সীমানার দিকে লাফ দিয়ে এগিয়ে যেত। সব লাফ মিলিয়ে সীমানা ছুঁতে পারলে এক ‘পাটি’ হতো। এভাবে পর্যায়ক্রমে দুই পক্ষের খেলা চলতে থাকত। এই খেলা যথেষ্ট কায়িক শ্রমের খেলা ছিল। 


একসময় আমরা খেলে এসেছি। – এলাটিং বেলাটিং সই লো,
কিসের খবর আইলো?”
এলাটিং বেলাটিং  খেলায় মেয়েরা দুদলে বিভক্ত হয়ে মাটিতে অঙ্কিত একটি রেখার দুদিকে মুখোমুখি হয়ে দাঁড়াত। শুরুতে একদল দাগের দিকে দুকদম এগিয়ে ছড়ার প্রথম চরণ ‘এলাটিং বেলাটিং’ বলে আবার পেছনে সরে আগের জায়গায় দাঁড়াত। দ্বিতীয় দল অনুরূপভাবে এগিয়ে এসে ‘কি খবর আইল’ বলে পাল্টা চরণ বলত। এভাবে কথোপকথনের মধ্য দিয়ে খেলাটি চলতে থাকত। শেষ চরণটি (নিয়ে যাও বালিকাকে) শেষ হওয়ার পর দ্বিতীয় পক্ষের একটি বালিকাকে ধরে টানাটানি শুরু করত। তাকে ধরে রাখতে বা টেনে নিতে পারলে প্রথমবার খেলা শেষ হতো।   আর খেলতাম #ওপেন্টি_বায়স্কোপ। দুটি মেয়ে সামান্য দূরত্বে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে পরস্পরের হাত উঁচু করে ধরত; অন্যরা সারি বেঁধে ওই হাতের নিচ দিয়ে চক্রাকারে ঘুরত আর সবাই মিলে ‘ওপেনটি বায়স্কোপ’ ছড়াটি আবৃত্তি করত। ছড়ার শেষ পঙ্ক্তির (আমার নাম জাদুমণি/ যেতে হবে অনেকখানি) শেষ শব্দটি উচ্চারণ করার সঙ্গে সঙ্গে ওই দুটি মেয়ে নিকটতম কোনো মেয়েকে ধরে ফেললে সবাই মিলে তাকে ওপরে তুলে কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করত। এভাবেই এ খেলা শেষ হতো।


একটি অতি প্রচলিত ছড়ায় যখন আমরা বলি—
‘চাল কাঁড়তে হল বেলা
ভাত খেয়ে নাও জামাই শালা’—এই ছড়াটির বর্তমান রূপ হল—ভাত খাওসে দুপুরবেলা। এখানে পাঠ্যান্তরের মাধ্যমেই সূচীত হচ্ছে সময়, যেখানে গালিগালাজের পরিবর্তে অন্যভাবে নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে বা অনুরোধ করা হচ্ছে। সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ভাষারও পরিবর্তন লক্ষণীয়। খেলাটি অঙ্গুলী গুনে এখনো বোধহয়  খেলি আমরা। 


রবীন্দ্রনাথ লোককথা , লোকছড়া , লোকখেলার মৌখিক পরম্পরার কথা বলেছেন। জনজাতিদের গল্পকথায় রামায়ণের অল্পবিস্তর যে উল্লেখ পেয়েছি, সেগুলি শ্রুতির আকারেই রয়ে গেছে তাদের মধ্যে বংশ পরম্পরায় প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে। সেখানে রয়েছে রামায়ণ সংক্রান্ত কিছু খেলা। এই কাহিনী , ছড়া , খেলা গুলিতে রামায়ণের রাম ও সীতা তাদের গোষ্ঠীর অন্তর্ভূক্ত হওয়ার অহংকার যেমন আছে, তেমনি আছে নাম না জানা রাজা-রাজড়ার কাহিনী, স্থানীয় ইতিহাস, আবার তার সঙ্গে মিশে আছে ভবিষ্যতের সম্মানজনক অধিকার পাওয়ার ইচ্ছা পূরণের কাহিনীও। 


বলা বাহুল্য, এগুলি সবই জনজাতি সমাজের কাছে রামায়ণের কিংবা বলা ভালো, রাম রাজার ঘটনা। অর্থাৎ অনুপ্রবেশ ও রূপান্তর ঘটেছে বিস্ময়জনকভাবে। রবীন্দ্রনাথ যে অতীতধর্মী কল্পনার আশ্রয়ের কথা বলেছেন, এককথায় জনজাতিদের এই গল্পকথা গুলি তারই প্রতিচ্ছবি বলা যেতে পারে। 
বীরভূম জেলার এক গ্রামে একটি জনজাতি পরিবার বাস করেন যে পরিবারটির পূর্বপুরুষ একসময় উঠে এসেছিলেন তৎকালীন সাঁওতাল পরগনার দুমকা অঞ্চল থেকে। এই পরিবারটির বৃদ্ধের ধারনায় রামরাজার ঘর অর্থাৎ প্রাসাদ হল স্থানীয় ‘গঢে’ মানে স্থানীয় রাজাদের গড়ে। শুধু তাই নয়, সেই বৃদ্ধের ধারনায় তিনি রামরাজাকে সেখানেই দেখেছেন। ইচ্ছাপূরণের কাহিনী এতই প্রবল যে সময়ের ব্যবধানও তার কাছে কোন বাধা নয়। বৃদ্ধটির ধারনায় এখনও তাদের সমাজে বা পরিবারে কোন ঝাম্‌লা (ঝামেলা) বা গোলমাল হলে রামরাজা চুপে চুপে আসেন এবং মীমাংসা করে দিয়ে যান। তার বক্তব্য—‘ভরত আছে, লখন আছে… কিন্তু আমরা কে উয়াদিকে নাই জানি, আমরাকে শুধু রাম রাজাকে জানি।‘ রামের প্রয়োজনীয়তা এবং উপস্থিতি তাদের কাছে এতটাই মূল্যবান। এত মূল্যবান হওয়ার একটাই কারণ রাম তাদের গোষ্ঠীসমাজভুক্ত এবং তাদের প্রথম রাজা।
জনজাতি অধ্যূষিত অঞ্চলে অনেকেই মনে করেন পুরুলিয়ার অযোধ্যা পাহাড় রাজা রামের রাজধানী। শুধুমাত্র তাইই নয়, সেখানে পাহাড়ের উপরে গাছে গাছে ঝুলন্ত স্বর্ণলতার ঝোপগুলিকেও কেউ কেউ মনে করেন সীতার চুল, যা রাবণ নিয়ে যাবার সময় গাছে আটকে পড়েছিল এবং বয়সজনিত কারণে তার রং সোনালী। এ যেন সেই ‘কোন সুদূরের কল্পনা’ যা সচেতন ভাবেই তার রূপময়তা ভেঙ্গে ছত্রখান হয়ে প্রবেশ করে বাস্তবে। রূপময়তা ও বাস্তবের এ এক আশ্চর্য্য মিলমিশ। জনজাতিদের লোককথাগুলি নিয়ে এত কথা বলার একটাই কারণ, রবীন্দ্রভাবনায় রূপকথা, লোককথা, ছড়া, #লোকখেলা ইত্যাদি সম্বন্ধে যে চিন্তা-ভাবনা ফুটে উঠেছে, জনজাতিদের লোককথাগুলিতেও তার বাস্তব রূপায়ণ সম্বন্ধে অবহিত হওয়া।

এছাড়াও আরো খেলা ছিল   – ছড়ার খেলা  আবৃত্তি-প্রধান, সেসঙ্গে সামান্য ক্রিয়াও যুক্ত থাকে। ছড়ার খেলা অনেক রকম। তার মধ্যে ইকড়ি মিকড়ি এর কথা উপরে বললাম। আর ছিল – আগাডোম বাগডোম… ছিল শিশুদের অভিনয়ধর্মী খেলা। #দে_পাখাল ছিল গোপাল বালক বালিকাদের মধ্যে প্রশ্নউত্তর খেলা।  #গাইগোদানি  সাধারণত রাখাল বালকেরা মাঠে গরু-ছাগল চরানোর অবসরে খেলে থাকত।


ডাংগুলি বা গুল্লিডান্ডা ভারতের সর্বাঞ্চলীয় একটি জনপ্রিয় খেলা। প্রধানত কম বয়সের শিশুরা এটি খেলত। দুই থেকে পাঁচ-ছয়জন করে দুই দলে বিভক্ত হয়ে এটি খেলতে পারত। দেড় হাত লম্বা একটি লাঠি এবং এক বিঘত পরিমাণ একটি শক্ত কাঠি খেলার উপকরণ। প্রথমটিকে ‘ডান্ডা’ ও দ্বিতীয়টিকে ‘গুলি’ বা ‘ফুত্তি’ বলা হতো। প্রথমে খোলা মাঠে একটি ছোট গর্ত করা হতো। যারা দান পায় তাদের একজন গর্তের ওপর গুলি রেখে ডান্ডা মেরে সেটিকে দূরে ফেলার চেষ্টা করত। প্রতিপক্ষের খেলোয়াড়রা চারদিকে দাঁড়িয়ে থেকে সেটিকে লুফে নিতে চাইত। । তারা সফল হলে ওই খেলোয়াড় বাদ হতো, আর ধরতে না পারলে গর্তের ওপর রাখা ডান্ডা লক্ষ করে ছুঁড়ে মারতে হতো।  ছোঁয়া গেলে সে দান হারাত, আর তা না হলে সে ডান্ডা দিয়ে তুলে গুলিকে আবার দূরে পাঠাত। পরে গুলি থেকে গর্ত পর্যন্ত ডান্ডা দিয়ে মাপতে থাকত। সাত পর্যন্ত মাপের আঞ্চলিক নাম ছিল: বাড়ি, দুড়ি, তেড়ি, চাঘল, চাম্পা, ঝেঁক, মেক।
সাত মাপে এক ‘ফুল’ বা ‘গুট’ এবং সাত ফুলে এক ‘লাল’ হতো। ভাঙা ফুলের ক্ষেত্রে যেখানে শেষ হয়, পরের খেলা সেখান থেকে শুরু হতো। বাড়ি, দুড়ি ইত্যাদি প্রতিটি মারের পৃথক পৃথক পদ্ধতি ছিল। বাদ না হওয়া পর্যন্ত একজন খেলোয়াড় খেলতে পারত। বাদ হলে দলের দ্বিতীয় একজন একই পদ্ধতিতে খেলত। এভাবে সবাই বাদ হয়ে গেলে বিপক্ষ দল দান পেয়ে খেলা শুরু করত। বস্ত্তত এ খেলাটি বর্তমান যুগের ক্রিকেটের গ্রাম্য সংস্করণ।


#ধাঁধা  একটি বুদ্ধিবৃত্তিক খেলা। এ খেলায় দলের মধ্যে যে বয়স্ক সে অন্যদের বিভিন্ন রকমের ধাঁধা জিজ্ঞেস করে এবং তারা সেগুলির উত্তর দেয়। কেউ না পারলে উত্তরটি সে নিজেই বলে দেয়। এতে ছেলে-মেয়েদের বুদ্ধিবৃত্তির চর্চা ও বিনোদন উভয়ই হয়ে থাকে।


আরো কত খেলার নাম বলব যা লুপ্ত হয়ে গেছে। কতবার আর বলব ২০০ অধিক প্ৰাচীন খেলা আজ লুপ্ত। সেগুলি ঠিক কিভাবে জীবিত হবে ? এক মাত্র গুরুসদয় দত্ত মহাশয় ব্রতচারীশিক্ষার মাধ্যমে প্রাচীন লৌকিক খেলা ও শরীর চর্চাগুলিকে নতুন করে প্রাণ দান করেছিলেন। কিন্তু আজ কটি শিশু সঠিক ব্রতচারীশিক্ষা পায় ? আমরা কি আমাদের প্রাচীন ঐতিহ্যকে পুনরায় জাগরিত করবার একটি চেষ্টা করতে পারি না? 
সব থেকে বড় কথা কি জানেন? প্রাচীন খেলাগুলিতে শরীরচর্চা ও মস্তিকের বিকাশ উভয়ই হতো। সেখানে ব্যায়াম ও বুদ্ধির চর্চার সম্পূর্ণ দিক দেখা হলে সব থেকে বৃহৎ জিনিস ছিল শিশুদের খুশি। একদঙ্গল শিশুর মহানন্দে কলকল ঝলঝল ধ্বনি চারিদিককে আনন্দ মুখর করে তুলতো। সেটাও কম কিছু প্রাপ্তি ছিল না।  শিশুরা খুশি হয় , অঙ্গ চালনা করে, বুদ্ধি খাটায় এটাই অনেক। খুশিই আসল, অন্য সব নকল।


সমাপ্ত 
©দুর্গেশনন্দিনী
তথ্যঃ ১ ) বাংলার লৌকিক ক্রীড়ার সামাজিক উৎস
২) গৌড়বঙ্গ সংস্কৃতি

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.