ফিরে দেখা – ইন্দিরা গান্ধীর জরুরি অবস্থা জারি : রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ (আর এস এস) কীভাবে লড়েছিল তার বিরুদ্ধে

বলা হয় স্বাধীন ভারতের এক কলঙ্কজনক অধ্যায় হল ১৯৭৫ সালের জাতীয় জরুরি অবস্থা জারি করা। ওই বছর ২৫ জুন মধ্য রাতে ঘোষিত হয় জাতীয় জরুরি অবস্থা।পরবর্তী ২১ মাস আপামর ভারতবাসী এক দমবন্ধকর পরিবেশে জীবন যাপন করতে বাধ্য হয়। উল্লেখ্য, জরুরি অবস্থা যখন জারি হয়,তখন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন ইন্দিরা গান্ধী।
পত্রপত্রিকা-সহ সকল ধরনের গণ মাধ্যমের স্বাধীনতা হরণ করা হল। কেন্দ সরকারের নজরদারিতে খবর প্রচার করতে বাধ্য করা হল সব ভারতীয় গণমাধ্যমকে।সরকার বিরোধি,জরুরি অবস্থার কারণে দুর্দশাগ্রস্ত সংবাদ প্রচার কঠোর ভাবে ~নিষিদ্ধ করা হল।শুধুমাত্র কতিপয় বিদেশী সংবাদ পত্র তৎকালের করুণ চিত্র বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরে।তা থেকেই রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের সংগ্রামের কাহিনি জানা যায়।স্বাধীন দেশের স্বাধীনতা,গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার জন্য সঙ্ঘের স্বয়ংসেবকগণ আপোসহীন ভাবে লড়েছিলেন স্বৈরাচারী ইন্দিরা গান্ধী সরকারের বিরুদ্ধে!তৎকালে দিল্লীতে কর্মরত বিদেশী সাংবাদিকরা ধারাবাহিক ভাবে ইন্দিরা-নিষ্ঠুরতা প্রকাশ্যে এনেছেন।

১৯৭৬ সালের ২৪ জানুয়ারি “ইকোনমিস্ট” পত্রিকায় একটি লেখা বেরয়।যার শিরোনাম ছিল “হ্যা,সেখানে এক অন্ধকার জগৎ“।
লেখা হয়,”সাধারণ অবস্থায় ভারতে একটি চার দলীয় বিরোধি জোট রয়েছে।
যথা-রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের রাজনৈতিক শাখা জন সঙ্ঘ,সোশ্যালিস্ট পার্টি,বিক্ষুব্ধ কংগ্রেস ও লোক দল।কিন্তু প্রতিরোধের অভিঘাতটা এসেছিল কেবল মাত্র জন সঙ্ঘের পক্ষ থেকে।জন সঙ্ঘের আশি হাজার দলীয় কর্মীকে কারারুদ্ধ করা হয়।যার মধ্যে ছয় হাজার জনই ছিলেন দলের পূর্ণকালীন সময়ের কর্মী”।

পরবর্তীতে, জরুরি অবস্থা জারি থাকাকালীন চার দলীয় জোটের মধ্যে মূলত রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের পরিচালনায় জন সঙ্ঘই ইন্দিরার “কালা কানুন”-এর বিরুদ্ধে গোপন আন্দোলন সংগঠিত করে।আর এস এস-এর প্রবীন প্রচারক দত্তপন্থ ঠেংড়ি ও জন সঙ্ঘের ডঃ সুব্রহ্মনিয়ান স্বামী এই আন্দোলন সংগঠিত করেন।শ্রী স্বামী সেই সময়ে ও বর্তমানেও রাজ্যসভার সাংসদ
ইকোনমিস্ট” আরও উল্লেখ করেছিল যে, “আন্দোলনের প্রতিদিনের কার্যকলাপ-কর্মসূচি চার জনের এক সমিতির নির্দেশে চালিত হত।তাঁরা সপ্তাহে তিন দিন একত্রে মিলিত হতেন।দিল্লী-বোম্বাই-মাদ্রাজ বা আহমেদাবাদে তাঁদের এই বৈঠক হত।কখনো-বা চলতি ট্রেনের কামরায়।
এই চারজন হলেন রবিন্দ্র ভার্মা।তিনি ছিলেন কেরল থেকে নির্বাচিত কংগ্রেসের প্রাক্তন সাংসদ।বর্তমানে বিরোধি কংগ্রেসে আছেন।ঠেংড়িজী,সোশ্যালিস্ট পার্টির প্রাক্তন সাংসদ এস.এম.জোশী ও সংসদের উচ্চ কক্ষ রাজ্যসভার সদস্য শ্রী স্বামী”।
পত্রিকাটি থেকে আরও ইতিহাস সামনে এসেছে।জানা যায়, “গোপনে প্রচার কার্য চলত শ্রীমতি গান্ধীর বিরুদ্ধে।বলা হত এটাই পৃথিবীতে একমাত্র ডানপন্থী বৈপ্লবিক শক্তি।যারা রক্তাক্ত ও শ্রেনী সংগ্রাম অস্বীকার করে।গণতন্ত্রের পুনরুদ্ধারে এটাই ছিল প্রথম ডানপন্থী আন্দোলন।যা আর.এস.এস-এর সাথে জন সঙ্ঘ যৌথ ভাবে চালনা করে।দশ হাজার স্বয়ংসেবক চারজনের দলে ভাগ হয়ে,গ্রামে গ্রামে ঘুরে কাজ করেছেন।আন্দোলন,জনচেতনা জাগিয়েছেন তাঁরা।তাঁদের বেশির ভাগই ছিলেন আর এস এস-এর সক্রিয় স্বয়ংসেবক।চার দলীয় জোটের অন্যরা শুধুমাত্র রাজনৈতিক বিষয়েই কর্মসূচি নিত।ইন্দিরার বিরুদ্ধে প্রচার চালাত।ফলে তারা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।বৃক্ষহীন তৃণভূমিতে আগুন লাগাতে ছিল তারা।

   "দেউলিয়া কর্মসূচি"

দ্য নিউইয়র্ক টাইম ম্যাগাজিন‘ আর এস এস-এর বিরুদ্ধে ইন্দিরার পদক্ষেপকে “দেউলিয়া” বলে এক নিবন্ধে উল্লেখ করে।১৯৭৬ সালের ৪ এপ্রিল আমেরিকান সাংবাদিক জে.অ‌্যান্টনি লুকাসের লেখা নিবন্ধটি প্রকাশ করে ‘টাইম’।” লুকাস আরও লেখেন,” রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ সাধারণত RSS নামে পরিচিত।কঠোর শৃঙ্খলা পরায়ণ ১২ থেকে ২১ বছরের কিশোর-যুবকরা স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে RSS-এ যোগ দেন।তাঁদের সেনা বলে অভিহিত করা হয়।RSS তাঁদের কোনোরূপ ধাতব বস্তু ব্যবহার করতে দেয় না।পরিবর্তে কাঠের লাঠি ও কাঠের তরবারি দেয়“।

RSS -এর বিষয়ে লুকাস একবার স্বরাষ্ট্র দপ্তরের মন্ত্রী ওম মেহতার কাছে জানতে চান।লুকাস লিখেছেন,”তিনি অতি অস্পষ্ট ভাবে বলেন,স্বয়ংসেবকদের হয়ত ধাতব তরবারি দেওয়া হয়”।লুকাস বিস্ময়ে আঁৎকে ওঠেন।মেহতাকে বলেন,”ধাতব তরবারি!সুশিক্ষিত,আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত সেনা বাহিনির বিরুদ্ধে স্বয়ংসেবক বাচ্চা ছেলেরা কী করতে পারে!যেখানে ৮৫ হাজার আধা সীমান্ত রক্ষী,৫৭ হাজার সেন্ট্রাল রিজার্ভ পুলিস ও ৭ লক্ষ ৫৫ হাজার রাজ্য পুলিস আছে”!
মেহতা বললেন,”ভাল।নিশ্চিত ভাবেই তাঁদের কাছে কিছু রাইফেলও আছে।”লুকাস স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর কাছে জানতে চাইলেন, “আপনি কি সেগুলি বাজেয়াপ্ত করেছেন”।মন্ত্রী জানালেন,”বাজেয়াপ্ত করা হয় নি।সেগুলি স্বয়ংসেবকরা বাড়িতে লুকিয়ে রাখে।তাই সেগুলির সংখ্যা জানা নেই”!

আরেকটি বিখ্যাত সংবাদপত্র ‘দ্য গার্ডিয়ান’ ২ আগষ্ট,১৯৭৬ একটি প্রবন্ধ প্রকাশ করে।যার নাম ছিল ‘The Empress Reigns Suprime. তাতে বলা হয়েছে,”দেশে জরুরি অবস্থার সময় অনেক স্বয়ংসেবক গ্রেফতারের ভয়ে নেপালে গা ঢাকা দেন।কাঠমান্ডু থেকে প্রাপ্ত সংবাদে জানা গিয়েছে,ভারত সরকারের অনুরোধে নেপাল পুলিস স্বয়ংসেবকদের গ্রেফটার করতে অস্বীকার করে।নেপাল রাষ্ট্রদূত অফিসের বিশ্বস্ত সূত্রে বলা হয়েছে,ইন্দিরা গান্ধী RSS-কে নিষিদ্ধ করলেও,নেপাল কখনো-ই স্বয়ংসেবকদের ভারতের হাতে তুলে দেবে না।পরবর্তী স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী ব্রহ্মানন্দ রেড্ডি জানান,’RSS সারা ভারতে ছড়িয়ে পড়েছে।দক্ষিণ ভারতের কেরলেও কাজ শুরু করেছে”।

দ্য নিউইয়র্ক টাইম২৮ অক্টোবর,১৯৭৬-এ লেখে যে,”জরুরি অবস্থা জারি থাকাকালীন ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি, মস্কো-পন্থী কমিউনিস্ট ও মুসলিম লীগ কংগ্রেসকে সমর্থন করেছিল।”

সুজিত চক্রবর্তী (Sujit Chakraborty)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.