সনাতন মাতৃকেন্দ্রীক। আবার জীব দ্বৈতসাত্তিক (দুই সত্তার) –

তনসত্তা যা দেহ গঠন করে ও
জাগ্রতসত্তা যা দেহে প্রাণের সঞ্চার করে অর্থাৎ সুনিয়ন্ত্রিত চালিকা শক্তি।

বিচিত্রা মাতৃকা প্রকৃতি এই দুই সত্তা আমাদের দেওয়ার সময় তার সকল বাস্তুউপাদানগুলিকে দুহাতে উজাড় করে ঢেলে দিয়েছেন। তাই মাতৃকা চিন্ময়ী (চিৎ + ময় – চিৎ অর্থাৎ চেতনার দ্বারা উপলব্দ্ধ) বা মৃন্ময়ী (মৃৎ + ময় – মৃৎ অর্থাৎ মাটির মূর্তিময়ী) হোক না কেন আমরা তাঁর অবিচ্ছেদ্য অংশ। আবার সেই কল্পে তাঁকে ঈশ্বর ধরলে আমরা অর্থাৎ জীবাত্মা পরমাত্মার অবিচ্ছেদ্য অংশ তাও প্রমাণিত হল। আবার দেখুন সেই প্রকৃতিকেই পরমেশ্বর বললে প্রকৃতির ন্যায় সর্বত্রবিরাজমান ও সর্বশক্তিমান প্রমান করা গেল। যাক গে, অত ভূমিকা না করে বলছি – সনাতনে মাতৃকা হল কল্পনার প্রেরণা উৎস।

আজ কার্তিক নিয়ে কিছু বলব। হ্যাঁ ঠিকই বানানটা ভুল লিখেছি, সঠিক –  কার্ত্তিক। কেন বলি! reference @ শিবপুরাণ ও অঘোরী আখ্যান

দেবাতিদেবের ষড়াহকাষ্ঠা বা ছয়টি রূপ আছে –
1)কাল, সময় বা নিয়তির নিয়ামক রূপ হল মহাকাল (স্ত্রী নিয়তি বা ~কালীকা~ কালিকা, এই মর্মে মহাকালই যম, তাই স্ত্রী নিয়তি),
2)তান্ডবরূপ রুদ্র (স্ত্রী এলোকেশী রুদ্রাণী),
3)শৈলীসত্তার স্রষ্টারূপ নটরাজ (স্ত্রী নটরাগিনী),
4)কৃপাভূত বরদা রূপ ভৈরব (স্ত্রী ভৈরবী),
5)মোক্ষার্পণী চন্ড (অর্থাৎ চন্ডাল যার স্ত্রী চন্ডী মতান্তরে চামুন্ডা)

এবং 6)নিশ্চলাধি সচেতনভব রূপ শবরূপী শিব (স্ত্রী শিবাণী বা পার্বতী)

আজকের ক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক মহাকাল রূপ। রুদ্রনিগম তন্ত্র মতে মহাকালের গাত্র বর্ণ উজ্জ্বল ঘোর অন্ধকার – কেমন odd লাগল না শুনতে??? হ্যাঁ, ভেঙে বলছি – for example, শামুকভাঙা সাপ দেখছেন? মিশ কালো কিন্তু গায়ে আলো পড়লে চকচক করে – ঠিক তেমনি। আরো উল্লিখিত বৈশিষ্ট্য –
ষষ্ঠাক্ষি (এবং অক্ষিগুলি বুকের প্রশস্ত ছাতিতে অবস্থিত, এবং সর্বদা যে কোনো 3টি চোখ খোলা ও 3টি নিমীলিত থাকে),
সহস্কন্ধা ষষ্ঠভূজ (অর্থাৎ ছটি হাতের জন্য দূর্গার মতো ছটি কাঁধ না – একটি কাঁধ থেকেই ছটি কাঁধের উৎপত্তি) ও প্রতিটি হস্ত শিরদন্ড(শিরদাঁড়া)ধারী,
ভীমকায়,
ব্যাঘ্রচর্ম নয় – মৃগচর্ম পরিহীত,
এলোকেশাশোভা (জটা নেই, খোলা চুল),
বজ্রনাভি – অর্থাৎ নাভিটি আমাদের মতো বৃত্তাকার না – বজ্রের মতো zigzag -⚡
ও তিনি ষড়বরাহচারক – এই ছটি শূকর ষড়রিপুর পরিচায়ক – এবং তাই তিনি হাতের শিরদাঁড়া দিয়ে মেরে মেরে তাদের  নিয়ন্ত্রণে রাখেন, কারণ রিপুরা আমাদের শ্বাশত সচেতনতার ওপর প্রভাব ফেলে – তাই বাউল কথায় বলছে ষড়রিপুর অধিষ্ঠান মেরুদন্ডের ঈরা-পিঙ্গলা-সুষুম্নায়।

সেই মহাকালের অঙ্গ মর্দন করাকালীন দেহস্নাত ঘর্ম থেকে জন্ম নেয় এক তেজপ্রভা বীজ। সেই বীজের কথা নারদের মুখে শোনা মাত্রই অন্তর্ধৃত ( কেন অন্তর্ধৃত তা বলছি…পরে) ইন্দ্রদেব ছুটে এলেন কৈলাশে এবং বললেন –

“হতৈশতৈস্ব দ্বন্দ্বেসেনাদেব চঅধ্যক্ষাথ্ |
দেবা সংকলনত্বমেব পূর্ণশ্চ হে নাথৌনাথ ||”
অর্থ  – এতদিন যাবৎ আপনি কোনো সুরাসুর দ্বন্দ্বে প্রত্যক্ষে অংশ নেননি। তাই আপনার এই সংকলন – এই বীজটি থেকে জাত তেজসম্ভূত শক্তিকণাটিকে আমাদের হতভম্ব সৈন্যদের অধ্যক্ষার্থে বা পরিচালনা অর্থে সমর্পণ করুন।  (সেনাপতির duty)

প্রসঙ্গ : তখন মহাদেবের একনিষ্ঠ এক ভক্ত অসুর জলন্ধর যে কিনা মহাদেবের কাছ থেকে তার xerox copy (easily বললাম) হওয়ার বর চেয়ে মহাদেবের তুল্য শক্তিধারী ও হুবহু মহাদেবের মতোই একই দেখতে হয়ে যায়। এরপর সবার আগেই ইন্দ্রের সভায় দখলদারি চালিয়ে ত্রিলোকের অধিপতি নিজেকেই মহাদেব ঘোষণা করে বসে। যারা মানেনি তাদের বন্দি করেন। প্রতিবার অসুর আক্রমণের মতোই এবারেও গোলেমালে ইন্দ্র কোনোক্রমে পালিয়ে বাঁচে ও বিন্ধ্য পর্বতের গুহায় আশ্রয় নেয়। জলন্ধরের নিপুণ রণকৌশলে দেবসেনারা হতভম্ব হয়ে যাচ্ছিল। তাই already ইন্দ্র আড়ালে একটা master plan কষছিল। অন্যদিকে মহাদেব নারদের মুখে এই খবর পেয়ে নিজের ভোলা মনের (তাই তো ভোলানাথ – ভোলা যে নাথ – বহুব্রীহি সমাস; যে নাথ বা দেবতা অতি সহজেই কারোর কথায় ভুলে যায় বা পটে যায়) ভুল বুঝতে পেরে মহাকালের রূপ নেন – কাল বা সময়কে পিছিয়ে সেই ভুল সংশোধন করতে। তৎক্ষণাৎ, বিদ্বাণ মহারাজ নন্দী তাঁকে গাত্রমর্দন (প্রভুকে ভক্তিপূর্বক আদর) করতে করতে নিরস্ত করেন এই বুঝিয়ে যে, সময় পেছালে তিনি প্রকৃতির বিরুদ্ধে যাচ্ছেন বা তাঁর স্ত্রী নিয়তির ইচ্ছার উপর হস্তক্ষেপ করছেন। তখনই উগ্র মহাকাল শান্ত হতে শুরু করেন এবং এই সময়ই তাঁর দেহসম্ভূত উষ্ণ ফুটন্ত ঘর্ম জমাট বেঁধে সেই তিলস্মীক বীজটি সৃষ্টি হল।

সেই বীজ মা পার্বতী গর্ভে ধারণ করে আঠারো দিনের মাথায় জন্ম দিলেন এক অদ্ভুত দৈব শিশু। যেহেতু মহাকালের সবকিছুই ছয় দিয়ে তাই সেই শিশুর মস্তকও হল ছটি। এবার দেবী পড়লেন বেশ সমস্যায় – শিশুর এক মাথাকে ভুলিয়ে শান্ত করছেন তো আরেক মাথা কেঁদে উঠে যাচ্ছে। ছটা মাথা মানে তো ছটা শিশুই। আবার ছটা শিশুকে মায়ের দুটি স্তন পান করাবেন কিভাবে? সমাধান করলেন মা নিজেই – স্বেচ্ছায় তিনি ছটি স্নেহময়ী মাতৃরমণীর রূপে বিলীন হলেন। এই ছয়টি মাকে একত্রে নারদ নাম দিলেন  “ষষ্ঠীকা”। ষষ্ঠীকা থেকেই “ষষ্ঠী” শব্দের ব্যুৎপত্তি। সেই জন্যই ষষ্ঠীপূজার সাথে শিশুদের অনবদ্য যোগ আছে, যেকোনো শিশুকেও মা ষষ্ঠী বলেই ডাকি। তাই শিশুদের গায়ে পা ঠেকাতে নেই।

আবার এই ষড়শিশুর পালনকর্ম সম্পাদনের জন্য ষষ্ঠীকল্পের ন্যাস বা সৃষ্টি। পালনকর্ম বা মায়ের যে করণীয় কর্ম তাহাই তাঁর ধ্যানজ্ঞান। সেই অসুর বধের অপূর্ণ কর্মকে কৃত (means already done) করতেই তাঁর অবতারণা। তাই ব্যাকরণে ব্যুৎপত্তি বা প্রত্যয় নির্দেশ করলে :  কৃৎ পূর্বক ষ্ণিক + আ = কৃত্তিকা (ষ্ণায়ম = আগম or আগমণ, ষ্ণিক = already আগত) অর্থাৎ অকৃতকর্ম সম্পাদনের জন্য যাঁর আগমন বা কর্মের অধিষ্ঠাত্রী দেবী যিনি – তিনিই কৃত্তিকা। আর কৃত্তিকার সন্তান কার্ত্তিক (বা দ্রাবিড় ভাষায় কার্ত্তিকেয়)।  আবার তাঁকে কুমারেশও বলে কারণ কুমার + ইশ্(ষ) = কুমারেশ। অর্থ : কুমার বা যুবকদের ইষ্ট। ( মূরূগাণ -ও দাক্ষিণাত্যের আরেকটি প্রচলিত নাম ) তাঁর মতো অপরূপ রূপ ও শৌর্যবীর্য সকল যুবকদের কাছেই কাম্য নিজেদের আরো আকর্ষণীয় করে তুলতে। তাই, প্রায়ই দেখি কোনো তৃতীয় পুরুষ সুঠাম যুবকের আলোচনার সময় প্রায়ই বলা হয় – “আহা! কি সুন্দর কার্ত্তিকের মতো দেখতে গো ছেলেটা”।

আচ্ছা নামকরণ গেল। ফিরে আসি প্রসঙ্গে – কর্মে। সেই দুর্দন্ডপ্রতাপ অসুরকে বধ করতে অগোচরেই বাড়তে লাগল সেই সুলক্ষণ শিশু। ছেলের বয়ঃসন্ধিতে ছটি মা কৃত্তিকা আবার নিজ অভিন্ন রূপ উগ্রচন্ডা চন্ডী কল্পে ফিরে এসে দিলেন অকাট্য অস্ত্রচালন শাস্ত্রের পূর্ণ ধারণা। আবার বাপের বিজ্ঞ চেলা নন্দী মহারাজের কাছ থেকে পেল দক্ষ সেনা পরিচালনা, রণনীতি, কূটনৈতিক কল্পের প্রভূত শিক্ষা – (master planning strategy according to circumstances of enemic power)। পক্ষীরা প্রকৃতির শোভা বর্ধন করে – আবার তাদের মধ্যেও অধিক সুন্দর তথা সৌন্দর্যের প্রতীক বলা হয় ময়ূরকে। ইন্দ্রের সভাসদ অক্ষয়দেবের আদেশে পারিজাত বৃক্ষ এনে দিলেন সেই জৈষ্ণিক জাতির (breed) ময়ূর। তাতে সওয়ার হলেন বালক দেবসেনাপতি।

আবার একটা আশ্চর্য দেখুন, উপরে কি বললাম কার্ত্তিক দেবসেনাপতি। ভাঙুন তো, দেবসেনা — পতি। অর্থাৎ দেবসেনার পতি। হ্যাঁ, সত্যি কার্ত্তিকের পত্নীর নাম দেবসেনা – ইন্দ্র ও শচীদেবীর রণদক্ষা কন্যা, সে যুদ্ধেও সহচর্য দিয়েছিল। ও বলতে ভুলে যাচ্ছি দাদা গণেশের মতো কার্ত্তিকও দুটি বিবাহ করেন – নাম সুন্দরবল্লৈ বা ভল্লৈ – পিতা বিষ্ণু, যদিও শাস্ত্রে এঁনার উল্লেখ কিঞ্চিত যৎসামান্যই।
সাধারণত কার্ত্তিকের হাতে ধনুর্বানই দেখা যায় তবে শাস্ত্রমতে কার্ত্তিকের প্রিয় অস্ত্র তাহ্নবিক – সকলেরই হয়তো অপরিচিত লাগল। ধরুন মোটামুটি এক মিটারের একটা শক্ত চ্যাপ্টা দন্ড ও তার দুটো প্রান্তে দুটো তরবারি একইরকম ভাবে আটকানো

      ????
????️         

কতকটা ওরকম????????????। ভূমির সাথে সমান্তরালে রেখে ঘোড়ার পিঠে চেপে শত্রু সেনাবাহিনীর মাঝে ছোটালে সেনাদের মাথাগুলো কাটা পড়ে। আবার দুরন্ত গতিতে ঘুরিয়েও বৃহদাকার চক্রের মতো বা ঢালের মতো আসন্ন তিরের মোকাবিলাও করা যায়। কিন্তু দাক্ষিণাত্য সংস্কৃতিতে এই অস্ত্রর বদলে মর্ষপল্লবী (সুদীর্ঘ দন্ডের ওপর নক্সাকাটা পান পাতার মতো লাগানো) রাখা হয় যা দিগদিগন্ত বিজয়ের প্রতীক।

যাই হোক, সাগরের নীচে চলতে থাকে জলন্ধর কার্ত্তিকের লড়াই। কিন্তু, নিজের অস্ত্রে কার্ত্তিক জয় পায়নি। দেবাতিদেবের জদদ্ধারী ত্রিশূল দিয়েই শেষমেষ হত্যা করতে হয় তাকে। এইভাবেই কৃত্তাকা-র কার্ত্তিকের অকৃত কর্তব্য সমাপন সম্ভব হল ও কার্ত্তিকই হলেন দেবসেনানীর স্থায়ী সেনাপতি।

■■■ আজকের যুগে কার্ত্তিকের মতো বিপ্লবী কর্মচেতা committed চরিত্র বড়ই দুর্লভ। কিন্তু ভারতস্বর্গের পরাধীনতার শৃঙ্খল মোচনে একাধিক কার্ত্তিক আমরা পেয়েছি – একদিকে যেমন নেতাজী থেকে বঙ্গের শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী – জীবনের প্রত্যেকটা দিন দেশকে বা মাতূভূমিকেই উৎসর্গ করে দিয়েছেন; অন্যদিকে তেমনি ক্ষুদিরাম থেকে মঙ্গল পান্ডে, যারা নির্দ্বিধায় নিজের প্রাণ, ঘাম, রক্তের শেষবিন্দু অবধি নিঃসংকোচ খরচা করেছে – কিন্তু বৈদেশিক অসুরদের সাথে সূচাগ্র মেদিনীরও আপোশ করেনি। দেশের সকল বালক, তরুণ ও যুবকদের ছাপান্ন ইঞ্চির ছাতিতে কার্ত্তিকের মতো স্বমাত্রেয় অভিমানবোধ, দৃঢ় সংকল্পে দৃপ্ত প্রাদেশিক কর্মপরায়ণতা ও অর্জন না হওয়া অবধি পুনঃ পরিকল্পনার দূরদর্শীতা ও নিরলস পুনঃপ্রচেষ্টার সাধ্য দেবাসেনাধিনায়ক কার্ত্তিক উজাড় করে ঢেলে দিক তাঁর আজ এই পূজার পুণ্য লগ্নে – এমনই আর্তি জানাই তাঁকে। জয়ম্ জয়স্তস্য কুমারেশৌ প্রণন্তি????। ভালো থাকবেন সকলে..।

শ্রীচৈতেন্যর শিষ্য নিত্যানন্দ গোস্বামীর জনৈক বংশধর

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.