গত ২৮শে আগস্ট পশ্চিমবঙ্গের স্বরাষ্ট্র দপ্তরের অতিরিক্ত মুখ্য সচিব আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায় চিঠি লেখেন রেলওয়ে বোর্ডের চেয়ারম্যানকে। চিঠিতে রাজ্য অনুরোধ করেছিল যে পশ্চিমবঙ্গে রেল ও মেট্রো পরিষেবা শুরু হোক্ এবং তার নিয়মাবলী, পদ্ধতি ও লজিস্টিকস্ অপারেশন মসৃণভাবে হওয়ানোর জন্য পরিষেবা প্রারম্ভের পূর্বে রেলওয়ে বোর্ড ও রাজ্যের মধ্যে একটি আলোচনার প্রয়োজন।
পশ্চিমবঙ্গ সরকারের এমত প্রস্তাবে পূর্ব রেলের জেনারেল ম্যানেজার শ্রী সুনীত শর্মা পয়লা সেপ্টেম্বর রাজ্যের মুখ্যসচিব রাজীব সিনহাকে জানান যে রাজ্যে মেট্রো ও লোক্যাল ট্রেন পরিষেবা অল্প অল্প করে শুরু করতে তাঁরা ইচ্ছুক, কিন্তু যেহেতু পরিষেবা চালু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ভিড়ের চাপ থাকবে খুব বেশি এবং রাজ্যের বেশিরভাগ মেট্রোরেল ও সাব-আর্বান স্টেশনগুলোতে যেহেতু ডিজিটাল অ্যাকসেস কন্ট্রোলের ব্যবস্থা নেই, ফলে শারীরিক দুরত্ববিধি, নিরাপত্তা সংক্রান্ত এবং অন্যান্য পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখার স্বার্থে সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের জেলাপ্রশাসনের সহায়তা প্রয়োজন হবে। শ্রী সুনীত শর্মা তাঁর চিঠিতে যথাশীঘ্র সম্ভব এইসকল বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য রাজ্য সরকারের সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্সে বসার ইচ্ছা প্রকাশ করেন।
এই চিঠির পর এক মাস পার হয়ে গেলেও আর কোনো উচ্চবাচ্য করেনা পশ্চিমবঙ্গ সরকার, ফলে লোক্যাল ট্রেন চালু হতে পারে না। প্রশ্ন—নিজেদের তরফ থেকে এগিয়েও রাজ্য সরকার এই বিষয়ে পিছিয়ে ও থমকে গেল কেন?
সূত্রের খবর অনুযায়ী রেলওয়ে বোর্ড চেয়েছিল রাজ্যের আধিকারিক, বিশেষজ্ঞ ও স্বাস্থ্য দপ্তরের কর্তাদের উপস্থিতিতে মিটিং করতে। কারণ রেল যোগাযোগ শুরু হলে কোভিড সংক্রমণের হার ও মাত্রা দুইয়েরই বৃদ্ধি প্রত্যাশিত। রাজ্যের স্বাস্থ্যদপ্তর তা মোকাবিলায় প্রস্তুত কিনা সেই গ্রীন সিগন্যাল নিয়েই রেল পরিষেবা শুরু করতে চেয়েছিল রেলওয়ে বোর্ড যাতে পরে তাদেরকে অযথা দোষের ভাগী হতে না হয়। রেলওয়ে বোর্ডের চেয়ারম্যান শ্রী বিনোদ কুমার যাদব গত ১৯শে সেপ্টেম্বর সাংবাদিক সম্মেলনে জানান যে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ বজায় রেখে চলছে রেলওয়ে, রাজ্য প্রস্তুত হলেই যথাশীঘ্র সম্ভব রেল যোগাযোগ চালু করা হবে। কিন্তু বাস্তবে পয়লা সেপ্টেম্বর পূর্ব রেলের চিঠি রাজ্যে এসে পৌঁছনোর পর, পশ্চিমবঙ্গের স্বাস্থ্যদপ্তর রাজ্যের স্বরাষ্ট্রদপ্তরকে জানিয়ে দেয় যে রেল যোগাযোগ শুরু হওয়ার পর কোভিড সংক্রমণ আরও বাড়লে তা মোকাবিলার সাধ্য রাজ্যের নেই। সম্ভবতঃ সেই কারণেই রেলওয়ের চিঠির জবাব রাজ্য দেয় না এবং বিষয়টি চেপে যায়। অর্থাৎ পশ্চিমবঙ্গে রেল পরিষেবা চালু হতে পারছে না পশ্চিমবঙ্গ সরকারের স্বাস্থ্যব্যবস্থার এবং প্রশাসনিক ব্যবস্থার অপর্যাপ্ততাজনিত অক্ষমতার কারণে। অথচ পশ্চিমবঙ্গ সরকার তা খোলাখুলিভাবে রাজ্যের মানুষকে জানায় নি। ফলে মানুষ ভাবছেন রাজ্যে ট্রেন না চালানোর সিদ্ধান্ত কেন্দ্রীয় রেলমন্ত্রক থেকে একতরফা নেওয়া হচ্ছে। ট্রেনের অভাবে লাটে উঠছে কোটি কোটি মানুষের জীবন ও জীবিকা, অথচ পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তরফ থেকে আদত সমস্যাটি খোলাখুলি ও সৎভাবে মানুষকে জানানোর উদ্যোগ নেওয়া হয় নি।
পূর্ববর্তী অভিজ্ঞতার কথা স্মরণ করেও পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সঙ্গে আলোচনা ব্যতীত এ রাজ্যে লোক্যাল ট্রেন চালানো রেলমন্ত্রকের পক্ষে সম্ভব হওয়ার কথা নয়। গত ডিসেম্বরে অ্যান্টি-সিএএ প্রতিবাদের নামে পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদে, উলুবেড়িয়ায় যেভাবে রেলওয়েজের ওপর আক্রমণ করেছিল একটি জনগোষ্ঠী, এবং তার ফলে যে বিপুল লোকসানের ভার বহন করতে হয়েছিল রেলকে, তারপর রাজ্য সরকারের পূর্ণ সহযোগিতা ছাড়া এ রাজ্যে ট্রেন চালানোর একক সিদ্ধান্ত নেওয়া রেলওয়েজের পক্ষে যৌক্তিক নয়। রেল পরিষেবা শুরু হওয়ার পর কোভিড সংক্রমণ বাড়লে পশ্চিমবঙ্গের সেই সব মানুষ যে পুনরায় ক্ষিপ্ত হয়ে রেলকে আবার আক্রমণ করবে না, সে গ্যারান্টি রাজ্য সরকারের তরফ থেকে না পেলে এ রাজ্যে সাবার্বান লোক্যাল ট্রেন পরিষেবা চালু করা কতখানি যুক্তিসঙ্গত, তা ভাববার বিষয়। বাস্তবে এমত গ্যারান্টি রাজ্য সরকারের পক্ষেও দেওয়া সম্ভব নয়, কিন্তু এ রাজ্যের নেতিবাচক রাজনীতির ধারা রেলওয়েজকে কৌশলগতভাবে এমত অবস্থান নিতে কিছুটা কি বাধ্য করেছে? বৃথা রাজনীতির মারপ্যাঁচে মারা পড়ছে সাধারণ মানুষ ও তাদের বেঁচে থাকার উপায়।
রেলওয়েজ ছাড়া, মফস্বলের সঙ্গে কলকাতার সংযোগ স্থাপনের জন্য পশ্চিমবঙ্গের অন্য পরিবহন ব্যবস্থা অপ্রতুল ও নিম্নমানের। রেল যোগাযোগ বন্ধ থাকায় পশ্চিমবঙ্গের মানুষ তা উপলব্ধি করেছেন। রাজ্যের বাস পরিবহন ব্যবস্থার কঙ্কালসার চেহারা প্রকাশিত হয়ে পড়েছে কোভিড-মহামারীকালে রেল যোগাযোগ বন্ধ থাকায়। তার ফলে বহু মানুষ ক্ষুব্ধ হয়েছেন কেন্দ্রীয় সরকারের ওপরেই। তাঁরা রেলওয়েজকে ‘গ্র্যান্টেড’ ধরে নিয়েছিলেন। রেলওয়ে আদতে পশ্চিমবঙ্গের লাইফলাইন। কিন্তু ট্রেন বন্ধ না হলে মানুষ হয়ত তা কোনোদিন উপলব্ধি করতেন না। যা চিরকাল পেয়ে অভ্যস্ত, তা হঠাৎ না পেলে মানুষ ক্ষুব্ধ ও অধৈর্য হয়। এ রাজ্যের মানুষও হয়েছেন। তাঁরা ভেবেছিলেন রেলের দায়িত্ব ও ক্ষমতা যেহেতু কেন্দ্রের, ফলে রেল না চালানোর সিদ্ধান্তও হয়ত কেন্দ্রেরই একতরফা। বাস্তব পরিস্থিতি ভিন্ন। দায়, কর্তব্য ও ক্ষমতা কেন্দ্রের হলেও রাজ্যের সক্রিয় ও ইতিবাচক সহযোগিতা ব্যতীত কেন্দ্রের পক্ষে যে দায়িত্ব পালন সম্ভব নয়, তা সম্যক বোঝা প্রয়োজন। রাজ্যের প্রশাসনিক ও পরিকাঠামোগত অক্ষমতার কারণে ট্রেন পরিষেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন এ রাজ্যের সাধারণ মানুষ। অথচ পরিকল্পনা বহির্ভূত খাতে অযথা খরচ না করে সরকারি পরিকাঠামো-খাতে যথাযথ খরচ করলে স্বাস্থ্য ও প্রশাসনিক ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গের এমত সরকারি অক্ষমতা দেখা দিত না, মানুষকেও ভুগতে হত না। কেন্দ্র-রাজ্য দ্বৈরথ নয়, সহযোগিতাই যে ফেডারেল স্ট্রাকচার, যাঁরা ফেডারেল স্ট্রাকচারের কথা মুখে বলেন, তাঁরা হয়ত তা উপলব্ধি করেন না। এটি বুঝে সঠিক লেজিসলেশন নির্বাচন করলে পশ্চিমবঙ্গের সাধারণ মানুষের এই দুর্ভোগ দূর হওয়ার একটি সম্ভাবনা তৈরি হতে পারবে।
অপদার্থ সরকার ট্রেন চালু করার পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়ে লক্ষ লক্ষ লোকের জীবিকাব্যবস্থাকে না চেয়েও ধ্বংস করে দিয়েছে। মহামারীর চাইতে তা কম ভয়াবহ সমস্যা নয়। কেন্দ্র সরকারকে বিষয়টি সহানুভূতির সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে এই মর্মে রেলমন্ত্রী শ্রী পীযূষ গোয়েলকে চিঠি দিয়েছেন পশ্চিমবঙ্গ থেকে ভারতীয় জনতা পার্টির রাজ্যসভার সাংসদ শ্রী স্বপন দাশগুপ্ত। মাননীয় রেলমন্ত্রীকে তিনি অনুরোধ করেছেন পশ্চিমবঙ্গের সাবার্বান লোক্যাল ট্রেন পরিষেবা চালু করার জন্য। পশ্চিমবঙ্গের কোটি কোটি মানুষের স্বার্থে শ্রী দাশগুপ্তের এমত প্রস্তাব স্বাগত। শ্রী স্বপন দাশগুপ্তের চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে গতকাল, ১৩ই অক্টোবর, পূর্ব রেলের অতিরিক্ত জেনারেল ম্যানেজার শ্রী অনীত দুলাত রাজ্যের স্বরাষ্ট্রদপ্তরের বর্তমান অতিরিক্ত মুখ্য সচিব শ্রী হরিকৃষ্ণ দ্বিবেদীকে পুনরায় পত্রাঘাত করেন। রেলের তরফ থেকে রাজ্যকে জানানো হয় যে রেলকর্মীদের জন্য চালানো বিশেষ ট্রেনগুলিকে ব্যবহার করার দাবীতে বিক্ষোভ, অবরোধ ইত্যাদি করে রাজ্যের ট্রাফিক পরিস্থিতি ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটাচ্ছেন রাজ্যের সাধারণ মানুষ। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের উচিত রাজ্যে লোক্যাল ট্রেন পরিষেবা চালু করার পদ্ধতি ও কার্যবিধি স্থির করার জন্য রেলের সঙ্গে অবিলম্বে ভিডিও কনফারেন্সে বসা। শ্রী অনীত দুলাত রাজ্যের স্বরাষ্ট্রদপ্তরের অতিরিক্ত মুখ্য সচিবকে মনে করিয়ে দেন যে আইনশৃঙ্খলা বিষয়টি রাজ্যের আওতাধীন। অতএব মানুষের ক্ষোভে ট্র্যাফিক ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটলে তার দায় ও তা মেটানোর বন্দোবস্ত করাও রাজ্যের কর্তব্য। রেল গত পয়লা সেপ্টেম্বর রাজ্যকে মিটিং-এ বসার অনুরোধ জানানোর পর দেড় মাস কেটে গেলেও সে মিটিং হয় নি। অনীত দুলাতের চিঠিতে সে বিষয়েও প্রকাশিত হয়েছে স্পষ্ট ক্ষোভ।
এবার অপেক্ষা রেলের তরফ থেকে দ্বিতীয় চিঠিটির কি প্রত্যুত্তর রাজ্য সরকার দেয় তা দেখার। রাজ্যের সাধারণ মানুষ চাইবেন বৃথা রাজনীতি ছেড়ে পাবলিক ওয়েলফেয়ারের কথা ভেবে যথাশীঘ্র রাজ্যে রেল পরিষেবা শুরু করার জন্য রেলওয়ের সঙ্গে সহযোগিতার প্রশাসনিক হাত বাড়িয়ে দেবে পশ্চিমবঙ্গ সরকার। কিন্তু রাজ্য কি করবে?
দেবযানী ভট্টাচার্য্য
Debjani Bhattacharyya