জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যে এই নিয়ে ধারাবাহিকভাবে দ্বিতীয়বার ভারতীয় জনতা পার্টি জম্মু ও লাদাখ অংশে সমস্ত আসনে জয়লাভ করল। রাজ্যের মোট ছটি লোকসভা কেন্দ্রের মধ্যে তিনটি কাশ্মীর উপত্যাকায়, দুটি জম্মু অঞ্চলে এবং একটি আসন লাদাখ অঞ্চলে। রাজ্যের আসন। বণ্টনে বৈষম্য আছে। আয়তনে জম্মু ও লাদাখ অনেক বেশি বড় হলেও কাশ্মীর উপত্যকার তুলনায় আসন সংখ্যা বেশি —লোকসভা এবং বিধানসভা উভয় ক্ষেত্রেই। কাশ্মীর উপত্যাকার মোট আয়তন। ১৫,৯৪৮ বর্গ কিলোমিটার, অন্যদিকে জম্মুর আয়তন ২৬,২৯৩ বর্গ কিলোমিটার এবং লাদাখের আয়তন ৫৯,১৪৬ বর্গ কিলোমিটার। আয়তনে ছোট হলেও উপত্যকার আসন তিন, মোট আসনের অর্ধেক। যাইহোক, গত লোকসভা নির্বাচনের মতো এবারও ভারতীয় জনতা পার্টি জম্মুর দুটি এবং লাদাখের একটি আসনে জয়লাভ করেছে। কিন্তু এবারের নির্বাচনের বৈশিষ্ট্য হলো বিজেপির ভোট শতাংশ বেড়ে ৪৬.৪ শতাংশ হয়েছে। গতবার এই শতাংশ ছিল ৩৪.৪ শতাংশ। এই তিনটি লোকসভার অধীনে মোট ৪১টি বিধানসভা ক্ষেত্র আছে। এর মধ্যে ২৭টি বিধানসভায় বিজেপি এগিয়ে আছে।লোকসভা অনুযায়ী একটা তুলনামূলক হিসেব দেওয়া যেতে পারে। উধমপুর লোকসভা কেন্দ্রে গত ২০১৪ নির্বাচনে বিজেপি পেয়েছিল ৪৬.৭৬ শতাংশ ভোট আর এবারে দলের ভোটের হার ৬১.৩৮ শতাংশ, যেটা দেখাচ্ছে গতবারের লোকসভা নির্বাচনের তুলনায় এবারে দল ভোট শতাংশে অনেক উন্নতি করেছে। বি জেপি নেতা এবং কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ড. জিতেন্দ্র সিংহ কংগ্রেস প্রার্থী তথা কাশ্মীরের প্রাক্তন। যুবরাজ ড. করণ সিংহের পুত্র বিক্রমাদিত্য সিংহকে ৩.৫৭ লক্ষ ভোটে পরাজিত করেছেন। যদিও, কাশ্মীর উপতকায়। বিজেপি মাত্র ২.৯৬ শতাংশ ভোট পেয়েছে। কাশ্মীর উপত্যকায় প্রদত্ত ভোটের হারও খুবই কম, মাত্র ৮.৭৬ শতাংশ। উপত্যকার তিনটি আসনই পেয়েছে ফারুক আবদুল্লার দল ন্যাশনাল কনফারেন্স। উগ্রপন্থী ও বিচ্ছিন্নতাবাদের সমর্থক পিডিপি একটিও আসন পায়নি। মাত্র ৭.৮৯ শতাংশ ভোট পেয়ে তিনটি আসনে জয়ী হয়। ন্যাশনাল কনফারেন্স। ফারুক আবদুল্লা শ্রীনগর কেন্দ্র থেকে জয়ী হন। উত্তর কাশ্মীরের বড়মূলা কেন্দ্র থেকে মোহাম্মদ আকবর লোন এবং অনন্তনাগ থেকে হাসনাইন মাসুদি জয়ী হন। অন্যদিকে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সমর্থক পিডিপি ২০১৪ তে প্রাপ্ত ২০.৫ শতাংশ ভোটের জায়গায় মাত্র ২.৪ শতাংশ ভোট পেয়ে কোনও আসনেই জিততে পারেনি। উধমপুর ছাড়া অন্য দুটি আসন, জম্মু এবং লাদাকে জয়ী হন যথাক্রমে বিজেপির যুগলকিশোর শর্মা এবং জামিয়াং শেরিং নামগিয়াল যথাক্রমে ৩০২৮৭৫ এবং ১০,৯৩০ ভোটের ব্যবধানে।
এতো গেল আসন সংখ্যার হিসেবনিকেশ। জম্মু ও কাশ্মীরে উপুর্যপরি দ্বিতীয়বার বিজেপির জয়ের পিছনে অন্য কতকগুলি ইঙ্গিতও রয়েছে দেশের জন্য। এক্ষেত্রে স্মর্তব্য যে, উগ্রপন্থী, বিচ্ছিন্নতাবাদী দলগুলি এবং তাদের সমর্থক পিডিপি একটি আসনেও জয়লাভ করতে পারেনি। জম্মু, লাদাখ এবং কাশ্মীর উপত্যকার কাশ্মীরি পণ্ডিতেরা বিজেপিকে সমর্থন করেছে সর্বতোভাবে। এর থেকে একটা বিষয় পরিষ্কার, জম্মু ও কাশ্মীরের এই নাগরিকেরা আবারও বুঝিয়ে দিয়েছেন, তাঁরা ভারতের মূল প্রবাহের সঙ্গে থাকতে চান; তারা জম্মু ও কাশ্মীরের জন্য ৩৭০ এবং ৩৫-এ ধারা চান না। তারা সংবিধানের এই দুটি অবৈধ ধারার অবলুপ্তি চান। এই ধারা দুটি সংবিধান সভায় পেশ না করে রাষ্ট্রপতির এক বিশেষ ঘোষণা বা ‘Promulgation’-এর মাধ্যমে আইনে পরিণত করা হয় যা সংবিধান বহির্ভূত। এই ধরনের কোনও আইন পাশ করাতে হলে তা সংবিধান সভায় পেশ করা এবং পাশ করা বাধ্যতামূলক। ফলে, আইন দুটির কোনো সাংবিধানিক বৈধতা নেই। আর এই প্রসঙ্গটিই সাম্প্রতিক নির্বাচনের পরে সামনে এনেছেন জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্য বিজেপির সভাপতি রবীন্দ্র রায়না। তিনি শীঘ্রই এই আইন দুটির অবলুপ্তি চেয়েছেন। এছাড়াও তিনি অধিকৃত কাশ্মীর থেকে আগত উদ্বাস্তুদের জন্য যে আটটি আসন বিধানসভায় সংরক্ষিত আছে সেগুলি মুক্ত আসন’ বা Defreeze করার দাবি জানিয়েছেন। তাছাড়াও তিনি আগামী বিধানসভা নির্বাচনের আগে কাশ্মীরি পণ্ডিতদের জন্য যে M-Form আছে তাও প্রত্যাহার করার দাবি জানিয়েছেন।
এই প্রসঙ্গে উল্লেখ্য যে, সংবিধানের ৩৭০ ধারার মাধ্যমে জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যকে বিশেষ অধিকার ও পৃথক সংবিধানসভা দেওয়া হয়েছে এবং ওই রাজ্যের ক্ষেত্রে সংসদের ক্ষমতাও সীমাবদ্ধ রাখা হয়েছে। আর ৩৫এ ধারা বলে রাজ্যকে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে, কারা রাজ্যের স্থায়ী বাসিন্দা হিসেবে গণ্য হবে তা নির্ধারণ করার বিশেষ অধিকার। আর এই স্থায়ী বাসিন্দাদের বিশেষ অধিকার ক্ষেত্র ও সুবিধাগুলিও স্থির করা যাবে ওই ৩৫এ ধারা বলে। এই বিষয়ে গত শুক্রবার, ২৪ মে, ন্যাশনাল কনফারেন্সের সভাপতি ফারুক আবদুল্লা বলেছেন, তিনি (অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রী মোদী) যতটা চান ততটাই শক্তিশালী হোন, কিন্তু তিনি রাজ্যের ৩৭০ এবং ৩৫এ ধারা সংবিধান থেকে রদ করতে পারেন না। এই প্রসঙ্গে শ্রীরায়না বলেছেন, যে কাশ্মীরভিত্তিক রাজনৈতিক নেতারা রাজ্যের মানুষকে ভুল বোঝাচ্ছেন। এবং তিনি ৩৭০ ধারাকে ‘ঘৃণার দেওয়াল’ বলে উল্লেখ করেছেন এবং এই কারণেই রাজ্যে অশান্তির পরিবেশ বর্তমান বলে মনে করছেন। শ্রীরবীন্দ্র রায়না আরও বলেছেন, “এই দুটি ধারারই অবসান করতে হবে। ৩৫এ ধারাটি পুরোপুরি বৈষম্যমূলক। যেমন, ওমর আবদুল্লা যদি রাজ্যের বাইরের কোনও মেয়েকে বিয়ে করে তাহলে তার স্ত্রী ধারা বলে বিভিন্ন সুযোগসুবিধার অধিকারী হবে, কিন্তু তার বোন শচীন পাইলটকে বিয়ে করে রাজ্যে অবস্থিত সমস্ত সম্পত্তির অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছে।” শ্রীরায়না আরও বলেছেন, “ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে জনসঙ্ এবং প্রজা পরিষদের সময় থেকেই বিজেপি সংবিধানের এই ধারাগুলির বিরোধিতা করে এসেছে।”
সংবিধানের ৩৬৮ নং অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, সংসদ ছাড়া অন্য কোনও সংস্থা বা ব্যক্তি সংবিধান সংশোধন করতে পারেন না; একমাত্র সংসদই কোনও আইন প্রণয়ন করতে পারে। কিন্তু জম্মু ও কাশ্মীর সংক্রান্ত আইনগুলি সংসদকে এড়িয়ে রাষ্ট্রপতির বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা। হয়েছে ১৯৫০, ১৯৫২ এবং ১৯৫৪ সালে। তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ড. রাজেন্দ্রপ্রসাদ বিশেষ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে কাশ্মীর সংক্রান্ত ঐ আইনগুলি সংবিধানের অন্তর্ভুক্ত করেন। রাজেন্দ্রপ্রসাদের ইচ্ছে না থাকলেও প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহর চাপাচাপিতে তিনি ওই বিজ্ঞপ্তিগুলি জারি করতে বাধ্য হন। এগুলির কোনও সাংবিধানিক বৈধতা নেই। আর আইনগুলি অস্থায়ী প্রকৃতির। তাছাড়া বাস্তবে ঐ আইনগুলির সাহায্যে উপত্যকার কিছু মানুষ, কয়েকটি পরিবার ও কিছু রাজনৈতিক নেতা ছাড়া আর কেউ উপকৃত হননি। বরং জম্মু ও কাশ্মীরের বিভিন্ন অংশের মানুষের মধ্যে এবং ভারতের বাকি অংশের মানুষের মধ্যে এক দুরপনেয় বিভেদ সৃষ্টি করেছে ঐ আইনগুলি। শুরু থেকেই ভারতীয় জনসঙ্ঘ, জম্মু প্রজা পরিষদ, বিজেপি, রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ, কাশ্মীরি পণ্ডিতগণ, লাদাখের মানুষজন, ভারতের বিভিন্ন প্রান্তের দেশপ্রেমিক মানুষ এই আইনসমূহের বিরোধিতা করে আইনটির বিলোপ চেয়েছেন। তাই সময় হয়েছে এই বৈষম্য সৃষ্টিকারী, কাশ্মীরি পণ্ডিত, জম্মু ও লাদাখের নাগরিকদের প্রতি বঞ্চনায় সহায়তাকারী অস্থায়ী, অবৈধ এই কালাকানুন রাষ্ট্রপতির বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে বাতিল করবার। পর পর দুবার লোকসভার নির্বাচনে উপত্যকার মুষ্টিমেয় বিচ্ছিন্নতাবাদী ছাড়া সমগ্র জম্মু, লাদাখ ও কাশ্মীরি পণ্ডিতগণ তথা নির্বাচকমণ্ডলী এটাই চেয়েছেন তাদের মতদানের মাধ্যমে।
বিনয়ভূষণ দাশ
2019-06-13